ভ্রমনভিত্তিক ধারাবাহিক কাহিনি | ফাল্গুন ১৪৩১

 যেখানে আকাশ নামে











অসিত কর্মকার 

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ 



 

মিহিরকিরণ রায় তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘তোমাদের নিখিলেশস্যারের বাড়ি এবার আমরা যাচ্ছিই, বুঝলে পিকলু! সামনে পঁচিশে ডিসেম্বর। সোমবার পড়েছে। শনিবার হাফ স্কুল। বিকেল বিকেল নিখিলেশবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লে রাত আটটা নাগাদ নাকি দিব্যি পৌঁছে যেতে পারব। তোমার মাকে নিয়ে যেতে চাইলেও উপায় নেই, তোমার ঠাম্মি আর দাদানকে তাহলে কে দেখবে। যদিও ওরা এখন অনেকটাই সুস্থ। কিন্তু তোমার তিন প্রাণের বন্ধু ঝিকি-মিকি-আলো-রই বা দেখভাল কী করে হবে।‘

 শুনে খুব আনন্দ হলেও মনটা একটু খারাপও লাগছে পিকলুর। মাকে ছাড়া সে কোথাও মোটেও ভাল কাটায় না। ঝিকি-মিকি-আলো-কেও ছেড়ে থাকতে হবে। ওরা পিকলুর প্রাণের প্রিয় তিনটি কুকুর

পিকলুর মা ইরাবতি বললেন, ‘আমিও যাব তবে এখন নয়, সামনের পুজোর ছুটিতে, তিনজনে মিলে কোথাও যাওয়া যাবে। তখন তোমার ঠাম্মি আর দাদান এলাহাবাদে তোমার রাঙাপিসির বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছেন। তোমার পলাশকাকুর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, ওই ক’দিনের জন্য ঝিকি-মিকি-আলো-কে পলাশ ওদের নিজের বাড়িতে নিয়ে রাখবে। পলাশকে ওরা খুব ভাল চেনে, পলাশও ওদের খুব ভালবাসে, ফলে ওর কাছে ওরা থাকবেও ভাল। আমাদেরও নিশ্চিন্তি।’

পিকলুর ভাল নাম আকাশকিরণ। পিকলুর বাবা মিহিরকিরণ পিকলুর স্কুল, ‘জগত্তারিণী মিত্র মেমোরিয়াল হাই স্কুল’-এর অংকের শিক্ষক। ওই স্কুলেরই  ইংরেজির শিক্ষক হলেন নিখিলেশ মজুমদার। তিনি সুন্দরবন সংলগ্ন গোসবা ব্লকের রাঙাবেলিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তিন বছর হয় পিকলুদের স্কুলে জয়েন করেছেন। এরই মধ্যে তার শিক্ষকতার সুনাম এবং নানা গুণাবলির কথা পিকলুদের এই ছোট্ট শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি মিষ্টভাষী, ছাত্রদরদী, নানারকম সমাজসেবামূলক কাজেও  উৎসাহী। ফুটবল খেলাতেও ওস্তাদ। বলেন, ‘গ্রামের গরীব ঘরের ছেলে আমি। দশে মিলে একটা বল কিনতে পারলেই খেলার আসল সরঞ্জামের সমস্যা মিটে যেত। আর গ্রামে মাঠের তো অভাব নেই। ধানমাঠেও কত খেলেছি।’

সুন্দরবন এবং ওখানকার জনজীবনের কত কাহিনি আর নিজের জীবনের আরও কত কথা সহজ-সরল ভাষায় কী সুন্দর করে বলেন নিখিলেশস্যার। শুনে পিকলুরা মুগ্ধ হয়

পিকলু দিন গুনছে নিখিলেশস্যারের ওই গ্রাম, ওই জনজীবন চাক্ষুস করার জন্য।  নিখিলেশস্যার একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় করানোর কথা বলেছেন। কিন্তু সেই মানুষটি যে কে এবং কেন তার সঙ্গে পরিচয় করাবেন তা ভেঙ্গে বলেননি।এমনকী তার বাবাকেও নয়। ফলে দু’জনেই বেশ রহস্যে জারিত হয়ে আছেন। বেজায় কৌতূহল, ‘মানুষটি কে? বিখ্যাত কেউ? কেন বিখ্যাত?’

মিহিরকিরণস্যারের সঙ্গে নিখিলেশস্যারের বড় ভাব-ভালবাসা এবং শ্রদ্ধার সম্পর্ক। স্কুলে জয়েন করার পরে প্রথম কয়েক মাস গ্রাম থেকেই যাতায়াত করতেন নিখিলেশস্যার। ভীষণই কষ্টকর ছিল তা। বিশেষ করে ঝড়-জলের দিনগুলোয়। মিহিরকিরণস্যারই পরামর্শ দিলেন, ‘প্রতিদিনের এত ধকলে আপনার শরীর টিকবে না নিখিলেশবাবু। ব্যাচেলার মানুষ, এখানেই কোথাও ঘরভাড়া নিন। সপ্তাহান্তে বাড়ি যাবেন। ‘কথাটা মনে ধরে নিখিলেশস্যারের। ঘর খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন মিহিরকিরণস্যার। সে কথা বাড়ি এসে বলতে পিকলু বায়না ধরে, ‘আমাদের পাড়াতেই স্যারের থাকার জন্য ব্যবস্থা কর, বাবা। দারুণ হবে। আমি এক্ষুণি পলাশকাকুকে গিয়ে বলি। পাড়ার সব কিছুই পলাশকাকুর নখদর্পণে। কোথায় কার বাড়িতে খালি ঘর পড়ে আছে, ভাড়াটে খুঁজছে তা পলাশকাকুকে বললেই তার হদিশ দিয়ে দেবে।

মিহিরকিরণের সম্মতির আর অপেক্ষা করেনি পিকলু। বারান্দার গেট খুলেই এক দৌড়ে সে তার পলাশকাকুদের বাড়িতে হাজির। মিহিরকিরণ আশ্বস্ত ছিলেন এই ভেবে যে, পলাশ খুব পরোপকারি ছেলে, ঠিক একটা ব্যবস্থা করবেই। করলও পলাশ। এমন একজন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়ে পলাশও অত্যন্ত খুশি

 

- দু ই -

আজ শনিবার। তেইশে ডিসেম্বর। ইরাবতি মিহিরকিরণ আর পিকলুর জামাকাপড়, গরমপোশাক সব ব্যাগে গুছগাছ করে রেখেছেন। পিকলু ক্লাশ করবে কী, ভিতরে ভিতরে যেন উত্তেজনায় ফুটছে। এক একটা ক্লাশ তার কাছে আজ বড় দীর্ঘ লাগছে। মনে হচ্ছে, দপ্তরি রামুদা সময়মত ঘন্টা বাজাতে বার বার ভুলে যাচ্ছে

রওনা হওয়ার আগ পর্যন্ত ঝিকি, মিকি আর আলোকে খুব করে আদর করল পিকলু। মনটা তার খুবই খারাপ লাগছে। ওরাও যেন পিকলুকে ছাড়তে চাইছে না। বার বার গায়ে পা তুলে মুখ ঘষে অদ্ভুত অজানা কিছু শব্দ করে ওদের মনের কথা ব্যক্ত করতে  চাইছে। সেটা যে অবশ্যই  যেতে বারণ করা তা বুঝতে পেরে চোখের কোণে  জল চিকচিক করে ওঠে পিকলুর। 

ট্রেনে ক্যানিং হয়ে যেতে হবে। ক’টা স্টেশান পেরোতে সৌভাগ্যক্রমে তিনজনেরই বসার জায়গা হল। নিখিলেশস্যার পিকলুকে বললেন, ‘তুমি জানলার পাশের আসনটায় বসো। জানলা দিয়ে গ্রামবাংলার প্রকৃতি দেখতে দেখতে যাবে। ভাল লাগবে।

এত বড়  আকাশ আর খোলা প্রান্তর এর আগে কোনওদিন দেখেনি পিকলু। অনেক অনেক দূরে যেখানে আকাশটা ঝুঁকে মাটি ছুঁতে চাইছে সেখানে সারিবদ্ধ ঘন সবুজ উঁচুনিচু যত গাছেদের সামিয়ানা। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট গ্রাম। মাঠে গরুর বিচরণ। মজার দৃশ্য দেখল সে একটা, দুটো বক একটা গরুর পিঠে চড়ে দিব্যি দুলকি চালে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। গরুটা নির্বিকার। মন দিয়ে ঘাস খাচ্ছে শুধু। নারী-পুরুষ মিলে চাষের কাজে ব্যস্ত। ছোট বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে হুটোপুটি খেলছে। বড় বাচ্চারা ডাং-গুটি খেলছে। থেকে থেকে শূণ্যে কতরকমের যে পাখিদের উড়াউড়ি। ট্রেনটাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীটা যেন তাদের চারিদিকে পাক খাচ্ছে। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পিকলু জানলেও বড় অদ্ভুত লাগছে কেন যেন তার এখন। আর ‘দিগচক্রবাল’ অর্থাৎ আকাশ এবং মাটির মিলনরেখা একদম পরিষ্কার দেখতে না পেয়ে মনটা তার বড্ড আনছান আনছান করছে। কিছু না কিছু প্রতিবন্ধক হয়েই চলেছে। তার মধ্যে দৃষ্টিশক্তির বিভ্রমও আছে। আসলে আকাশ বলে তো কিছু নেই, ওটা মানুষের দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতার আবরণ, তাই ‘দিগচক্রবাল’রেখা বলেও বাস্তবে কিছু হয় না, ওখানে কেউ যেতেও পারে না, যতই যাওয়ার চেষ্টা করা যায় ততই রেখাটা আরও দূরে দূরে সরে যায়, তা জানে পিকলু। তবুও………. 

