কয়েকদিন কয়েকদিন
আগের কথা। ফোন পেলাম ত্রিপুরা থেকে। রজতদার ফোন। রজতদা মানে রজতবরণ চক্রবর্তী।
শিশুসাহিত্য ‘কিশোর বার্তা’
পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। দীর্ঘ ৩৬ বছর
ধরে যা চলমান। ফোনে কতকটা আদেশের সুরে অনুরোধ করে বসলেন, ‘ছড়া
সম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদার সম্বন্ধে একটা নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ লিখে দিন। আমরা
ভবানীদার নামে একটা সংখ্যা বার করব বলে মনস্থ করেছি।’
এ-কথা শুনে
আমার তো আক্কেল গুড়ুম। কলকাতায় থাকি, একটু-আধটু সাহিত্য করি, স্বভাবতই ভবানীদার সঙ্গে
আমার যোগাযোগ একটা থাকবে—এ ভাবনাটা ছিল তাঁর মনের মধ্যে। কিন্তু তা যে কতটা অমূলক
তা তিনি জানবেন কী করে?
কথাটা একদম
সত্যি। ভবানীদার সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল না। চিনতাম না ভবানীদাকে।
ডায়মন্ডহারবারে বসবাসকারী একটা ছেলের পক্ষে হাওড়ার নির্দিষ্ট কোনও লোককে চেনা
খুব একটা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না, তা তিনি যতই নামিদামি খ্যাতিমান ব্যক্তি হোন না কেন। এ-কথা অবশ্যই
অনস্বীকার্য। সে-কথা আর খুলে বলতে গেলাম না রজতদার কাছে।
এক শিক্ষক
পরিবারে আমার জন্ম। বাবা-দাদারা সব শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। স্বভাবতই
পাঠ্য বই ছাড়া নানারকম রেফারেন্সের বই, গল্প, উপন্যাস, পত্রপত্রিকাতে
ভরে উঠত আমাদের বাড়ির লাইব্রেরি। সেই পত্রপত্রিকা, বই আমরা
খুশিমতো টেনে নিয়ে পড়তাম। লেখকদের লেখা পড়ে মনে মনে একটা ধারণা গড়ে উঠত
আমাদের। সেখান থেকে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের নাম জেনেছিলাম প্রথম। পরে প্রায় সব
পত্রপত্রিকাতে তাঁর লেখা দেখতাম। চোখে পড়লেই গোগ্রাসে তা গিলে ফেলতাম। সহজ সরল
ভাষায় লেখা ছড়াগুলো সুললিত ছন্দে মোড়া। মজার মজার ছড়া; আমার
খুব ভালো লাগত। এক দুর্বার আকর্ষণে পড়ে যেতাম। নীরবে নিভৃতে পড়তে পড়তে আপন মনেই
হেসে ফেলতাম। কখনো-কখনো আচার-অনুষ্ঠানে গিয়ে আবৃত্তি করতাম। সে এক অদ্ভুত আনন্দের
দিন ছিল আমার কাছে। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করার মনোবাসনা চেপে বসল
আমার মাথায়। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ভেসে গেল আমার জল্পনাকল্পনা। লাখ টাকার লটারি
টিকিট পাওয়ার মতো হঠাৎ করে রাজ্য সরকারের একটা চাকরি জুটে গেল আমার কপালে। সেই
কারণে আমাকে জলপাইগুড়ি জেলাতে চলে যেতে হল। অধরা থেকে গেল আমার মনোবাসনা। এর
মধ্যে জলপাইগুড়ি জেলার বিভিন্ন সাহিত্যানুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে বহুবার
গেছেন। সে-খবর আমি পেয়েছি। কিন্তু র্দুভাগ্য এতটাই, সেখানে
যাবার মতো সময় আমার হয়ে উঠত না।
রামচন্দ্রের
বনবাসের মতো দীর্ঘ ১৪ বছর পর ১৯৯৭ সালে কলকাতায় ফিরলাম আমি। আমার পোস্টিং হল
সি.আই. ডি. ডিপার্টমেন্টে। তখন থেকে আমার নিয়মিত যাতায়াত শুরু হল কলেজ স্ট্রিট
পাড়াতে।
কলেজ
স্ট্রিটের ‘বর্ণপরিচয়’
বিল্ডিং তখন গড়ে ওঠেনি। পাবলিশার্সদের ছোটো ছোটো সব বই-দোকান ছিল
সেখানে। একদিন সেখানে গিয়ে শুনলাম ভবানীদা এসেছেন মামুর দোকানে। খুঁজে খুঁজে
গিয়ে হাজির হলাম সেই দোকানে। সেখানে প্রথম দেখলাম ভবানীদাকে। ছিপছিপে লম্বা,
উজ্জল চোখ, টিকালো নাক—এক নিরহংকারী মানুষ বসে
আছেন ভক্তবৃন্দের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করছেন নানান বিষয় নিয়ে। তাঁর সঙ্গে
সৌজন্য বিনিময় করে একসময় আমি ফিরে গেলাম আমার অফিসে। সেদিন বেশি কথাবার্তা হল না
তাঁর সঙ্গে। কিন্তু...
