পার্থপ্রতিম আচার্য

                                                                                                                                                                                                                      ছবি - রাহুল মজুমদার

  আমাদের ভবানীদা









পার্থপ্রতিম আচার্য





 

হা-হা, হা-হা, হা-হা!

হাসছি আমি, হাসছ তুমি

হাসছে সবাই আহা,

হাসছে স্বপন, হাসছে তপন

হাসছে রাহা-লাহা

হাসছে অরুণ-বরুণ-তরুণ

ঘোষ-বোস-সাউ-সাহা!

হা-হা, হা-হা, হা-হা!

(হাসির চোটে, তুফান ছোটে/ ভবানীপ্রসাদ মজুমদার)

     আমাদের অলংকারশাস্ত্র অনেক প্রাচীন এবং তাতে নয়টি রসের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু  বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সম্পদছেলে ভুলানো ছড়া’-য় যে রসটি পাওয়া যায় তা ওই নয়টি রসের সীমাবদ্ধতায় সীমায়িত নয়। তা সম্পূর্ণ আলাদা এবং জনসমাদৃত। রবীন্দ্রনাথ ওই রসটির নাম দিয়েছিলেনবাল্যরসঅবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আপন প্রচেষ্টায় মানুষের মুখে মুখে ফেরা বিভিন্ন ছড়া সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।  সংগৃহীত ছড়া নিয়েমেয়েলি ছড়ানামে একটি মস্ত প্রবন্ধ লিখেছিলেন ১৩০১ বঙ্গাব্দেরসাধনাপত্রিকার আশ্বিন-কার্তিক সংখ্যায়। রবীন্দ্রনাথের মতন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গ্রামবাংলার বিবিধ স্থান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন ছড়া,  লিখেছিলেনছেলে ভুলানো ছড়ানামের প্রবন্ধ এবং তা প্রকাশ হয়েছিলভারতীপত্রিকার বৈশাখ ১৩৩০ বঙ্গাব্দে। অর্থাৎ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ছড়ার সবিশেষ গুরুত্ব এবং মর্যাদা রয়েছে। মানুষ যখন লিখতে শেখেনি, তারও আগে থেকে শিশুমনের মনোরঞ্জনের জন্য মুখে মুখে তৈরি হত ছড়া। সেই কোন সুদূরের মা-ঠাকুমাদের সৃষ্টি করা প্রবহমান ছড়াই সংগৃহীত হয়েছিল অনেক অনেক বছর পরে। মুখে তৈরি ছড়া যখন লিখনে পরিণত হল, সেই পরম্পরাতে বহুযুগ ধরে বাংলা সাহিত্যে মদনমোহন তর্কালংকার, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, সুকুমার রায়, অন্নদাশঙ্কর রায় হয়ে হাজির হয়েছেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার

আশির দশকের শেষের দিকে আমার সামান্য সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতেই পেয়েছি ভবানীদার স্নেহ এবং উৎসাহ। ভবানীদার ছড়া ও কিশোর কবিতায় আলোড়িত হচ্ছে তখন বাংলা ভাষার প্রায় সকল ছোটোদের পত্রিকা। সেই সময় পোস্টকার্ডে চিঠি লিখতাম ভবানীদাকে; সেই চিঠির জবাবও আসত অত্যন্ত সুন্দর হস্তাক্ষরে। সাধারণ ডট পেনে লেখা অক্ষর সকল মুক্তোর মতন ঝকঝক করত। প্রতিদিন ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষা করতাম কবে ভবানীদার পাঠানো পত্রিকা অথবা ভবানীদার লেখা চিঠি এসে পৌঁছাবে

ভবানন্দ ভারতী—এই ছদ্মনাম ছাড়াও সম্ভবতশরকৃষ্ণ চট্টসূর্যনামেও প্রচুর লিখতেন ভবানীদা। আশির দশকের শেষের দিকে সম্পাদনা করেছিলেন নির্বাচিত কবিদের ছড়ার সংকলনগাঁটছড়া

শ্রীরামপুর থেকে সেই সময় প্রকাশিত হতশিশুপ্রিয়পত্রিকা। কৃষ্ণচন্দ্র ভড় সম্পাদিত ওই পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার ও শিশির সাঁতরা