ক্যানিং স্টেশানে খুব ভিড়। শহুরে ভ্রমনার্থী সব। শনি-রবি-সোম, এই তিনদিনের টানা ছুটির মজা উপভোগের জন্য উন্মুখ সবাই। 

প্রচুর দোকানপাট আর ঘন লোকবসতি নিয়ে শহরটা বেশ ঘিঞ্জি।এই প্রথম ভ্যানরিক্সায় চাপল পিকলু।গন্তব্য ফেরিঘাট।বেশ মজার বাহন। বাইরে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসে হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া

- ‘আমরা কি স্যার ওখান থেকে নদী পার হব?’ পিকলু জিজ্ঞেস করল

- ‘না পিকলু, বাস ধরব। যাকে বলে ম্যাজিকগাড়ি। খুব দ্রুত চলে বলেই ওই নাম। মাতলা নদী তো আর সেই নদী নেই আর। তার বুকে এখন উঁচু করে চরা পড়েছে। ভাটায় মানুষজন হেঁটেই পার হয়ে যায়। জোয়ারে ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যায়। দূরের যাত্রিরা বাস, অটো বা ম্যাজিকগাড়ি ধরে। ওই দেখ স্টেডিয়াম। ওখানে একসময় ভয়ঙ্কর মাতলা বড় বড় ঢেউ ভাঙত। আর আমরা এই যে রাস্তা দিয়ে চলেছি তা ছিল একসময় মাতলার বুক।‘বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন নিখিলেশস্যার

পিকলু শুনে তো অবাক। মিহিরকিরণস্যার বললেন, ‘তাহলেই বোঝো পিকলু, ভৌগোলিক পরিবর্তণ কীভাবে হয়। এটা তারই একটা উদাহরণ। পৃথিবীতে এমন বহু নদী পুরোপুরি মজে গিয়ে জনবসতিতে পরিনত হয়েছে। এই যে কলকাতার বউবাজারে মেট্রোবিপর্জয়ের কথা শুনছো, বাড়িঘর ভেঙ্গে পড়ায় অনেক পরিবার ঘরছাড়া হচ্ছে, সেখানে নাকি একসময় নদী বয়ে যেত। ভাবতে পার! এখানেও এমনটা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

কথা পথকে ছোট করে দেয়। পিকলুর মনে হল মাত্র কয়েক মুহূর্তে তারা ফেরিঘাটে চলে এল। শীতকাল। দিনের আলো মজে এসে চারিদিকটা হাল্কা কুয়াশামাখা ছায়াছায়া। বেশি দূর আর চোখ চলে না। ফিটকিরি রঙ আকাশের গায়ে কেমন ছড়ানোছিটানো লালচে আভা। অদ্ভুত লাগছে পিকলুর, আকাশ এমনটাও হয়!

যত গাড়ির হেল্পার আর কনডাকটারদের হাঁকাহাঁকি-চিৎকার, ‘ছেড়ে দিল, ছেড়ে দিল-দেউলবেড়ে, আমলামেতি, ভড়তগড়, মসজিদবাটি, শিবগঞ্জ……।আরও কত না দূর-দূরান্তের গ্রামের যাত্রি খুঁজছে ওরা। পিকলুর মনে  হচ্ছে, তার চেনাজানা পরিসরের বাইরে পৃথিবীটা আরও অনেক অনেক বড়। গ্রামের নামগুলো মুখস্থ রাখার চেষ্টা করে পিকলু। বাড়ি ফিরে মা-ঠাম্মি-দাদানকে বলবে

বসার জায়গা পেতে একটা বাস ছাড়তে হল পিকলুদের। ফের জানলার পাশেই বসতে পেল সে। তবে বিকেল এখন সন্ধা নামার মুখোমুখি। বাতাস আরও বেশি ঠান্ডা হতে লেগেছে, তাতে কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ, একেই বুঝি বলে মাটির গন্ধ। ছায়াছায়া অন্ধকারে কালো রঙের পোঁচ লাগতে শুরু করেছে। তাতে কিছু জোনাকিদের উড়াউড়ি। মাতলা-ব্রিজ পেরোচ্ছে গাড়ি, নীচে ক্ষীয়মান জোয়ারে কটা নৌকো ভাসছে। জলে কোনওরকম উচ্ছ্বলতা নেই। কাছে-দূরের ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠছে। ব্রিজ পেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়ে বাসটা সত্যিই ম্যাজিকগতিতে ছুটছে এখন। একে একে কত গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছে

একেকটা গ্রাম আসছে, বাস থামছে, হেল্পার হাঁক পেড়ে নাম ঘোষণা করছে। যাত্রি নামছে বেশি উঠছে কম। ভাঙ্গনখালি, কুলতলি  ইত্যাদি আরও কত না গ্রাম  পিছনে ফেলে বাস ছুটে চলেছে। বাইরে আলাদা আলাদা করে কিছুই আর দেখতে পাচ্ছে না পিকলু। শুধুই অন্ধকার। তাতে  বিন্দু বিন্দু  গ্রামবাসিদের ঘরের আলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন এক ভয়তাড়িত রোমাঞ্চ পিকলুর মনকে গ্রাস করছে। মনে হচ্ছে এই বাস আদৌ তাঁদের গন্তব্যে নিয়ে চলছে না। অন্য কোথাও, কল্পনার বাইরের কোনও জগতে। নিখিলেশ স্যারের বলা ওই মানুষটার কথা মনে পড়ল পিকলুর। যার পরিচয় জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে সে। উল্টোদিকের সিটে বসে নিখিলেশ স্যার। দু’চোখ মুদে এসেছে তাঁর। ঘুমিয়ে পড়েছেন। পিকলুর পাশে বসে মিহিরকিরণস্যার। পিকলু তাঁর গায়ে মৃদু টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ওই মানুষটা কে হতে পারেন, বাবা?’

- ‘কোন মানুষটা?’

- ‘স্যার যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করাবেন বলেছিলেন?’

মিহিরকিরণস্যার বার কয়েক মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন, না, তিনিও কোনওরকম অনুমান করতে পারছেন না। বললেন, ‘নতুন জায়গায় যাচ্ছ, মনে একটু-আধটু রহস্য-রোমাঞ্চ থাকা ভাল। তা নইলে ঠিক উপভোগ করা হয় না।

কথাটা বেশ মনে ধরল পিকলুর

একটু বাদে পিকলু লক্ষ করল, তাদের বাসটা যেন অন্ধকারের গন্ডি ডিঙিয়ে হাল্কা আলোর জগতে প্রবেশ করছে। কাছেই জনবসতির আঁচ পাচ্ছে পিকলু। 

হেল্পার বড় করে হাঁক পাড়তে থাকে, ‘সোনাখালি, সোনাখালি, লেবি ঝাও, লেবি ঝাও।

একরকম হুড়মুড়িয়ে প্রচুর যাত্রি নামল। তাদের মধ্যে কিছু ভ্রমনার্থিও। বাইরে তাকিয়ে পিকলু দেখল, এ তো রীতিমত আলো ঝলমল একটা গঞ্জ। প্রচুর দোকানপাট। মানুষজনের ভিড়। হেল্পারের ফের একচোট হাঁকাহাঁকিতে নিখিলেশস্যারের ঘুম ভাঙল। তিনি খানিক লজ্জিতই হলেন বুঝি, মিহিরকিরণস্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যরি, চোখদুটো একটু……….,’ পরক্ষণে পিকলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার আমরা হোগল নদীর ওপর দিয়ে বাসন্তী-ব্রিজ পেরোব। নদীর ওপারে বাসন্তী গ্রাম। এর চেয়েও বড় গঞ্জ। জনবসতিও অনেক বেশি।

