সকালবেলা দুজন
কনস্টবল নিয়ে যতীনদারোগা বার হলেন কচুবেড়ের পথে। সরকারি একটা লঞ্চ দেওয়া আছে
থানাতে। এটা নিয়ে সব দ্বীপে যাতায়াত করে অফিসার, ফোর্স। থানা থেকে দ্বীপগুলোর দূরত্ব খুব একটা
কম নয়। প্রশাসনিক কাজে বিস্তর অসুবিধে হয়। কোন জায়গায় কোন অস্বাভাবিক মৃত্যু
হলে তার সদ্গতি করতে মুশকিল হয় খুব। থানা থেকে লঞ্চে করে যাওয়া। সুরতহাল করে
মৃতদেহ থানায় নিয়ে আসা। সেখান থেকে পোস্টমর্টেম করার জন্য সদরে পাঠানো। দুটো
তিনটে দিন পথেই কেটে যায়। অন্যান্য জায়গার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও গোসাবা
অঞ্চলের লোকেদের যে কি অসহনীয় দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হয়, তার খবর সরকারের
কাছে থাকলেও সুরাহা হয়নি আজও পর্যন্ত।
গোসাবা থানায়
জয়েন করার পর দু'বার মেজবাবুর
সাথে কচুবেড়িয়া গ্রামে গিয়েছেন যতীনদারোগা। কিন্তু কখনো কেস তদন্ত করতে একাকি
যাননি।তাই থানা ছেড়ে বের হবার আগে বড়বাবু ভালো করে বুঝিয়ে বলে দিলেন। মন্টুবাবু
তার অভিযোগপত্রে যাকে যাকে সাক্ষী হিসেবে মেনেছে, তাদেরকে আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করা থেকে
শুরু করে তা ডায়রীতে নথিভুক্ত করতে বলেছেন বড়বাবু। আসামি পলাশের ব্যাপারে
খোঁজখবর নিতে বলেছেন। ধারে কাছে পেলে অ্যারেস্ট করে থানায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন।
সাবধান করে দিয়েছেন যেন কোন মতেই মন্টু মাস্টারের ফাঁদে না পড়তে।
একবছরে বড়বাবু
মোটামুটি এলাকার লোকজনদের সম্বন্ধে একটা ধ্যানধারণা তৈরি করে নিয়েছেন। তাঁর
অভিজ্ঞতায় যেন কেমন একটা সন্দেহের দানা বেঁধেছিল। মাস্টারমশাইয়ের অভিযোগ
সম্বন্ধে কেমন যেন একটা সন্দেহের আবরণ তৈরি হয়েছিল তার মনে। কারণ তিনি খোঁজ
পেয়েছিলেন পলাশ হলো সুরেশ দাসের ছেলে। সুরেশ দাস হলো মন্টু দাসের বড় ভাই। বছর
দেড়েক আগে কচুবেড়ের ঘাটের কাছে পাওয়া গিয়েছিল সুরেশ দাসের লাশ। গায়ে ছিল
আঘাতের অসংখ্য চিহ্ন। ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছিল তাকে। কে বা কারা
তাকে এমন নৃশংসভাবে খুন করেছে, কেন তাকে খুন হতে হয়েছে, কারা, কখন তাকে খুন করেছে, এ নিয়ে বিস্তর তদন্ত করেছিলেন মেজবাবু। রহস্য উদ্ঘাটনের
জন্য তার সমস্ত বিদ্যে বুদ্ধি প্রয়োগ করেছিলেন তিনি। এমনকি সোর্সের পিছনে বিস্তর
টাকা ঢেলেছিলেন। কিন্তু সে রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি।
যতীন দারোগা এসব
খবর জানেন না। জানার কথাও নয়। বড়বাবু ইমতিয়াজ খান যতীন দারোগাকেও বলেননি কথাটা।
কারণ তদন্ত করার আগে তার মাথায় যদি কোনো ধারণা দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেদিকে
