গল্প - ৪ | শ্রাবণ ১৪৩১

  ভূতের গল্প











শ্যামলশুভা ভঞ্জ পণ্ডিত 

হাওড়াপশ্চিম বঙ্গ








এই গল্পের      >
মুদ্রিত সংখ্যাটি
রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

"আমি এ বছর আর ভূতের গল্প লিখতে পারব না, সে আপনাকে জানিয়ে দিলাম।"-সমীর বাবু বললেন। ফোনে গলাটা কেমন যেন ধরা, সর্দি বসা লাগল।

অবনী বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- "পারবেন না মানে, কেন কি হল, শরীর খারাপ নাকি?"

"না,  ওসব বোগাস গল্প লেখা আমার দ্বারা আর হবে না।"

"বোগাস মানে কি মশাই, আজ দশ বছর ধরে আপনি প্রতি বছর আমাদের এই পত্রিকায় ভূতের গল্পই তো লিখছেন, ছেলে বুড়োরা সে সব গল্প গোগ্রাসে গিলছে। আর  আজ বলছেন লিখবেন না।" ভূতলোক পত্রিকার সম্পাদক অবনী মোহন চাটুজ্জে একটু অধৈর্য হয়ে ওঠেন। পুজো বার্ষিকীর প্রায় সব লেখাই এসে গেছে,  কেবল সমীর বাবুরটি ছাড়া। অথচ সমীর বাবুর এই লেখাটি তাদের পুজোবার্ষিকীর স্টার আইটেম। কত মেল, কত ফোন যে আসে কেবল একথা জানতে এবার সমীর বটব্যালের ভূতের গল্প থাকবে তো! সমীর বাবুর গল্প মানেই পুজোবার্ষিকী নিমেষে শেষ। আর সেই সমীর বটব্যাল এত  রাতে  ফোন করে বলছেন তিনি এ বছর আর লিখবেন না। অমিয় বাবুর তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়।

"কেন লিখবেন না দাদা!"

সমীর বাবু বিনয়ী গলায় বললেন- "না দাদা, কি জানি মনে হচ্ছে, সারাটা জীবন ভুল ভাল লিখেই কাটালাম, এখন আফশোস হচ্ছে।"

অবনী বাবুও নাছোড়বান্দা-" আফশোস কেন মশাই, আপনার লেখা পড়তে সবাই এত ভালোবাসে আর আপনি বলছেন ভুলভাল।"

সমীর বটব্যাল বললেন- "ভদ্রলোকের একই কথা দাদা। ভূতের গল্প আমি আর লিখব না। লিখব না বলছি যখন সেকথার নড়চড় হবেনা।"