-‘’বাসন্তী’ নামটা বেশ অন্যরকম, তাই না স্যার? এ তো মেয়েদের নাম হয়।পিকলু বলল

-‘হ্যাঁ, মেয়েদের নামে একটা গ্রামের নাম, খুব কমই শোনা যায়। শুনেছি ওই গ্রামের জমিদারের একমাত্র মেয়ের নাম ছিল ‘বাসন্তী’। জমিদারের ইচ্ছে অনুযায়ি পুরনো নাম পাল্টে আদরের মেয়ের নামে গ্রামের নাম রাখা হয়। যদিও এই নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এই অঞ্চলে বেশ কিছু গ্রামের নাম আছে যা থেকে তোমার মনে ইতিহাস খোঁজার কৌতূহল জাগবে। যেমন ধরো একটা গ্রাম আছে যার নাম ‘ভরতগড়’। এই নাম থেকে অনুমান করা যায়, ভরত নামে কোনও রাজা বা জমিদারের গড় ছিল ওটা। গড় অর্থাৎ দুর্গ, পরিখা, খাত বা কেল্লা বোঝায়। সময়ের সঙ্গে তা মাটির গর্ভে চলে গিয়েছিল। খনন কাজ চালাতে তার অস্তিত্ব মেলে। একশ বছরেরও বেশি  আগে ওই অঞ্চলে বন কেটে আবাদের কাজ শুরু হলে গড়, কয়েকটা শিবমন্দির, দিঘির অস্তিস্ত পাওয়া যায়।  রাণীগড় নামেও একটি গ্রাম আছে। তাহলে বুঝতেই পারছ, রাজা-রাণীর সময়ের ব্যাপার-স্যাপার এসে গেল না! দুটো গ্রামের নাম  ‘শিবগঞ্জ আর ‘নফরগঞ্জ’। ‘গঞ্জ’ বলতে তো আমরা বুঝি নদীতিরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা কোনও বানিজ্যকেন্দ্র।আর তাকে ঘিরে ক্রমশ বেড়ে ওঠা জনবসতি। এখন ওই দুটো গ্রামের খুব কাছাকাছি কোনও নদী নেই ঠিকই কিন্তু একটা সময় নিশ্চয়ই কাছেই ছিল। তাদের তিরে রমরমা গঞ্জ গড়ে উঠেছিল। কালের নিয়মে সে নদী এখনও মরেহেঁজে না গেলেও চর পড়ে পড়ে দূরে সরে   গেছে। গড়ে উঠেছে জনবসতি, শুরু হয়েছে চাষবাস। কিন্তু নামের সঙ্গে একদা গঞ্জের মহিমার ইঙ্গিত রয়ে গেছে।

ইতিমধ্যে বাসন্তী-ব্রিজ পেরিয়ে বাসন্তীগঞ্জের কোলঘেষা বড় রাস্তা ধরে বাসটা স্টপ দিল। হেল্পার ফের হাঁকাহাঁকি শুরু করে, ’গীর্জাঘর, গীর্জাঘর……, বাসন্তী ঝারা লাববে লেবি ঝাও, লেবি ঝাও।

অধিকাংশ যাত্রি এখানে নেমে গেল। উঠল মাত্র দু’তিনজন। বাস এখন একরকম ফাঁকাই। ফলে ঠান্ডাভাবটা বাড়ছে

নিখিলেশস্যার ফের বলতে শুরু করেন, ’বাইরে তাকিয়ে দেখো পিকলু, বাসন্তীর গীর্জা।

পিকলু দেখল, মস্তবড় এক গীর্জা। রঙবেরঙের আলো আর কাগজের সাজে একেবারে ঝলমল করছে। কত মানুষের সমাগমে চারিদিকটা গমগম করছে। সাজানো এবং আনুষঙ্গিক আরও অনেক কাজে ব্যস্ত সবাই। সবার মধ্যে এক উৎসবের মেজাজ। পিকলু অবাক বিস্ময়ে দেখছে গীর্জার ঘড়িঘড়ের ডানদিকে কৃত্রিম এক পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে করুণাঘন দয়াময়ি মা মেরির শান্তস্নিগ্ধ অপূর্ব এক মূর্তি। পাশেই মা মেরির কোলে শায়িত ক্রশবিদ্ধ রক্তাক্ত যীশু। যীশুর ক্ষমাসুন্দর অপার্থিব মুখমন্ডল। সন্তানশোকে কাতর মা মেরি। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল পিকলুর। খুব কান্না পাচ্ছে তার এখন। মিহিরকিরণস্যারও বড় কৌতূহলি হয়ে দেখছেন। তাঁরও মনটা দ্রবীভূত হয়ে উঠছে

- ‘না এলে খুব মিস করতাম রে পিকলু!

- ‘হ্যাঁ, বাবা।এর বেশিকিছু বলতে পারে না পিকলু। তার কান্না যে কন্ঠার গোড়ায় আটকে আছে। দু’চোখ চিকচিক করছে অশ্রুজলে

নিখিলেশস্যার বললেন, ‘এ অনেক পুরনো গীর্জা, পিকলু। এর আসল নাম’চার্চ অফ দি সেন্ট টেরেসা অফ দি চাইল্ড জেসাস’। ফাদার ই. ডেলপ্লেস নামে এক অধ্যাপক ১৮৭৩ সালে এই গ্রামে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার আর শিক্ষা বিস্তারের জন্য আসেন। তাঁরই উদ্যোগে ১৮৭৪ সালে এখানে একটি কাঁচা গীর্জাঘর নির্মিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে ফাদার পল মেসারিক এই সুবিশাল পাকা গীর্জাটি নির্মাণ করান। কাল থেকে ভেতরে স্কুল মাঠে মস্ত মেলা বসবে। চলবে পঁচিশে ডিসেম্বরের পরদিন পর্যন্ত। আমাদের গ্রামেও মেলা বসে। আমরা সবাই মিলে যাব।  তোমার ভাল লাগবে।

খুশি হল পিকলু। গ্রামের মেলা সে কোনওদিন দেখেনি। 

বাসটা ফের একটু একটু করে আবার ঘন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে জোর গতিতে ছুটতে শুরু করল। নামা-ওঠার যাত্রি নেই তেমন। মাঝে মাত্র দুটো স্টপেজ দিয়ে সোজা গিয়ে বাসস্ট্যান্ডে থামল। গ্রামের নাম মসজিদবাটি। রাস্তার দু’পারে গুটিকয় গুমটি গুমটি চা-তেলেভাজা, মিষ্টি, মুদি-মশলা, সাইকেল-ভ্যানরিক্সা সারানো ইত্যাদির দোকান। রাস্তার কোল ঘেঁষে দু’তিনটে  মাছ-মাংসের দোকান। খরিদ্দারের ভিড়ের তুলনায় সামনে পাতা যত  বেঞ্চে বসা গল্প-আড্ডার লোকই বেশি।তাদের হাতে হাতে চা, বিড়ি-সিগারেট

নিখিলেশস্যার বললেন, ’আমরা আবার নদী পেরোবো পিকলু। সামনেই গোসবা নদী। তবে এবার আর ব্রিজের ওপর দিয়ে গাড়িতে নয়, নৌকোয় পার হব।চলো সামনের দিকে হাঁটি, একটুখানি পথ। একটা নৌকো মিস করা মানে অন্তত আধাঘন্টা বসে থাকা। 

পিকলুরা জোরে পা চালাতে লাগল। আর সব যাত্রিরাও তাই। এতক্ষণ বসে আসার পরে হাঁটতে ওদের ভালই লাগছে। শরীরের জমে ওঠা কল-কব্জাগুলো ছাড়ছে। রক্ত  চলাচল বাড়তে ঠান্ডা  শরীরগুলো উষ্ণতার আরাম পেতে  শুরু করেছে। খেয়াঘাটে পৌঁছে পিকলু তো অবাক, ’এ্যাত্ত বড় নদী!

জোয়ারে ভরাভারা নদী। শীতে শান্ত। অন্ধকার হলে কী হবে ঘোলাজলের ঘষা-কাচবর্ণ আলোর ছটা আর কিছু নৌকো থেকে ছিটকে পড়া আলোর আভায় নদীটাকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। তবে ওপারটা চট করে ঠাহর হয় না।খুব ভাল করে লক্ষ করলে ছোট্ট ছোট্ট আলোর বল অস্বচ্ছ দেখা যায়।ওগুলো ওপারের গঞ্জের দোকানপাটের আলো

নিখিলেশস্যার বললেন, ‘নদী বড় বা ছোট তার চওড়া পরিসর দেখে হয় না পিকলু, বিচার হয় তার দৈর্ঘ দিয়ে। আমরা তো জাস্ট নদীর এপার  থেকে ওপারে যাব। তবে হ্যাঁ, এই নদীটা বেশ চওড়াই। কিন্তু  তুমি ওপারটা দেখতে পাচ্ছ না বলে আরও বেশি বড় লাগছে তোমার কাছে।

- ‘হ্যাঁ স্যার, আমিই ভুল বলেছি। এটা আমি জানতাম। কিন্তু এর আগে আমি তো কোনওদিন এত জল একসঙ্গে দেখিনি তাই বিস্মিত হয়ে ভূগোলের সত্যিটাই ভুলে গিয়েছিলাম।

ছেলের কথায় হেসে উঠলেন মিহিরকিরণস্যার। সেইসঙ্গে নিখিলেশস্যারও

মিহিরকিরণস্যার বললেন, ‘দেখ, বিস্ময় কেমন স্মরণে বিস্মরণ ঘটায়।

- ‘খেয়া পারাপারের নৌকো এখন ভটভটি। যন্ত্রচালিত। দিকনির্ণয়ের জন্য মাঝি শুধু হাল ধরে থাকে।

