তরুণকুমার সরখেল

                                                                                                                  ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে লেখক আদ্রা আবৃত্তি পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে

  ‘টুকলু’ পত্রিকায় ভবানীপ্রসাদ   মজুমদারের লেখালেখি









তরুণকুমার সরখেল





 

পুরুলিয়া জেলা থেকে প্রকাশিতটুকলুশিশুকিশোর পত্রিকায় (পত্রিকাটির সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে ২০২২-এ) ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের প্রথম ছড়াটি প্রকাশিত হয়টুকলু ছড়া সংকলন’-এ ১৮ই চৈত্র ১৩৮৩, ইংরাজির ১লা এপ্রিল, ১৯৭৭। টুকলুর প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশ পায় ১৯৭২ সালে। পাঁচ বছরের মাথায় টুকলুর একটি রঙিন ও আকর্ষণীয় ছড়া সংকলন প্রকাশ পায় যার মুখবন্ধ লিখেছিলেন খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন ড. রমা চৌধুরী। লেখক তালিকায় ছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, স্বপনবুড়ো, অন্নদাশঙ্কর রায়, ধীরেন্দ্রলাল ধর, দক্ষিণারঞ্জন বসু, আনন্দ বাগচী, হরেন ঘটক, নির্মলেন্দু গৌতম, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, কৃষ্ণ ধর প্রমুখ। লেটার প্রেসে রঙিন কালিতে ছাপা ও সঙ্গে জিংকের ব্লক করে মানানসই ছবিসহ সংকলনটিতে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের দুর্দান্ত একটি ছড়া রয়েছে। ছড়ার নামভূতের ছেলের অন্নপ্রাশনছড়াটির শেষ চার লাইন ছিল এরকম—

আরে, এ যে সেজোমামার আঁচিলওলা কান!

ভাবতে গিয়েই হঠাৎ দেখি আমার কানেই টান!

সেজোমামা বলছে হেঁকে, হতচ্ছাড়া ভোলা,

রোজই দেখি একই ব্যামো, পড়তে বসেই ঢোলা!


সেই শুরু। এরপর বড়োসড়ো আঙ্গিকের মজায় ভরপুর এবং ছন্দের ঠাসবুননে অসাধারণ সব ছড়া টুকলুর দপ্তরে পাঠাতে লাগলেন ভবানীদা। ১৩৮৪ সালের টুকলু শারদ সংখ্যায় (সম্পাদনায় হারাধন কর ও কর্মাধ্যক্ষ অমল ত্রিবেদী) ভবানীদা লিখলেন জমজমাট সাতাশ লাইনের একটি ছড়া—পদে পদে বিপদ

হাঁচি-কাশি টিকটিকি, ছুঁচ-কলা-হ্যাচ্ছো!

নিশ্চয়ই তুমি কোনও শুভ কাজে যাচ্ছো?

হ্যাঁচ্ছো! হ্যাঁচ্ছো! হ্যাঁচ্ছো!

কুসংস্কার বিরোধী এবং ছোটো-বড়ো সকলের কাছেই সমান আকর্ষণীয় এই ছড়াটি পরবর্তীকালে বহু জায়গায় বহু আবৃত্তিকার এটি পাঠ করে বহবা কুড়িয়েছেন

প্রবাহআয়োজিত সারা বাংলা কবি সম্মেলন উপলক্ষ্যে টুকলু ১৯৭৮ সালে প্রকাশ করে একটি বিশেষ সংকলন। তাতে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারেরব্যাঙ ও হাতির লড়াইছড়াটি প্রকাশ পায়। টুকলু পত্রিকার প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই যুক্ত খগেন্দ্রনাথ মিত্র (জন্ম ২রা জানুয়ারি ১৮৯৬ ও মৃত্যু ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮) তাঁর ৫৯, দেবীনিবাস রোড, কলকাতা-৭৪ বাসভবনে ১৮ই নভেম্বর ১৯৭৬ সালে টুকলুর জন্য দুই পৃষ্ঠার মুখবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে টুকলু প্রকাশ করেখগেন্দ্রনাথ মিত্র স্মরণ সংখ্যাসেই স্মরণ সংখ্যায় ভবানীপ্রসাদ মজুমদার লিখলেনভোম্বল সর্দারছড়াটি। সেই ছড়াটির শেষ চার লাইন ছিল এরকম—

কী যে ছাই বসে বসে লিখি ছড়া-ছিত্তির

মাঝে মাঝে ঘেন্নায় জ্বলে যায় পিত্তির!