আমি তখন
গোয়েন্দা পুলিশের দুঁদে দারোগা। খোঁজখবর রাখা, তদন্ত করা আমার পেশা। সে ভালো হোক বা মন্দ হোক, তাতে
কিছু যায় আসে না। তবে লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে নিতে হয় আগে থেকে। আমার তখন
লক্ষ্যবস্তু ছিলেন ভবানীদা। খোঁজখবর করে জানতে পারলাম, ভবানীপ্রসাদ
মজুমদারের জন্ম হাওড়া জেলার জগাছা থানার অন্তর্গত দক্ষিণ শানপুরে। শিক্ষকতা পেশা।
শানপুর কালীতলা বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক। পিতা নারায়ণচন্দ্র মজুমদার,
মাতা নিরুপমাদেবী। অর্ধাঙ্গিনী পদ্মা মজুমদার। দুই মেয়ে। বিবাহিতা।
উচ্চশিক্ষিতা। বড়ো মেয়ে মনোমিতা স্বামীর সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে থাকেন। ছোটো মেয়ে
মধুমিতা থাকেন কলকাতায়। এই হল মোটামুটি ভবানীদার পারিবারিক হিসাবনিকাশ।
ভবানীদার
লেখালেখি শুরু সেই বাল্যকাল থেকেই। তখন তিনি পরাণস্মৃতি নিম্ন বুনিয়াদি
বিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রেরণাদাতা ছিলেন তাঁর স্কুলের শিক্ষক মহাশয়রা। ছেলেবেলা
থেকে শারীরিক দুর্বলতা থাকায় তিনি খেলাধুলা, হাই জাম্প, লং জাম্প এসব গুছিয়ে করতে পারতেন না।
পারতেন ছন্দ মিলিয়ে মজার মজার কথা বলতে। সেটাই হল তাঁর কাল। প্রতি শনিবার টিফিনে
ছুটি হয়ে গেলে মাস্টারমশাইদের তত্ত্বাবধানে ছাত্রছাত্রীদের শারিরীক ও মানসিক সাহস
জোগাতে, বুদ্ধি ও স্মৃতির বিকাশ ঘটাতে নাচ, গান, আবৃত্তি প্রভৃতির আয়োজন করা হত। সেখানে
শারীরিক দুর্বলতার কারণে ভবানীদার উপর ভার পড়ল ছড়া-কবিতা লিখে শোনানোর। গাছেরও
প্রাণ আছে। গাছ বাড়ে, নড়াচড়া করতে পারে সে-কথা শিক্ষক
মহাশয়ের কাছে জেনে, সেই অল্প বয়সে ভবানীদা তাঁর ভাবনার কথা
লিখে ফেললেন ছড়ার ছন্দে।
‘গাছ বলল ফুলকে, পিঠটা দে তো চুলকে। ফুল বললে গাছ রে সেই সুখেতেই নাচ রে। ফুলটির নাম কিংশুক, তাই সে বড় হিংসুক।’
এরকম উদাহরণ
অনেক ছড়িয়ে আছে। অনেক কবিতা-ছড়ার কথা বলা যায়। কিন্তু এত স্বল্প বয়সে তাঁর
কাব্য প্রতিভার বিচ্ছুরণ, সত্যি কল্পনা
করা যায় না। ভবানীদা জন্মেছিলেন ১৯৫৩ সালের ৯ই এপ্রিল। মাত্র বারো-তেরো বছর বয়সে,
১৯৬৫ সালে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশ পায় ‘দৈনিক
বসুমতী’ পত্রিকায়। ছোটদের পাতায়। তারপর তো ইতিহাস। বহু
