আতাসুল গ্রামের নাম কেউই প্রায় জানে না। সে না জানলেও ক্ষতি নেই। যার গল্প আজ শুনব, তার নাম তকাই।
১১ বছরের তকাইয়ের বাবা ভিন রাজ্যে কাজ করে। বছরে দুবার বাড়ি আসে। কাজের চাপ বেশি থাকলে কোনো কোনো বছর একবারই আসে। সে হল গিয়ে ওই পুজোর সময়। তাও আবার পুজোর শুরুতে নয়। হয় নবমী নয়তো দশমীতে এসে এক সপ্তা থেকেই আবার ফিরে যায়।
তকাই যখন জন্মেছিল, তখন একেবারে মাখা ময়দার মতো নরম ছিল। ওর ঠাকুমা দেখতে গিয়ে বলেছিল, ‘ও আমার নাড়ু গোপাল, আমার তকাই...।’ সেই থেকে তকাই নামটাই থেকে গেছে।
তকাইয়ের মা সেলাইয়ের কাজ করে। শাড়িতে সুন্দর সুন্দর কাঁথা স্টিচের ফোঁড় দেয়। যে ওদের দিয়ে এই কাজ করায়, আগে তার বাড়ির উঠোনে বসেই গ্রামের মহিলারা একসঙ্গে বসে কাজ করত। তকাই জন্মানোর পর ওর মা কাজ বুঝে নিয়ে বাড়িতে চলে আসে। তকাইকে সামলানোও হয় আবার কাজও হয়।
তকাইয়ের ঠাকুমাও অবশ্য অনেকটা সামলায় তকাইকে। তকাই যখন তিন মাসের, ওর ঠাকুমা ভবিষ্যতবাণী করেছিল, ‘আমার তকাই খুব বুদ্ধিমান। বড় হয়ে পরিবারের নাম উজ্জ্বল করবে।’
এক মাস, দু মাস পেরিয়ে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে তকাই। এখন ওর তিন মাস বয়েস। তকাইয়ের ঠাকুমা ওকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াবার সময় বলে, ‘তোমার বাবা, মা অনেক কষ্ট করে। তুমি বড় হয়ে বাবাকে, মাকে দেখো কেমন? আমি তখন থাকব না গো নাড়ুগোপাল।’
ঠাকুমার নাড়ুগোপাল কী বোঝে সেই জানে কেবল মুখ দিয়ে আওয়াজ করে ‘আঙ্গু’। ঠাকুমা উচ্ছ্বসিত! বলে, ‘অ বৌমা, দেখেছ নাড়ুগোপাল কেমন কথা বলছে। এতটুকুন বয়েসে কোনো পোলাপান এমন জবাব দেয় না। ঠাকুর ঠাকুর। আমার সোনাটাকে আগলে রেখো।’ দুহাত জড়ো করে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানায় ঠাকুমা।
তকাইয়ের যখন চার বছর বয়েস তখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। হঠাৎ করেই চলে গেলেন তকাইয়ের ঠাকুমা। তকাই অত কিছু না বুঝলেও ঠাকুমাকে সে আর খুঁজে পাচ্ছে না যে, সেটা খুব বুঝতে পারল। মায়ের চলে যাবার খবর পেয়ে তকাইয়ের বাবা এল সুরাট থেকে। তকাই ওর বাবা আর মাকে প্রশ্ন করে করে অস্থির করে তুলল। প্রশ্নটা হল, ঠাকুমা কোথায়!
