পাবলো খবরটা পেয়েই পড়া ছেড়ে উঠে চলে গেল মন্দিরে। গিয়ে শুনল প্রত্যেকদিনের মতোই আজও পুরুতকাকু মন্দিরে পূজো করতে গিয়েই দেখতে পেলেন কালিপ্রতিমা কিরকম ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে। ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলেন নাকের নথ, কানের দুল, হাতের চুড়ি কিছুই নেই। পাবলো মন্দিরের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে প্রতিমার কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখল, হ্যাঁ সত্যি সত্যিই বেশ কয়েকটা গয়না নেই। প্রতিমার আরও কাছে চলে গেল পাবলো। গিয়ে বুকভরে জোরে জোরে শ্বাস নিল আর ঠিক তখনই পুরুতকাকু আর কয়েকজন বয়স্ক লোক ওকে ধমকে উঠল, “এই পাবলো, তুই ওখানে কি করছিস? চলে আয়।" পাবলো ধমক খেয়ে চলে এল ওখান থেকে। মণিরামপুরের লোকজন ঠিক করল মন্দিরের দরজায় তালা দেওয়া হবে আর তাড়াতাড়ি পুলিশে খবর দিতে হবে যাতে করে চোর চুরি করে বেশি দূরে যেতে না পারে। পুলিশ এসে সব দেখে, শুনে জিজ্ঞাসা করে জানল যে রাতে মন্দির বন্ধই থাকে আর চাবি থাকে মন্দিরের পুরোহিতের কাছেই। পুলিশ প্রাথমিকভাবে পুরুতকাকুকেই সন্দেহ করল আর তাকে ধরে নিয়ে গেল জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য।
এদিকে পাবলো মনে মনে ঠিক করে নিল কালিঠাকুরের প্রতিমার কাছে যে গন্ধটা পেয়েছিল সেটা তার মনে রেখে খুঁজে বের করতে হবে এর উৎসটা কোথায়। সে ভাবল একদম একা একাজ হবে না, তাই তার বন্ধু বাবলুকে গিয়ে বলি কারণ বাবলুই একমাত্র তার এই অদ্ভুত ক্ষমতার কথাটা জানে। বাবলুকে গিয়ে পাবলো বলল, “বাবলু, আমার মনে হয় ঐ গয়না গুলো পুরুতকাকু নেয়নি বুঝলি।" বাবলু তার স্বভাবসিদ্ধ কেজো ভঙ্গিমায় প্রথমেই সরাসরি জানতে চাইল, “তুই কি তোর ঘ্রাণশক্তি ব্যাবহার করে বলছিস নাকি অনুমান করে বলছিস?” পাবলো বলল, “না আমি অনুমান করে বলছি না।" সঙ্গে সঙ্গে বাবলু তুড়ি মেরে বলল, “ও ঘ্রাণশক্তি কাজে লাগিয়ে বুঝতে পারছিস, তাহলে আর কোনও চিন্তা নেই, ঐ গয়নাও উদ্ধার হবে আর চোরও ধরা পড়বে।" পাবলো অবশ্য খুব সাবধানী, সে বলল, “না না এত নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে ওগুলো উদ্ধার হবেই।" বাবলু অতি উৎসাহে বলে উঠল, “চল্ তাহলে এখনই লেগে পড়ি।" পাবলো প্রথমে ভেবেই পাচ্ছিল না কোনখান্ থেকে শুরু করবে। বাবলুই তাকে পরামর্শ দিল, “চল্ প্রথমে আমরা পুরুতকাকুর ঘরটা থেকেই শুরু করি।" মন্দির সংলগ্ন ঘরটায় পুরুতকাকু একাই থাকেন, সেখানেই ওরা প্রথমে গেল। ঘরের দরজা আলগাভাবে ভেজানো ছিল, ঠেলা দিতেই খুলে গেল। ঘরে ঢুকে কিছু জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে দেখছিল পাবলো, ঠিক তখনই আবার হঠাৎ করে এসে পড়ে রাজেনজ্যাঠা ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, “এই ভিতরে কে রে?” তখন বাধ্য হয়ে ওরা বেরিয়ে এসে বলল, “জেঠু আমরা।