নিখিলেশস্যার পিকলুকে বোঝান। পাশে বসে মিহিরকিরণস্যারও তা শুনছেন। শিখছেন। অন্ধকারে ডিজেলপোড়া সাদাটে ধোঁয়া উড়িয়ে ভটভটি চলেছে গোসবার পথে। গন্ধটা ঠিক নেওয়া যাচ্ছে না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে পিকলুর। মিহিরকিরণস্যারেরও। কিন্তু মানিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় কী! বললেন, ‘বর্তমান সভ্যতা হল গতি-সভ্যতা। শহর ছাড়িয়ে গ্রামদেশও তার দখলে চলে  আসছে। তার সুফল ভোগ করতে  হলে কিছু কুফল তো আমাদের সইতেই হবে। এই সমস্যা সারা বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। মেরুপ্রদেশের বরফ গলছে।  অনেক শীতপ্রধান দেশের  জমে থাকা বরফ অসময়ে গলে যাচ্ছে। ফলে জলস্তর ক্রমশ বাড়ছে। আঘাত হানছে জীববৈচিত্রে। অনেক প্রাণীই হয়ত অচিরেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অরণ্য  ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পৃথিবী নামক এই সুন্দর গ্রহটিই হয়ত আর থাকবে না একদিন।…… 

মিহিরকিরণস্যার আরও বলে যান। পিকলু শুনছে। শুনছেন নিখিলেশস্যার। আর সব যাত্রিরাও।সবারই কথা বন্ধ হয়ে গেছে। পিকলুর মনে হচ্ছে, এক নৌকো ভয়তাড়িত অসহায় মানুষ  মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। আর ওই ভটভট শব্দটা যেন মৃত্যুঘন্টা বেজে ওঠার শব্দ। কারোর রেহাই নেই। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে কেঁপে উঠল পিকলুর। মিহিরকিরণের একটা হাত শক্ত করে ধরল সে।অবলম্বনের মতো করে

- ‘কী হল, ভয় পাচ্ছ?’

- ‘না, নৌকোটা কেমন একটু দুলে উঠল না!ভয় পাওয়ার লজ্জা থেকে নিজেকে গোপন করতেই যেন পিকলু বলল

মিহিরকিরণস্যার তা বুঝতে পেরেই ফের বলতে শুরু করেন, ‘এই পরিবেশদূষণ, উষ্ণায়ন থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে ব্যাপক প্রচার চলছে। নেওয়া হচ্ছে ভাল ভাল উদ্যোগ। কিন্তু নাগরিক সচেতনতার অভাবে অনেক উদ্যোগই বিফলে যাচ্ছে। সুতরাং শুধু রাষ্ট্রের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতে পারি না। আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। শুধু আলাপ-আলোচনায় থেমে থাকা নয়, সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে পৃথিবীকে রক্ষা করতে হবে।ভয় পেলেও চলবে না। আমাদের নিরন্তর এর বিররুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে, তবেই না একসময় ইতিবাচক ফল মিলবে। এখনও সময়  আছে। ঘাবড়াবার কিছু নেই।

মিহিরকিরণস্যার অনুভব করছেন, তাঁর ধরা হাতটা থেকে পিকলুর হাতের চাপ একটু একটু করে শিথিল হচ্ছে

পিকলুর মনে পড়ছে, এ বছর তাদের বৃক্ষরোপণ প্রকল্পের কথা। পলাশকাকুর তৈরি ‘কচিকাঁচার দল’-এর উদ্যোগে পাড়ার ফাঁকা জায়গাগুলোতে অনেক গাছ লাগানো হয়েছে। পাড়ার লোকেরা মিলে চাঁদা তুলে সেসব গাছে বেড়া দেওয়া হয়েছে যাতে কোনওভাবে নষ্ট না হয়। পরিচর্যার কাজও ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তাতে ছোট-বড় সবাই সামিল হয়। ওই দিন ছোট্ট এক বক্তৃতায় পলাশকাকু বলেছিল, ‘প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের এই উদ্যোগ সামান্যই। কিন্তু এই ছোট্ট উদ্যোগ মহীরূহ হতে পারে যদি আমরা আমাদের এই উদ্যোগের কথা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারি। সেইমতো ছড়িয়েও দেওয়া হল ফেসবুক, হোয়াসঅ্যাপ, টুইটের মাধ্যমে। কচিকাঁচাদের এমন সাধু উদ্যোগ জেনে প্রিন্ট-মিডিয়াও সানন্দে কভার করল। টিভি চ্যানেলগুলোও সম্প্রচার করল। যার ফলে মহীরূহ হয়ে ওঠার ইঙ্গিতই মিলছে। সারা রাজ্যে তো বটেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের অনুসরণ করে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে

ভটভটি এসে গোসবার খেয়াঘাটে ভিড়ল

বেশ জমজমাট গোসবাগঞ্জ। একদিন বাদেই যে বড়দিন পালন। জামাকাপড়ের দোকানগুলোয় তাই ভিড় বেশি। ভিড়ভাট্টা কাটিয়ে পিকলুরা তুলনায় ফাঁকা একটি জায়গায় এল। এখানে ভ্যানরিক্সার স্ট্যান্ড। যাত্রি পেতে হাঁকাহাঁকি চলছে

নিখিলেশস্যার বললেন, ‘এবার আমরা ভ্যানরিক্সায় চড়ব পিকলু।

- ‘তারপর?’ বড় ক্লান্ত লাগছে পিকলুর

হেসে ফেললেন নিখিলেশস্যার। বললেন, ‘তারপর আর কিছু নয়। এই ভ্যানরিক্সাই আমাদের একেবারে ঘরের দুয়ারে পৌঁচে দেবে।

মিহিরকিরণস্যার বললেন, ‘তাহলেই বোঝ পিকলু, তোমাদের এই স্যার কত কষ্ট করে ওনার ডিউটি করতেন।

ভাবতে গিয়ে পিকলু অবাক হচ্ছে। নিখিলেশস্যারের প্রতি তার শ্রদ্ধা উত্তরোত্তর বাড়ছে

মিহিরকিরণ ভ্যানরিক্সাওলার ডানদিকে পা ঝুলিয়ে বসলেন। পিকলু আর নিখিলেশস্যার পিছনে পা ঝুলিয়ে। পিকলুর কাছে এ এক মজার যাত্রা। ভ্যানরিক্সা ধীর লয়ে চলছে। চালক  বুঝি সারাদিন চালিয়ে এখন বেশ ক্লান্ত। একটু বাদে নিখিলেশস্যার ডানদিকে অনতিদূরের এক বাংলোবাড়ির দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘ওই যে বাড়িটা দেখছ পিকলু, ওটা কিন্তু ঐতিহাসিক।

এই অন্ধকারে বাড়ি বলে পরিষ্কার কিছু দেখা না গেলেও বাড়ির অবয়বের  মতো একটি মস্ত ঘর দেখতে পাচ্ছে পিকলু। এই গ্রামদেশে  ওই বাংলোবাড়িটা কেন ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত? অবাক হল পিকলু। বলল, ‘কী রকম?’

- ‘এই গ্রামে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন। ওই বাংলোতে ছিলেন। আমাদের কাছে এ এক  পরম গর্বের ব্যাপার।

পিকলু এখন রোমাঞ্চিত। মিহিরকিরণস্যারও।বললেন,’ আমি শুনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনও এক সাহেবের আমন্ত্রণে  গোসবায় এসেছিলেন।এখানে ছিলেনও দু’দিন। সাহেবের নামটা এই  মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না।

- ‘হ্যামিলটন সাহেব। স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন। স্কটল্যান্ডের মানুষ। চাকুরিসূত্রে  এই দেশে এসে এই  দেশকে বড় আপন করে নিয়েছিলেন। কর্মজীবন থেকে অবসরের পরেও নিজের দেশে ফিরে যাননি। এখানকার দুঃখ - দারিদ্রলাঞ্ছিতঅশিক্ষা - কুশিক্ষা, কুসংস্কারে নিমজ্জিত মানুষগুলোকে আলোর  দিশা দেখাতে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে  তিনটি গ্রাম গোসবা, রাঙাবেলিয়া আর  সাতজেলে লিজ নিয়ে গড়ে তুললেন   নিজের লাট অঞ্চল। লোকে বলত ‘হ্যামিলটন সাহেবের লাট’।জীবনের সমস্ত  সঞ্চিত অর্থ  মানবসেবায় বিভিন্ন কর্মকান্ডে  নিয়োজিত করলেন। স্বপ্ন  দেখেন, এক সুসভ্য উন্নত সমাজজীবন গড়ে তোলার। গড়ে তুললেন অবৈতনিক বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়। পানীয় জলের বড় অভাব তখন। দূষিত জল খেয়ে  হতভাগ্য মানুষগুলো নানা রোগে পড়ে, অকালে প্রাণও যায়। তিনি পানীয় জলের পুকুর কাটালেন। অন্য কাজে তা ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। সমবায় ব্যাঙ্ক তৈরি করে সুদখোর মহাজনদের হাত থেকে ঋণের দায়ে জজ্জরিত মানুষগুলোকে বাঁচাতে প্রয়াসী হলেন। গড়ে তুললেন সমবায় রাইসমিল, শষ্যভান্ডার, তাঁতশালা কৃষিক্ষেত্রে আনলেন আধুনিক প্রযুক্তি। সেই সময়ের নিরিখে যা ছিল এক যুগান্তকারি ঘটনা। বিনিময়ের সুবিধার্থে প্রচলন করলেন এক টাকা নোটের। সাহেবের এই বিপুল কর্মযজ্ঞের কথা রবীন্দ্রনাথ জানলেন। তিনিও যে এরকম স্বনির্ভর গ্রাম গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন। সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রবল আগ্রহী হয়ে উঠলেন। সে খবর এল সাহেবের কাছে। অত্যন্ত আনন্দিত হলেন সাহেব। তিনি রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানালেন। ১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে রবীন্দ্রনাথ গোসবায় এলেন। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনযোগে ক্যানিং বন্দর হয়ে মাতলা নদীপথে মোটরলঞ্চযোগে। আমরাও যে পথে এলাম আর কী। তবে মোটরলঞ্চের পরিবর্তে ম্যাজিকগাড়ি আর ভটভটি চেপে। ট্রেন তখনও বাষ্পচালিত। মন্থর গতির। মহেশ রায়চৌধুরিরা তখন এই অঞ্চলের জমিদার। সাহেব জমিদারের নায়েব নবীনচন্দ্র দে মহাশয়ের উপর ভার দিলেন কবিগুরুর আদর আপ্যায়নের। ওই বাংলোর সামনে সভা করে কবিকে সাদর অব্যর্থণা জানানো হল। সাহেবের কর্মকান্ড দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন রবীন্দ্রনাথ। উৎসাহিত হলেন শান্তিনিকেতনে  ফিরে তাঁর সাধের শ্রীনিকেতনে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবেন। নতুন বছরের প্রথম দিনে কবি গোসবা থেকে বিদায় নিলেন। লঞ্চঘাটে তখন হাজার মানুষের ভিড়। তাদের মন ভারবেদনাতুর।

