"মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে..."
হ্যাঁ, ব্যাপারটা ঠিক তেমনই।
জন্মসূত্রে আমি শিবপুর, হাওড়ার
মানুষ হলেও বর্তমানে আমার নিবাস উত্তর চব্বিশ পরগণার মফস্বল শহর খড়দহের রহড়া-য়।
স্বভাবতই তাই হাওড়া জেলার প্রতি আমার আলাদা একধরনের দুর্বলতা মায় আকর্ষণ তো আছে
বটেই ! আর শ্রদ্ধেয় ছন্দরসিক ভবানীদাও হাওড়া জেলারই একজন সম্মানীয় ব্যাক্তিত্ব।
ইদানীং বাংলা সাহিত্য জগতে যতোজন ছড়াকার নিয়মিতভাবে ছড়াচর্চা করে চলেছে/চলেছেন
তাতে প্রথিতযশা ভবানীপ্রসাদ মজুমদার মানুষটির নাম একেবারেই শীর্ষে। কয়েক হাজার
পত্র-পত্রিকায় এবং শিশুপাঠ্যেও তাঁর রচনা সর্বজনবিদিত। ওনাকে নিয়ে বেশ কিছু
স্মৃতির মেঘ হৃদয়ের অসীম আকাশজুড়ে আজও ভেসে চলেছে। আপাদমস্তক ছিপছিপে গড়নের
মানুষটির মন যে সরোবরের মতো এতোটাই বড়ো, উদার তা যে বা যিনি তাঁর সাথে মিশেছে/মিশেছেন, তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছে/পেয়েছেন সে-ই বা তিনি-ই তা উপলব্ধি করেছে/করেছেন।
বহুবছর আগে একবার একটি শিশু-কিশোর উপযোগী পত্রিকা সম্পাদনা করবো বলে ওনাকে ফোন করে
লেখা দিতে অনুরোধ করেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে দিলখোলা হাসি হাসতে হাসতে অবলীলায় তিনি
বলেছিলেন, "যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে
এসো আমার বাড়িতে। হ্যাঁ, লেখাও
নিয়ে যাবে, গল্পগুজবও হবে, দু'মুঠো ডাল-ভাত খেয়েও না হয়
যাবে !" সদাহাস্যময় ভবানীদার সাথে আমার প্রথম আলাপ কিন্তু ল্যান্ডফোনের
মাধ্যমেই। এরপর সময়ের সাথে সাথে যতোদিন গেছে, বিজ্ঞান উন্নত হয়েছে, নৈকট্য
বেড়েছে মোবাইল ফোনের সাহায্যেও। বিভিন্ন প্রান্তের প্রচুর সাহিত্য পত্র-পত্রিকাতেও
আমাদের দু'জনের রচিত ছড়াই একইসাথে
প্রকাশিত হতে দেখেছি। বহু অনুষ্ঠানে ওনাকে উপস্থিত হতে দেখলে মনটা যেন খুব ভালো
হয়ে যেতো আমার। ছড়ার টানে আর অগণিত লেখক-সম্পাদকদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় অনেক
দূর-দূরান্তেও ঠিক উপস্থিত হতেন ভবানীদা। তবে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম যখন কানাঘুষোয়
জানতে পেরেছিলাম, যাদের
তিনি নিজের হাতে করে 'ছড়াকার' হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, সঙ্গে করে বিভিন্ন
অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ-কেউই নাকি চরম অমানবিক হয়ে হঠাৎ করে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিলেন
ওনার সাথে, আড়ালে আবডালে নিন্দেও
করেছেন ভবানীদাকে নিয়ে, আর
নিজেদের সম্রাট প্রতিপন্ন করে গেছেন বারংবার অর্থাৎ নিজেদের ঢাক নিজেরাই পিটিয়ে
গেছেন তারা। আমি সবকিছু বুঝলেও তাদের সেই কীর্তি তাদেরকে কোনোভাবেই বুঝতে দিইনি, বরং তাদের সংসর্গ এড়িয়ে
নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অবশেষে সরেও এসেছি।
বর্ধমান জেলার কালনা একটি নামকরা ও বর্ধিষ্ণু শহর। পুরো নাম অম্বিকা কালনা।
এখানে জাগ্রত অম্বিকা মায়ের মন্দির আছে, শুনেছি, সারাবছর নাকি অসংখ্য
ভক্তের সমাগম ঘটে সেখানে। সেই কালনা শহর থেকে ছোটোদের মনের মতো একটি পত্রিকা
("ছড়াপত্র পরত") নিয়মিত প্রকাশ করতেন শ্রদ্ধেয় হোমিওপ্যাথি ডাক্তারবাবু
শ্রী সমর কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়। তাঁর সাথে আমারও কিন্তু দারুণ সম্পর্ক ছিলো, ঠিক অম্লমধুর যাকে বলে !
