ছোটবেলায় আমরা কার্টুন দেখতাম, কমিকস্ বইতে সচিত্র পড়তাম ‘সিন্ধবাদের কাহিনী’। তখন স্বপ্নেও ভাবিনি যে পেশাগত কারণে এদেশে বাস করব। দীর্ঘদিনের লালিত মানসিকতায় মনে মনে এই সুলতান শাসিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি নিয়ে অজ্ঞানতা ছিল, সামান্য অস্বস্তি। যখন ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারীতে ওমানের রাজধানী মাস্কাটে পা রাখি, আমার জন্য অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। মধ্যপ্রাচ্যের এক মুসলিম দেশ, যেখানে মহিলারা নৌবাহিনী, বায়ুসেনাতে কাজ করছেন মাথা উঁচু করে। কোনরকমে নিষেধাজ্ঞা নেই! ১৮৫৬ সালে উত্তরাধিকার নিয়ে কোন সমস্যা হওয়ায় ওমানকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। ওমান ও জাঞ্জীবার। ওমানীরা দেখতে মিশ্র। প্রচুর জাঞ্জীবারী থাকে। বেঁটেখাটো, কালোকুলো জাঞ্জিবারীরা এরা কি যে ভদ্র, চাক্ষুষ না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ওমানে প্রচুর বালোচ আছে। বহু আগে এরা বালুচিস্তান থেকে এসেছিল। ওমানেই সেটেলড্ হয়ে গেছে। কথিত আছে যে একবার প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনের সাথে যুদ্ধ হয়। তখন পাকিস্তান থেকে সৈন্য এসেছিল ওমানে। যুদ্ধশেষে তারা ফিরে যায়নি। আমার মনে হয়েছিল, একি পৃথিবীর কোন অংশ না স্বর্গ বলে কিছু থাকলে, তা এই দেশ। শান্তি ও পরিচ্ছন্নতার নিরীখে ওমান বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে অন্যতম। অথচ ১৯৮০ সালের আগে ওমান এক অনুন্নত দেশ ছিল। এক বিশাল পরিবর্তন এলো সুলতান বিন মহম্মদ যখন শাসনভার গ্রহণ করলেন। খনিজ তেলের সম্পদ তো ছিলই, আধুনিক ব্যবস্থায় রূপায়ণ ঘটতে লাগল দ্রুতগতিতে আর ওমান রূপান্তরিত হল এক আধুনিক, পরধর্মসহিষ্ণু, উদার দেশে। যেখানে একনায়কতন্ত্র চলে, কিন্তু স্বৈরাচারীতা নয়। যেখানে ক্রাইম নেই বললেই চলে। রাত বারোটায় গা ভর্তি গয়না পরে রাস্তায় নিরাপদে ঘোরা যায়। ছিনতাই, শ্লীলতাহানি ওমানে হয় না। আজ ১৫ বছর হল বাস করছি, একটি ঘটনাও শুনিনি। বিশ্বাস হচ্ছে নাতো! না হবারই কথা। দুটো মন্দির, কৃষ্ণমন্দির ও শিবমন্দির, বড় ক্যাথিড্রাল ওমানে পরধর্মের প্রতি উদারতার নির্দশন। শিবমন্দিরের ভেতরে বাঙালীরা দূর্গাপুজা পালন করেন। অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠা সহকারে ছোট্ট প্রতিমার মূর্তিকে পুজো করা হয়। মন্দির স্থাপনে ও ভারতীয়দের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজের জন্য গুজরাতীদের অবদান প্রচুর। ভারতের গুজরাট উপকূল থেকে সমুদ্রপথে কচ্ছী ব্যবসায়ীরা ওমানে আসে ও নানা ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে। পুরনো মাস্কাট আর নতুন মাস্কাট, দু’ভাগে মাস্কাট নগরী।
বন্দর মাত্রাতে [Matrah] জাহাজ, সুলতানের নিজস্ব জাহাজ, রণপোত নোঙর করা থাকে। দেখা যায় কাঠের তৈরী পুরনো নৌকো। একটু দূরেই প্রাসাদ, মিউজিয়াম, গুরুত্বপূর্ণ অফিস। কোলাহল নেই। এক আশ্চর্যজনক শান্ত, নিঃশব্দ স্থান। পুরনো মাস্কাটে পুরনো আমলের বাড়িঘর দেখা যায়। মনে হয়, সময় থেমে আছে এখানে। অনতিদূরে এক জেলে গ্রাম সিদাব, পাশেই মারিনা। যেখান থেকে গভীর আরবসাগরে ভ্রমণ করে ডলফিনদের নাচানাচি দেখতে বোট ভাড়া পাওয়া যায়। শ’য়ে শ’য়ে ডলফিনরা লম্ফঝম্প করে, যা কিনা মনে রাখার মত দর্শনীয়। পুরো ওমান নাতিউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা। সমুদ্র ও রুক্ষ পাহাড়ের মিশেল সৌন্দর্য্য, যাতে শান্তির প্রলেপে মোড়া। মাস্কাট থেকে ৭৫ কিমি দূরে কুরিয়েত ড্যামটি এক জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্থান। এটি ‘ওয়াদি ডেখা’ নামেও পরিচিত। কৃষিকাজের জন্য এই ড্যামের জল ব্যবহৃত হয়। ওমানে বছরে হাতে গোণা কদিন বৃষ্টি হয়ে থাকে। পাহাড় থেকে নেমে আসা সেই বৃষ্টির জল ভীষণ প্রলয়কারী হয়। কুরিয়ত ড্যামে বৃষ্টির জল সংগৃহীত হয়। ভারী মনোরম উদ্যান।