শুনতে শুনতে আরও রোমাঞ্চিত হচ্ছে পিকলু। যে পথ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলিতে একদিন ধন্য হয়েছে, যে জলপথের যাত্রি হয়ে তিনি জলকে শুদ্ধতার ষ্পর্শ দিয়েছিলেন সেই পথের সাথি আজ সেও হয়েছে! জীবনে এ বড় কম পাওয়া নয়! এ কথা ঠাম্মি-দাদান আর মাকে বলার জন্য মন তার উতলা হয়ে দু’চোখের কোল আনন্দাশ্রুতে ভরে উঠছে। আঁধারের অবগুন্ঠনে ঢেকে আছে সে সলজ্জ অশ্রুজল!

রাস্তা বেশি একটা চওড়া নয়। দু’পার ধরে বৃক্ষরোপন প্রকল্পের গাছের সারি। শীতে জবুথুবু, কুয়াশার সাদা থানে মোড়া।ফাঁকে ফাঁকে গৃহস্থ ঘরের আলো দেখা যাচ্ছে। কোনও কোনও ঘরে বড়দিন পালনের আলোর রোশনাই, প্রভু যীশুর জন্মস্থান গোশালার সাজ। মাইকে যীশুর উদ্দেশ্যে স্তুতিগান বাজছে। বাড়ি থেকে এতদূরের এমন এক পরিবেশে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলছে পিকলু। সে যেন পিকলু হয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না।এখানকারই কেউ হয়ে উঠছে। সে আর পিকলু নয় অন্য কেউ। ভাবতে গিয়ে একটু কষ্ট হলেও মনের কোণের কোথায় যেন একটা অদ্ভুত ভাল লাগাও খেলা করছে তার। কেমন হয় এখানে থেকে গেলে!

দূর থেকে মাইকের আওয়াজ আসছে। এখান থেকে তার অস্পষ্ট ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। একই ঘোষণা বার বার। সম্বিৎ ফিরে এল পিকলুর। ভাল করে কান পেতে ঘোষণাটা বোঝবার চেষ্টা করছে সে। ভ্যানরিক্সাটা আরেকটু এগোতে পিকলু দেখল বাঁদিকের এক সরু মেঠো রাস্তার অনতিদূর প্রান্তে এক ছোট মাঠে কী যেন এক অনুষ্ঠান হচ্ছে। মাঠটার মাঝে মঞ্চ বাঁধা, মাথায় সামিয়ানা। অনুজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা। অনেক লোকের ভিড়। আরও অনেক মহিলা-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, ছোটরা দল বেঁধে ওদিকে এগিয়ে চলেছে। তাদের কারোর কারোর হাতে টর্চলাইট, কারোর কারোর হাতে নারকেলের মালার মধ্যে জ্বালানো মোমবাতি বসানো।ওই সামান্য আলোতেই ওরা পথ চলেছে। ঘোষণাটা এবার পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে পিকলু

- ‘বন্ধুগন, বন্ধুগন, আমাদের আজকের পালাগান ‘বনবিবির পালা’  আর কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হতে চলেছে।পরিবেশনায় ‘বনমাতা পালাগান সংস্থা’।বনবিবি মায়ের ভূমিকায় জনপ্রিয় অভিনেত্রি শ্রীমতি ভগবতী সাঁপুই। সময় রাত্রি দশ ঘটিকা। আপনারা দলে দলে যোগ দিয়ে এই পালাগান সাফল্যমন্ডিত করে তুলুন। বন্ধুগন বন্ধুগন…

এ কোন পালা বা যাত্রাপালার কথা ঘোষণা হচ্ছে? যদিও পিকলু কোনওদিন যাত্রাপালা দেখেনি তবে নাটক-থিয়েটার দেখেছে কিছু, সবই ছোটদের আনন্দ এবং শিক্ষামূলক, তাই তার কৌতূহল হচ্ছে খুব। কে এই বনবিবি, কেন তাকে নিয়ে এই পালাগান? নিশ্চয়ই বিখ্যাত কেউ একজন। নিখিলেশস্যারকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, ‘বনবিবি এখানকার আঞ্চলিক  দেবী। নাম থেকেই বুঝতে পারছ, বনের প্রধানা তিনি। এই বনাঞ্চল অর্থাৎ সুন্দরবনের জনজীবনের রক্ষাকত্রী। সকলের আরাধ্যা। তারই মহিমাবর্ণিত কাহিনিনির্ভর পালাগান এ। ইতিহাস এবং কল্পনা আশ্রিত এমন আরও বহু পালাগান এই অঞ্চলের মানুষের মনে শ্রদ্ধাভক্তির জায়গা করে নিয়েছে। ফলে ভীষণই জনপ্রিয়। যেমন, গাজি-কালু-চম্পাবতীর পালা, দক্ষিণারায়ের পালা, মুকুটরায়ের পালা ইত্যাদি।

- ‘তুমি কি ওই পালাগান শুনতে চাও, পিকলু? আমার তো ভীষণ মন চাইছে। এমন সুযোগ আর কবে আসবে জানি না।মিহিরকিরণস্যার বললেন

- ‘হ্যাঁ বাবা, আমারও খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু যদি ঘুমিয়ে পড়ি!

নিখিলেশস্যার মুচকি হেসে হাতঘড়িতে সময় দেখলেন। বললেন সবে তো মাত্র রাত্রি আটটা। পালা শুরু হতে এখনও দু’ঘন্টা বাকি। বাড়ি পৌঁচে ফ্রেস হয়ে কিছু খাওয়া-দাওয়া করে ঘন্টাখানেকের একটা ঘুম দিয়ে নিলেই দেখবে তুমি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছ।

পরামর্শটা খুব মনে ধরল পিকলুর। হ্যাঁ, শরীর তার এখন একটু বিশ্রাম চাইছে। তবে সে স্যারের বাড়ি পৌঁছেই আগে দাদান-ঠাম্মি আর মা-কে ফোন করবে। ভালভাবে পৌঁছোনোর সংবাদ তো দেবেই সেই সঙ্গে আরও অনেক কথা যা ইতিমধ্যে তার মনে জমে ভান্ডার পূরণ  করে ফেলেছে প্রায়। জিজ্ঞেস করবে, ঝিকি-মিকি-আলো কেমন আছে? বলবে, ‘ওদের কথা খুব খুব মনে পড়ছে! তোমরা ভাল থেকো, সাবধানে থেকো

একসময় ভ্যানরিক্সা বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁক নিয়ে দুই পুকুরের মাঝের সরু মাটির রাস্তা ধরল। একটু এগোতেই রাস্তার মাথায় একটা দো-তলা বাড়ি। পাকা নয় মাটির। খড়ের চাল। উঠোনে এসে ভ্যানরিক্সা থামলে নিখিলেশস্যার বললেন,’আমরা এসে গেছি পিকলু, এই আমাদের বাড়ি,নেমে পড়।

- ‘দেখ পিকলু, মাটির দোতলা বাড়ি, দারুণ না?’ মিহিরকিরণস্যার বললেন

পিকলু অবাক চোখে বাড়িটা দেখছে। ইলেকট্রিকের আলো আছে। চওড়া বারান্দায় বেশি আলোর দুটো বাল্ব ঝুলছে। তাদেরই আলো এসে পড়েছে সামনের ফাঁকা জায়গাটায়।একেই বুঝি উঠোন বলে। বেশ ঝকঝকে তকতকে। উঠোন ঘিরে শীতের শাকশব্জির বাগান। বাগানের প্রান্তজুড়ে নানারকম ফল- ফুলের গাছ। ফুলের গন্ধে ম-ম করছে বাতাস। বুকভরে বারকয়েক শ্বাস নিতে নিজেকে বেশ হাল্কা বোধ করছে পিকলু। যেন অবসাদ ক্লান্তি অনেকটাই ঝরে গেছে। বলল, ‘দারুণ ইন্টারেস্টিং, বাবা।

- ‘এই বাড়িগুলো কিন্তু সাইন্টিফিক। গরমের দিনে ঠান্ডা। আবার ঠান্ডার দিনে গরম। তার মানে সারা বছরের জন্য আরামদায়ক।

- ‘কীভাবে?’