ধাবিত হতে পারে যতীনদরোগার তদন্ত। সেখান থেকে বার হতে পারবে না কিছুতেই। তিনি যা
বলেছেন তার উপর জোর দেবে বেশি। তাই সবকিছু জেনেও ব্রহ্মার মত নিশ্চুপ ছিলেন
বড়বাবু।
সুরেশ দাস
মার্ডার কেসে সন্দেহজনকভাবে দুইজনকে ধরেছিলেন মেজবাবু। বিনীত আর সেলিমকে। একজনের
বাড়ি বিহারে, অন্যজনের বাড়ি
মগরাহাটে। কারণটা ছিল কলকাতা থেকে ফেরার সময় সুরেশবাবুর সঙ্গে একই নৌকাতে ছিল ওরা
দুজনে। দুজনেই নামকরা খুনে। আধুনিক ভাষায় সুপারি কিলার। মোটা টাকা পেলে নিজের
বাপকেও খুন করতে বাধে না। অনেক কষ্ট করে ফাঁদ পেতে, বড়বাবুর সাথে শলাপরামর্শ করে ওই দুজনকে
ধরেছিলেন মেজবাবু।কিন্তু মুখ রক্ষা হয়নি। প্রচুর মারধোর খাবার পরেও কোন কথা মুখ
দিয়ে বের হয়নি তাদের। যে নৌকাতে করে সুরেশ দাস সহ ওরা দুজনে ফিরছিল কচুবেড়ে
অভিমুখে, সেই মাঝিও খুন
হয়েছিল ওরা ধরা পড়ার দিন।
ঠিক একইভাবে নদীর
চরে পাওয়া গিয়েছিল পরান মাঝির লাশ। তাতে মন্টু মাস্টারের কি আস্ফালন! থানা ঘেরাও
করে বড়বাবুকে বলেছিল– আপনার রাজত্বে আমরা কি সুস্থ, স্বাভাবিক, শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচার আশা ত্যাগ করব? আমরা এত বলা
সত্বেও কেন ধরছেন না আসামীদের? কেন আমার দাদা পরান মাঝির মত গরীব মানুষেরা সুবিচার পাবে না? খুনীরা মাথা উঁচু
করে সমাজে বাস করবে, আর আপনারা পয়সা
খেয়ে চুপচাপ থাকবেন, এরকম কতদিন চলবে? এরকম হাজার
প্রশ্নবানে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল পুলিশ প্রশাসনকে। বিধ্বস্ত করে তুলেছিল
বড়বাবুকে।
আসলে এফ.আই.আর-এ
যাদের নাম দেওয়া হয়েছিল,
সেই নামগুলো যে
সঠিক নয় তা তদন্তে গিয়ে বড়বাবু বুঝতে পেরেছিলেন। তবুও অনুনয়-বিনয় করে তাদের
বললেন– আপনারা দয়া করে কোর্টে সারেন্ডার করুন। বড়বাবুর আবেদন অগ্রাহ্য করতে
পারেনি তারা। তদন্ত শেষে দোষ খুঁজে না পেয়ে কেস থেকে তাদের নাম বাদ দিয়েছিলেন
তিনি। সেকথাও বার বার শুনতে হয় বড় বাবুকে।
সুরেশ দাস যখন
খুন হলেন তখন পলাশের বয়স হবে বছর বারো। গোসাবা হাইস্কুলের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র
ছিল পলাশ। কখনো ক্লাসে দ্বিতীয় হয়নি। অকালে বাবাকে হারিয়ে কেমন যেন একাকিত্বের
মধ্যে পড়ে গেল। প্রাণচঞ্চল ছেলেটা হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল। নিজেকে যেন কেমন সংকুচিত
করে ফেলল। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব
জলাঞ্জলি গেল। সময়ে নাওয়া নেই, খাওয়া-দাওয়া নেই, যেন এক অন্য জগতের ছেলে বনে গেল পলাশ। সবসময় কি যেন ভাবছে
সে। দশটা প্রশ্ন করেও তার কাছে উত্তর মেলা ভার। এসব কথা মাস্টারমশায়ের কাছে শুনে
