গল্প - ৩ । ফাল্গুন ১৪৩১


সরস্বত্যৈ নমঃ 

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ



 

অন্তুর মনটা খুব খারাপ, কারণ এবছরে তার সরস্বতীপুজোটাই মাটি। অন্তুর বাড়িতে প্রত্যেকবারই পুজো হয়, এবারে হল না। এক তো তার মায়ের শরীর খারাপ, তার ওপর অফিসের কাজে বাবা বাইরে গেছেন। মাস খানেকের আগে ফিরবেন না। পুজো আর হয় কী করে? 

বিল্টু, পলাশ, নিতাই, সন্তুরা গতকাল বিকেল থেকেই পুজোর যোগাড় করছে। তাদের যে ঘরে পুজো হবে সে ঘর পরিষ্কার করা। রঙীন কাগজের শিকলি বানানো। বাড়ির দরজায় শোলার কদমফুল, দেবদারু আর আমপাতার মালা ঝোলানো। যেখানে মা সরস্বতী বসবেন, তার পিছনে মায়ের লালপাড় বাসন্তী রঙের শাড়ি টানটান করে টাঙানো। ময়দা গুলে আঠা বানানো হয়ে গেছে। ছোট্ট ছোট্ট শোলার ফুল সেই আঠা দিয়ে বাসন্তী শাড়ীর ওপরে সাঁটানো হয়ে গেছে। রাত নটা নাগাদ বাবার সঙ্গে পোটো পাড়ায় গিয়েছিল, মা সরস্বতীর প্রতিমা আনতে। পোটোপাড়ায় তখন খুব ভিড়, ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি। এ শহরের সবাই যেন এসেছে প্রতিমা কিনতে। ছোট বড়ো, নানান ধাঁচের, নানান রঙের প্রতিমা। অনেক খুঁজে মনের মতো প্রতিমা নিয়ে যখন তারা বাড়ি ফিরল, রাত তখন সাড়ে এগারোটা! তার পরেও আছে আলপনা দেবার কাজ।

এবার অন্তুর এসব কিছুই নেই। আজ এই সকাল সাড়ে দশটায় সকলের বাড়িতে পুরোহিতমশাইরা এসে গেছেন। সব বাড়ি থেকেই পুজোর আওয়াজ আসছে। ঘন্টা বাজছে, শাঁখ বাজছে। শোনা যাচ্ছে মন্ত্রপাঠ, “সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে, বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমোস্তুতে”। অঞ্জলি দেওয়ার সময় পাশের বাড়ির বিল্টু ডেকেছিল। বলেছিল, কী রে? আমাদের বাড়ি আয়, অঞ্জলি দিবি না? কাকু নেই কাকিমার শরীর খারাপ, তোদের পুজো হয়নি, তো কী হয়েছে? অঞ্জলি দিবি না? প্রথমে ভেবেছিল, যাবে না, তারপর বিল্টু বার বার বলাতে, অন্তু অঞ্জলি দিয়েছে। অঞ্জলি দেওয়ার পর, বিল্টুর মা যখন প্রসাদ দিলেন, বিল্টু হাতের মুঠিতে প্রসাদ নিয়েই দৌড়ে পালিয়ে এসেছে। তার চোখে তখন জল চলে আসছিল। কাকিমা দেখতে পেয়ে গেলে, নিশ্চয়ই কোলের কাছে টেনে নিয়ে আদর করতেন। সকলের সামনে সে ভারি লজ্জার হতো।

অন্তুদের বাড়ির পিছনেই একটা পুকুর। তার বাঁদিকের পাড়ে বিশাল একটা তেঁতুলগাছ। আর উল্টোদিকে তালগাছের সারি। তারমধ্যে একটা তালগাছ আবার নেড়া! কবে জানি বাজ পড়েছিল, গাছের মাথা জ্বলে গিয়েছিল। তারপর থেকে ওইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে বেচারা। বাবা বলেন, তাঁরাও ছোটবেলা থেকে অমনই দেখে আসছেন। তালগাছের ফাঁকে ফাঁকে যতদূর দেখা যায় মাঠ আর মাঠ। এদিকটা তাই নিরিবিলি, লোকজনের যাওয়া আসা কম। প্রসাদ নিয়ে এসে, বাড়ির পিছনের পাঁচিলে পা ঝুলিয়ে বসল অন্তু। চোখের জল মুছতে মুছতে বিল্টুর মায়ের দেওয়া প্রসাদ খেল, তারপর চুপ করে বসে রইল, দূরের দিকে তাকিয়ে।