লেখা ছাপা হয়েছে তাঁর বসুমতীতে। নানান কাগজে, বিভিন্ন
পত্রপত্রিকায়।
পত্রপত্রিকার
কথা যখন উঠল, তখন ভবানীদার
প্রথম বইয়ের কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে কথাটা। ভবানীদার প্রথম বই হল
‘মজার ছড়া’। ওই বইটা বার হয়েছিল ‘শিশুসাহিত্য সংসদ’ থেকে। ১৯৮১ সালের মে মাসে।
ওই বই
প্রকাশের ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ভবানীদা বলেছেন, “আমি ভাগ্য বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমার
ভাগ্য কেমন শোনো। শিশুসাহিত্য সংসদের মালিকের নাম ছিল মহেন্দ্রনাথ দত্ত।
শিশুসাহিত্য পরিষদ নামে শিশু সাহিত্যিকদের একটি সংস্থা আছে কলকাতায়। আমি ওঁদের
সঙ্গে যুক্ত। প্রতিবছর ওঁদের একটি করে বার্ষিক অনুষ্ঠান হত দু-দিন ধরে। ওঁরা
হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে প্রচার করতেন কী কী হবে অনুষ্ঠানে। সে-বছর শিশুসাহিত্য নিয়ে
বলবেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ছোটদের নাটক নিয়ে বলবেন...
ইত্যাদি।
“আমি অনুষ্ঠানে
গেছি। যে-কোনো কারণেই হোক পূর্ণেন্দু পত্রী সেদিন আসতে পারেননি। শিশুসাহিত্য
পরিষদের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য। পণ্ডিতের
ঘুড়ি নামে একটি বই আছে ওঁর। বললেন, ‘ভবানী! তোমাকে একটা কাজ
করতে হবে। ওই দ্যাখো, পূর্ণেন্দু পত্রী চিঠি পাঠিয়েছেন,
আজ উনি আসতে পারবেন না। কিন্তু ওঁর বলার জন্য তো একঘণ্টা সময় ধরা
আছে। এখন বলো কী হবে? কাকে পাব, কাকে
বলব এখন? তোমাকে যদি বলি, তুমি একঘণ্টা
কবিতা পড়তে পারবে? তুমি তো প্রতিটি সাহিত্যপাঠের আসরে আসো,
অনেক কবিতা শোনাও।’
“বললাম, ‘চেষ্টা করে দেখব ক্ষিতিদা।’
“ ‘তুমি দেখো ভাই,
আর কোনও উপায় নেই।’
“যথারীতি আমাকে
সুযোগটা দিলেন। উনি মঞ্চে উঠে বললেন, ‘বিশেষ কারণে
পূর্ণেন্দু পত্রী আজ আসতে পারছেন না। সেই সময়টা আমাদের তরুণ কবি ভবানীপ্রসাদ
মজুমদার কবিতা পড়বেন।’
“কবিতা পড়ছি।
দেখলাম, সামনের আসনে কোঁচানো ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একজন জমিদার
গোছের ভদ্রলোক বসে আছেন। হাতে শৌখিন লাঠি। কবিতাপাঠের পর আমাকে উনি হাতের ইশারায়
ডাকলেন। নমস্কার করে পাশে বসলাম। বললেন, ‘ভাই, আজ তুমি যে কবিতাগুলো পড়লে, এমন কত কবিতা তোমার
লেখা আছে?’