তকাইয়ের বাবা ওকে কোলে নিয়ে বাড়ির বাইরে এসে আকাশের একটা তারা দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে তোর ঠাকুমা।’ তকাই অবাক চোখে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ঠাকুমা আকাশে গেল কীভাবে সেটাই ও বুঝতে পারল না।
এর পর পার হয়ে গেল আরও ছ’টা বছর। তকাই দশ বছর পূর্ণ করেছে। দশ বছরের জন্মদিনে তকাইয়ের বাবা এসে ওকে দশটা গাছের চারা কিনে দিয়েছে। বাবার সঙ্গে সঙ্গে থেকে তকাই সেগুলো বাড়ির পাশের জায়গাটাতে পুঁতেছে। পাঁচটা ফলের আর পাঁচটা ফুলের গাছ।
তকাইয়ের বন্ধুরা শুনে অবাক হয়ে গেছে। ফুলের গাছ আবার জন্মদিনের উপহার হয় নাকি? রায়ান বলল, ‘আমাকে বাবা খুব সুন্দর একটা জ্যাকেট দিয়েছে আমাকে।’ শুভম বলল, ‘আমি জন্মদিনে বাবার কাছে ক্রিকেট ব্যাট চাইব।’
এখন ইন্টারনেটের যুগে শহর গ্রাম সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। আগেকার দিনের মতো গ্রামের মানুষ দুনিয়ার আধা খবর জানতে পারে না - সেই দিন চলে গেছে। এখন সবাই সব জানে। অল্প বয়েসী ছেলেমেয়েরা আরও বেশি জানে। তাই তাদের চাহিদাও অন্যরকম হয়ে গেছে, আগের মতো সরল সাধাসিধে নেই। তবে তকাইয়ের ব্যাপারটা আলাদা। ওর বন্ধুদের থেকে ও একটু আলাদা। চাহিদা নেই।
তকাইয়ের বাবা সুরাটে একটা কাপড়ের থান তৈরির কারখানায় কাজ করে। টানা ডিউটিতে খুবই পরিশ্রম হয়। তকাই বাবার খাটুনি দেখতে পায় না কিন্তু মায়েরটা দেখে। কত সূক্ষ্ম নকশা কাঁথা ফোঁড় দিয়ে দিয়ে ভরাট করে মা। দুটো তিনটে ছুঁচে বদলে বদলে সুতো পরিয়ে রঙবেরঙের নক্সা ফুটিয়ে তোলে।
তকাই স্কুলে ফার্স্ট সেকেন্ড না হলেও খুব খারাপ রেজাল্ট করে না। চুপচাপ শান্ত বলে ক্লাসের অনেক ছেলে ওর পেছনে লাগে। চিমটি কাটে, কাতুকুতু দেয়, ব্যাগ লুকিয়ে রাখে। তকাই কিছু বলে না। ওর যারা ভালো বন্ধু, তারাই প্রতিবাদ করে তকাইকে বিরক্ত করলে।
তকাই এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। এই সময়ে একদিন রাজ্য সরকার আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতার নোটিস আসে স্কুলে। ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইট, নাইন আর টেন অংশ নিতে পারবে আলাদা আলাদা বিভাগে। প্রধান শিক্ষক অভিজিৎ নস্কর ক্লাসে ক্লাসে ঘুরে ছেলেদের উৎসাহিত করেন নাম দেবার জন্য। তকাইয়ের বন্ধু বাদল ক্লাসের মনিটর, ও তকাইয়ের নাম দিয়ে দেয়। তকাইয়ের খুব একটা ইচ্ছে ছিল না।
বাদল বলতে তকাই বলল, ‘আমি তো এখনো পুরোপুরি বড় হইনি। এখন কী করে লিখব বাবা মাকে সাহায্য করার কথা?’