অবনী বাবু এবার রেগে ওঠেন "লিখবেন না মানে কি, লিখবেন, আলবাত লিখবেন। আমার এই পত্রিকায় লেখার জন্য কত লোক লাইন দিয়ে থাকে আর আপনি বলছেন লিখবেন না,  মজা পেয়েছেন নাকি!" ফোনটা খুঁট করে কেটে গেল। অবনী বাবু খাটের পাশে থাকা বেডল্যাম্পটা অন করে দেখলেন রাত বারোটা দশ। আশ্চর্য! পাগল নাকি ভদ্রলোক! রাত বারোটা দশে ফোন করে কোন সুস্থ লোক বলে আমি আর লেখা দেব না!।আসলে অবনী মোহন চাটুজ্জে ভূতলোক নামে একটি অতি জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক। তার কারবারটাই ভূত দিয়ে। রোগা, মোটা, লম্বা সব রকম ভূত আর তাদের নিয়ে বড়, মেজো, ছোট গল্প ছড়া ইত্যাদি জমা করে তার পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। বেশ নামকরা পত্রিকা। মন্দার বাজারে বিক্রি বাটাও মন্দ নয়। তা সমীর বটব্যাল তার সেই ভূতলোক পত্রিকার নামজাদা লেখক। ভূতের গল্প লেখায় সমীর বাবুর জুড়ি মেলা ভার। অত্যন্ত প্রচার বিমুখ, নির্বিবাদী, অকৃতদার মানুষ এই সমীর বটব্যাল। নামি দামি লেখকদের মতো অহংকার নেই, দাবি দাওয়া বিশেষ নেই। মুক্তোর মত  হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি যত্ন করে প্রত্যেকবার সম্পাদকের অফিসে পৌছে দিয়ে যান। টাকা পয়সা দিতে দেরী হলেও কোন বিরক্তি নেই, শখ বলতে খেতে ভালোবাসেন এই যা! দফতরে আসার আগে একটি ফোন করে বলেন দাদা "অমুক দিনে আসছি কিন্তু", এ এক ধরনের সংকেত। গরম গরম হিংএর কচুরি, মুচমুচে ফিস ফ্রাই, রসালো জিলিপি এনে রাখতে হবে এই আর কি। ব্যস সমীর বাবু বেজায় খুশী। প্রাণখোলা হাসি হেসে বলবেন- "বুঝলেন কি না, লোকে বাঁচার জন্য খায় আর আমি খাওয়ার জন্য বাঁচি। এই দুনিয়ায় কত সুস্বাদু সব খাবার,   মুখ দিয়ে নয় মশাই মন দিয়ে খেতে হয় । অবনী বাবু উঠে বসলেন জানালার বাইরে চারিদিক নিস্তব্ধ,  নিঝ্ঝুম। চাঁদের আবছা আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে তার বেডসাইডের টেবিলটা। মোবাইলটা টেবিলে রাখা, হাতে নিয়ে দেখলেন ফোনটা সুইচ অফ করা। আশ্চর্য! তবে কি তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন এতক্ষণ,  স্বপ্ন কি এত নিখুঁত হয়! কে জানে কদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তার, পুজো যত এগিয়ে আসে সম্পাদকের চিন্তা তত বাড়ে। সত্যি তো সমীর বাবুর চিরটাকাল ভীষণ সময়জ্ঞান। অন্য সবাইকে তাগাদা দিতে হলেও উনি সময় থাকতেই লেখা দিয়ে দেন। আর  কি সব লেখা! নিশিরাতের নিশাচর, অন্ধরাতের স্কন্ধকাটা, হানাবাড়ির হাহাকার, চাঁদপুরের রক্তচোষা এইরকম অসংখ্য গল্প এক এক করে তার পত্রিকায় ঠাঁই পেয়েছে। কি হল তবে, এ বছর বর্ষার মেঘ কলকাতা অব্দি পৌছে গেল অথচ সমীর বাবুর লেখা তাঁদের দফতরে পৌছল না। না, কাল একবার খোঁজ নিতেই হচ্ছে ভদ্রলোকের। কেবল ফোন করলে চলবে না। কাল বিকেলে ওর বাড়ি যাবেন তিনি।