শিশুদের কচি বুকে এঁকে চাল-চিত্তির

হাসিমুখে চলে গেল খগেন্দ্র মিত্তির!

উপরের ছড়াটিতেছড়া-ছিত্তিরকয়েনেজটি সহজেই নজর কেড়ে নেয়। ভোম্বল সর্দারের স্রষ্টাকে কী সুন্দরভাবে তিনি স্মরণ করেছেন

টুকলু সে-সময় ছোটোদের কাছে সব পেয়েছির আসর হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি শারদ সংখ্যা দুর্দান্ত প্রচ্ছদ আর লেখক তালিকায় জমজমাট হয়ে ঠিক সময় প্রকাশ পেত। ১৩৮৫-র শারদ সংখ্যা প্রকাশ পেল প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলেন ঘোষ, শৈল চক্রবর্তী, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য প্রমুখের লেখা নিয়ে। যথারীতি ভবানীপ্রসাদ মজুমদার লিখলেন চমৎকার একটি ভূতের লেখা, নাম—বোমদত্যির ছড়াযার শুরুটা ছিল এরকম—

ছোটো একরত্তি

বেঁটে বোমদত্যি

বলি শোনো সত্যি

নয় মিছে গল্প!

ব্যাটা ভারি দস্যি

খেত লাল-লস্যি

তাতে গুলে নস্যি

নাকে দিত অল্প!

সে-বছরই শীত সংখ্যায় (১৩৮৫) ছাপা হল তাঁর মজার একটি ছড়াপরোপকারীর বুদ্ধিছড়াটির শেষ চারটি লাইন উল্লেখ করলেই আসল মজাটি উপলব্ধি করতে পারা যাবে

বুদ্ধি করে পাগলা কুকুরটাকে

তোমার পিছে লেলিয়ে দিলেম বলে

তাইতো ছুটে পাকড়ালে ট্রেনখানা

নইলে চোখের সামনে যেত চলে!

টুকলু যেহেতু ত্রৈমাসিক পত্রিকা তাই বছরে চারটি এবং কোনো-কোনো বছর পাঁচটি বা ছয়টি সংখ্যাও প্রকাশ পেত। শীত সংখ্যায়পরোপকারীর বুদ্ধিপ্রকাশ হতে না হতেই পাঠকরা তাঁর কাছ থেকে পেয়ে গেল বত্রিশ লাইনের দীর্ঘ ছড়াগ্যাস হতে সাবধানবাঙালি মানেই গ্যাস আর অম্বল। আর সেসব নিয়েই তার এই মজার ছড়াটি টুকলুর পাতায় প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলমে জায়গা করে নিয়ে নিয়েছিল। ছড়াটির শেষ দুটি লাইন হল—

তাই বলি ভাইসব, আদরের বাপজান

কোনও গ্যাসই ভাল নয়, গ্যাস হতে সাবধান।

পরের সংখ্যাটি ছিলশিশুবর্ষ সংখ্যাহরেন ঘটক সহ দুই বাংলার নামিদামি সাহিত্যিকরা কলম ধরেছিলেন টুকলুর জন্য। ভবানীদা টুকলুর জন্য লিখলেন ছেষট্টি লাইনের ছড়াযাত্রাবিচারভাব-ভাষা আর ছন্দে ভরপুর ছড়াটি পরবর্তীকালে তাঁর কোনও ছড়া গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে কি না জানা নেই। তবে সে-সময় আদ্রায় অনেকেই এটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে পাঠ করত। ১৩৮৬-র শারদ সংকলনের জন্য টুকলুর দপ্তরে লেখা পাঠালেন অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, হরেন ঘটক, পূর্ণেন্দু পত্রী, সুকুমার বড়ুয়া সহ দুই বাংলার নামিদামি ছড়াকাররা। আর ভবানীদা? না, তিনি ছড়া লিখলেন না, তিনি লিখলেন গল্প। গল্পের নামকেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ড-কারখানাভবানীদার ছড়া-কবিতায় যে টান টান মজার ব্যাপারটা থাকে, এখানে গল্পেও রয়েছে সেই নির্ভেজাল মজা ও আনন্দ। গল্পকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের পরিচয় পাওয়া যাবে এই গল্পটির মধ্য দিয়ে