মাস্কাট থেকে ১৫৫ কিমি দূরত্বে অবস্থিত ‘নিজওয়া’ [Nizwa] এক পুরনো ঐতিহাসিক নগরী। উত্তর ওমানের এই নগরী একদা রাজধানী ছিল। নিজওয়া ফোর্ট, পুরনো ‘সুক’ [souq] দর্শনীয় স্থান। এছাড়া খেজুর গাছে ঘেরা মরুদ্যান ও উচুঁ পর্বতশ্রেণী নিজওয়ার আকর্ষণ। ‘জাবাল আখতার’ ও ‘জাবাল শামস’ এমনি হিলস্ স্টেশন। ‘আল হাজার’ পর্বতশ্রেণীর অন্তর্গত জাবাল আখতার এক রমণীয় স্থান। ‘জাবাল আখতার’ মানে সবুজ পাহাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০ মিটার উপরে জাবাল আখতারে প্রচুর গোলাপ, এপ্রিকট চাষ হয়। আমরা গত ডিসেম্বরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। অক্টোবর থেকে মার্চ, ওমানের ওয়েদার আরামদায়ক থাকে। প্রচুর ট্যুরিস্ট আসে বেড়াতে।
‘জাবাল শামস’কে [Jabel Shams] মধ্যপ্রাচ্যের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বলা হয়। ওয়াদি গুল, ক্যানিয়নটি হাজার পর্বতশ্রেণীর মাঝখানে অবস্থিত। ৩০০ বছর আগের ওমানী গ্রাম, সরু বিপজ্জনক পথে গাধা বা খচ্চরদের পিঠে চাপিয়ে মালপত্র আনা নেওয়া হত। ওমানের আরেক বিস্ময় ‘আল হুতা কেভস’। কয়েক হাজার বছর আগের এই গুহাকে আবিষ্কার করে স্থানীয় মানুষজন। জাবাল শাম পর্বতের নিচেই এই গুহা। এসিডিক জলে লাইমস্টোন দ্রবীভূত হয়ে তৈরী হয়েছে এই প্রকৃতির বিস্ময়। খনিজ দ্রব্যের বিভিন্ন আকার আকৃতিতে সিলিঙ থেকে ঝুলে থাকা স্ট্যেলেকটাইটস ও স্ট্যলেগমাইট দেখা যায়। বেশ কটি চেম্বারে গুহাটিকে বিভক্ত করা হয়। ফসিল ও বিভিন্ন ক্রিস্টাল দৃশ্যমান। নিজওয়া থেকে অনতিদূরে বাহলা ফোর্ট। সবচেয়ে পুরনো ফোর্ট ওমানের। ১৩শ শতাব্দীর এই ফোর্ট ইউনেস্কো হেরিটেজ সেন্টার। বাহলাকে ‘ব্ল্যাক ম্যাজিকে’র শহর বলা হয়। মদিনাত-আল-শহর। কথিত আছে, এখানে ‘জীন’রা ঘোরাফেরা করে। এখানে ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা হয়। যদিও সরকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বহুপূর্বে কাউকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছিল। নানারকম গাঁথা শোনা যায় এই নিয়ে। Sur, ‘সুর’ আরেক পুরনো ওমানী শহর। এখানে টার্টেল বীচ বিখ্যাত। সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হল দিগন্ত বিস্তারিত বালিয়াড়ি। ওয়াইবা স্যান্ডডিউনস্ [Wahiba Sanddunes]. কয়েকতলা উচুঁ বালির পাহাড়, তাতে ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি নিয়ে খাড়া সেসব পাহাড়ে চড়া ও নামা! এক দুঃসাহসী খেলা বটে! তাঁবু নিয়ে অনেকে রাতে থাকেন। সুর-এ ওমানের অন্য উপজাতিরা, বেদুইনরা বসবাস করে।
সুর থেকে ২০কিমি দূরে [Qalhat] কালহাত গ্রামের উল্লেখ ইবন বতুতার বইয়ে আছে। বেশ কবার ভূমিকম্পে এই প্রাচীন বন্দর নগরী ধ্বংস হয়। বিবি মরিয়মের সমাধি অন্যতম। বিবি মরিয়ম হরমুজ সাম্রাজ্যের রাজা বাহা আল-উদ্দীন আয়াজের বেগম ছিলেন। এই সৌধ আজও ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে কালহাত, একদা বন্দর নগরী তথা রাজধানীর গৌরব বহন করছে। মার্কো পোলো এই নগরীর প্রশংসা করেছেন। একদা সমৃদ্ধ ঝকঝকে নগরী মৃত হয়ে যায় কালের প্রলেপে। রাজধানী মাস্কাট স্থানান্তরিত হয়। ওমান ধীরে ধীরে শক্তিশালী অথচ শান্তিপূর্ব দেশে পরিণত হয়।
|