পরদিন সারাটা দিন অবনী বাবুর অসম্ভব ব্যস্ততায় কাটল। মাথা তোলার সময় ছিল না। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে ড্রাইভারকে বললেন "বাগবাজার চলো"। মাঝে রাস্তার অবশ্য একবার দাঁড়াতে হয়েছিল- সে কাগজের বাক্সে ইয়া বড় বড় রসে টইটম্বুর রসকদম্ব আর গরম গরম পুর ঠাসা সিঙাড়া কিনবার জন্য। সমীর বাবুর পেল্লায় পৈত্রিক বাড়িটা একটু নিরিবিলি এলাকায়। পুরোনো বনেদি পাড়া। বড় বড় দোতলা বাড়ি, গলির একদম শেষমাথায় সমীর বটব্যালের বাড়ি। বাড়ির সামনের জমিতে গাছপালা যেন গোটা বাড়িটাকে ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে। অবনী বাবু বাইরের লোহার দরজাটা ঠেলে বাগানে ঢুকতেই অন্ধকার যেন ঝাঁপিয়ে এল চোখে, আম জাম নিম গাছের ঘন ছায়া স্ট্রিট লাইটের হলুদ আলো আটকে রেখেছে গেটের বাইরে । মনে মনে ভাবলেন 'বাব্বা বাগানটির কি দশা! চারিদিকে আগাছা,  সাপখোপ থাকলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। 'এই বাড়িটাতে তিনি এর আগে সাকুল্যে একবার এসেছেন। সেবার সমীর বাবুর শরীর বেজায় খারাপ হয়েছিল, একমাস খোঁজ নেই। তারপর এই আসা। যতদূর জানেন ওর আত্মীয় বলতে বিশেষ কেউ নেই। এক ভাইপো অনন্ত আর রাঁধুনি কাম অল ইন ওয়ান নিতাই। নিতাইএর রান্নার হাত বড় হোটেলের শেফদেরও হার মানাবে। বাগান পেরিয়ে মূল বাড়ির বড় কাঠের দরজায় হাত দিতেই দরজাটা খুলে গেল। দরজাটা ভেজানো ছিল। ভেতরের বৈঠকখানা ঘরটিতে হালকা একটা নীল রঙের বাল্ব জ্বলছে। বিশাল বড় ঘরটাতে যেন আলো অন্ধকারের লুকোচুরি চলছে। এর আগের বার সকালে এসে মনে পড়ে এই ঘরটাতে অবনী বাবু বসে নিতাইএর হাতের গরম ফুলকো লুচি আলুর চচ্চড়ি আর বোঁটা সহ বেগুন ভাজা খেয়েছিলেন। শেষপাতে ছিল এলাচের গন্ধ ভরা ঘন দুধের পায়েস। এবার কি কপালে আছে কে জানে! একটু চোখ সয়ে এলেই অবনী বাবু দেখলেন ঘরটা একই আছে। বসার বিশাল আরামকেদারা, কাঠের ভারি টেবিল,  কাঠের গোটা তিনেক চেয়ার। টেবিলে মিষ্টি সিঙাড়ার প্যাকেটদুটো রাখতেই মিহি চেনা গলা ভেসে এল "এসব আনলেন যে কেন!" অবনী বাবু চমকে ফিরে দেখলেন আওয়াজটা আসছে আরামকেদারার থেকে। আরামকেদারাটা ঘরের এককোণে আবছা আলো আঁধারিতে পেছন ফিরিয়ে রাখা। মনে হচ্ছে ওখানেই বসে আছেন ভদ্রলোক। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও গলাটা সমীর বাবুরই।

"না মানে আপনার শরীর কি খুব খারাপ?"

"ধুস, ওসব পাট আমার নেই মশাই, তবে বড় কান্না পাচ্ছে, কাঁদতে পারছি না।"

"সে কি কেন!" মনে মনে ভাবলেন মাথাটা বিগড়োল নাকি, অবশ্য লেখকরা কল্পনা প্রবণ হন এমনিতেই।

সমীর বাবু একটু ফোত করলেন "দেখুন না অনন্ত দিন কুড়ি জাঁকিয়ে বসে আছে, কদিন ঠিক ছিল দিন চার পাঁচেক অনাসৃষ্টি শুরু করছে।"

"কি করছে?"

"বিরিয়ানি,  মাংসের চপ,  ফিস ফ্রাই, কচুরি, আলুর দম, এলাচ দেওয়া কালোজাম, খাস্তা গজা, কবিরাজী কি না খাচ্ছে। আর আমি কিচ্ছু খেতে পারছিনা। আরে তোর নিজের কাকা যে খেতে পারছে না সে খেয়াল আছে! সব স্বার্থপর"

খাবারগুলোর নাম শুনে অবনীবাবুরই জিভে জল আসছিল, সেখানে সমীরবাবুর মত লোভী মানুষকে এসব খাবার না দিয়ে দেখিয়ে খেলে তো দুঃখ হবেই। অবনীবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন- "আচ্ছা নিতাইকে তো দেখছি না, সে রান্না করেনা এখন!"