একদিন পলাশকে ডেকে খুব বকাবকি করেছিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে অনেক
উদ্বুদ্ধজনক কথা বলেছিলেন। শুনিয়েছিলেন অনেক জ্ঞানের কথা। কোন কারণে ভেঙে না
পড়ার কথা। সেসব কথা মনে পড়লে আজও অবাক ভাবেন বড়বাবু ইমতিয়াজ খান।
সেই পলাশের নামে
এত বড় অভিযোগ? ব্যাপারটা সহজে
মেনে নিতে পারলেন না বড়বাবু। তাই ইচ্ছে করেই দুদিন কোন অফিসার পাঠাননি
কচুবেড়েতে। কিন্তু মাস্টারমশাই যা শুরু করলেন, তা দেখে মনে হল, ইনি সমাজের শিক্ষক নয়, সমাজ থেকে বেতন নেওয়া কোন রাজনৈতিক দলের শিক্ষক। নিজের
আখের গোছানোর শিক্ষক।
ভাটার মুখে ছিল
মাতলা নদী। তাই এক ঘন্টার পব ৪৫ মিনিটে পৌঁছে দিল লঞ্চ। কচুবেড়ের ঘাটের কাছে লঞ্চ
বাঁধতেই যতীন দারোগাসহ দুজন কনস্টবল স্বপন ও সুধীর নেমে পড়ল।
লঞ্চঘাটে পুলিশ
নামাতে দেখে সাথে সাথে ভিড় জমে গেল। তারপর শুরু হল নমস্কারের সাথে প্রশ্নবাণ।
কোথায় যাবেন স্যার? কি দরকার স্যার? কাউকে খবর দিতে
হবে স্যার? একটু চা খাবেন
স্যার? এখানে একটু বসুন
স্যার। স্যারে স্যারে ছয়লাপ হয়ে গেল। তাদের মধ্যে একজনকে যতীনদারোগা শুধালেন–
নির্মল মন্ডলকে কোথায় পাবো?
নির্মল মন্ডল
কচুবেড়ে গ্রামে থাকে। থানার হোম গার্ডের চাকরি করে। গতকাল যতীনদারোগা তাকে বলে
দিয়েছিলেন কচুবেড়ের ঘাটের কাছে থাকতে। তাকে ঘাটের কাছে দেখতে না পেয়ে, তাই যতীন দারোগা
জিজ্ঞাসা করলেন।
একজন উঁকি মেরে
রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল- ওই তো আসছে স্যার।
যতীনদারোগা দেখতে
পেলেন খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে ঘাটের দিকে আসছে নির্মল। তাকে দেখে স্বপন ও সুধীরকে নিয়ে যতীন দারোগা পা বাড়ালেন।
কাছে এসে সাইকেল
থেকে নামল নির্মল। তারপর যতীনদারোগার নির্দেশ মতো তাদের নিয়ে গেল সুরেশ বাবুর
বাড়িতে।
দু'কামরা চালাঘর মৃত
সুরেশবাবু। খড়ের ছাউনি। একেবারে গ্রামের বড় রাস্তার পাশেই। তার পাশে বিঘে-দুই
খোরো চাষের জমি। ঘেরা দেওয়া। সামনে একটা পুকুর। খুব একটা বড় নয়। সেই পুকুরে
পাতি হাঁস, রাজহাঁসেরা ডুবে
ডুবে গেঁড়ি খাচ্ছে। রাস্তার পাশে তারহীন ইলেকট্রিক পোস্ট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে
আছে।
ঘরের দাওয়াতে
বসেছিলেন এক বৃদ্ধা। নির্মল বলল–উনি পলাশের দিদিমা। বাচ্চাদের হই হই শুনে ঘরের
ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন পলাশের মা, সীতাদেবী। সামনে খাকি পোশাকের পুলিশ দেখে সলাজে মুখের
অর্ধেকটা ঢেকে নিলেন কাপড়ে। নির্মল বারান্দায় উঠে মহিলাকে বলল– পিশি! আমাদের
ছোটবাবু এসেছেন। ঘরটা একটু সার্চ করবেন।
চাপা গলায়
সীতাদেবী শুধালেন-- কেন?