টুকলুর পরের শীত সংখ্যা প্রকাশ পেল ভবানীদার খেলা বিষয়ক ছড়াক্রিকেটের ছড়াযার প্রথম ছয় লাইন ছিল এরকম—

এক দুই তিন রান

ব্যাট হাতে ইমরান

বন বন সারা মাঠে ঘুরছে

দোশী দিল গুগলি

সেই বল হুগলী

মার খেয়ে আকাশেতে উড়ছে!

খেলা বিষয়ক ছড়ার পাশাপাশি পরের সংখ্যায় লিখলেন বিজ্ঞানীদের নিয়ে ছড়া। ১৩৮৭-র বর্ষা সংকলনে দীর্ঘ ছড়া (বাহান্ন লাইন)— নামকলকাতার ফুটবলের রোজনামচাশুধু তাই নয়। সে-সময় ভবানীদা দু-হাতে লিখছেন বলে ওই একই সংখ্যায় তাঁরভবানন্দ ভারতীছদ্মনামেও আর একটি লেখা প্রকাশ পেল। শারদীয় ১৩৮৭ টুকলুতে প্রকাশ পেল আবৃত্তিযোগ্য সুন্দর ছড়াতিন তিরিক্ষে

ডালিম গাছে দাড়িম্ব

গুনছি কটা পাড়িম্ব?

মালী এসেই কানটা ধরে

বললে ঘুষি মারিম্ব

শুনেই মাথা ঘুরন্তিস

পরান-পাখি উড়ন্তিস

তারপরে কী? গপ্পো আমার

এইখানেতে ফুরন্তিস

নটে গাছটি মুড়ন্তিস!

এই ছড়াটি কি শুধু ছোটোদেরই ভালো লাগবে? আমার মনে হয় বড়োরাও এটা পড়তে ও শুনতে আগ্রহী হবেন

 

টুকলু-র সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ সংখ্যা    

`‘দ্য গ্রেট অলিম্পিয়ান ফ্যামিলিনামের মজার এবং খেলা বিষয়ক ছড়াটি ওই বছরের শীত সংখ্যায় প্রকাশ পেল। এটিও দীর্ঘ ছড়া     ১৩৮৮-র বিশেষ ছড়া সংখ্যাতেও তাঁরখেলার মাঠের মজার ছড়াশিরোনামের একটি দুর্দান্ত ছড়া প্রকাশিত হল। ওই বছরই (১৩৮৮ সালের ১লা মার্চ) ভবানীপ্রসাদ মজুমদার এলেন পুরুলিয়া জেলার আদ্রা রেল শহরেটুকলু শিশুসাহিত্য বাসর’-এর একটি অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতে। সেখানে ভবানীদা বেশ কয়েকটি হাসির ছড়া পাঠ করেন যা শুনে ছোটো ও বড়ো সকলে হেসে গড়িয়ে পড়ে। শারদ ১৩৮৮-র মজার ছড়াটির নাম ছিলঐতিহাসিক জলসাছড়াটির শুরুটা ছিল এরকম—

তিন-দিন, তিন-রাত

গালে ঠেসে পান

গান জোর গেয়েছিল

চেঙ্গিস খান

তাক-ধিন, ধিন-তাক

তেরে-কেটে-ধিন

তবলাতে কে ছিলেন

আলাউদ্দীন

টুং-টাং, টুং-টাং

টুং-টুং টাং

বেহালা বাজিয়েছিল হিউয়েন সাঙ।

ছড়াটির শেষটা ছিল—

জলসাতে ছিল আরও

মজার জিনিস

সব কিছু লিখে গেছে

মেগাস্থিনিস।

কিন্তু শুধুই কি মজার ছড়া? ওই একই সংখ্যায় তিনি ছদ্মনামে লিখলেনবিশ্ব প্রতিবন্ধীবর্ষেনামক একটি ছড়া যার শেষটা ছিল এরকম—

হোক না যতই বিকল অঙ্গ

করব ব্যথার শিকল ভঙ্গ

বেদনা?

