জগদীশ মণ্ডল

                                                                                                                                                                                                                      ছবি - রাহুল মজুমদার

  ছন্দ ছড়ায় গন্ধ ছড়ায়:       ভবানীপ্রসাদ মজুমদার











জগদীশ মণ্ডল





 

যাঁর ছন্দে মন দোলে, হৃদয়ে সুর তোলে, কথায় পাই অভিনব বিন্যাস—লেখা পাঠ করলে অনায়াসে চোখ বন্ধ করে বলা যায় লেখকের নাম। তিনি হলেন বর্তমান শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্রছড়া নিয়ে যাঁর কারবার/ ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।তাঁকে পরিচয় করাতে হয় না, ছন্দেই তাঁর পরিচয়। ছন্দ নিয়ে অনায়াসে খেলতে পারেন অভিনব আঙ্গিকে। নতুন নতুন সৃষ্টি হয়ে ওঠে গবেষণার বিষয়। তাঁর লেখনী বাস্তবের অনবদ্য প্রয়াস। মজায় মোড়া লেখাগুলো শিশু থেকে বুড়ো সবার মন নাড়ায়। তাঁর লেখার বিষয়বস্তুতে কী নেই—ভূত থেকে মনীষী, কবি থেকে বিপ্লবী, বিজ্ঞানী থেকে দার্শনিক। নিপুণ হাতের তুলিতে লেখাগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে। ধনী থেকে কৃষক, কুলি থেকে মজুর—কেউ বাদ পড়ে না

বর্তমানে নতুন ছন্দের যে লেখা পাই সেটি বলা যায় গবেষণার বিষয়। অ-কার মিলের ছন্দ—

ঝড় হয় ভয় হয় ঘরে ফিরে

আরে এ কি? তুই দেখি ভয়ে হলি

 

আবার ই-কার মিলের ছন্দ—

ইচ্ছে করে এক্ষুনি তোর কানটি মুলেই

দি

আ মলো-যা কাঁদিস কেন ছি ছি ছি

ছি

 

এরকম আ-কার, উ-কার, এ-কার, ঐ-কার, ও-কার, ঔ-কার দিয়ে ছন্দের কারুকাজ মন দোলায়

হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলাকে তিনি এঁকেছেন—

কোথায় গেল গুলতি-হাতে বনবাদাড়ে হারিয়ে যাওয়া

পরের গাছে চুরি করেই আম-জাম-কুল-পেয়ারা খাওয়া...

 

সোনার হরিণ ধরতে হবেই তাই সবেতেই অবহেলা

ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে যায় হারিয়ে ছেলেবেলা।

 

মজার লেখায় তিনি যুক্তি দিয়ে মুড়েছেন। যেমন—

সরস্বতী বললে হেসেই দ্যাখ-রে দিদি লক্ষ্মী

মর্ত্যের সব ছেলেমেয়ের আমার পুজোর ঝোঁক কী!

লক্ষ্মী বলেন, আসল কারণ জানেও না কাক পক্ষী

প্রশ্ন ফাঁসের আশায় সবাই পোহায় এতই ঝক্কি!

 

আবার—

শিব বললে, সাবাস নারদ! বুদ্ধি পরিপাটি

ইচ্ছে করে, গায়ে তোমার গুড় মাখিয়ে চাটি!

 

এমন মজার মানুষটির জন্ম হয় হাওড়া জেলার জগাছা থানার দাশনগরের সন্নিকটে দক্ষিণ শানপুর গ্রামে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ এপ্রিল। পিতা নারায়ণ মজুমদার, মাতা নিরুপমা দেবী। তবে তাঁদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে দয়হাটা গ্রামে। ঠাকুরমার কাছে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প তাঁকে পড়াশোনায় আকৃষ্ট করে। পড়াশোনা শুরু হয় ঠাকুরমার কোলে চেপে। ঠাকুমা ভরতি করে দেন দক্ষিণ শানপুর পরান স্মৃতি নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে। শান্ত স্বভাবের ভবানীবাবু পড়াশুনায় বরাবরই ভালো ছিলেন। স্কুলে পড়াশোনার পরিবেশ তাঁকে ছোটোদের লেখার প্রতি আকৃষ্ট করে। স্কুলে বই পাঠের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে খবর তৈরি করা এবং খবর পাঠ। এছাড়া সাফারি, কাতাই (সুতো কাটা), বাগান তৈরি

