প্রতিটি কাজ এই রকম অনেক
জ্ঞানের সমাহারে নিষ্পন্ন করা সম্ভব হয়। এই জন্য সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে শুরু হয়েছে জ্ঞান আহরন। একজনের আহরিত জ্ঞান
অন্যজন গ্রহন করেছে, কখনো বা পরিমার্জিত
করেছে। এমনিভাবে সামগ্রিক জ্ঞান ভাণ্ডার বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রয়োজনকে সামনে রেখে
জ্ঞান আহরনের পাশাপাশি নিছক কৌতুহল মেটাতেও মানুষ জ্ঞান আহরণ করে থাকে। এইভাবে অর্জিত জ্ঞান আবার পরবর্তী কালে ব্যবহারিক জ্ঞান হিসাবে
আত্মপ্রকাশ করে।
যে বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞানের
দরকার সেই বস্তুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রচিত হয় পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। ইন্দ্রিয়
গুলির ক্ষমতা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন। আবার কোন ব্যক্তি অনুশীলনের মাধ্যমে এগুলির
ক্ষমতা বাড়াতে পারে। হয়তো দূরে গাছের উপর কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। সেটা কাঠবিড়ালী
হতে পারে,
পাখি হতে পারে আবার অন্য এমন কিছু হতে পারে যা’ পর্যবেক্ষক
আগে কোন দিন দেখেনি। এক্ষেত্রে
যার দৃষ্টি শক্তি প্রখর সে বস্তুটি সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে আসতে পারে, যদি আগে থেকে তার সম্বন্ধে জানা থাকে। যে বস্তুটিকে আবছা দেখছে
তার পক্ষে সিদ্ধান্তে আসা ঠিক নয়। আরো কাছে গেলে, ধরা যাক, নিশ্চিত হওয়া গেল সেটা একটা পাখি।
কিন্তু সেই অবস্থান থেকে পাখির প্রজাতি সম্বন্ধে নিশ্চিত ভাবে বলা নাও যেতে পারে।
এই ভাবে কোন বস্তুকে জানতে গেলে তার অধিকতর কাছে যেতে হবে। কতটা কাছে যেতে হবে
সেটা নির্ভর করবে বস্তুর প্রকৃতি ও পর্যবেক্ষকের পূর্ব অভিজ্ঞতার উপর। এর জন্য
প্রয়োজন নিবিড় ভাবে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ।
জ্ঞানের জগতের আরো গভীরে যেতে
গেলে শুধু মাত্র চোখের উপর নির্ভর করলে চলে না। দুটি পাত্রে জল আছে। তাদের
চোখে দেখে জল বলে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। কিন্তু জলের উষ্ণতা সম্বন্ধে
জ্ঞান প্রয়োজন হলে চোখের সাহায্যে তা’ সম্ভব হয় না। তখন প্রয়োজন হয়
স্পর্শেন্দ্রিয়ের। এই ভাবে কিছু জিনিস দেখে বোঝা যায়, কিছু দেখে এবং অনুভূতির দ্বারা বুঝতে হয়। এর পরে আছে বিভিন্ন পরীক্ষার দ্বারা বস্ত চেনা।
ধরা যাক দুই খণ্ড লোহা আছে। এদের মধ্যে কোন লোহাতে যদি চৌম্বক ধর্ম
থাকে তবে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কোনটার দ্বারাই তা’ সোজা ভাবে বোঝা সম্ভব নয়।
বুঝতে হবে নির্দিষ্ট পরীক্ষার মধ্য দিয়ে।
অনেক সময় ইন্দ্রিয়ের
সীমাবদ্ধতার জন্য জ্ঞান আহরণ বাধা পায়। তখন প্রয়োজন হয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। এরা ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা দূর করতে সাহায্য করে। তবে অনুশীলনের
মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা কিছু বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে ব্যবহারিক জীবনে
কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। হয়তো কোথাও কিছুতে আগুন লেগেছে। সেই জন্য যে সামান্যতম
গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে তা’ অনুভব করার ক্ষমতা থাকলে সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে কোন
বিষয়ে আহরিত জ্ঞান যত বৃদ্ধি পেতে লাগল অন্যের কাছে বলা তত জটিল হতে শুরু করল। তখন একঢালা
আলোচনার বদলে ভাগ ভাগ করে আলোচনার