তোমরা মোটেই নয়কো নিঃস্ব

সাথে আছে এই বিশাল বিশ্ব

কেঁদো না।

ভবানীদারমজার ছড়ানামক গ্রন্থটির (শিশু সাহিত্য সংসদ) আলোচনাও বেশ বড়ো করে প্রকাশিত হয়েছিল ওই সংখ্যাতেই। টুকলু মানেই যেন ভবানীদার মজার ছড়া। বছরের সব কয়টি সংখ্যাতেই তাঁর উপস্থিতি থাকবেই। শীত সংখ্যা (১৩৮৮) টুকলুতে প্রকাশ পেলপৌষ-পার্বণের নিমন্ত্রণনামক পিঠে বিষয়ক একটি দুর্দান্ত ছড়া

১৩৮৯-র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হল তাঁরমৌমাছিনামের ছড়াটি এবং বর্ষা সংখ্যায় প্রকাশ পেলখোকার বুদ্ধিএবং জমজমাট পুজো সংখ্যায় ছাপা হল তাঁর দুর্দান্ত ছড়াপঞ্চকসবচেয়ে চমৎকার ছড়াটি টুকলুর শীত সংখ্যায় বেরোল। ছড়ার নামটাপুর-টুপুর ছড়ার নূপুর

ঝড় বয়

ভয় হয়

ঘরে ফিরে

আরে একি

দুই দেখি

ভয়ে হলি

গাছগুলো

বেঁকে চুরে

হাঁটু ভেঙে

দ!

এইভাবে প্রতি লাইনের শেষে একটি মাত্র অক্ষর দিয়ে অন্ত্যমিলের দুর্দান্ত চমক দিয়ে ভবানীদা ছড়াটিকে সাজালেন। টুকলুর পাতায় পুরো এক পৃষ্ঠায় ছাপা হল ছড়াটি। সেই কবে পড়েছিলাম সেই লেখাটি, কিন্তু এখনও দুটো লাইন মনে গেঁথে রয়েছে। লাইন দুটো হল—

ভিকটোরিয়া

ইডেন গার্ডেনস

আলিপুরের

জু

ট্রেন পড়ল নর্দমাতেই

থু-থু-থু

থু।

টুকলু পত্রিকার দশম পূর্তি সংখ্যা বৈশাখ ১৩৯০ ও শারদ ১৩৯০-এর প্রথম পাতায়  হইহই করে বের হল পাঁচটি করে মোট দশটি লিমেরিক। সঙ্গে জিংকের ব্লক দিয়ে মানানসই ছবি। ওই বছরের শীত সংখ্যায় তিনি লিখলেনগন্ধবিচারপরের বছর নববর্ষ সংখ্যায় তিনি দুর্দান্ত অন্ত্যমিলের চমক আর অপূর্ব ছন্দের মোড়কে মিশিয়ে লিখলেনমিঠে কড়াং মজার ছড়াংযার শুরুটা ছিল এরকম—

একটা জিরাফ

খেয়েই সিরাপ

মেজাজ কী রাফ

টলিতং

সবাই মিলেই পাকড়ে তাকে

বাঘের কাছে চলিতং!