"আর বলবেন না মশাই, পরশু দুপুরে নিতাইকে গিয়ে কানে কানে বলেছি 'এই যে নিতাই, আমাকে বাদ দিয়ে অমন সুন্দর বিউলির ডাল, আলু পোস্ত আর চুনো মাছের বেসন বড়া খাচ্ছিস চালতার টক দিয়ে, লজ্জা করছে না! অনন্তটা না হয় চিরকালের বেয়াদব, বংশের কলঙ্ক। তুই তো তেমন নোস! শুনে সেকি কাণ্ড!' লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কান্না কাঁটি করে বিকেলে অনন্তকে বলল "আমার পয়সা মিটিয়ে দিন বাবু, আমি আর থাকবুনি।" 'কি এমন বলেছি। আহা! মৌরি বাটা দিয়ে বিউলির ডাল ভাবুন তো মশাই'

অবনীবাবুর হাসি পেয়ে গেল। হাসি চেপে বললেন "আচ্ছা, আপনি ভূতের গল্পটা লিখে আমাদের অফিসে একদিন চলুন আমি আপনাকে সব কটা আইটেম খাওয়াব।"

"সে আপনার সাধ্যে নেই মশাই। কাল রাত্তিরে তো আপনাকে বললাম যে আমি আর মিথ্যে কথা লিখব না। কি সব গাঁজাখুরি গল্প। ভূতেরা নাকি রক্ত চুষে খায়, মাথা চিবোয়। বোগাস! আরে যারা রসগোল্লার রস চুষে খেতে পারেনা, মাছের মুড়ো চিবুতে পারেনা তারা খাবে মানুষের মাথা! মিনিংলেস"

অবনীবাবু কি উত্তর দেবেন বুঝতে পারছিলেন না, ভদ্রলোকের মাথাটা সত্যি গেছে। না হলে চা দূরে থাক, একবার বসতে অব্দি বললেন না এখনও।

গলাটা এবার খাঁকরিয়ে বললেন "চলি তাহলে পারলে একবার অফিসে যাবেন লেখা নিয়ে।"

সমীর বটব্যাল একটু হাসলেন যেন- "শুনুন যাওয়ার আগে মালাটা একটু বদলে দিয়ে যান তো, অনন্তটা এত অসভ্য বাসি মালাটা বদলে দিয়ে গেল না"

"কই"

"ওই তো সামনের দেওয়ালে দেখুন"

অবনী বাবু হালকা নীলচে আলোয় সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সামনের দেওয়ালটা জুড়ে বড় ফটোফ্রেম,  হাসি মুখে সমীর বটব্যাল। নীচে লেখা স্বর্গীয় সমীর বটব্যাল। জন্ম-১৯৬৭, মৃত্যু-২০২০ আর পড়তে পারলেন না অবনী বাবু। কোনক্রমে জুতোটা গলিয়ে ছুট লাগালেন বাইরের গেটের দিকে। পেছনে তখন সমীর বাবু অথবা তার ভূত মিহি গলায় চেঁচাচ্ছে-"ও দাদা, কেন পালাচ্ছেন। ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। কেন যে বোঝেন না, অনন্তটাও আজ বিকেলে দৌড় লাগাল দরজাটা অব্দি লাগিয়ে গেল না, আরে মশাই,  মিষ্টি সিঙাড়াগুলো নিয়ে যান পচে যাবে যে" আর কে শোনে কার কথা! বাইরের লোহার গেট ঠেলে অবনী চাটুজ্জে সোজা গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে বললেন "গাড়ি চালাও"। ওফ! আর যাই হোক ভূতের গল্পের শখ অবনীবাবুর চিরকালের মতো ঘুচে গেছে।