- পলাশকে খুঁজতে।
- সে আবার কি করেছে?
- কেন, জানো না? তোমার ঠাকুরপো
তার নামে কেস করেছে থানায়।
নির্মলের কথা
শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন সীতা দেবী।বিষয়ে অভিভূত হয়ে গেলেন বৃদ্ধ দিদিমা। তিনি
উদ্বিগ্নের সঙ্গে শুধালেন- মন্টু কেশ করেছে! কি করেছে পলাশ?
- অঞ্জলিকে সে নাকি
জোর করে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে কোথাও।
- কোথায় নিয়ে
গেছে পলাশ? চোখ কপালে তুলে
দিদিমা স্বগোতক্তি করলেন।
কিন্তু কে দেবে, সেই প্রশ্নের
জবাব? কার কাছে আছে সেই
প্রশ্নের উত্তর? দিদিমা নিজেই
নিজের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। ক'দিন ধরে সত্যিই অঞ্জলীকে দেখা যাচ্ছে না বাড়িতে। ওর বাবা
মা সব বাড়িতে আছে, অথচ মেয়েটা নেই, ব্যাপারটা কি? একা একা মেয়েটা
গেল কোথায়? তাহলে কি সত্যিই
পলাশ অঞ্জলিকে নিয়ে গেছে কোথাও? ওর বাবা-মা সে ব্যাপারে তাকে কিছুই বলেনি। মনের মধ্যে হাজার
প্রশ্ন এসে ভিড় করে দিদিমার মনে। তবে পাড়ার মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে একটু কানাকানি
চলছে। সে কথা কানে এসেছে সীতাদেবীর। তবে অঞ্জলির নামের সাথে তার ছেলের নামটা জুড়ে
দেয়নি কেউ। আজ ছেলের নামটা শুনে কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি।
যতীন দারোগা
শুধালেন-- পলাশ কোথায়?
- সে তো স্যার
মামার বাড়িতে গেছে।
- এখন তো মামার
বাড়িতে যাবে। ধরতে পারলে আসল মামার বাড়ি দেখবে। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তীর্যকতার
সাথে কথাগুলো বললেন যতীনদারোগা। পরক্ষণে কি মনে করে শুধালেন- কবে গেছে?
- গত বুধবার। পঁচিশ
তারিখে।
যতীনদারোগা সাথে
সাথে এফ.আই.আর. এর কপিটা বার করে দেখলেন। ঘটনাটা পঁচিশ তারিখেই। সেদিনই সে
কিডন্যাপ করেছে অঞ্জলিকে। ব্যাপারটার মধ্যে সন্দেহের আঁচ পেয়ে তিনি শুধালেন-- গত
বুধবার থেকে আজও বাড়িতে ফেরেনি পলাশ? বলি ব্যাপারটা কি ?
ব্যাপারটা কি তার
জানবে কি করে সীতাদেবী? দু'দিনের জন্য মামার
বাড়িতে যাচ্ছি বলে ছেলে যদি সাত দিন সেখানে কাটায়, তাহলে তার আর কি বলার আছে? সংসারে টানাটানির
জন্য ওর মামারা অবশ্য বলেছিল পলাশকে ওরা ওখানে রেখে দেবে, সীতাদেবী রাজি
হননি। ওই একটা মাত্র ছেলে তার। একমাত্র সহায় সম্বল। তাকে ছেড়ে তারা শাশুড়ি বউ
মিলে এই পাষাণপুরীতে থাকবে কী করে? কিন্তু ছেলে যে এভাবে ওখানেই থেকে যাবে, তা চিন্তা করেনি
ওরা।
বাড়িতে ফিরলেই
যেন থানাতে গিয়ে দেখা করে,
কোথাও যেন
পালিয়ে না যায়। পালিয়ে গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে থানা প্রশাসন। এইসব নানান
বাধ্যবাধকতায় বেঁধে বাড়ি থেকে বার হলেন যতীন দারোগা।
পথে বার হতেই
দেখা হয়ে গেল মন্টু মাস্টারের সঙ্গে। বোধ হয় তিনি খবর পেয়েছিলেন, তাই হন্তদন্ত
হয়ে তিনি আসছিলেন। গা দিয়ে ঘাম ঝরছে পুরোদমে। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। তবুও মুখে
হাসি ফুটিয়ে তিনি বললেন– কখন এলেন স্যার?