এবং শেষটা ছিল—

নড়িং-চড়িং

ন্যাংটো-ফড়িং

তিড়িং-তিড়িং

জুড়ন্তিস

পড়িং-পড়িং

ছড়াং পড়িং

ছড়াং আমার

ফুরন্তিস।

না, তাঁর ছড়া ফুরন্তিস হয়নি। তিনি কত ছড়া যে টুকলুর পাতায় লিখেছেন তার যেন শেষ নেই। টুকলুর সুবর্ণজয়ন্তীবর্ষ পর্যন্ত তাঁর ছড়া হইহই করে প্রকাশিত হয়েছে। টুকলুর পাতা ওলটালেই খুঁজে পাওয়া যাবে ভবানীদার ছড়া। নববর্ষ সংখ্যার পরেই বর্ষা সংখ্যায় তিনি লিখলেনহবু-গবুর হাওয়া-খাওয়াএটিও একটি দীর্ঘ এবং আবৃত্তিযোগ্য ছড়া। শারদ সংখ্যায় টুকলুর জন্য কলম ধরলেন স্বপনবুড়ো, আশাদেবী, দক্ষিণারঞ্জন বসু সহ এ-পার বাংলা ও ও-পার বাংলার বহু ছড়াকার ও নামিদামিরা। ভবানীপ্রসাদ মজুমদার দপ্তরে পাঠালেনচার্জন্তুর চার্ছড়াঅর্থাৎ চারটি জন্তু নিয়ে ছড়া। গরিলা, হরিণ, কাছিম ও বাঁদরকে নিয়ে ছড়া। গরিলার ছড়াটি ছিল এরকম—

আমি গরিলা, গাছে চড়িলা

পেটে ভরিলা ফল

আমি লড়িলা, সব মরিলা

দেহে অসুরের বল!

আবার হরিণের ছড়ার শেষ চারটি লাইন ছিল এরকম—

আমরা হরিণ, খিদেয় মরিং

খাই না মারিং-ধরিং

তাই বারোমাস লতা-পাতা-ঘাস

খেয়েই তো পেট ভরিং।

এই ধরনের ছড়া শুনলেই বলে দেওয়া যায় এগুলো ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়া। এই ছড়াটির সঙ্গে মিল রেখেই পরবর্তী শীত সংখ্যা ১৩৯১ (১৯৮৫)-তে তিনি পাঠালেনঅর্ধ-ডজন পশুর ভজনসেই অর্ধ ডজন পশুরা হল সিংহ, বাঘ, হাতি, জলহস্তী, উট ও গণ্ডার। ১৩৯২-র নববর্ষ সংখ্যা প্রকাশ পেল তাঁর কবি বন্দনারবি-প্রণাম! কবি-প্রণাম!

টুপুর টুপুর উদাস দুপুর উপুড় রোদের কলস

কল্প-লোকের গল্প-গাথায় হারায় হৃদয় অলস

লুট করে মন কাব্য সে কোন বিশ্বজয়ী ডাকু-র

সোনার খনি, মাথার মণি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!

এই ছড়াটির প্রথম অক্ষরগুলি পরপর যোগ করলে পাওয়া যাবেটুকলু সোনাদের প্রণাম নিও রবি কবি।এই সুন্দর ভাবনা ও সুন্দর শব্দচয়নের মাধ্যমে ছড়াকারের কবি প্রণাম সার্থক হয়ে উঠল। ওই বছরের পুজো সংখ্যায় ছাপা হল তাঁর দীর্ঘ ছড়াজীবজন্তুর জবর ছড়াএটি ছড়ার মূল শিরোনাম হলেও প্রতিটি ছড়ার আবার আলাদা আলাদা শিরোনাম যুক্ত করলেন তিনি। আর শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারা যাবে কোন জন্তুকে নিয়ে এই ছড়াটি তিনি লিখেছেন। যেমন—আমরা মহিষ কী আর কহিস’, ‘আমরা বলদ নেইকো গলদ’, ‘আমরা ঘোড়া কপাল পোড়া’, ‘আমরা ছাগল নইকো পাগল’, ‘আমরা গাধা মনটি সাদা’, ‘আমরা শেয়াল লাগাই খেয়ালছোটোরা এই শিরোনামগুলো দেখেই ছড়াটি পড়তে বা শুনতে আগ্রহী হয়ে যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। শীত সংখ্যায় তিনি লিখলেনসাবাস সাবাস গাভাসকারতবে এটি তিনি ভবানন্দ ভারতী ছদ্মনামে প্রকাশ করলেন। নববর্ষ সংখ্যা লিখলেনইন্দুমতী বিন্দুবতীও বর্ষা সংখ্যায় লিখলেননারাণদা-হারাণদা১৩৯৩-এর শারদ সংখ্যায় পাঠালেন তাঁর ছড়াএকটি ডজন ফলের ভজননাম শুনেই বোঝা যায় এটি ডজন খানেক ফলের ভজন