আমি ভবানীদাকে একত্রে চার-পাঁচটি লেখা খামে ভরে পাঠিয়ে দিতাম। ভবানীদাশিশুপ্রিয়ছাড়াও লেখা দিয়ে দিতেন দিলীপকুমার বাগ সম্পাদিতঅভিনব অগ্রণী’, বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিতমণিমুক্তা’-র মতন ছোটোদের পত্রিকায়। পরবর্তীকালে ভবানীদার শানপুর (দক্ষিণ), দাসনগর, হাওড়ার বাড়িতে গিয়েছি বহুবার। অধুনা দ্বিতল বাড়িটি সেই সময় ছিল কাদামাটির গাঁথনিতে গড়া। প্রচুর বই, পত্রপত্রিকার মধ্যে পড়াশোনা ও লেখালেখি করতেন শানপুর বিদ্যালয়ের শিক্ষক, বাংলা ভাষার অনন্যসাধারণ ছড়া-লিখিয়ে  ভবানীদা। যাঁর ব্যবহার আজও দিলখোলা, আন্তরিক, অহমিকাহীন, প্রাঞ্জল

জীবনানন্দ দাশ তাঁরকবিতার কথাপ্রবন্ধে জানিয়েছিলেন, কবিতা ও জীবন একই জিনিসের দুইরকম উৎসরণ। অর্থাৎ, জীবন সম্পর্কে বোধ যদি অপরিপূর্ণ হয় তবে প্রকৃত কবিতা রচনা করা সম্ভব নয়। ছড়ার ক্ষেত্রেও ওই একই বোধ জাগ্রত থাকে। ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়া ও কিশোর কবিতা চলমান সময়, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক বাতাবরণকে অনুধাবন করেই রচিত হয়ে থাকে। জীবন সমন্বিত সমস্ত বিষয়ে সর্বদা সচেতন থেকেছেন তিনি। শুধুমাত্র ছোটোদের কল্পনাপ্রবণ মায়াময়, বিস্ময়কর জগৎ নয়, বড়োদের মানসলোকও সমানভাবে স্পর্শ করতে তাই সক্ষম হয়েছে ভবানীদার শ্রুতিমধুর, অন্তরঙ্গ, অবিকল্প ছড়া ও কিশোর কবিতা। প্রসঙ্গত জানাই, কম বয়সে বেশ কিছু বড়োদের জন্য কবিতাও লিখেছেন ভবানীদা



হা-হা, হা-হা, হা-হা!

হাসছি আমি, হাসছ তুমি

হাসছে সবাই আহা,

হাসছে স্বপন, হাসছে তপন

হাসছে রাহা-লাহা

হাসছে অরুণ-বরুণ-তরুণ

ঘোষ-বোস-সাউ-সাহা!

হা-হা, হা-হা, হা-হা! 

(সম্পর্কের সুতো)

 

বাংলা ভাষায় বাংলা ছড়া ও কিশোর কবিতার নির্মল তরঙ্গায়িত শাণিত ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্যকে লালন করেছেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। হাঁচি, কাশি, টিকটিকি থেকে সত্যানুরাগী মনীষীদের জয়গান, চির-সবুজ গ্রামদেশ থেকে দ্বিধাগ্রস্ত নগর সভ্যতার থই না পাওয়া  মানুষ—সর্বত্র স্পর্শ করেছে ভবানীদার অত্যাশ্চর্য ছড়া। ছন্দ ভবানীদার সহজাত। বাংলা ছড়ায় ছন্দ নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-সহ ছন্দ ব্যবহারের পরিশীলিত সৃজনময় কাজ বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে থাকবে

লেখকের মনন সঠিক কৌতুকপ্রবণ, হাস্যরসাত্মক ও তীব্র অনন্যচিত্ত না হলে প্রকৃত মনোগ্রাহী, চিত্তাকর্ষক এবং তৃপ্তিদায়ক রচনা শিশুকিশোরদের জন্য লেখা সম্ভব নয়। চিন্তাঋদ্ধ হৃদয়, নির্ভেজাল কবিত্বের বাঁধনে পুরোমাত্রায় সংলিপ্ত থাকে একজন সৃজনশীল শিশুসাহিত্যিকের। বলাবাহুল্য, ভবানীদার তা রয়েছে বলেই চারটি দশক ধরে দেশ-কাল নির্বিশেষে সকল বাঙালির কাছে তিনি অন্যতম জনপ্রিয় ছড়াকার ও কিশোর কবিতার লেখক হিসেবে নন্দিত, সমাদৃত এবং সম্মানিত। এ বড়ো সাধারণ কথা নয়

  

<