“বললাম, ‘বেশি নেই, ২০০-২৫০ মতো আছে।’
“পকেট থেকে কার্ড
বার করে আমায় দিলেন। বললেন, ‘তোমার ওই লেখাগুলো নিয়ে যত
তাড়াতাড়ি পারো আমার অফিসে দেখা করবে।’
“আমি ক্ষিতিদাকে
বললাম। ক্ষিতিদা বললেন, ‘ভবানী, তোমার
বরাত খুলে গেল। যাও, তুমি লেখাগুলো নিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে
দেখা কোরো।’
“আমি গেলাম। বইটা
বেরোল। এভাবে আমার সূচনা হল। ভাবো, বললে গল্প মনে হবে। উনি
ছিলেন সরস্বতী প্রেসের মালিক। তারপর সরকার তো সরস্বতী প্রেস কিনে নিল।
“যেদিন বইটা
বেরোল, আমি শিশুসাহিত্য সংসদের অফিসে গেছি—বইটা পাব। উনি
লোকজনকে বললেন, ‘দাও তো, দশটা বই ভালো
করে প্যাক করে। নিয়ে যাব।’ নিলাম। তারপর বললেন, ‘চলো, আজ তোমাকে একজায়গায় নিয়ে যাব।’
“গাড়িতে বসলাম।
গাড়ি গিয়ে গড়িয়া হাটের কাছে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে থামল। এক প্যাকেট
মিষ্টি কিনলেন। বললেন, ‘মিষ্টিটা নাও। তুমি লীলাদিকে
মিষ্টিটা দেবে, আর বইটা দেবে। দিয়ে প্রণাম করবে।’
“আমি তাই করলাম।
বেরিয়ে আসার সময় বললেন, ‘কেন লীলাদির বাড়িতে এলাম বলো তো?
আমি তোমার বই করব কি না, তোমার লেখার নেওয়ার
পর বেশ কয়েকজনকে ফোন করেছিলাম। লীলাদিই একমাত্র বলেছিলেন, ওর
বইটা করুন। আমি বলছি, আপনি ঠকবেন না।’ বলেছিলেন,
‘হাজার হোক, আমি তো কারবারি লোক, ব্যাবসা করি। বেশ কয়েকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, একমাত্র লীলাদিই উচ্চ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘মহেন্দ্রবাবু,
আপনি ওর বই করুন। আপনার কোনও অসুবিধা হবে না। আপনি লাভবান হবেন।’
”
তারপর আর
পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। দু-হাতে যেভাবে ছোটো-বড়ো নানান পত্রপত্রিকাতে
কবিতা-ছড়া লিখেছেন। নানাধরনের ছড়া। মজার ছড়া, খেলার ছড়া, ভূতের ছড়া, পশুপাখির
ছড়া, ঋতু বিষয়ক ছড়া, সামাজিক ছড়া,
বিজ্ঞানভিত্তিক ছড়া, শিশুতোষ ছড়া, মহামানবের ছড়া, শরীর-স্বাস্থ্য বিষয়ক ছড়া,
পার্বণের ছড়া, প্রতিবাদী কবিতা-ছড়া—এরকম
অনেক ভাগেই বিভক্ত করা যায় তাঁর লেখা ছড়াগুলো। যা এখন ছেলেপুলেদের মুখে মুখে
ঘোরে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, জানতে ইচ্ছে করে, এ পর্যন্ত কত ছড়া তিনি লিখেছেন? কোনও এক
সাক্ষাৎকারে ভবানীদা বলেছিলেন তা প্রায় ২০ হাজারের ওপর। এতদিনে তা ২১-২২ হাজারে
গিয়ে পৌঁছেছে নিশ্চয়ই।
অজস্র
প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা-ছড়ার বই। সেগুলো বাজারে রমরমিয়ে চলে।