নিখিলেশস্যার বললেন, ‘সে আলোচনা পরে হবে পিকলু। আগে তো ঘরে ওঠ।

নিখলেশস্যারের মা-বাবা যেন পিকলুদের সাদরে গ্রহণ করার জন্যই তৈরি হয়ে বারান্দার চৌকিতে বসে আছেন। পাশে বসে একটি মেয়ে। পিকলুর থেকে দু-তিন বছরের বড়ই হবে। নতুন অতিথি দেখে তার চোখেমুখে অদ্ভুত এক আলোর উদ্ভাস। চোখের ভাষায় খুশি হওয়ার ইঙ্গিত। নিখিলেশস্যার তাঁর মা-বাবার সঙ্গে প্রথমে পিকলুদের পরিচয় করালেন। পিকলু ওঁদের প্রণাম করল। মিহিরকিরণস্যারও করলেন। দু’জনে ‘থাক বাবা থাকসুখে থাক, বড় হও, ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুক বলে আশীর্বাদ করলেন। পিকলুর চিবুক ছুঁয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ালেন। তারপর নিখিলেশস্যার মেয়েটিকে দেখিয়ে পিকলুর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এ হল তোমার এক দিদি, ডাক নাম বনি, ভাল নাম বন্যা। বন্যার সময় জন্মেছিল বলে মা নাতনির এই নাম রেখেছে। আমার দাদার মেয়ে। সামনে মাধ্যমিক দেবে। দাদা বদলি হয়ে বউ-ছেলেকে নিয়ে এখন শিলিগুড়িতে। বনির পরীক্ষা হয়ে গেলে ও ওর মা-বাবার কাছে চলে যাবে। পরবর্তী পড়াশুনা ওখান থেকেই করবে।

পিকলু মৃদু হেসে বলল, ‘তুমি তাহলে আমার এক দিদি হলে, বনিদি।

বনির মুখে খুশির হাসি ফুটল। বলল, ‘আর তুমি হলে আমার আরেক ভাই, পিকলুভাই, তাই তো?’

- ‘হ্যাঁ।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু তুমি আমার নাম জানলে কী করে?’

- ‘কাকুর মুখে তোমার কথা অনেক শুনি। এমন গুণী ছেলে কমই নাকি দেখা যায়।

একটু লজ্জাই পেল পিকলু, ‘ও কিছু না!

মিহিরকিরণস্যার মুচকি হেসে বনির উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তুমি যে বরাবর ক্লাশে ফার্স্ট হও সে খবরও কিন্তু আমি জানি।

বনি সলজ্জ হেসে মিহিরকিরণস্যারকে প্রণাম করল

দোতলায় দুটি ঘর। তার একটিতে পিকলুদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পোশাক ছেড়ে ঘরোয়া পোশাক পরে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নিয়ে জলখাবার খাওয়া হল। বাড়ির মুরগির ডিমের ওমলেট, নিজেদের ক্ষেতের চালের মুড়ি, বাগানের কলা আর মিষ্টি। মিষ্টিটা নিখিলেশস্যারের বাবা সুধন্যবাবু দোকান থেকে কিনে এনে রেখেছিলেন। ঘরে পাশাপাশি দুটি ছোট চৌকি। তাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিছানা পাতা। পায়ের কাছ দিয়ে লেপ ভাজ করে রাখা। আর পাতলা করে সুন্দর আঁকিবুঁকির ও দুটো কী? অবাক হয়ে বিছানার আরও কাছে এল পিকলু। অতিথিদের দেখভাল, খাতির-যত্নের স্বতঃপ্রণোদিত দায়িত্ব নিয়ে বনি এখন পিকলুদের সঙ্গে। বুদ্ধিমতি মেয়ে। জিজ্ঞেস করল, ‘কী দেখছ পিকলু, এগুলোকে বলে কাঁথা, কিন্তু নিছক কাঁথা নয়, নকশি কাঁথা। আমার ঠাকুমা-বড়ঠাকুমার হাতে তৈরি। পুরনো কাপড়ের পাড় থেকে সুতো তুলে সেলাই করা। ভীষণ ভীষণ ধৈর্যের কাজ। একেকটা কাঁথা তৈরি করতে দেড়-দু’মাস পর্যন্ত লেগে যায়।বলতে বলতে বনি একটা কাঁথা খুলে দু’জনের সামনে মেলে ধরল। দু’জোড়া চোখের সামনে খুলে গেল বাংলার ঐতিয্যবাহি গ্রামীন শিল্পকর্মের এক নতুন জগৎ। টিউব-লাইটের আলো এসে পড়েছে কাঁথাটার ওপর। পিকলু ভাল করে দেখল, না রঙ দিয়ে আঁকা নয়, নানা রঙের সুতোর কাজে ফুটে উঠেছে পুরো এক গ্রামবাংলা, যা সে এতদিন বইতেই দেখেছে।কী ভীষণ সূক্ষ্ম হাতের কাজ

- ‘অপূর্ব!মিহিরকিরণস্যার মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘এ শুধু নিছক শিল্পকর্ম নয় পিকলু, বনির ঠাকুমা-বড়ঠাকুমার সংসারের প্রতি, গ্রামবাংলার এই প্রকৃতির প্রতি তাঁদের অন্তরের টান, আবেগ-বাৎসল্য-স্নেহভালবাসা  এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। পয়সা দিয়ে এর মূল্য বিচার হয় না।

পিকলু কিছু বলে না, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই আছে শুধু। আরও একটা জিনিসে পিকলু অবাক। এত এত বই! মাটির দেয়ালের গর্তে কাঠের ফ্রেম করে তাকের পর তাক ভরা শুধু বই আর বই। পিকলু ঘুরে ঘুরে তাকগুলোতে চোখ বোলাচ্ছে। বনি পাশে পাশে হাঁটছে। বলল, ‘আমরা বাড়ির সবাই খুব বইয়ের ভক্ত। এগুলোর অধিকাংশই বাবা আর কাকার কালেকশান। ঠাকুরদার কালেকশানের কিছু রেয়ার বইও আছে। তুমি বই পড়তে ভালবাসো না পিকলু?’

- ‘ভীষণ। তবে এত বই আমাদের বাড়ি নেই। প্রতি বছর বইমেলা থেকে বই কিনি। জমাতে জমাতে একদিন ঠিক তোমাদের মতো হবে। কি বল, বনিদি?’

- ‘হ্যাঁ নিশ্চই। নাও, এবার তোমরা একটু বিশ্রাম নাও। পালাগান শুনতে যাবে তো আবার।

- ‘তুমিও যাবে?’ পিকলুর কন্ঠস্বরে আন্তরিকতার ছোঁয়া। সে চায় বনিদিও সঙ্গে চলুক

- ‘আমি? তা যেতেই পারি। বহুবার শোনা। তবুও ভাল লাগে। দুখের কাহিনি!

- ‘না বনিদি, ও তো বনবিবির পালা। মাইকে হাঁকছে, মন দিয়ে শোন।

- ‘দুখেও আছে।

- ‘দুখে কে?’ 

- ‘পালাগান শুনলেই জানতে পারবে।

রহস্য বজায় রেখে বনি নীচে নেমে গেল। পিকলু মোবাইল হাতে বিছানায় এল। , কী আরামই না লাগছে! বাড়িতে পৌঁছসংবাদ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। শুধুই কি পৌঁছসংবাদ?