১৩৯৪-এর বৈশাখ (নববর্ষ) সংখ্যার টুকলুতে তিনি লিখলেনসুকুমার রায়, তাঁকে ভোলা দায়ও ভবানন্দ ভারতী নামে লিখলেনছড়ার রাজা সুকুমারদুটি লেখাই দীর্ঘ। এই সংখ্যাটির সঙ্গে আমিও ভীষণভাবে জড়িত। কারণ, এই সংখ্যায় আমার প্রথম লেখা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পেল (আমার বয়স তখন চৌদ্দ বছর)। লেখাটি ছাপা হল টুকলু সোনাদের পাতায়। বর্ষা সংখ্যায় তিনি পাঠালেনচার ছড়াআর এদিকে আমিও মহা উৎসাহে টুকলুতে লেখা পাঠাতে লাগলাম। টুকলুর কর্মাধ্যক্ষ মাননীয় অমল ত্রিবেদী উৎসাহ দিয়ে সেই লেখা ছেপে আমার বাবার হাত মারফত আমাকে পাঠাতে লাগলেন। টুকলুর শারদ সংখ্যা মানেই বেশ মোটা কলবরে এবং নামিদামিদের লেখায় ঠাসা চমৎকার একটি সংখ্যা যার লিনোকাট প্রচ্ছদ করে দিতেন বিষ্ণু সামন্ত। ১৩৯৪-এর শারদ সংখ্যায় আমরা পেলাম ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়াশরৎ যখন আসেএক কলম জুড়ে সুন্দর একটি শিশুতোষ ছড়া এটি। যথারীতি শীত সংখ্যা ও নববর্ষ সংখ্যাতেও তাঁর দুটি ছড়াভূত হইতে সাবধানএবংমহান হ্যানিম্যানছাপা হল এবং শারদ সংখ্যায় (১৩৯৫) ছাপা হলমিঠে কড়া মেঠো ছড়ানামের ফুটবল ও ক্রিকেট নিয়ে আলাদা ছড়া

এদিকে ততদিন ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের দুটি চমৎকার ছড়ার বইনাম তাঁর সুকুমারমিঠে কড়া পশুর ছড়াপ্রকাশিত হয়ে গেল। দুটি গ্রন্থেরই পরিবেশক ছিল নিউস্ক্রিপ্ট, এ-১৪, কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা-৭। বই দুটির চমৎকার আলোচনা করলেন অমল ত্রিবেদী। শীত ১৩৯৫, ‘একুশে ফেব্রুয়ারির ছড়াউপহার দিলেন টুকলুর পাঠক-পাঠিকাদের। যার শেষ দুটি লাইন ছিল এরকম—

একুশ মায়ের প্রতিচ্ছবি অন্তবিহীন অন্তরে

একুশ আসুক বিষাদ-বিধুর, মিলন মধুর মন্তরে।

বৈশাখ সংখ্যায় (১৩৯৬) লিখলেনএলো বৈশাখএবং বর্ষা সংখ্যায় লিখলেনবৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুরআর শারদ সংখ্যায় লিখলেন মনমাতানো ছড়া (যেটি টুকলুতে আবার পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল)দুঃখে সুখে শিউলি বুকেছড়াটি মনে দাগ কেটে যাবার মতো

বিশেষ বর্ষা সংখ্যায় (১৩৯৭) তিনি পাঠালেনসবার বন্ধু ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণসব্যসাচী শৈল চক্রবর্তীদুটি ছড়াই স্বনামে ও ছদ্মনামে পাশাপাশি ছাপা হল। দুটি ছড়াই আবার ছাপা হল পুজো সংখ্যায়। শীত-বসন্ত যৌথ সংখ্যায় (১৩৯৭) বের হল তাঁরমাসি পিসির পাঁচ পাঁচালিনামের দুর্দান্ত মজার একটি ছড়া। ছড়াটির শেষ চার লাইন না উল্লেখ করে থাকতে পারলাম না