কিন্তু হিসাবের সংখ্যায় তা কত? এ প্রশ্নটা সবার মনে উঁকি মারলেও তা বলা দুষ্কর। কারণ, প্রতিবছরে তার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। তবে এর একটা রাফ হিসেব বলা যেতে পারে।
প্রায় শতাধিক কবিতা, ছড়ার বই আছে তাঁর। ‘মজার ছড়া’, ‘রূপালী ছড়া’, ‘সোনালি
ছড়া’, ‘সদ্য গড়া’, ‘যাচাই করা বাছাই
ছড়া’, ‘ছন্দে গাঁথা এ কোলকাতা’, ‘ছড়ার
ভিড় আবৃত্তির’, ‘মিঠেকড়া মাছের ছড়া’, ‘মিঠেকড়া পশুর ছড়া’, ‘মিঠেকড়া পাখির ছড়া’,
‘মিঠেকড়া খেলার ছড়া’, ‘মিঠেকড়া ভূতের ছড়া’,
‘ছন্দে গড়া মহান যাঁরা’, ‘টাপুর টুপুর ছড়ার
নূপুর’—এরকম ছন্দে গড়া মজার মজার আরও অনেক বই।
শুধু তাই
নয়—‘গানে গানে মজার ছড়া’, ‘গানে গানে আরো ছড়া’, ‘ছড়ার মেলা ছড়ার খেলা’,
‘ছড়ার গাড়ি দিচ্ছে পাড়ি’, ‘ছড়ার হাট
জমজমাট’, ‘ছড়াছড়ি গড়াগড়ি’, ‘মিঠেকড়া
পুজোর ছড়া’ ইত্যাদি শিরোনামে ছড়ার সিডি ও ক্যাসেট আছে
বাজারে। যা এককথায় শিশুকিশোরদের মনের খোরাক। আনন্দ, খুশির উপকরণ।
এবার একটু
নিজের প্রসঙ্গে আসি। আগেই বলেছি আমি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। পদোন্নতিতে তখন
আমি ডি.ডি.আই. রেলওয়ে অ্যান্ড হাইওয়ে ক্রাইম ইন্সপেক্টর। সি.আই.ডি. অফিস, ভবানীভবন। চাকরি-জীবনের শুরু থেকে দেখে
আসছি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ‘মঙ্গলপথ’ ও
‘আরক্ষাবার্তা’ নামে দুটি মুখপত্র নিয়মিত
প্রকাশিত হয়ে আসছে। তাতে আমরা নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে লেখালেখি করতাম। লেখকদের
উৎসাহিত করতে বিভিন্ন ব্যাপারে তাঁদের দক্ষতার নিরিখে বিচার বিবেচনা করে পুরস্কার
প্রদান করা হত একটা সভা করে। সে-বারে পশ্চিমবঙ্গ নন-গেজেটেড পুলিশ কর্মচারী সমিতি
অন্যান্য কৃতীদের সঙ্গে বিশিষ্ট সাহিত্যিক হিসাবে আমাকেও সম্মাননা জানাবার
সিদ্ধান্ত নিল। দিন স্থির হল ইং ৩১/১২/২০১০ তারিখ। সেদিন ভবানীভবনের তিনতলায়
সি.আই.ডি-র কনফারেন্স হলে আমন্ত্রিত কবি হিসাবে হাজির ছিলেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।
তাঁর জন্য সময় বরাদ্দ ছিল আধঘণ্টা। পরিপূর্ণ পুলিশে ভরা কনফারেন্স হলে বক্তৃতার
ফাঁকে শুরু করলেন তাঁর ছন্দে গড়া রসে মোড়া মজার মজার ছড়া পাঠে। একটা দুটো নমুনা
দিই তার। (১) ‘খুব ভোরে গাছে চড়ে ও-পাড়ার রাম চুরি করে ঝুড়ি ভরে পাড়ছিল আম। সাড়া পেয়ে, এল ধেয়ে লাঠি হাতে মালি বলে পাজি, পুরো গাছই করে দিলি খালি! আয় নেমে, বড়ো হয়ে হবি চোর পাকা চল দেখি, কী বলেন তোর বাবা-কাকা? রাম বলে, কোথা যাবে? তুমি হাঁদা-হাবা ওই দ্যাখো, মগডালে বসে কাকা-বাবা।