পিকলুর মন  নানা কথায় উপচে উঠছে। ধূধূ মাঠ, দিকচক্রবালের গা ঘেঁষে গাছেরা  প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে। কিছুতেই ওরা মাটি আর আকাশের মিলনরেখাটিকে  দেখতে দেবে না তাকে। চাষী পুরুষ আর মহিলারা চাষের কাজে ব্যস্ত।ওদের ছেলেমেয়েরা তখন খেলায় মত্ত। ভাটার নদীর হতচ্ছন্ন চেহারা যেমন দেখেছে পিকলু তেমনি জোয়ারের ভরাভারা নদীও। সে নদী পেরোতে  মেশিন বসানো নৌকো ভটভটিতে চড়েছে সে। এই প্রথম ভ্যানরিক্সায় চড়ার মজাই বা বাদ যাবে কেন। অনেক বছরের পুরনো বিশাল গির্জা আর তার সামনের ওই মূর্তি দুটো!এখনও চোখে ভাসছে পিকলুর। বর্ণনা দিতে গিয়ে গলা আটকে আসছে তার। স্যারের নিজেদের বাগানের ফল, ক্ষেতের চালের মুড়ি, মুরগির ডিম খাওয়াও এক নতুন অভিজ্ঞতা। তাদের তো সব কিনে খেতে হয়। মাটির দোতলা বাড়ির কথা তুলে সে নিজেই তার ঠাম্মিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘ভাবতে পার!...’ নকশি কাঁথা দেখে মুগ্ধতার কথা বলে শেষ করতে পারে না। এরমধ্যেই তার যে একটি গুণী দিদি জুটেছে সে কথাও সোহৎসাহে বলল পিকলু। আর বই আর বইয়ের কথা। স্যারের মা-বাবা অর্থাৎ নতুন দাদু- দিদান যে কী ভীষণ ভাল! তাকে খুব আদর-সোহাগ করছেন। একটু বাদেই সবাই মিলে পালাগান শুনতে যাচ্ছে। বনবিবির পালা। পিকলুর দাদু সর্বানন্দ রায় খুশি হয়ে বললেন, ‘দেখে এসো দাদুভাই, এমন সুযোগ সহজে মেলে না।পিকলু খুশি হয়ে ঝট করে বিছানা থেকে নেমে পিছনের এক জানলার কাছে দাঁড়িয়ে মোবাইলটা বাইরের দিকে বাড়িয়ে ধরে, মাইকে পালাগানের প্রচারের কথা বাড়ির সবাইকে শোনায়। জানতে চায়, ঝিকি-মিকি-আলোর কথা। কেমন আছে ওরা!

পাশের বিছানায় মিহিরকিরণস্যার জাস্ট একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে ঘুমিয়েই পড়লেন। তাঁর নাক ডাকার মৃদু ডাক শোনা যাচ্ছে। 

 

- তিন - 

          পালাগানের মাঠ

নিখিলেশস্যার কৃতি ছাত্র ছিলেন। এই অঞ্চলের খুবই জনপ্রিয় মানুষ। তার উপর সম্মানীয় শিক্ষক। এলাকার সাংস্কৃতিক মহলেও বিশেষ পরিচিত তিনি। তাঁর সঙ্গে কলকাতা থেকে  দু’জন পালাগান শুনতে এসেছে। তাদের একজন আবার শিক্ষক। পালাগানের আয়োজকেরা একটু সামনের দিকে বসার ব্যবস্থা করে দিল। বিছানো খড়ের ওপর ছেঁড়াফাটা ত্রিপল পাতা। সামনে মাটি  ফেলে তৈরি মঞ্চ। সামিয়ানা থেকে তিনটে মাউথ-স্পিকার ঝুলছে। মঞ্চের তিন দিক রঙিন শাড়ি আর বিছানার চাদর দিয়ে ঘেরা। দুটি চাদরের ফাঁক দিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মঞ্চে প্রবেশ আর বেরোনোর ব্যবস্থা। মঞ্চের সামনেটা জুড়ে কনসার্ট বাজিয়েরা বসে। মাথার ওপর অনন্ত খোলা আকাশ। সেখানে চাঁদ-তারা কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না পিকলু। কুয়াশা সব গ্রাস করে নিয়েছে। পালাগানের মাঠটুকু বাদ দিলে চারপাশটাকেও ঘন অন্ধকার প্রবলভাবে জাপ্টে ধরেছে। ভেসে আসছে প্রভু যীশুর স্তুতিগানের করুণ সুর। এমন এক পরিবেশের সঙ্গি হতে পারবে কোনওদিন তা ভাবতে গিয়ে অবাক হচ্ছে পিকলু। অথচ মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে সে যেন এখন এক অন্য জগতের একজন হয়ে গেছে

ছেলে আর মেয়েদের আলাদা বসার ব্যবস্থা। দর্শকদের মধ্যে থেকে থেকে একটা উদগ্রীব ভাব। উশখুশ করছে সবাই। মাইকে একটু  বাদে বাদে ছোট্ট করে  ঘোষণা, ‘বন্ধুগন, আপনারা একটু ধৈর্য ধরে বসুন। আমাদের পালা এক্ষুণি শুরু হতে চলেছে। হাতঘড়িতে সময় দেখলেন নিখিলেশস্যার, দশটা বাজতে  এখনও পাঁচ মিনিট বাকি। সে কথা মিহিরকিরণস্যারকে জানাতে তিনি বললেন, ‘এই অঞ্চলের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় দেখছি এই পালাগান, তড় আর সইছে না।

- ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন স্যার, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলোর মনের খোরাক তো এগুলোই। এসব পালাগানের কাহিনির সঙ্গে ওরা ওদের জীবনের সাযুজ্য খুঁজে পায়। বনবিবি হলেন ওদের ঘরের মায়ের মতো। সকল বিপদ-আপদের রক্ষাকত্রী। ওদের বিশ্বাস, বনবিবি অলক্ষ্যে সবার দুঃখ-কষ্ট, ভালমন্দ দেখছেনই শুধু নয় নিবারণের জন্য কাতরও হচ্ছেন।

দু’জনের কথা মন দিয়ে শুনছিল পিকলু, হঠাৎই স্কুলের ঘন্টাটা বেজে উঠল যেন এই মাঠে। মুহূর্তের মধ্যে কনসার্টও বেজে উঠল। তাতে কতরকমের যে বাজনা।গমগম করে উঠল পালাগানের মাঠ। দর্শকরা খুশিতে হইচই করে হাততালি দিয়ে উঠল

একটি অল্প বয়সী ছেলে একটা চেয়ার এনে মঞ্চের একদম পিছন দিকটায় বসিয়ে দিয়ে চেয়ারটাকে সাদা কাপড় দিয়ে মুড়ে দিল। আরেকজন একটি মাটির  মূর্তি এনে ওই চেয়ারটায় বসিয়ে দিয়ে তার গলায় একটা মালা পরিয়ে দিল। মূর্তি বলতে বাঘের পিঠে বসে এক মহিলা, পরণে শাড়ি। তার কোলে বসে   একটি বালক। নিখিলেশস্যার বললেন, ‘উনিই বনবিবি। আর কোলে  বসে আছে যে বাচ্চাটি সে হল দুখে, বড় কষ্টের জীবন ওর।পিকলুর মনে পড়ল বনিদির বলা দুখে-র কথা। আয়োজককদের একজন দ্রুত পায়ে মঞ্চে ঢুকে মাউথ-স্পিকারে বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করল, ‘বন্ধুগন, শুরু হতে চলেছে আজকের পালাগান ‘বনবিবির পালা!ফের একপ্রস্ত কনসার্ট বেজে উঠল। পালাগানের সকল কুশীলবেরা মঞ্চে উঠে বনবিবির মূর্তিটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে জোড়হাত করে গান ধরে,

 

জয় জয় বনমাতা, বনের বিবি,

আঠার ভাটির এই অভাগাদের রচো তুমি বিধিলিপি,

  হৃদয়ে রাখি তোমায় অষ্টপ্রহর পূজি

বাদার দেশের তুমি সকলার মা,

মা মা বলি ডাকিলে তোমায় মোদের বিপদ থাকে না

মাগো তুমি এই অভাগাদের রাখিও  চরণে

যেন তোমার কৃপা পাই জীবনে-মরণে

 

গান শেষ হতে কুশীলব-রা আনত মাথায় বড় করে বনবিবিকে প্রণাম করে। তারপর দর্শকদের দিকে তাকিয়ে ফের একবার প্রণাম করেই দ্রুত পায়ে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়। এতক্ষণ মৃদু লয়ে কনসার্ট বাজছিল, মুহূর্তে তা সপ্তমে চড়ল। মঞ্চে কুশীলব দু’জন প্রবেশ করতেই শুরু হল ‘বনবিবির পালাগান’। নিখিলেশস্যার পিকলুর কানের কাছে মুখ এনে মৃদু কন্ঠে বললেন, ‘ওটা ছিল দেবীবন্দনা গান, অন্যান্য দেবদেবীর প্রতি যেমনটা হয়ে থাকে।

পালাগান চলছে। কুশীলবদের সাধারণ সাজগোজ। সস্তার কসমেটিকে সেজেছে সবাই। তবে অভিনয়ে আন্তরিকতার অভাব নেই। কাহিনি এইরকম,

বনবিবি এই বাদার দেশের সকল ধর্মের মানুষের আরাধ্যা দেবী। তিনি সর্বধর্মের সমন্বয়কারিনি। মন্দির, দেবালয়, থান এমনকী কুলদেবীর আসনেও তাঁর ঠাঁই। এমনই তাঁর মহিমা। কিন্তু কে এই বনবিবি? জনশ্রুতি, এক অভিজাত মুসলিম ঘরের কন্যা তিনি। তাঁর পিতা ছিলেন সুদূর মক্কাবাসী, বেরাহিম ও মাতা গুলালবিবি। এই  বনদেশেই বনবিবির জন্ম, বেড়ে ওঠা। জীবনযাপনে বিলাসিনী হলেও এই বিলাসজীবনই তাঁর সাধন-ঐশ্বর্য। তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তিতে মুগ্ধ বাদার দেশের যত খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ।  বনবিবি তাদের অভয়দাত্রী।তিনি বরাভয় –মূর্তি ধারণ করে গেয়ে ওঠেন,

 

আঠার ভাটির দেশে আমি সবার মা

মা বলি ডাকিলে তার বিপদ থাকে না

বিপদে পড়ি যেবা মা বলি ডাকিবে

কভু তারে হিংসা না করিবে

 

