তুহিন কুমার চন্দ


ছবি - স্নেহাশীষ চক্রবর্তী  

    আমার বন্ধু ভবানীপ্রসাদ 











তুহিন কুমার চন্দ





 

আমার বন্ধু ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। আমার সঙ্গে ওর পরিচয় সেই ১৯৮০ সালে। আমি রায়গঞ্জ থেকে যখন কলকাতা যেতাম তখন কলেজ স্ট্রিটে আড্ডা দিতে যেতাম। সুবোধ ব্রাদার্স, নিউস্ক্রিপ্ট পেরিয়ে বসন্ত কেবিন। সমর পাল আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু; যতদিন কলকাতা থাকতাম, আমি এই আড্ডায় যেতাম। রাহুল মজুমদার, দেবাশীষ বসু, কার্তিক ঘোষ, ৺শিশির গুহ, সুখেন্দু মজুমদার—আরও অনেকে। আড্ডা হত মূলত ছড়া নিয়ে, কবিতা নিয়ে

আমার খুব কাছের বন্ধু বলতে ভবানী চিরকালই ভীষণ খাদ্যরসিক। খেতে খুব ভালোবাসত। একবারের ঘটনা বলি। আমি মাত্র আড্ডায় পৌঁছেছি। ভবানী বলল, “তুহিন, ব্যাংকের কাজ সেরে এসেছ, এসো দুজনে বাড়ি থেকে আনা পরোটা খাই।

আমি না করলাম না। রাজি হয়ে পরোটায় একটা কামড় দিয়েই ভবানীকে বললাম, “ভবানী, খেও না, গন্ধ হয়ে গেছে।

আমায় বলল, “সকালবেলার ভাজা তো, ও কিছু নয়, চালিয়ে দাও।

আমি চালাতে পারলাম না। দেখি ভবানী ঠিক খেয়ে নিচ্ছে। বলল, “ওগুলো ছন্দের চাপে ঠিক হজম হয়ে যাবে।

***

আর একবার একটি ছেলে ভবানীকে এসে বলল, “আমাদের ক্যাপস্টান সিগারেটের একটা ক্যাপশন লিখে দিতে হবে দাদা।

আমরা আড্ডায় এতটাই মশগুল ছিলাম যে ভবানী বিরক্ত হয়ে ছেলেটিকে বলল, “কাল এসো, লিখে দেব।

ছেলেটিও নাছোড়বান্দা।—না স্যার, এক্ষুনি দিতে হবে। আকাশবাণীতে বিজ্ঞাপন চলবে স্যার।

ভবানী আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ওকে বলো, খুব ভালো লিখে দেবে। তবে শুনি কত দেবে তোমরা।

ছেলেটি বলল, “কিছু দেব স্যার।

ও বলল, “পাঁচশো লাগবে কিন্তু।

তখনের পাঁচশো টাকা মানে বিরাট ব্যাপার। রাজি হয়ে গেল ছেলেটা। বোঝো ঠেলা, লিখব আমি দামদর করছে ভবানী! কিছু করার নেই, লিখে দিলাম—

স্বাদে আর আমেজে ক্লান্তিটা থামে যে।

ছেলেটা বেজায় খুশি। ভবানী টাকাটা নিয়ে বলল, “যাক, কয়েকদিনের আড্ডার খরচ উঠল।

এই আমাদের ভবানীপ্রসাদ

***

ভবানীকে নিয়ে আমাদের দাদু অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তখন সময় পেলেই ওখানে যেতাম

ওভারল্যান্ড কাগজে আমাকে জয়েন করতে বলেছিল ভবানী, আমি করিনি। কারণ, আমি তখন ভারতীয় স্টেট ব্যাংকের অফিসার পদে আসীন

রায়গঞ্জে আমার ডাকে সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র শিল্পীদের নিয়েউৎসব সাহিত্য পুরস্কারদেয়া হত—স্বর্ণ এবং রৌপ্য পদক। প্রথম বছরেই ভবানীকে স্বর্ণপদকে সম্মানিত করা হয়েছিল। সে-বার যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা দেবাশীষ বসু, পঙ্কজ সাহা, উৎপলেন্দু চৌধুরী, নিমাই ভট্টাচার্য, মনোজ মিত্র, জ্ঞানেশ মুখার্জি প্রমুখ। প্রতিবছর এই উৎসব হত। ২০ বছর চলার পর সেই উৎসব রায়গঞ্জ বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ভবানী দু-বার আমাদের বইমেলায় এসেছে। আমার বাড়ির সবার সঙ্গে ওর আত্মিক যোগাযোগ চিরকালের। আমার বিয়েতে ভবানী দল বেঁধে গিয়েছিল বেলেঘাটায়। এটা ভবানীর পক্ষেই সম্ভব

***

এই তো বছর কয়েক আগে ওর বাড়ি গিয়ে আড্ডা দিয়ে এসেছি একবেলা। আমি আসছি শুনে ভবানী ওই খোঁড়া পায়েই ওর বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে রিসিভ করেছিল

কত গল্প, কত স্মৃতি মেদুরতা; সেই রায়গঞ্জ কুলিক ফরেস্টের পাখিদের সঙ্গে আমাদের নানান কথাবার্তা, পাখি নিয়ে ভবানীর তাৎক্ষণিক ছড়া লেখা। আমার ছোট্ট দুই মেয়েকে দুই কোলে নিয়ে বনাঞ্চল পরিক্রমা ইত্যাদি

ভবানীর দুটো বই আমি নিজ দায়িত্বে প্রকাশ করেছিলাম। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল বই দুটি

যেদিন খবর পেলাম ওর অঙ্গহানির কথা, সেদিন যে আমি কীভাবে কাটিয়েছি বলতে পারব না

আমি সময় পেলেই ওর কাছে যাই। ছন্দের দোলায় নিজেদের ভাসিয়ে দেই অজানায়

  

<