সন্দেহ নেই, উনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন
বরাবরই। লেখা ডাকযোগে পাঠাতাম, পত্রিকা
প্রকাশ পেয়ে গেলে সময়মত ঠিক বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছে যেতো "ছড়াপত্র পরত"।
বহুবছর আগেকার একটি ঘটনা হঠাৎ মনে পড়ে গেলো। একবার সেই সমরদার পত্রিকার
সারাদিনব্যাপী একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে আমি আর ভবানীদা এক
ট্রেনেই (শিয়ালদহ-কাটোয়া লোকাল) হাজির হয়েছিলাম কালনায়। হাওড়া থেকে শিয়ালদহ এসে
ট্রেনের যে কম্পার্টমেন্টে ভবানীদা উঠেছিলেন কাকতালীয়ভাবে কীভাবে জানিনা আমিও
বারাকপুর প্ল্যাটফর্ম থেকে সেই বগির সেই কম্পার্টমেন্টেই উঠেছিলাম, উঠেই আবার সেখানে দেখা, তারপর একসঙ্গেই সারাটা পথ
ভ্রমণ। লক্ষ করেছিলাম বিশ্বাসী ভবানীদার সাথে সেইসব অকৃতজ্ঞ চাটুকাররাও স্বার্থের
তাগিদে কেউ কেউ উপস্থিত সেই বগিতেই, যারা আজ তাঁকে চিনতেই পারেননা। চলন্ত ট্রেনের কামরায় দিব্যি তারা সেদিন হাসি
খুশিতে মশগুল, বারবার ভবানীদার টাকায় চা
বা এটা-ওটা খেয়েই চলেছেন। ভাবতে গেলে আজও ভীষণরকম বিস্মিত হই, বুকের কোণে যন্ত্রণাবোধ
হয়। কালনা পৌঁছে যাবার পর স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে একটি চায়ের দোকানে সকলকে নিয়ে
গিয়ে চা-বিস্কুট খাওয়ালেন নাছোড় ভবানীদা। এরপর সারাদিন বেশ হৈ-চৈ করে কাটিয়ে
অনুষ্ঠানশেষে একসঙ্গেই কাটোয়া-শিয়ালদহ লোকাল ট্রেনে বাড়ি ফিরেছিলাম। যতোক্ষণ
একসঙ্গে ট্রেনে ছিলাম ততোক্ষণই দিব্যি আনন্দ, হাসি, মজা আর গল্পগুজবে কেটে
যাচ্ছিলো। বলতে দ্বিধা নেই, আজও
সেসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায় ভীষণই ভাস্বর। এসব ছাড়াও স্মৃতিসাগরে উঁকি মেরে যায়
বর্ধমানের সমুদ্রগড় সংলগ্ন নাদনঘাট অঞ্চলের শাস্ত্রী স্মৃতি সংঘের অনুষ্ঠানের কথা, যেখানকার সর্বময় কর্তা
শ্রী জনার্দন ঘোষ (মন্টুদা) মহাশয়ের আন্তরিক আহবানে হাজির হতাম আমরা, ভীষণ মনে পড়ে অভিজিৎ বেরা
সম্পাদিত "সৃজনী ভারত" পত্রিকার অনুষ্ঠান উপলক্ষে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার
বুড়ুলে হাজির হওয়ার কথা। সেসব দিনগুলি অতীত হয়ে গেলেও ইতিহাস তো ভুলে যাওয়া যায়না।
মহাকালের শাশ্বত নিয়মে আজ আমাদের সকলেই প্রায় পড়ন্তবেলায়, বর্তমানে সেই ছড়াসম্রাট
ভবানীদাও (ভবানীপ্রসাদ মজুমদার) শারীরিকভাবে অত্যন্ত অসুস্থ। অনেকটা দূরে থাকি বলে
তাঁর সাথে হয়তো চাক্ষুষ হয়না, তবু
এর-তার কাছ থেকে নিয়মিত খোঁজখবর পাই। জানি এই পৃথিবীতে কেউই আমরা চিরকাল থাকবোনা।
সকলকেই একদিন ছুটি নিতেই হবে, চলেও
যেতেই হবে। তবুও পরম কৃপাময় ঈশ্বরের কাছে এটুকুই আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করি, উনি (ভবানীদা) যেন আরও
বহুদিন, বহুবছর আমাদের মধ্যে থাকেন
এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন।
ছন্দে থাকেন, ছন্দে
বাঁচেন
ছন্দে জীবন ভরা,
ছন্দে হাসেন, ছন্দে
কাঁদেন
হৃদয় হরণ করা ;
ছন্দে সুরে মিশেই যে গো
গান হয়ে যায় কথা --
প্রাণের প্রণাম জানাই এবং
প্রেমের নীরবতা।