পুরোনোআবোল তাবোলবইয়ের লেখা পড়ে তিনি ছড়া লেখার প্রতি মনোযোগী হন। ওই বইয়ের বিভিন্ন লেখায় ছন্দের দোলা তাঁকে লিখতে অনুপ্রেরণা জোগায়। তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় কলকাতার দৈনিক বসুমতীতে, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে, ডাকঘর বিভাগে। পরিচালক ছিলেন ডাক হরকরা। তখন তাঁর বয়স ১২ বছর। তারপর আর লেখা প্রকাশের জন্য চিন্তা করতে হয়নি। লিখেছেন বহু পত্রপত্রিকায়। বাংলা ছাড়িয়ে বর্হিবঙ্গে এবং দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার পেশায় শিক্ষক। শানপুর কালীতলা বিদ্যামন্দির স্কুলে দীর্ঘদিন ধরে তিনি প্রধান শিক্ষকতা করেছেন। ছেলেদের পড়াতে পড়াতে ছন্দের তালিম দিতেন। মজার মজার ছড়ায় ভরিয়ে দিতেন ছাত্রদের। তাঁর প্রকাশিত ছড়া সংখ্যা ১৫০০০ অতিক্রম করেছে। ছড়ার উপরে তার ৪০টির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। সিডি প্রকাশিত হয়েছে ৭টি। উল্লেখযোগ্য ছড়া গ্রন্থ হল, ‘সোনালী ছড়া’, ‘রুপোলী ছড়া’, ‘মজার ছড়াকলকাতাকে নিয়ে লেখাকোলকাতা তোর খোল খাতাহাওড়া জেলাকে নিয়ে ছন্দে ছন্দে বেঁধেছেন তাঁর লেখনীহাওড়া ভরা হরেক ছড়ামাছকে যে নিপুণ তুলিতে ছড়ায় গাঁথা যায় সেটি বোঝা যায় তাঁর লেখামিঠেকড়া মাছের ছড়াবইটিতে। পাখিকে উড়িয়েছেন তাঁরমিঠেকড়া পাখির ছড়াবইতে। পশুও বাদ যায়নি। তাঁর লেখা আস্ত একটি বই উপহার দিয়েছেন—মিঠেকড়া পশুর ছড়াভূত নিয়ে তাঁর লেখাগুলো ছোটোদের ভয় না ধরিয়ে বুদ্ধির সোপান তৈরি করে। এ বিষয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থমিঠেকড়া ভূতের ছড়াছোটোদের নানাধরনের খেলা নিয়ে লিখেছেনমিঠেকড়া খেলার ছড়াএছাড়া রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকুমার, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে লিখেছেনছন্দে গড়া মহান যাঁরা’, ‘রবীন্দ্রনাথ নইলে অনাথ’, ‘নাও ফুল নজরুল’, ‘নাম তাঁর সুকুমার’, ‘ছড়ায় ছড়ায় সত্যজিৎইত্যাদি গ্ৰন্থ

সত্যিকারের মজা ছড়ায় যে বই—হাসতে হাসতে ভাসতে ভাসতেবৃষ্টির নূপুর বাজার শব্দ পাই তাঁরটাপুর টুপুর ছড়ার নুপুরবইটিতে। ভৌগোলিক চিন্তা-চেতনার বিকাশে শিশুদের আকাশ, চাঁদ, তারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়আকাশ ভরা গ্রহ তারাবইটি। ভাষা আন্দোলনের উপর তাঁর নির্ভরযোগ্য একটা ছড়ার বইরক্তে রাঙা একুশেসমাজের বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করায়যাদের বলে সমাজ চলেবইটি