শেয়ালদহে থাকত শেয়াল, এখন যেথায় ইস্টিশান

খেয়াল হলেই গাইত খেয়াল চিবিয়ে সবাই মিষ্টি পান

খেয়াল গেয়েই তুলত দেয়াল, সে কী মধুর মিষ্টি গান

এইভাবেতেই উঠল গড়েই শেয়ালদার এই ইস্টিশান।

১৩৯৮-র রবীন্দ্র সংখ্যায় তিনি নামে ও ছদ্মনামে লিখলেন দুটি দীর্ঘ ছড়ারবি প্রণাম কবি প্রণামএবংপ্রণাম রবি বিশ্বকবিওই একই সংখ্যায় তাঁর প্রকাশিত ছড়ার বইছড়া ছবিতে ফল’ (প্রকাশক শিশু সাহিত্য সংসদ) বইটির আলোচনা বের হল। পরবর্তী বর্ষা সংখ্যায় উপহার দিলেনবৃষ্টির কৃষ্টিও শারদ সংখ্যায়যাক ভেসে সব পুজো

ততদিনে এই সাড়াজাগানো শিশুসাহিত্যেকের মোট চৌদ্দটি চমৎকার ছড়ার বই প্রকাশিত হয়ে গেছে। বইগুলির নামমজার ছড়া’, ‘মিঠেকড়া পশুর ছড়া’, ‘মিঠেকড়া খেলার ছড়া’, ‘মিঠেকড়া ভূতের ছড়া’, ‘নাম তাঁর সুকুমার’, ‘ছন্দে গাঁথা এ কলকাতা’, ‘ছড়ায় গড়া মহান যাঁরা’, ‘হাওড়া ভরা অনেক ছড়া’, ‘যাদের বলে সমাজ চলে’, ‘কীটপতঙ্গ নিয়ে কত রঙ্গ’, ‘ফুল-ফল-গাছ, পশু-পাখি-মাছ’, ‘ছড়া-ছবিতে ফুল’, ‘ছড়া ছবিতে মাছকিশোর কবিতা সমগ্র (প্রথম পর্যায়)বলাই বাহুল্য, এই প্রাণ দোলানো ও মনভোলানো বইগুলির তালিকা টুকলু পত্রিকায় মাঝে-মধ্যেই প্রকাশিত হতে লাগল। নববর্ষ ১৩৯৯ সংখ্যায় ভবানীদা লিখলেন বত্রিশ লাইনের পাতাভরা ছড়াএলো বৈশাখপরবর্তী শারদ সংখ্যা ছিল সত্যজিৎ স্মরণ সংখ্যা। সেই সংখ্যায় তিনি লিখলেনমনের মানিক সত্যজিৎলেখাটি কালার পেজে আলাদা ক্রোড়পত্রে ছাপা হয়েছিল

টুকলু ত্রৈমাসিকের পাশাপাশি ছিল পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ছড়া কার্ডটুকলু ছড়া কার্ডএই কার্ডে থাকত চার লাইনের ছড়া। পোস্টকার্ডের আকারে এই কার্ডের প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়া থাকত। মোট একশোটি কার্ড প্রকাশিত হয়েছিল টুকলুর। তারপর শততম কার্ডে (যাতে অনেকগুলো চার লাইনের ছড়া স্থান পেয়েছিল) ভবানীদা লিখলেন—