“ রাজেনজ্যাঠা অবাক হয়ে বলে উঠলেন, “আ্যঁ সেকি! তোরা কি করছিস ওখানে? বেরিয়ে আয়।“ ওরা অগত্যা বেরিয়ে এল আর বাবলু বুদ্ধি করে বলল, “আমরা প্রসাদ খুঁজছিলাম, রোজ পুরুতকাকু আমাদের প্রসাদ দেয় তাই।“ এতে রাজেনজ্যাঠা হেঁসে উঠে বললেন, “ও এই ব্যাপার, আজ ওখানে কোনো কিছু পাবি না, তোরা বাড়ি যা।“ পাবলো আর বাবলু যেন হাপ ছেড়ে বাঁচল যে রাজেনজ্যাঠা কিছু বুঝতে পারেনি। আসলে পাবলো একদমই চায় না যে কেউ ওর এই ঘ্রাণশক্তির কথা জানতে পারুক।
পাবলোরা বাইরে বেরিয়ে এসে একটা গাছতলায় এসে বসল। বাবলু জিজ্ঞেস করল, “কিরে কিছু বুঝতে পারলি?” পাবলো মাথা নেড়ে বলল, “না সেরকম কিছু বুঝতে পারলাম না। আমি মন্দিরে যে গন্ধটা পেয়েছিলাম সেই গন্ধটা আর কোথাও পাচ্ছিনা। পুরুতকাকুর ঘরেও না।“ বাবলু বলল, “কিন্তু পুলিশ তো পুরুতকাকুকে নাকি লক আপে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছে, পুলিশ ভাবছে যেহেতু পুরুতকাকুর কাছেই চাবি ছিল আর মন্দিরের তালা ভাঙা হয়নি তাই পুরুতকাকুকে জেরা করলেই সব খবর পাওয়া যাবে। আমাদের নির্দোষ পুরুতকাকুকে বাঁচাতেই হবে।“ পাবলোও একমত হল আর বলল, “চল্ আর একবার মন্দিরে যাই, যদি কিছু জানা বা দেখা যায়।“ বাবলু বলল, “কিন্তু মন্দির তো বন্ধ রাখা হয়েছে, কাউকেই তো ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।“ পাবলো বলল, “হ্যাঁ ঠিকই তবে আমরা মন্দিরের চারপাশটা একবার ঘুরে দেখি চল্।“ ওরা এসে দেখল মন্দিরের দরজায় তালা ঝুলছে আর মন্দির চত্বর একদম ফাঁকা। এই সুযোগে পাবলো গেটের কাছে গিয়ে শুঁকে দেখল ভালো করে, না সেই গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে না। খানিকটা হতাশ হয়ে বাবলু বলল, “তাহলে কি আমরা চুরির রহস্য ভেদ করতে পারব না?” পাবলো কিন্তু শুঁকতে শুঁকতে মন্দিরের পিছনে চলে এল। এসে বলল, "আরে বাবলু, আমি সেই গন্ধটা পাচ্ছি।" বাবলু উৎসাহিত হয়ে বলল, “গন্ধটা লক্ষ করে এগোতে থাক্, তারপর দেখা যাক কি হয়!" পাবলো গন্ধটা শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে মন্দিরের পিছনের দেওয়ালে এসে থেমে বলল, “বাবলু আমার মনে হচ্ছে গন্ধটা দেওয়ালের ভিতর থেকেই আসছে।“ বাবলু তা শুনে হতাশায় ও ক্ষোভে ধ্যাৎ বলে একটা জোরে ঘুষি মারল মন্দিরের দেওয়ালে, আর কি আশ্চর্য! দেওয়ালের একটা ইট ফট্ করে ভিতরে ঢুকে গেল। ওরা দুজনেই চমকে উঠল। পাবলো বলল, “পরের ইটটাতেও মেরে দেখ্ তো।