(২) রাত বারোটায় কালনা নেমে রওনা হলাম একা, পথের ধারে হঠাৎ এক ভূতের সাথে দেখা। ভূত বললে, দাঁড়া, এমন সুযোগ কি আর পাব? এক্ষুনি তোর ঘাড় মটকে রক্ত চুষেই খাব। কেঁদে বললাম, সে কি, আমি থুত্থুড়ে এক বুড়ো, আমার দেহের রক্ত শীতল, ঠান্ডা বরফ পুরো। তার চেয়ে ভাই পাকড়ে কোনও জোয়ান ছেলে মেয়ে, দারুণ মজা পাবে তাদের গরম রক্ত খেয়ে। ভূত বললে, হোক ঠান্ডা, করব তোকে সাবাড়, ইচ্ছে আমার হচ্ছিল আজ খুব কোল্ড ড্রিঙ্কস খাবার।
তাঁর
বুদ্ধিদীপ্ত মজার মজার ছড়া শুনে, ছড়া পাঠের ভঙ্গিমা দেখে কতকটা যেন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন সকলে।
সারাদিন ক্রাইম ক্রিমিনাল নিয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখে মুচকি হাসি দেখে ভবানীদা
বেপরোয়া তখন। আধঘণ্টার জায়গায় পাকা দু-ঘণ্টা পরে তিনি অবকাশ পেলেন মঞ্চ থেকে
নামার। আমি অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। একরাশ বিস্ময় এসে জড়িয়ে
ধরল আমাকে। হোক না নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, তা কি মাথার মধ্যে
সব গুঁজে রাখা যায়? পরে জেনেছি, ভবানীদার
স্মরণশক্তি ঈর্ষণীয়। ঈশ্বর প্রদত্ত। যা অনেকের কাছে নেই। তিনি আজও অনায়াসে মুখস্থ
বলে দিতে তাঁর প্রথম বইয়ের ছড়াগুলো।
তাঁর
সহৃদয়তার কথা শুনেছি অনেকে। সেদিন স্বচক্ষে দেখলাম, শুনলাম তাঁর মুখের কথা। না হলেও বেশ কয়েকবার আমার, তরুণ
ঘোষের মতো নগণ্য সাহিত্যিকের প্রশংসাসূচক নাম নিয়েছেন তাঁর বক্তৃতায়। তাঁর সেই বক্তৃতায়
গর্বে বুকটা ফুলে উঠলেও লজ্জায় সাহেবদের সামনে এতটুকু হয়ে গেলাম।
একটা সময়
গেছে তখন ছিল পুথি সাহিত্যের চল। সাহিত্যিকরা বড়ো বড়ো কাহিনি, কাব্য লিখতেন পুথিতে। সেগুলো ছন্দাকারে
লেখা হত। কবিগণ তা পাঠ করে শোনাতেন কোনও আসরে। সেইরকম সহজাত কবির মতো কবি হলেন
ভবানীদা। খুব অল্প বয়স থেকে ছন্দ করে কথা বলায় অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিভা
দেখে উৎসাহ দিয়েছেন বাড়ির লোকজন, আত্মীয়স্বজন। প্রেরণা
জুগিয়েছেন স্কুলের শিক্ষক মহাশয়রা। তবুও গুরু হিসাবে ভবানীদার কাছে প্রাধান্য
পেয়ে এসেছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুকুমার রায়। পুরোনো কাগজের দোকানে একটা মলাট
ছেঁড়া ‘আবোল তাবোল’ পড়েই নাকি
ভবানীদার এই উত্থান। তাই তাঁকে এখনও পথিকৃৎ হিসেবে মানেন। তাই তিনি দ্ব্যর্থহীন
ভাষায় তাঁর ছড়ায় বলতে পেরেছেন—
‘গুরু আমার রায় সুকুমার
গুরু আমার গুরু,
তাঁর ছড়াপাঠ করেই আমার
ছড়া লেখা শুরু।’
‘আবোল তাবোল’
স্রষ্টা সুকুমার রায়কে গুরুজ্ঞানে উচ্চাসনে বসালেও সুনির্মল বসু,
যোগীন্দ্রনাথ সরকার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো কবিগণ ছিলেন