কিছুক্ষণ পর তেঁতুলতলার দিক থেকে একজন বুড়ো মানুষকে অন্তু আসতে দেখল। তাঁর কাঁধে মস্ত একটা ঝোলা। মাথা ভর্তি সাদা ধপধপে চুল, কাঁধ অব্দি নেমে এসেছে, আর সেইরকমই সাদা গোঁফদাড়ি। অন্তু তাঁকে চেনে না, এ পাড়ার লোক নয়। অন্য পাড়া থেকে আসছেন হয়তো। অন্তুকে উনি খেয়াল করেননি। অন্তুর সামনেই তালগাছের গুঁড়ি ফেলা ঘাটের পাশে তিনি ঝোলাটা রাখলেন। তারপর পিছল গুঁড়িতে সাবধানে পা ফেলে, জলে নেমে গেলেন। হাঁটু জলে গিয়ে বুড়ো মানুষটা আঁজলা ভরে জল তুলে, মুখে ঘাড়ে জলের ছিটে দিলেন। ভেজা হাত মুখের ওপর বুলিয়ে নিলেন। তারপর জল ছেড়ে উঠে আসতে লাগলেন।

উঠে আসার সময়েই তাঁর সঙ্গে অন্তুর চোখাচোখি হল। পাঁচিলে পা ঝুলিয়ে অন্তুকে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হলেন, তারপর হাসলেন। দু চোখে হাসির ঝিলিক নিয়ে জিগ্যেস করলেন, “এখানে একলা বসে আছো? মা সরস্বতীর পুজো দাওনি আজ? অঞ্জলি দাওনি?”

“অঞ্জলি দিয়েছি, বিল্টুদের বাড়ি। আমাদের এবার পুজো হয়নি, কিনা? মায়ের শরীর খারাপ, বাবাও বাইরে গেছেন”। বুড়ো মানুষটি মুখে চুকচুক শব্দ করে বললেন, “এঃ হে। সেই জন্যে মন খারাপ করে বসে আছ? তা মন খারাপ হওয়ার কথাই তো! কিন্তু মন খারাপ করে বসে থাকলে তো চলবে না, অন্তু? মা সরস্বতীকে বলতে হবে তো, তোমার মনের কথা!”

“আপনি আমার নাম জানেন? কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না”। অন্তু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

“আমি সব জানি। তোমার ডাক নাম অন্তু, ভালো নাম অতীন। সবার নাম না জানলে আমার চলে না যে! বিশেষ করে তোমার মতো যারা ছোট্ট, তাদের নাম তো আমাকে জানতেই হবে। তা নাহলে মা খুব রাগ করবেন যে!”

“তোমারও মা আছেন? তিনি বুঝি খুব বুড়ি?”

বুড়ো মানুষটি খুব সুন্দর হাসলেন, বললেন,  “নেই আবার? মা না থাকলে চলে? আর বুড়ি, নাঃ, আমার মা কোনদিন বুড়ি হন না। এই যে দেখছো এই মস্ত ঝোলাটা! এই ঝোলা মায়ের কাছে যতক্ষণ না নিয়ে যাবো, ততক্ষণ মা অধীর অপেক্ষায় বসে থাকবেন”।

“কী আছে ওই ঝোলায়?”

“সে অনেক কিছু। সে সব কী তুমি বুঝতে পারবে, অন্তুবাবু? তোমাদের মতো ছোট্ট ছেলেমেয়েরা, মায়ের কাছে যা যা চায়, তার সব ফর্দ আছে ওই ঝোলায়!”

“তাই? আমরা কে কী চাই, সে কথা জেনে তোমার মায়ের কী লাভ?”

“তা তো বলতে পারবো না, বাবা! মায়ের আদেশ, আমি পালন করি মাত্র! সক্কলের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সবার খবর আমাকে জানতে হয়। আর মায়ের আবার লাভ কী? মায়েরা কী ব্যবসা করেন, যে তিনি ছেলেমেয়েদের থেকে লাভের আশায় খবর নেবেন? এই যে তুমি এখন এই পাঁচিলে একা একা বসে আছো, তোমার মা তো জানেন না! তিনি জানেন, তুমি বিল্টুদের বাড়ি অঞ্জলি দিয়ে, প্রসাদ নিয়ে, বিল্টুর সঙ্গেই আছো! আমি যখন গিয়ে বলবো, আমাদের অন্তুকে দেখলাম, একা একা বাড়ির পিছনে বসে আছে, পাঁচিলের ওপর। তখন তিনি অসুস্থ শরীরেও দৌড়ে আসবেন, ও অন্তু, ওখানে কী করছিস, একা একা? ঘরে আয়, বাবা! তাতে মায়ের আর কী লাভ বলো?”