বাদল বলল, ‘যা খুশি লেখ না। তোর নাম আমি লিখে দিলাম। ‘তকাই মনে মনে একটু ঘাবড়েই গেল। তারপর এসে গেল সেই দিন। সেদিন টিফিনের পর আর ক্লাস হল না। প্রতিযোগিতায় লেখার জন্য কাগজ দেওয়া হল। ঠাকুমাকে স্মরণ করে তকাই লেখা শুরু করল। শব্দসীমা ৫০০। কম হলে অসুবিধে নেই কিন্তু বেশি হলে এন্ট্রি বাতিল করা হবে।
নিজের নাম, ক্লাস, বয়েস ইত্যাদি যা যা লেখার লিখে তকাই লিখল-
আমি এখনো চাকরি করার মতো বড় হইনি। আমার বাবা সুরাটে কাজ করে। বাবাকে খুব বেশি পাই না। বছরে দুবার বাড়ি আসে বাবা। আমার কষ্ট হয় বাবার জন্য। কিন্তু কাজ তো করতেই হবে তাই বাবা বাইরে থাকে।
আমার মা খুব সুন্দর হাতের কাজ করে। শাড়িতে, চাদরে কাঁথা ফোঁড় দিয়ে নক্সা ফুটিয়ে তোলে। সারাদিন বাড়ির সব কাজ করার পর দুপুর থেকে হাতের কাজ নিয়ে বসে যায়। একটুও বিশ্রাম নেয় না মা। সেলাইয়ের জন্যে অনেক রঙের সুতো কিন্তু ছুঁচ মাত্র তিনটে। মাকে তাই বারবার সুতো বদলে বদলে পরাতে হয়। লাল সুতোর কাজ শেষ করেই একই ছুঁচে আবার সবুজ পরাতে হয়। মায়ের অসুবিধে হয়।
আমি চাকরি করে আগে মাকে যত রঙের সুতো, ততগুলো ছুঁচ কিনে দেব। সব ছুঁচে সুতো পরানো থাকবে। মা একটা রঙের ফোঁড় শেষ করেই আর একটা দিয়ে কাজ শুরু করে দেবে। নতুন করে সুতো পরানোর সময় নষ্ট হবে না।
এরপর আমি বাবাকে বলব সুরাট থেকে চলে আসতে। বাবা এখানেই কোনো কাজ করবে। ঠাকুমা বলত, ‘বসে থাকলে গায়ে জং ধরে যায়। যতদিন শরীর চলে, কাজ করে যেতে হবে।’ তাই বাবাও কোনো একটা কাজ করবে কিন্তু আমাদের সঙ্গেই থাকবে।
ভুলো আমাদের বাড়ির সামনে শুয়ে থাকে। মা বলে, ‘ও আমাদের পাহারাদার।’ চাকরি পাবার পর আমি ভুলোর জন্যে একটা ঘর বানিয়ে দেব। ছবিতে কুকুরদের ঘর দেখেছি, ঠিক ওরকম বানাব। ভুলো আরাম করে থাকবে।
এখনো অবধি এগুলোই ইচ্ছে আছে। পুরোপুরি বড় হয়ে আরও অনেক কিছু করব বাবা মায়ের জন্য।
ক্লাস এইটের আরও একুশটি ছাত্র অংশ নিয়েছিল এই রচনা প্রতিযোগিতায়। তারা কেউ লিখেছে, বড় ইঞ্জনিয়ার হয়ে বাবা মাকে বিশাল ফ্ল্যাট আর গাড়ি কিনে দেব। কেউ লিখেছে, বাবা মাকে বিদেশে বেড়াতে নিয়ে যাব। কিন্তু তকাইয়ের মতো মনের কথাটা কেউ লেখেনি। আর তাই, বিচারকদের খুব পছন্দ হয়েছে ওর লেখা। প্রথম পুরস্কারের জন্য মনোনীত হল তমোঘ্ন মণ্ডল।
পুরস্কারের ৬০০০ টাকার চেক দিয়েছে রাজ্য সরকার থেকে। তকাই অপেক্ষা করছে কবে ওর বাবা আসবে। বাবা এলে ব্যাঙ্কে চেক জমা দেবে আর ও বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে মায়ের জন্য এক ডজন ছুঁচ কিনে আনবে। টাকা যখন পেয়েই গেছে, ইচ্ছেপূরণে বাধা কোথায়!