“ আবার বাবলু একটা জোরে ঘুষি মারল, আর পরের ইটটাও একইভাবে ভিতরে ঢুকে গেল। এরকম করে ঠিক ছটা ইট নড়ে গিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল আর একটা ছোট গোলাকার গর্ত তৈরি হল। ওরা তখন ভাবল ভিতরে ঢুকবে, কিন্তু আবার এও ভাবল যে কেউ যেন না ওদের দেখতে পায়, তাহলে আবার ওদেরই চোর ভেবে বসবে। ফলে খুব সতর্ক হয়ে চারদিকে ভালো করে দেখে ওরা একে একে ভিতরে ঢুকে গেল। ভিতরের অন্ধকারে সেরকম বিশেষ কিছুই অবশ্য চোখে পড়ল না ওদের। কিছুক্ষণ সেখানে দেখে নিয়ে হতাশ হয়ে যেই বেরিয়ে আসতে যাবে হঠাৎ বাবলুর পায়ে কি একটা ঠেকল, অন্ধকারে ভালো বুঝতে না পারলেও সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বাইরে এসে দেখল সেটা একটা মিস্ত্রিদের প্লায়ার্স বা প্লাস। পাবলো সেটা হাতে নিয়ে ভালো করে শুঁকে বলল, “হ্যাঁ এই গন্ধটাই মন্দিরে প্রতিমার কাছে সকালে পেয়েছিলাম।“ বাবলু বলল, “এর থেকে বোঝা যাচ্ছে চোর একজন মিস্ত্রি।“ পুরুতকাকুর কাছে যদি জানতে পারা যেত যে গতকাল কারা কারা মন্দিরে এসেছিল, কিন্তু পুরুতকাকু তো এখন থানার লক আপে সেখানে তো যাওয়া কোনমতেই সম্ভব না আমাদের পক্ষে।“
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে ওরা বাড়ি ফেরার উদ্যোগি হল, নয়তো আবার বকুনি খেতে হবে। ফিরতে ফিরতে বাবলু মন খারাপ করে বলল, “আমরা মনে হয় চুরির কিনারা করতে পারলাম না পাবলো।“ পাবলোও বিষন্ন মনে বলল, “দেখি পুলিশ কবে চোর ধরতে পারে, আমাদের তো আর কোনও উপায় নেই।“ আর এই বলে ওরা যে যার বাড়ি চলে গেল। বাড়ি এসে পাবলো দেখল তাদের বাড়িটা অন্ধকার হয়ে হয়ে আছে। পাবলো দেখল ওদের দরজা খোলা কিন্তু কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। তখন মাকে দুবার ডাকতেই ওর দিদি টর্চ হাতে এসে বলল, “নে পাবলো এসে গেছিস যখন তুই আলোটা ইলেক্ট্রিশিয়ানকে দেখা।“ পাবলো জিজ্ঞেস করল, “কেন, কি হয়েছে?” ওর দিদি বলল, “আমাদের বাড়ির লাইনে কোনো ফল্ট হয়ে কারেন্ট চলে গেছে তাই মিস্ত্রিকে ডাকা হয়েছে, যা তাড়াতাড়ি টর্চটা নিয়ে যা।“ পাবলো টর্চটা নিয়ে ভিতরে গিয়ে দেখল একটা রোগা ঢ্যাঙা মতো লোক ওদের মেন সুইচের কাছে ফিউজ বক্সের মধ্যে টেষ্টার দিয়ে লাইন চেক করছে। লোকটা ফিউজ বক্সের তারগুলো আর ফিউজগুলো যখন দেখছিল তখন পাবলোর হঠাৎ মনে হল সেই চেনা গন্ধটা যেন পাচ্ছে। সে লোকটার কাছে একটু এগিয়ে গিয়ে ভালো করে গন্ধ শুঁকল হ্যাঁ একদমই সেই গন্ধটা। পাবলোর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তাহলে কি এই লোকটাই মন্দিরে ঢুকে গয়না চুরি করে প্লায়ার্স ফেলে পালিয়েছিল? একবার ভাবল লোকটাকে জিজ্ঞেস করবে যে তার কি প্লায়ার্সটা হারিয়ে গেছে। কিন্তু আবার ভাবল যদি এই প্রশ্নটা করলে সে