- এসেছি অনেকক্ষণ।
রেইড করলাম পলাশদের বাড়িতে। পলাশকে পেলাম না। সম্ভবত অঞ্জলিকে নিয়ে কোথাও
পালিয়েছে। কে জানে, মামার বাড়িতে
গিয়ে উঠেছে কিনা? যেখানেই যাক, ওটাকে ধরে জেলে
পুরে দেব। আপনি নিজেও একটু খোঁজখবর রাখুন। খবর পেলে আমাদের জানান।
- সে তো অবশ্যই
স্যার! দয়াকরে গরীবের বাড়িতে যদি একটু পদধূলি….।
- হাঁ হাঁ, অবশ্যই যাব।
আপনার স্ত্রী ও পড়শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে না। তা আপনি এত হন্তদন্ত হয়ে কোথা
থেকে আসছেন?
- আর বলেন কেন
স্যার! পার্টি পলিটিক্স করলে সব দিকে একটু মাথা দিতে হয়। না হলে লোকজন ভোট দেবে
কেন? উপকার পেলে তবেতো
উপকার করবে। একটু গিয়েছিলাম স্যার প্রাইমারি স্কুলে। ওখানে কয়েকদিন ধরে
সেটেলমেন্টের অফিসাররা আসছেন। জমিজমা সেটেল মেন্ট করতে। তাদের খাওয়া-দাওয়া, লোক চিনিয়ে
দেওয়া, সবকিছুই তো আমাকে
করতে হচ্ছে স্যার! গ্রামে বাস করলে যা হয় আরকি।
- তা বেশ, তা বেশ।
যতীনদারোগা অত্যন্ত শ্লেষের সাথে উৎসাহের মোড়কে মুড়ে বললেন- আপনাদের মত
মানুষেরা না থাকলে সমাজের যে কি বিপদ হতো, তা সত্যি ভাবা যায় না। সে কথা আমরা বুঝি। বাড়ির বৌ-ঝিরা
তা বুঝতে চায় না। তারা নিশ্চয়ই বলে থাকে - ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যেও না।
যতীন দারোগার কথা
শুনে হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়েন মন্টুদাস। কথায় কথায় তারা হাজির হয় মন্টু
দাসের বাড়িতে। বাড়িতো নয়, যেন একটা রাজপ্রাসাদ। সেই রাজপ্রাসাদ দেখে স্তম্ভিত হয়ে
গেলেন যতীন দারোগা। যতীন দারোগা ভেবে পেলেন না, সবরকম প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে কিভাবে মন্টুদাস এ
রাজপ্রাসাদ বানালেন? কিভাবে ইঁট, সিমেন্ট, বালি জোগাড় করে
আনলেন? সত্যি! টাকার
জোরে কি না হয়? বাঘের দুধও
মেলে। তার নিদর্শন বোধহয় মন্টু দাসের রাজপ্রাসাদ।
সেই রাজপ্রাসাদে
ঢুকতেই আদর অভ্যর্থনার বন্যা বয়ে গেল। সাথে সাথে দামি দামি চেয়ার এল। থালা ভর্তি
নানান রকম খাবার এল। রকমারি কাটা ফল এল। সাথে প্যাকেট প্যাকেট বিস্কুট, আর বড় কাপে
ভর্তি দার্জিলিংয়ের চা।
হাঁটতে হাঁটতে
ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন যতীন দারোগা, তার সঙ্গী সাথীরা। তাই বসার চেয়ারে যুত করে
বসলেন তারা। একটা চেয়ার টেনে মন্টুবাবু বসলেন। তারপর হাত জড়ো করে বললেন– আপনি আজ
না বলবেন না স্যার! গরিবদের বাড়িতে আজ প্রথম পদধূলি দিয়েছেন। দুটো ভাত…..।
কথা আর শেষ করতে