প্রয়োজন হল। যেমন প্রাণীদের সম্বন্ধে আলোচনার ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রাণীকুলকে দুটি
প্রধান ভাগে ভাগ করা হল। মেরুদণ্ডী ও অমেরুদন্ডী। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে একটাই
মিল,
সবার মেরুদণ্ড আছে। বাকী বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মিল থাকতেও পারে
না থাকতেও পারে। তাই, জ্ঞান আহরণের সময়
মিল এবং অমিল দুটোই জানতে হয়। এছাড়া জানতে হয় বস্তুটি বিশ্লেষণ করলে কী পাওয়া যাবে
আর অন্য কোন কোন বস্তুর সহযোগে সেটা সৃষ্টি হয়েছে। কোন বস্তু বা প্রাণীর বিশেষ
বৈশিষ্ট্যকে পোষণ দিতে বিশিষ্টতার জ্ঞান দরকার। যেমন গরু পালন করতে গেলে গরু
সম্বন্ধে বিশিষ্টতার জ্ঞান দরকার। গরুকে ঘরে রাখতে হবে বটে তবে আমরা বদ্ধ ঘরে থাকি
বলে গরুকে সেভাবে রাখা যাবে না, তার জন্য লাগবে
খোলামালা ঘর। আবার গরুকে
আমাদের মত ভাত, রুটি লুচি এসব খেতে দিতে পারি না; তাকে খড় ভুসি ইতযাদি দিতে হবে। এরপর আসছে পরিমানের বিষয়।
আমাদের গ্রহনীয় খাদ্য - পরিমান গরুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আবার বিভিন্ন জাতের
গরুর মধ্যে এই সমস্ত ব্যবস্থাপনার তারতম্য হতে পারে।
এছাড়া আছে সঙ্গতিশীল জ্ঞান
অর্থাৎ কোন বস্তু বা বিষয় সম্বন্ধে পুরোপুরি
জ্ঞান। যেমন অন্ধ ব্যক্তি হাতির যে অংশ তার অনুভুতির দ্বারা জানতে চায় সেটুকুই জানে। তাদের কারো কাছে
হাতি থামের মত, কারো কাছে হাতি কুলোর মত। একমাত্র চক্ষুষ্মান
ব্যক্তি জানে হাতি থাম বা কুলোর মত হয়েও বিশিষ্ট রকমের। তাই তার জ্ঞানই হল
সঙ্গতিশীল জ্ঞান।
এভাবে জানার পরে বাকী থাকে
বস্তুর ব্যবহার। বস্তুর একাধিক রূপ থাকলে সব রূপের ব্যবহারই জানার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
যেমন ধরা যাক মধুর উৎপত্তি সম্বন্ধে জানা হল। সেই সঙ্গে মধুর
কার্যকারিতা কী, টাটকা মধুর গুণ কী ও পুরানো মধুর গুণ
কী,
কীরকম মাত্রায় খাওয়া দরকার এগুলোও জানতে হবে। এই জ্ঞানকে আমরা
বলি ব্যবহারিক জ্ঞান। এই ভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে নানা রকম কাজ শেখাও ব্যবহারিক জ্ঞানের মধ্যে পড়ে। যেমন -চাষ
আবাদ,
গাছ কাটা, গাড়ি চালানো, ফটোগ্রাফি, দোকানদারি করা
ইত্যাদি। যত গুলি সম্ভব এই জাতীয় কাজ শিখলে জীবনে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। তবে, এত বিচিত্র রকমের কাজ করে কেউ জীবিকা নির্বাহ করে না। জীবিকার প্রয়োজনে যখন একটি
বা দুটি কাজ শিখলে চলে তখন এত কাজ জেনে কী হবে? উত্তরে বলা যায়, বিভিন্ন কাজ
সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান থাকলে সেই বিষয়ে তাকে কেউ ঠকাতে পারবে না ক্ষেত্র বিশেষে
অন্যের উপর নির্ভরশীলতা কমবে।
নানা রকম সমস্যা সমাধান কিংবা
অধিকতর স্বচ্ছন্দে থাকার জন্য জ্ঞানের
সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন হয়। যেমন কেউ চামড়া জানে, সুতো জানে আবার বোতামও জানে। আপাত দৃষ্টিতে কোন জানার সঙ্গে কোন জানার মিল
খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই তিন রকম জ্ঞানের সমাহারে কেউ যদি একটা থলি তৈরি
করে তবে মানুষের অনেক কাজে লাগে।
যে নিজের জীবনকে যত বেশি
ভালোবাসে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে তত ভালোবাসতে পারে। তার মধ্যে তৈরি হয় জ্ঞান তৃষ্ণা
আর অনুসন্ধৎসা। তার মধ্যে জন্ম নেয় আহরিত জ্ঞানের সমন্বয়ে অভাব মেটানোর অদম্য প্রেরণা। যেমন, যেমন এডওয়ার্ড জেনার বাড়ির পরিচারিকার কথা অনুসন্ধিৎসু মন
দিয়ে শুনেছেন ও সেই পথে অগ্রসর হয়ে বসন্ত রোগের টিকা আবিষ্কার করেছেন। তাঁর জ্ঞান
নিয়োজিত হয়েছে মানব কল্যানে।