“যাঃ, তাই আবার হয় নাকি? আমার মা, তোমার মা কী করে হল?”

“ওই দেখ, তাও জানো না বুঝি? সব মায়ের মধ্যেই তো আমার মা রয়েছেন, যেমন সব ছেলেমেয়ের মধ্যেই রয়েছি আমি”!

“এ আবার কী কথা? তোমার কথাবার্তা কেমন কেমন যেন! তোমাকে তো আমি চিনিই না, কিন্তু তুমি আমার নাম জানলে কী করে? আর তোমার মা আমার মাকে চিনবেনই বা কী করে?”

“তোমার নাম জানা এমন কী কঠিন, অন্তুবাবু? তোমার বইয়ে, খাতায় তোমার নাম লেখনি? বিল্টুদের বাড়ি মা সরস্বতীর পায়ের কাছে, তোমার যে বই খাতা রেখে এলে! সেখানেই তো তোমার নাম পেলাম”।

“তুমি বিল্টুদের বাড়িতেও গিয়েছিলে? সেখান থেকে আমার নাম জেনেছো? কিন্তু তুমি পুজোর সময়, মাকে ছুঁয়েছো কেন? আমার মা বলেন, পুজোর সময় আকাচা কাপড়ে ঠাকুরের গায়ে হাত দিতে নেই”।

“তোমার মা ঠিকই বলেছেন! আমি তো মাকে ছুঁইনি! মা-ই তো আমাকে বললেন, অন্তুটা মন খারাপ করে চলে গেল। অন্যান্যবার কত কিছু বলে, এবার কিছুই বলল না! যা তো দেখ, আমার অন্তু কী বলে?”

“তোমার মা বললেন? কে তোমার মা?”

“বোঝো কাণ্ড। আজকে সব জায়গায় যাঁর পুজো হচ্ছে। আর তোমার ঘরে তাঁর পুজো হচ্ছে না বলে, তোমার মন খারাপ। সেই মা সরস্বতীই তো আমার মা, তাও জানো না বুঝি”?

“মা সরস্বতী তোমার মা?”

“তিনিই তো”।

“সব ছেলেমেয়েদের মনের কথা তোমার ওই ঝোলায় ভরে, তুমি নিয়ে যাচ্ছো, মা সরস্বতীকে দেবে বলে?”

“তাই তো বললাম, বাবা, এতক্ষণ?” বুড়োর চোখের কোলে, গালের ভাঁজে চিকচিকে হাসি।

“আমাদের বাড়িতে তাঁর পুজো হয়নি, আমার মনের কথাও তুমি নিয়ে যাবে, মা সরস্বতীর কাছে!”

“একশবার যাবো, বাবা। ওই তো আমার কাজ, এ ছাড়া আমার আর কাজ কী?”

“কে কী বলল, তোমার ঝোলার মধ্যে কার কী মনের কথা আছে, আমায় বলবে?”

“এই রে! সেটা তো কাউকে বলি না, বাবা! ধরো তোমার মনের কথা আমি যদি সবাইকে বলে বেড়াই, তোমার ভাল লাগবে, বলো?”

“না তা লাগবে না। সে খুব খারাপ হবে। তবে আমি জানি কে কী বলেছে?”

“তুমি জানো? কী করে জানলে, বাবা?  তা দু একটা শুনি!”

“আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়, সে খুব হিংসুটি, জানো তো? সে নিশ্চয়ই বলেছে, সে যেন সবার থেকে অনেক অনেক বেশি নম্বর পায়। তার সব জানা বিষয় থেকেই যেন পরীক্ষার সব প্রশ্ন আসে! অংক পরীক্ষার দিন, অন্য সকলের যেন মাথা গুলিয়ে যায়। তাই না?”

“কে, কিংশুক?”

“ও তুমি কিংশুককেও চেন?”

“সবাইকে চিনি, তোমাকে বললাম না? তবে কিংশুক ওইরকম কিছু বলে না। আর কিংশুক মোটেই হিংসুটে নয়। লেখাপড়া একটু বেশিই করে। অন্য আর কিছু করে না। তোমাদের সঙ্গে খেলে না। লুকিয়ে আম পাড়তে যায় না। পুকুরে খোলামকুচি ছুঁড়ে ব্যাংবাজি করে না। ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ায় না। খাতার তলায় লুকিয়ে গল্পের বই পড়ে না। মানে কোন দুরন্তপনা কিচ্ছু করে না”।