পারলেন না মন্টুবাবু। যতীন দারোগা ঠিক একইরকম বিনয়ের সাথে বললেন– আজ আর অনুরোধ
করবেন না মাস্টারমশাই! আমরা তাড়াতাড়ি থানায় ফিরলে আর একদল তদন্তে বার হবে। অন্য
কোন একসময়ে….. বলে কথার মোড় ঘোরালেন অন্যদিকে।
- আপনারা হলেন
সরকারের খাস লোক। আর আমরা হলাম সরকারি কর্মচারী।একের সাথে এক মিললে তবে তো দুই
হবে। একসাথে কাজ করলে…..।
যতীন দারোগা
কথাটা বলতে না বলতেই টোপটা গিলে ফেললেন মন্টুবাবু। একান্ত উৎসাহের সাথে তাই তিনি
বললেন– আমরা তো সেটাই চাই স্যার! মিলেমিশে কাজ না করলে, কাজের অগ্রগতি
হবে কি করে? এখানকার কিছু লোক
হয়তো আপনার কানভারি করবে। মন্টুদাস স্বার্থপর। মন্টুদাস নিজের পার্টি ছাড়া আর
কাউকে চেনে না। মন্টু দাসের এত সম্পত্তি হলো কি করে? এসব অপবাদের খতিয়ান শোনাবে আপনাকে। ওদের কথায়
বিশ্বাস করবেন না স্যার। ওরা সব বিরোধী পক্ষের লোক। আমার দাদা মারা গেল, আর ওরা গ্রামে
রটিয়ে বেড়াল, আমি দাদাকে খুন
করিয়েছি। বড়বাবু সেকথা বিশ্বাস করে কয়েকদিন নাচানাচি করল। কিন্তু আপনি বলুন
স্যার! কোন ভাই তার নিজের দাদাকে কি খুন করতে পারে? বাবা মারা যাবার পর ওই দাদাই আমাকে ছেলের মত
মানুষ করেছে। স্কুলের চাকরি করে দিয়েছে। তাকে আমি খুন করাবো?
- তা হঠাৎ করে
আপনার দাদার ছেলে, আই মিন পলাশ
আপনার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেল কেন? কি তার উদ্দেশ্য? যতীন দারোগা বেশ চিন্তিত মুখে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন।
- ব্যাপারটা অন্য
কিছু নয় স্যার! মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণ আমার সম্মানহানি করা। ওর
বন্ধু বিকাশের সাথে আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে আমার নাক কাটা। এছাড়া টাকা-পয়সার
দাবি করা। সব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে….।
- ও আচ্ছা আচ্ছা।
সবকিছু বুঝতে পারার ভাব দেখিয়ে কথাটা বললেন যতীন দারোগা।
চায়ের পেয়ালায়
চুমুক দিতে দিতে আরো অনেক কথা বললেন মন্টুদাস। যতীন দারোগা এক এক করে
সাক্ষী-সাবুদদের হাজির করতে বললেন। তারা এলে এক এক করে আলাদাভাবে তাদের
জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। কখন, কোনসময়ে পলাশ
অঞ্জলিকে নিয়ে যেতে দেখেছে তারা? সকলেই বলল– ঘটনাটা স্বচক্ষে তারা দেখেনি। কচুবেড়ের ঘাটে মন্টু মাস্টারকে
তারা চিৎকার করে বলতে শুনেছে– ওই নৌকাতে করে পলাশ আমার মেয়েকে নিয়ে পালালো। তা
শুনে নৌকাটা ধরার জন্য অন্য নৌকাতে চেপে তারা পিছনে পিছনে গিয়েছিল, কিন্তু ধরতে
পারেনি।
যতীন দারোগা
শুধালেন-- নৌকাটা কার ?