ভবানীদার কাছে আদর্শ, প্রতিভাধর কবি। তাঁদের লেখা পড়ে
জেনেছেন কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে কত সহজ সরল ভাষায় তা পরিবেশন করা যায়, কত মজা করা যায়; কীভাবে শিশুকিশোরদের শিক্ষা দেয়া
যায়।
ভবানীদা
তাঁর সাহিত্য-জীবনে সম্পাদনা করেছেন বহু পত্রপত্রিকা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘একতারা’, ‘ঝালাপালা’,
‘হিজিবিজি’, ‘গাঁটছড়া’, ‘গরমমশলা’ ইত্যাদি। সহযোগী সম্পাদক হিসাবে সম্পাদনা
করেছেন ‘শিশুপ্রিয় অনির্বাণ’, ‘চন্দ্রিমা’,
‘অন্বেষণ’ ইত্যাদি। কবি ও অতি সাধারণ মানুষের
ছড়া লেখায় প্রেরণা জোগাতে বহুদিন তিনি ওভারল্যান্ড খবরের কাগজে এক লাইনে ছড়া
লিখে বাকি তিন লাইন লিখিয়েছেন কবিদের দিয়ে। সেসব লেখা দেখে লেখার বিচার করেছেন
তিনি। ভালো লেখাগুলো ঠাঁই করে দিয়েছেন কাগজে। আসলে ছড়া অন্ত প্রাণ ভবানীদার।
ছড়া নিয়ে প্রচুর চিন্তাভাবনা করেন। ছড়ার উপর প্রচুর পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন।
তিনি তাঁর লেখা ছড়াগুলোর শিরোনামও সাজিয়ে দিয়েছেন ছন্দে। যাতে পাঠকের মনে দোলা
দিয়ে যায় ছড়ার শিরোনাম পড়ে। সেসব ছড়ার শিরোনামে কবির নাম না থাকলেও অনায়াসে
চিনে ফেলা যায়—এটা ভবানীদার ছড়া। এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজারের উপর ছড়া লিখেছেন
তিনি। সে লেখাগুলো নানান প্রকরণে বিভক্ত করা যায়। বিস্তর পর্যালোচনা করা যায়।
সেসব কাজ ক্রিটিকদের, গবেষকদের; আমার
মতো সামান্য মানুষের নয়। সুতারাং সে-প্রসঙ্গে না যাওয়াই শ্রেয়।
এডওয়ার্ড
লিয়রের পঞ্চপদী ব্যঙ্গাত্মক কবিতার নিয়ম অনুসারে লেখা হয় ‘লিমেরিক’। সে-কবিতা লেখার কিছু পদ্ধতি বিদ্যমান। তা সহজে বোধগম্য
হওয়ার জন্য নবীন কবিদের জন্য ছড়াকারে তিনি লিখেছেন—
‘লিমেরিকে
থাকবে দেহে পাঁচ চরণ
মিলের খেলা এক, দুই, পাঁচ—এই ধরন
তিন-চারেতে অন্য মিল
লিমেরিকের এই দলিল
শেষ লাইনে হতেই হবে বিস্ফোরণ।’
আমার প্রথম
থেকেই ধারণা ছিল ভবানীদা শুধু মজার ছড়া লেখেন। কিন্তু আমার সে ধারণাটা যে কত
ভ্রান্ত তা বুঝেছিলাম পরে। বহু কঠিন সিরিয়াস বিষয় নিয়ে তিন অত্যন্ত সহজপাচ্য
করে পরিবেশন করেছেন। দু-একটা নমুনা না দিলেই নয়। ‘কাঁদছে শিশু, জাতির শিশু’ কবিতার
একটি ছত্রে তিনি লিখেছেন—
‘ধুঁকছে অযুত-নিযুত শিশু, মরছে বিনা
পুষ্টিতে
শিশু-দিবস করেই আমরা নাচছি আত্মতুষ্টিতে!
লক্ষ শিশু গুমরে কাঁদে আমার হৃদয় মন জুড়ে
তাদের হয়ে এই আবেদন, হবে কবে
মঞ্জুর এ?
আস্তাকুঁড়ে নাস্তা ঢুঁড়ে রাস্তা জুড়ে শীর্ণ হাত
প্রশ্ন নাচায় : বলতে পারেন, জাগবে কবে জীর্ণ জাত?’