“জানি জানি, তারাই তোমার মায়ের কাছে খুব ভালো ছেলে। আর আমরা? দুষ্টু, অবাধ্য, দুরন্ত”।

“এই দেখ। রাগ করলে নাকি? আরে ধুর পাগল। আমি তাই বললাম বুঝি? মায়েদের কাছে দুরন্ত ছেলেরাই বেশি প্রিয় হয়, সেটা জানো কী? মায়ের সামনে যে ছেলে সারাদিন বই মুখে নিয়ে বসে থাকে, তার মায়ের আর চিন্তা কী? কিন্তু যে ছেলে আমগাছে উঠে আম পাড়ে, তার মায়ের চিন্তা, এই বুঝি ছেলেটা গাছ থেকে পড়ে হাত ভাঙল। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে, এই বুঝি মাঞ্জায় হাত কাটল। যতক্ষণ না ছেলে বাড়ি ফেরে, মা চিন্তায় থাকেন। ছেলেটা কী করছে? কোথায় গেছে, ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন?”

“প্রিয় হয় না, হাতি হয়। মায়েরা তাদের ধরে খুব পেটায়”।

“বাঃ রে, মা রেগে গেলে পেটাবে না? আর তারপর রাগ পরে গেলে? দুধের সরটা। সন্দেশটা। হজমিগুলি কিনে খাবার পয়সাটা। গরম গরম ভাজা পরোটাগুলো। নিজের হাতে গড়া নারকেলের নাড়ুগুলো। মা দেয় না বুঝি”?

“তা দেয়”।

বুড়ো মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কিন্তু আমি আর ওসব পাই না!”

“কেন?”

“আমার এখন অনেক বয়েস হয়ে গেছে, কিনা। তাই দুষ্টুমি করতে পারি না, মাও আর পেটায় না। না পেটালে মার মনে কষ্ট হবে কী করে? আর কষ্ট না পেলে, একটু বেশি আদরই বা করবে কেন?”

“তা ঠিক। তবে বড়ো হবার যে অনেক বেশী মজা?”

“ছাই মজা। কে বলেছে তোমায়, এসব কথা?”

“মজা নয়? বড় হলে, যেখানে খুশি চলে যাও। এই যেমন বাবা গেছেন। অফিসে কাজ করে, এত্তো এত্তো টাকা আনে। আইসক্রিম, ক্রিমবিস্কুট, ফুচকা, পোট্যাটো চিপ্স, যখন যেটা ইচ্ছে, কিনে খেলেই হল। একা একা বাসে চড়ো, ট্রেনে চড়ো। মজা কম? তারপর অফিসে ছুটি থাকলে পায়ের ওপর পা চাপিয়ে, বুক ফুলিয়ে সারা দিন গল্পের বই পড়া যায়! খাতার কিংবা পড়ার বইয়ের তলায় লুকিয়ে পড়তে হয় না। সকাল সন্ধে কেউ বলে না, ওরে বই খোল, পড়তে বস”।

“বললাম না, ছাই মজা। তোমার বাবা বড়ো হয়েছেন, সেটা মানবে তো?”

“সে তো বটেই, বাবারা তো দেখেছি সব সময় বড়োই হন”।

“ঠিক। এই ধরো, আজ মা সরস্বতীর পুজো। তোমার মায়ের শরীর খারাপ। বাড়ির পুজো হল না। তুমি মন খারাপ করে, একা একা এই পাঁচিলে বসে আছো। তিনি বুঝছেন না? কিন্তু এ সব জেনে বুঝেও তিনি অফিসের কাজ ছেড়ে আসতে পারলেন? পারেননি। বিদেশে গিয়ে কী ওঁনারও মন খারাপ হচ্ছে না? পারছেন কী এখানে চলে আসতে?”

“তা ঠিক”।

“তারপর ধরো, তোমার বাবার ইচ্ছে হল, ধুর রোজ রোজ ট্রেন-বাসের ভিড় ঠেলে অফিস যাবো না। পারবেন? শরীর খারাপ হলে, আলাদা কথা। তাতেও দেখবে, সারাদিন ফোন আসছে, কবে আসছেন? কী হয়েছে? কেন এলেন না? হাজার কৈফিয়ৎ। তখন তোমার বাবা বলেন না, এর থেকে অফিস যাওয়ায় অনেক আরাম!”

“তা বলেন”। 

“বলছি তো, বড়ো হওয়াতে কিচ্ছু মজা নেই। যে বলেছে, সে একদম বাজে কথা বলেছে। কিন্তু তুমি কী তাড়াতাড়ি বড়ো হতে চাইছো নাকি?”