শিশুদের নিয়ে তাঁর ভাবনা—

শিশুদের মুখে তাই নেই আজ হাসি

বুকে নেই উল্লাস নেই আলো আশা,

শিশুদের দিতে হবে খুশি রাশি রাশি

দুনিয়া উজাড় করে প্রীতি ভালবাসা।

 

সাহিত্য সাধনা এবং সাহিত্যে মৌলিকতা সৃষ্টির জন্য তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেসুকুমার রায় শতবার্ষিকী পুরস্কার’-টি। তাঁর কথায়, এটি সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ রায় নিজ হাতে তাঁকে তুলে দিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায় অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু নিজের হাতে করে পুরস্কার দেননি কাউকে। পিতার নামাঙ্কিত পুরস্কার স্বর্ণপদক ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ২ এপ্রিল তুলে দেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের হাতে

তিনি শতাধিক পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, সুকান্ত পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি ছড়া সাহিত্য পুরস্কার, শিশু সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্যিক সংসদ পুরস্কার, নিখিল ভারত শিশু সাহিত্য সম্মেলন পুরস্কার, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান পত্রিকার শৈব্যা পুরস্কার, উৎসব স্বর্ণপদক, ধূমকেতু স্বর্ণপদক, যোগীন্দ্রনাথ সরকার স্মৃতি পুরস্কার, হরেন ঘটক স্মৃতি পুরস্কার, লোকসংস্কৃতি পরিষদ পুরস্কার, মল্লভূম পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ শিল্পী সংসদ পুরস্কার, নেতাজি যুব পুরস্কার, চিকিৎসা চিন্তা পুরস্কার, নবীন ক্রীড়া সংসদ রজতজয়ন্তী বর্ষ পুরস্কার প্রভৃতি

তিনি যে শুধু ছড়া শিল্পী তা নয়। স্বরচিত কবিতা পাঠে তাঁর দরদী কণ্ঠ যখন উন্মুক্ত হয় তখন শ্রোতারা অবাক হয়ে শোনেন। তাঁর ছড়া-কবিতা পাঠ যাঁরা শুনেছেন, তাঁরাই মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর বলার ভঙ্গিমাও আলাদা। ফলে মানুষ সহজেই আকৃষ্ট হন তাঁর কথাশৈলীতে। তিনি যে কবিতাটি অনেক সাহিত্য অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের অনুরোধে আবৃত্তি করেন তা হল—

খুব ভোরে গাছে চড়ে ও-পাড়ার রাম

চুরি করে ঝুড়ি ভরে পাড়ছিল আম!

সাড়া পেয়ে, এল ধেয়ে লাঠি হাতে মালি

বলে: পাজি, পুরো গাছই করে দিলি খালি!

আয় নেমে, বড় হয়ে হবি চোর পাকা

চল দেখি, কী বলেন তোর বাবা-কাকা?

রাম বলে, কোথা যাবে? তুমি হাঁদা-হাবা

ওই দ্যাখো, মগডালে বসে কাকা-বাবা!

 

আর একটি বহুল প্রচারিতঐতিহাসিক জলসাছড়াটি হল—

তিন-দিন তিন-রাত গালে ঠেসে পান

গান জোর গেয়েছিল চেঙ্গিস খান!

তাক ধিন ধিন তাক তেরে কেটে ধিন

তবলাতে কে ছিলেন আলাউদ্দীন!

 

তিনি ছড়া-কবিতায় অলংকার ব্যবহারে দক্ষ মানুষ। অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ, সমাসোক্তি প্রভৃতি অলংকারে সমৃদ্ধ থাকে তাঁর রচনা কৌশল। যেমন—

কেউ বলে ছ্যাঁচড়া, কেউ বলে ছেঁচকি

মুড়ো-টুড়ো দিলে খেতে পারি পাঁচ ডেচকি।

 

এ তো গেল সাহিত্যের টুকিটাকি। এবারে বলি, মানুষ হিসাবে ভবানীবাবু খুব সাদাসিধে ও সদালাপী। বন্ধুপ্রিয়, সুসাথী, পরোপকারী এবং আত্মভোলা। তিনি দুই কন্যার জনক। বড়ো মেয়ের নাম মধুমিতা এবং ছোটো মেয়ে মনোমিতা মজুমদার। স্ত্রী পদ্মা মজুমদার

আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় দীর্ঘদিনের নয়, তবু তাঁর বাড়িতে গেছি কয়েকবার। আমার লেখাভূতগুলো সব জ্যান্তগ্ৰন্থে তাঁর একান্ত আগ্ৰহে ভূমিকা লেখার জন্য হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। সেই সূত্রে তাঁর এবং তাঁর গৃহিণী বউদির অমায়িক ব্যবহার সম্পর্কে বলতে ইচ্ছে করে। বাড়িতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মধ্যে বসে থাকেন আর ছড়া ভাবেন বার বার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। সামনে, পেছনে, ডাইনে, বামে, মাথার উপর শোভা পায় অজস্র বই আর পুরস্কারের সুদৃশ্য সম্ভার। প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে বসে সাহিত্য আড্ডা। দাশনগর নবীন ক্রীড়া সংসদে তাঁর পরিচালনায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে সাহিত্য বৈঠক এবং মাসিক পত্রিকা প্রকাশ। এখান থেকে সাহিত্যে আলো ছড়িয়েছেন অনেক সাহিত্যিক। নবীন প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে এখান থেকে। গল্প করতে, আড্ডা জমাতে ভালোবাসেন তিনি। নবীন লেখকদের উৎসাহদাতা হিসাবে তাঁর নামটি প্রথমে থাকে। তথাকথিত পণ্ডিত লেখকরা নবীন লেখকদের লেখা দেখে নাক সিটকান, কিন্তু তিনি থাকেন তা থেকে শত যোজন দূরে। বলেন, পত্রপত্রিকায় নবীনরা ভালো লিখছেন। কীভাবে কোথায় লিখতে হবে তার খোঁজ দেন। লেখা লিখিয়ে নিয়ে নিজেই পাঠিয়ে দেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। লেখা ছাপা হলে ফোন করে সংবাদ জানান। এমন বন্ধুর খোঁজ মেলা ভার

কথায় বলে, লেখকের লেখা বাড়ে যখন গৃহিণী ছাড়ে। এদিক দিয়ে ভবানীবাবু সফল। সাহিত্য সাধনায় বউদির অবদানের কথা তিনি স্বীকার করেন বার বার। কেউ গেলে এক কাপ চা না খাইয়ে ছাড়েন না

ভবানীদা হলেন গল্পপ্রিয় মানুষ, তাই আত্মভোলা। একবার বউদি বাঁধাকপির তরকারি উনানে বসিয়ে বলে গেলেন, “আমি একটু দোকানে যাচ্ছি, তুমি হয়ে গেলে নামিয়ে নিও।

আমি তখন নিজেও উপস্থিত তাঁর বাড়িতে। বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ বউদি, আমি আছি, লক্ষ রাখব।

কিন্তু লক্ষ যখন গেল তখন তরকারি পুড়ে বিকট গন্ধ ছাড়ছে। আমি তাড়াতাড়ি গ্যাসের নব বন্ধ করলাম

বউদি এসে বললেন, “যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই।

আমি অবশ্য তাড়াতাড়ি বললাম, “বউদি, আমারই দোষ। আমি গল্প না জমালে এ-কাণ্ড ঘটত না।

তখন বউদি ব্যাপারটা সহজ করে বললেন, “এমন ঘটনা মাঝে-মধ্যেই ঘটে।

যে জন্য এ-কথা বলা তা হল, পারিবারিক সুস্থতার জন্য ভবানীদা সাহিত্যের তরী নিয়ে এতদূর এগিয়ে চলেছেন। এ-তরীতে আরও নতুন সওদা পাওয়ার আশায় আছি। তাই বলতে হয়—

ছড়া লেখায় ছড়া গড়ায়

দেখান নতুন জাদু,

ভবানীদার ছড়া আসল

মুচমুচে সুস্বাদু।

<