বনের বাঘও তাঁর সাধনশক্তির কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। বাঘের পিঠে বসে তিনি সর্বত্রগামিনী। তাঁর মহিমা এই আঠার ভাটির দেশে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ভাটিদেশের ঈশ্বর দক্ষিণারায় ও তাঁর মা নারায়ণীর সঙ্গে বনবিবির বিরোধ বাধে। ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধের শেষে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়। এরপর থেকে তিন জনই ভাটিদেশে পূজ্য হতে থাকেন

কাহিনি এগিয়ে চলে। পিকলু অধীর আগ্রহী হয়ে ওঠে, কখন দুখের অধ্যায় আসে। বনবিবির কোলের ওই  বালকের কাহিনি শুনতে চায় সে

ধোনাই আর মোনাই দুই ভাই। বরিজহাটি গ্রামে তাদের বাস। সপ্তডিঙা সাজিয়ে তারা চলেছে সুন্দরবনে। মধু সংগ্রহ করতে। ওদের সঙ্গে এক বালক। এক দুখিনী বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান সে। সপ্তডিঙা গড়খালি নদীতে এসে পড়লে ভাটিশ্বর দক্ষিণারায় এই যাত্রা আটকান। ধোনাই-মোনাইয়ের কাছে তিনি নরবলি দাবি করেন, তবেই তাদের মুক্তি। নিরুপায় ধোনাই-মোনাই দুখেকে দক্ষিণারায়ের হাতে তুলে দিয়ে মু্ক্ত হল

অসহায় বালক দুখে প্রাণ বাঁচাতে কাতর কন্ঠে মা বনবিবির কৃপা প্রার্থণা করতে লাগল, কহ মা বনবিবি কোথা রইলে  এই সময়,

 

জলদি করে এসে দেখ তোমার দুখে মারা যায়

কড়ার দিয়াছো মাগো যদি না পালিবে,

ভাটি মধ্যে তোমার কলঙ্ক রয়ে যাবে

 

মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে পিকলুর। চোখে জল আসে। দুখে কি পারবে নিজেকে বাঁচাতে। বনবিবি ওর প্রতি সদয় হবেন তো! ওদিকে মহিলাদের দিক থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। দুখের মুক্তির আশায় সবাই কাতর

বনবিবি, তিনি যে সকলের মা, দুখের প্রার্থণায় তিনি সাড়া দিয়ে আকাশচারিনীরূপে ঘোষণা করলেন, ‘বাছা আমার, ভয়  পাস নে। আমি যে তোদের মা। এ দেহে প্রাণ থাকতে তোর শরীরে আঁচড়টি পর্যন্ত কেউ কাটতে পারবে না। তোকে আমি বাঁচাবই সোনা আমার!

বনবিবি দক্ষিণারায়কে অনেক করে বোঝালেন। কাকুতি-মিনতি পর্যন্ত করলেন। কিন্তু কিছুতেই দক্ষিণারায়ের মন টলল না। নরবলি তার চাই-ই। দুখের  নররক্তে তিনি তাঁর আরাধ্যাদেবীকে সন্তুষ্ট করবেন। যাতে করে এই ভাটিদেশে তিনি আরও আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। 

উপায়ান্তর না দেখে বনবিবি দক্ষিণারায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। সে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। পরাজিত হলেন দক্ষিণারায়। দুখেকে বনবিবির হাতে তুলে দিলেন।দুখের জীবন রক্ষা হল।বনবিবি দুখের জীবন বৃত্তান্ত শুনতে চাইলে  দুখে কেঁদে কেঁদে গায়,

 

এক অভাগিনি বিধবার সন্তান আমি মাগো,

হতভাগ্য দুখে

অন্ধ মাতা আমার, জগৎ-সংসার দেখে না

আমার গায়ে-মুখে দু’হাত বুলায়ে 

অন্তরচোখে সন্তান দেখে, মুখে কথা ফোটে না

ঘরেতে অন্ন নাই, ক্ষুধায় জঠর জ্বলে

ধোনাই-মোনাইয়ের সাথে পাঠায়, যদি কোনও কাজ জোটে

 

মহিলামহলে এবার কান্নার রোল ওঠে। পিকলুর খেয়াল হয় কখন যেন তারও দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নেমেছে

বনবিবির দয়ায় দুখের মায়ের অন্ধত্ব দূর হল, মুখে কথাও ফুটল। প্রভূত বিষয়-সম্পত্তির মালিক হল দুখে

বনবিবির কাছে ধোনাই-মোনাই অপরাধ স্বীকার করল, দুখেকে ওইভাবে বনে ছেড়ে যাওয়া তাদের উচিৎ কাজ হয়নি। বনবিবি তাদের শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা করতে রাজি হলেন, ধোনাইয়ের মেয়ে চম্পাকে দুখের হাতে তুলে দিতে হবে। ধোনাই হৃষ্টচিত্তে বনবিবির এই প্রস্তাব মেনে নিল। ওদের শুভ বিবাহ ধুমধাম করে সম্পন্ন হল। কনসার্টে বেজে উঠল বিয়ের বাজনা। দর্শকরা হর্ষধ্বনি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল, ‘জয় বনবিবি মায়ের জয়, জয় বনবিবি মায়ের জয়!পিকলুর মনেও এখন আনন্দ

গ্রিণরুম থেকে পালাগানের বিবেক গান ধরে মঞ্চে উঠে আসছে,

 

বনবিবি মা, বনবিবি মা গো…

আমরা তোমার পালা গাই

তোমার মহিমার তুলনা যে নাই

মা তুমি আছো সাথে যেদিকেই তাকাই

বছর বছর তোমায় পূজি,

থাকো অন্তরে বারোমাস

তোমার দয়ায় বাঁচি আমরা

তোমারই জয় গাই

বনবিবি মা গো…! 

 

পালাগান শেষ হল। কুশীলবরা মঞ্চে এসে বনবিবি এবং সকল দর্শকদের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাল সবাই এখন ঘরমুখি। ছোট বড় দল বেঁধে ফিরছে। ফলে একত্রে অনেক আলোয় রাস্তাঘাট দেখতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। ঘড়িতে সময় দেখলেন নিখিলেশস্যার, পাক্কা বারোটা। কথা ছিল পালা শেষে রাস্তার পাশের ধর্মঠাকুরের থানের কাছে সবাই একত্রিত হবে। বনির  ফেরার জন্য অপেক্ষা করছেন ওঁরা। বনি ওর বান্ধবিদের সঙ্গে গল্প করতে করতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে এসে বনি পিকলুর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল, ‘পালাগান কেমন লাগল পিকলু?’

- ‘খুব ভাল। বনবিবির পাশাপাশি দুখের চরিত্রটা কিন্তু ভীষণ টাচি। অতটুকু ছেলে কী দারুণ অভিনয় করল।

- ‘তুমি কি কেঁদেছ?’

- ‘কই না তো!ধরা পড়ে  যাওয়ার বিস্ময় নিয়ে পিকলু জিজ্ঞেস করল, ‘কী করে বুঝলে?’

-‘তোমার চোখমুখ বলছে। চোখ দুটো এখনও লাল হয়ে আছে। আমিও কেঁদেছি। এতবার দেখেও ধাতস্ত হতে পারিনি।

- ‘আমিও পারব না।

ওরা দু’জনে কথা বলতে বলতে আগে আগে চলেছে। পিছনে মিহিরকিরণস্যার আর নিখিলেশস্যার। ওঁদের আলোচনার বিষয় এই অঞ্চলের লোকসংস্কৃতি

ঘুরতে এসে একটু অনিয়মকেই প্রশ্রয় দেন মিহিরকিরণস্যার। যেহেতু এখানে পৌঁছে এক প্রস্ত যথেষ্ট খাওয়া হয়েছে তাই রাতের খাওয়াটা পিছিয়ে দেন। অর্থাৎ পালাগান দেখে এসে রাতে খাওয়া সারবেন। আপত্তি ছিল না কারোর। নিখিলেশস্যারের মা-বাবা তাঁদের সময়মতো খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছেন। এক ছড়া চাবি নিখিলেশস্যার সঙ্গে রেখেছেন। বনি তাঁদের সবাইকে খেতে দেওয়ার আয়োজন করছে দেখে মিহিরকিরণস্যার বললেন, ‘তুমিও আমাদের সঙ্গে বসে পড় বনি, সবাই মিলে একসঙ্গে খাব।

- ‘তা হয় না স্যার। আপনাদের দেওয়াথোওয়া সেরে তবে আমি খেতে বসব।

- ‘খুব হবে বনিদি। তুমি সব খাবার এখানে নিয়ে এসো। আমরা সবাই মিলে ব্যুফেসিস্টেমে খাব।

পিকলুর কথায় সবাই হেসে উঠলেন। সমর্থণ জানিয়ে নিখিলেশস্যার বললেন, ‘তাই হোক।

বনি বলল, ‘শহরে অনুষ্ঠানবাড়িতে তো শুনি এখন এই সিস্টেমই চলছে।

বনি সব খাবার এক জায়গায় করতে লাগল

(ক্রমশ)