কিংবা তাঁর
লেখা ‘জীবন যোদ্ধা, জানাই
শ্রদ্ধা’ কবিতা। যার প্রথম চার চরণে তিনি লিখেছেন—
‘কেউ ভালোবাসে রজনীগন্ধা, কেউ বলে কেয়া-করবী
ডালিয়া-জিনিয়া, গোলাপ-টগর, জুঁই-চাঁপা রূপে গরবী!
ওরা ভালবাসে ফুল, শুধু ফুল, ফুলের স্নিগ্ধ হাসি
আমি মানুষের জয়গান গাই, মানুষকে
ভালোবাসি।
ভবনীদা তাঁর
সাহিত্য-জীবনে বহু নবীন সাহিত্যিকের বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। বইয়ের নামকরণ
ঠিক করে দিয়েছেন। আর ছড়া-কবিতা সংশোধন করে দিয়েছেন অজস্র। তাঁর এই মহানুভবতা, নবীন সাহিত্যিকদের প্রতি তাঁর সহৃদয়
সহানুভূতি, ভালোবাসা কোনোদিন ভোলার নয়।
ভবানীদা
তাঁর সাহিত্য জীবনে শতাধিক পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য হল পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ছড়া-সাহিত্য পুরস্কার, সুকুমার রায় শতবার্ষিকী পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
পুরস্কার, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র পুরস্কার, সুলেখা পুরস্কার ইত্যাদি।
এত
পুরস্কারের মাঝে আপনার কাছে সেরা পুরস্কার কোনটি? ‘ফজলি’ পত্রিকার পক্ষ থেকে এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার
নেবার সময় কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তার উত্তরে তিনি
বলেছিলেন, “দেখো ভাই, একজন পাপকের কাছে
সব পুরস্কারই সমান উল্লেখযোগ্য। তা সে যত ক্ষুদ্রই হোক, যত
সামান্যই হোক। তবুও আমি বলব আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘সুকুমার
রায় শতবার্ষিকী পুরস্কার’। আমি তো জানি, এই পুরস্কার আর কারও পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাঁর ছেলে সত্যজিৎ রায় বাবার
নামে পুরস্কার নিজের হাতে আমার গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন—এর মূল্য অনেক। শতবর্ষ তো
একবারই আসে! দ্বি-শতবার্ষিকী পুরস্কার কেউ পেতে পারে—সত্যজিৎ রায়ের হাতে পাবে কি?”
পুরস্কারের
জন্য যখন সিলেক্ট করেছিলেন, তখন ওঁরা
দশজনের জনের কাছে নাম চেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে হরেন ঘটক, লীলা
মজুমদার এঁরা ছিলেন। সুকুমার রায়ের উত্তরসূরি কে? সুকুমার
রায়ের পরে কে ওঁর মতো লিখেছেন মজার মজার ছড়া? অনুষ্ঠানের
দিন সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন—উনি তো গমগমে গলায় হো হো করে হাসতেন। বলেছিলেন,
“দশজনের কাছে নাম চাওয়া হয়েছিল, আটজন
পাঠিয়েছিলেন। আপনারা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, আটটা চিঠি খুলে
দেখি একটাই নাম আছে—ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। চিন্তা করো!”
সত্যজিৎ
রায়ের হাত থেকে সুকুমার রায় শতবার্ষিকী পুরস্কার নেওয়া নিঃসন্দেহে ভবানীদার
জীবনে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। তবুও একটা কথা উল্লেখ না করলে নয়, তা হল বাংলা ছড়া-সাহিত্য লিখে ভবানীদা
যেভাবে আপামর জনতার মনে স্থান করে নিয়েছেন তা অত্যন্ত ঈর্ষণীয়। মনমাতানো ছড়া
লিখে তিনি অনায়াসে জয় করে নিয়েছেন সবার হৃদয়। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ থেকে সম্প্রতি তিনি করেছেন ‘ইন্টারন্যাশনাল ম্যান অব দ্য ইয়ার’। আরও
সম্মান, আরও পুরস্কার তিনি পান, এটা আমাদের কাম্য। তবে আমাদের জন্য আরও লিখতে থাকুন, এটা আমাদের দাবি, আমাদের প্রার্থনা।
<
|