“না, না খুব তাড়াতাড়ি চাইছি না, কিন্তু আমাদের ফটিকদার মতো যেন অনেক, অ-নে-ক দিন ছোট হয়ে না থাকতে হয়”।

“ফটিক? যে তিন বছর পরে, সবে ক্লাস এইটে উঠল? ওর কথা না বলাই ভালো। লেখাপড়ায় এতটুকু মন নেই, ওরই মতো যতো বদছেলের দল জুটিয়ে সারাদিন শয়তানি করে বেড়ায়! ওর মতো ছোট হয়ে থাকাটা মোটেই কাজের কথা নয়। সে যাগ্‌গে, তোমার সঙ্গে কথায় কথায় অনেক দেরি হয়ে গেল, এবার কিন্তু মা খোঁজ করবে, কোথায় গেল ছেলেটা! এত দেরি করছে কেন? এই বেলা চটপট বলে দাও তো, তুমি কী চাও মা সরস্বতীর কাছে? তোমারটা পেলেই আমার এবেলার মতো সব কাজ সারা। মায়ের কাছে ঝোলা জমা করে, আমার ছুটি”।

“না মানে, মায়ের কাছে কিছু আদায় করে নেব বলে তো আর পুজো নয়। বছর বছরে দু-তিনদিনের জন্যে মা এলে, বেশ লাগে। লেখাপড়া শিকেয় তুলে, একটু হৈচৈ হুল্লোড়, ভালো মন্দ খাওয়া দাওয়া, এই আর কী! বাড়িতে জেঠু-জেঠিমা, মাসীমা-মেসোমশাই এলে যেমন হয় আর কী?”

“বাঃ, বেশ বলেছো। মা এলেই আনন্দ। তবু কিছুই কী মনে হয় না? যেমন জেঠু একটা ভালো ক্রিকেট ব্যাট দিলে মজা হয়। কিংবা মাসীমা একটা হাতঘড়ি। সেরকম মায়ের থেকেও...”

“এ রাম, আমি বুঝি জেঠুর থেকে কিছু চাই? নাকি মাসীমাকে বলি, আমায় হাতঘড়ি দাও? ভালোবেসে যা দেবেন, ভালই দেবেন”।

“ও বাবা, তুমি তো সরেশ ছেলে দেখছি।

“না, না, তেমন কিছু নয়। মায়ের কাছে কী চাইবো? ফার্স্টবয় কিংবা গুডবয় হতে চাই না, সে খুব হ্যাপা। আবার ফটিকদাও হতে চাই না, সে খুব বদনাম। তবে লেখাপড়াও হল, একটু আধটু খেলাধুলোও হলো, আবার টুকটাক দুষ্টুমিও করলাম। সব মিলেমিশে সে বেশ একটা জমজমাট ব্যাপার যেন হয়”।

 

হঠাৎ কানে এল মায়ের ডাক।

“অন্তু, ও অন্তু। তুই কোথায় রে? আমি বলি তুই বিল্টুদের বাড়ি রয়েছিস। কখন ফিরলি অঞ্জলি দিয়ে?”

“দেখলে, বললাম, মায়ের ডাক আসার সময় হয়ে এসেছে! দেরি হলেই মায়েরা ঠিক টের পান, জানো তো। তুমি এসো আর আমিও আসি”।

বিল্টুও ডাকতে এসেছে। সে জানে মনখারাপ হলে অন্তু কোথায় বসে থাকে। সে দৌড়ে এল বাড়ির পিছনদিকে, বলল, “ঠিক জানি, তুই এখানেই থাকবি। মা ডাকছেন, চ!”

“কোথায়?”

“আমাদের বাড়ি, আবার কোথায়?”

“অঞ্জলি দিলাম তো, এখন আবার কেন?”

“পুজোর ভোগ খাবো একসঙ্গে, চল”।

“না রে, মা একা একা ঘরে থাকবে। আর আমি ভোগ খেতে যাবো?”

“ধ্যাৎ, কাকিমা একলা থাকবেন কেন? মা এসেছেন, কাকিমাকে নিতে। কাকিমা, তুই, ঠাকুমা সবাই যাবি”।

পাঁচিল থেকে নেমে আসতে, অন্তুর একটা হাত ধরল বিল্টু। ঘরের দিকে ফিরতে ফিরতে অন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বুড়ো মানুষটাও কাঁধে ঝোলা নিয়ে রেডি। অন্তু তাকাতে সে হাত তুলল, তার দুই চোখ হাসিতে উজ্জ্বল। অন্তু বিল্টুর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, মা সরস্বতী সবার দিকেই লক্ষ্য রাখেন।