বুঝতে পারে যে তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে তাহলে সে পালিয়ে যাবে ফলে তাকে আর ধরা যাবেনা। এইসময় বাবলু থাকলে ভালো হত। যাইহোক, এইসব ভাবতে ভাবতেই লোকটা মেনসুইচের কাছে ফল্টটা সারিয়ে ফেলল আর সব লাইট জ্বলে উঠল। আলোতে পাবলো ভালো করে দেখল লোকটাকে, আরে! এতো ওদের পাড়ার ইলেক্ট্রিকের দোকানেই থাকে। পরে পাবলোর মা এসে লোকটার মজুরি মিটিয়ে দিতে সে চলে গেল। আর পাবলো বাবলুর থেকে একটা নোটের খাতা আনার নাম করে বেরিয়ে গিয়ে লোকটাকে অনুসরণ করতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরেই দেখল লোকটা একটা নির্মিয়মান অন্ধকার বাড়িতে ঢুকে গেল। আস্তানাটা দেখে নিয়ে পাবলো সোজা বাবলুকে গিয়ে সব বলল। বাবলু তক্ষুণি লাফ দিয়ে উঠে বলল, “তাহলে চল্ এখনই পুলিশকে গিয়ে সব বলি।" পুলিশের নাম শুনেই পাবলো একটু নার্ভাস হয়ে গেল। কিন্তু বাবলু একটুও ভয় না পেয়ে বলল, “পাবলো দেরি করলে যদি লোকটা পালিয়ে যায়, চল্ এক্ষুণি পুলিশকে সবকথা খুলে বলি।“ পাবলো বলল, “কিন্তু পুলিশ যদি জিজ্ঞেস করে তোমরা কি দেখে লোকটাকে সন্দেহ করছো, তখন কি বলবি?” বাবলু বলল, “তখন সব বলে দেব যে তুই গন্ধ শুঁকেই নিশ্চিত হয়েছিস।“ পাবলো এই কথা শুনেই বেঁকে বসল, “না আমি এইকথা কাউকেই জানাতে চাইনা।" তখন বাবলু অনেক বুঝিয়ে বলল, "কিন্তু এইকথাটা না বললে পুলিশ কোনও সাহায্যই করবে না ফলে চোরও পালিয়ে যাবে আর পুরুতকাকুও থানায় আটকে থাকবে। তাই আর দেরি না করে এখনই চল্।“ অগত্যা অকাট্য যুক্তির চাপে পড়ে পাবলো রাজি হল আর দুজনে থানায় গিয়ে সবকথা খুলে বলল। পুলিশ অফিসার প্রথমে আজগুবি গল্প বলে হেঁসেই উড়িয়ে দিল, কিন্তু বারবার ওদের চাপাচাপিতে আর যুক্তিতে শেষে রাজি হয়ে কয়েকজন কনষ্টেবল নিয়ে পাবলোর দেখিয়ে দেওয়া নির্মিয়মান বাড়িটাকে ঘিরে ফেলল। তারপর পিস্তল উঁচিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। ঢুকে একদম শেষের কোণার ঘরে দেখল একটা লম্ফের আলো জ্বলছে আর তিনটে লোক বসে তাস খেলছে। পুলিশ অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রায় বিনা প্রতিরোধে সবাইকে পাকড়াও করল। তারপর তল্লাশি করে কোথাও কিছুই না পেয়ে যখন পুলিশ অফিসার বিরক্ত হয়ে পাবলো আর বাবলুকে তিরস্কার করছিল, ঠিক তখনই পাবলো গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে একটা দেওয়ালের কাছে এসে বলল, “আমি এখানে একটা গন্ধ পাচ্ছি, এখানটা ভেঙে দেখা দরকার।“ তখন দুজন কনষ্টেবল দুটো ইট দিয়ে ঠুকতেই ফাঁপা জায়গায় একটা তাক পাওয়া গেল। আর সেই তাকে টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল কালিঠাকুরের গয়না গুলো জ্বলজ্বল করছে।