- ওটা ওদেরই নৌকা
স্যার! বহুদিন ধরে ঘাটে বাঁধা ছিল।
- আচ্ছা মন্টুবাবু!
বিকাশকে কি পাওয়া যাবে?
- ওকে এখানে কি করে
পাবেনই স্যার? ওর বাড়ি তো
সোনাখালীতে।
- তাহলে আপনার
মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হল কি করে?
- পরিচয় বলুন আর
আলাপ বলুন, সেটা হয়েছিল
একবারই। এই গোসাবায়। আমার মেয়ে গিয়েছিল তার বান্ধবীর বিয়েতে। সেখানেই আলাপ
হয়েছিল ওদের। কিন্তু পলাশ যে এরকম একটা কান্ড করে বসবে…..!
- তা আপনি কিছু
চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়েকে আমি উদ্ধার করে দেবোই। আসামীকেও ধরে ফেলব খুব
তাড়াতাড়ি। এমন লেখা লিখে দেবো, আর যেন জীবনে জেল থেকে ছাড়া না পায়।
একথা বলেই একটু
দম নিলেন যতীন দারোগা। তারপর কি ভেবে হঠাৎ মন্টুবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন- আচ্ছা
মন্টুবাবু! আপনার মেয়ের বয়স কত?
- অভিযোগপত্রে তো
লিখে দিয়েছি স্যার! চোদ্দ বছর।
- কোন ছবি টবি আছে? কাগজে বিজ্ঞাপন
দিয়ে দেব। রেডিও-টিভিতে যাতে ব্রডকাস্ট হয় তার ব্যবস্থা করে দেব।
মন্টুবাবু সে কথা
শুনে কিছুটা থম হয়ে ভাবলেন। তারপর একসময় বললেন- না স্যার! অমন কাজ করবেন না।
একে তো নাক-কান কাটা গেছে। তার ওপর এসবকিছু হলে মেয়েকে আর বিয়ে দিতে পারব না।
যতীনদারোগার কানে
সে কথাটা কতটা ঢুকলো কে জানে?তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন মন্টুবাবুর চোখ মুখের
দিকে। মেয়ে অপহরণ হওয়ার জন্য যতটা চিন্তিত হবার কথা ততটা চিত্র ফুটে উঠছিল না
তার চোখে মুখে। তবে দক্ষ অভিনেতার মতো মন্টুবাবুর গলার স্বরে ঝরে পড়ছিল সেই
আকুলতা।
যতীন দারোগা
বললেন- তাহলে আজ আমরা আসি মন্টুবাবু!
মন্টুবাবু হেসে
বললেন- একটা গোপন কথা ছিল স্যার! পাশের ঘরে একটু আসুন।
কথামতো
মন্টুবাবুর সাথে যতীন দারোগা গেলেন সেই ঘরে। মন্টুবাবু তার পকেট থেকে একটা খাম বার
করলেন। তারপর সেটা যতীনদারোগার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন- স্যার! এটা আপনার
জন্য।
যতীন দারোগা বুঝে
গেলেন ব্যাপারটা। সরাসরি না বললে ব্যাপারটা অন্যরকম হতে পারে ভেবে মৃদু স্বরে
বললেন– ওটা আপনার কাছে রেখে দিন মন্টুবাবু! আগে কাজটা করি, তারপর না হয়….।
- তা বললে হয়
স্যার! এটা আমাদের রীতিনীতি। প্রশাসনের লোকজন এলে….।
- না মন্টুবাবু!
মনে দুঃখ পাবেন না। কাজ কাম না করে কোনদিন আমি কারোর কাছ থেকে…. বলতে বলতে বাইরে
এলেন।
তারপর নমস্কার
জানিয়ে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন যতীন দারোগা।