নমো নমো সিদ্ধিদাতা গণেশায় নমঃ

হল প্রকাশ টুকলু কার্ডের সংখ্যা শততম

নমো নমো সরস্বতী, নমো দুর্গা-কালী

টুকলু কার্ডের সেঞ্চুরিতে জোরসে লাগাও তালি।

আবার ছদ্মনামে লিখলেন—

সাজিয়ে নিশান, বাজিয়ে বিষাণ

বিশাল বিজয় ডঙ্কা

প্রকাশ হলো টুকলু কার্ডের

একশোতম সংখ্যা।

আবার লিখলেন—

ভরিয়ে ভুবন ভালোবাসায়

ছড়িয়ে ছড়ার ট্যাকসো

টুকলু ছড়া কার্ডের এবার

সংখ্যা হল একশো।

টুকলু পত্রিকার কর্ম্যাধ্যক্ষ ও পরবর্তীকালে সম্পাদক অমল ত্রিবেদীর সঙ্গে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিনের। অমলদা যখন ইত্যাদি প্রকাশনীতে কাজ করতেন, সে-সময় থেকেই যোগাযোগ। পরে ওভারল্যান্ড পত্রিকায় কাজ করার সময় আমিও অমলদার নিক্কো বোর্ডিং-এ চলে যেতাম। হাওড়া স্টেশন থেকে টানেলে বেরিয়ে ভবানীদার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম। ভবানীদা আসতেন অনেকগুলো ছড়া নিয়ে। টুকলু, সঞ্চিতা প্রভৃতি পত্রিকা ছাড়াও অনেকের ছড়া পেতাম তাঁর কাছে। সঙ্গে তাঁর স্বাক্ষর করা বই ও বিভিন্ন পত্রিকাও পেতাম

পুরুলিয়া এলে তিনি বেশিরভাগ সময় অমলদার বাড়িতেই কাটাতেন। আদ্রা আবৃত্তি পরিষদের অনুষ্ঠানে এসেছেন বেশ কয়েকবার। আদ্রায় স্বপনবুড়োর ছড়া নিয়ে কর্মশালাতেও এসেছেন তিনি। তাছাড়া পুরুলিয়া শহরে ঝলক পত্রিকার অনুষ্ঠানেও এসেছিলেন একবার। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই অমলদা ও ভবানীদার সঙ্গে থাকতাম আমি। ভবানীদা যেমন মজার মজার ছড়া লেখেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেগুলির পাঠও করতেন চমৎকারভাবে। ছোটো-বড়ো সকলেই হেসে গড়িয়ে পড়ত। আর সব লেখাই বলতেন মুখস্থ। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল সে-সময়। দীর্ঘ ছড়া গড়গড় করে বলে যেতে পারতেন। আমাদের আদ্রার রেল আবাসনে (টি-ফর্টি সি) যে-বার এসেছিলেন, সে-সময় তাঁর কাছ থেকে বেশ কয়েকটি বই উপহার পেয়েছিলাম। সব কয়টি বইয়ে স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন রঙিন স্কেচ পেনে। ততদিনে তাঁর রক্তে চিনি ধরা পড়েছে। তাই আদ্রায় এলে বেগুনি (তেলেভাজা) ছিল তাঁর প্রথম পছন্দের। তেলেভাজা আর আড্ডা দিতে দিতে সময় ফুরিয়ে যেত। একবার আদ্রার একটি অনুষ্ঠানে তাঁর জন্য এলাহাবাদ ব্যাংকের একটি গেস্ট হাউসে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। আমি রাত্রি দশটার সময় তাঁকে সেখানে নিয়ে গেলে তিনি কিছুতেই থাকতে রাজি হলেন না। শেষে রিকশা করে অমল ত্রিবেদীর বাড়িতে (লোয়ার ঝরিয়াডি) নিয়ে গিয়ে জোর আড্ডা দিয়ে তবে ঘুমোতে গেলেন। এই হল আমাদের ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। তাঁর প্রতি রইল আমার শ্রদ্ধা ও প্রণাম। তাঁর জন্য আমার এই ছোট্ট উপহার

 

এই ছড়াটি মজুমদারের, এই ছড়াটি অন্য,

এই ছড়াটি আর কারও নয়, ভবানীদার জন্য

এই ছড়াটি ছড়ার রাজার, দাশনগরে বাড়ি,

ছোটো-বড়ো সবার প্রিয়, লেখেন কাঁড়ি কাঁড়ি

এই ছড়াটি তাঁকেই দিলাম মুক্ত-মালার সাথে,

যাও ছড়া যাও এক্কেবারে ভবানীদার হাতে

বলো গিয়ে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন তিনি,

কলম হতে ঝরে পড়ুক শর্করা আর চিনি

যাও ছড়া যাও বলো গিয়ে ভবানীদার ঘরে,

আবার তিনি লিখুন ছড়া ছোটো-বড়োর তরে

আবার তিনি ছড়িয়ে পড়ুন শহর থেকে গ্রামে,

জয়ধ্বনি উঠুক আবার ভবানীদার নামে

  

<