‘ছেলে
আমার খুব সিরিয়াস, কথায় কথায় হাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।’
এই কবিতাটা বা কবিতার কিছু লাইন যখনই কোনও অনুষ্ঠানে বা গর্বিত
মা-বাবার মুখে তাদের ইংরেজি জানা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বলতে শুনি, তখনই
মনে আসে কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কথা। যিনি শিশু মনস্তত্ত্ব বুঝে রচনা করেছিলেন
এইরকম অসংখ্য ছড়া। তার মধ্যে বেশিরভাগই বাংলাভাষা ও বাঙালিকে নিয়ে।
হাওড়া জেলার জগাছা থানার
অন্তর্গত দাশনগরের কাছে দক্ষিণ শানপুরে কবি ৯ই এপ্রিল ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
এই শানপুরে কবির শৈশব থেকে আজও এগিয়ে চলা। শিক্ষা শেষ করে এইখানেই কালীতলা
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে প্রধান শিক্ষক হিসাবে
যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে এই বিদ্যালয় থেকেই অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান
শিক্ষক। পেশায় শিক্ষক হলেও, তিনি ছিলেন আশৈশব সাহিত্যপ্রেমী।
সাহিত্য সাধনাই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল। যদিও মাত্র বছর দুয়েক আগে মধুমেহ রোগে
ভুগে তাঁর বাঁ-পা হাঁটু থেকে বাদ যায় ও শারীরিক নানান সমস্যায় নিজের হাতে কলম
ধরে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারেন না। কিন্তু কবি-মন তাতেও থামে না। তাঁর স্ত্রীর
(পদ্মাদেবী) সাহায্য নিয়ে কিছু কিছু সৃষ্টিতে আজও মেতে আছেন। কিন্তু ওই যে
একবারের একটা দুর্ঘটনা আবার এক নতুন ঘটনায় মোড় নিল; ডান-পায়ে
ভর দিয়ে চলতে গিয়ে অতি সম্প্রতি ঘরের ভেতর পড়ে গিয়ে কবির মালাইচাকি ভেঙে
দু-টুকরো হয়েছে।
বন্ধুবান্ধবরা আজও তাঁর
খোঁজ রাখেন। সৃষ্টির উল্লাসে বাংলা সাহিত্যে যে কয়েকজন ছড়াকারের নাম প্রথমেই আমাদের মনে আসে, তার মধ্যে ভবানীপ্রসাদ মজুমদার একজন। যিনি একটি দুটো নয়, লিখেছেন কুড়ি হাজারের মতো ছড়া। প্রকাশ করেছেন নামে-বেনামে অসংখ্য ছড়া।
ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের মতো
শিশু মনস্তত্ত্ব বুঝে, শিশুদের মনের কথা বুঝে কবিতায় বা
ছড়ায় আর কেউ বাংলা সাহিত্যে এত ছড়া মনে হয় আর কেউ লেখেনি। হয়তো তা সম্ভব হয়েছে
তিনি শিক্ষক ছিলেন বলেই। বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিশুদের সঙ্গে তিনি সময় কাটিয়েছেন;
তাদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত দেখেছেন বলেই রচনা করেছিলেন এক-একটা
কালজয়ী ছড়া। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে আজ অনেকেই নামি-দামি ছড়ার লেখক হয়ে উঠেছেন।
তাঁরা অনেকেই এক বাক্যে স্বীকার করেন, কবি ভবানীপ্রসাদ
মজুমদারের সাহচর্য না পেলে তাঁদের এ-জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব ছিল না।
তিনি দেখেছেন মা-বাবা
শিশুসন্তানটিকে মানুষ করবার জন্য কীভাবে তার কচি প্রাণটিকে চাপে রাখে। মা-বাবাদের
কেবল একটাই চিন্তা—মার্কস বাড়াও, আর টপার
হও।
‘ন্যায়-নীতি আর প্রেম-প্রীতি সব শিকেয়
রেখেই তুলে
ইঁদুর-দৌড়ে
লাফাও-ঝাঁপাও-হাঁফাও দুঃখ ভুলে।’
সেই কাকডাকা ভোর থেকে
শিশুকে তোতাপাখির মতো বোল শেখানো হয়—বড়ো হতে হবে, ডাক্তার হতে হবে। আর তার জন্য মার্কসের পেছনে ছোটো থেকেই তার মগজে ঢুকিয়ে
দেওয়া হয় শক্ত শক্ত কথা আর অসংখ্য বইয়ের বোঝা। গানের ক্লাস,
যোগার ক্লাস, ড্রয়িং, সাঁতার,
টিচার—ক্লান্ত শিশুটিকে কেউ বলে না, তোমরা
ফুলের মতো ফোটো। তাই তো কবি তাদের মনের কথা বুঝে লিখলেন—
‘কেউ বলে না তোমরা
সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠো
চেঁচায় সবাই, ছোটো-ছোটো ছোটো...’
কবি আজকের শিশুদের হারিয়ে
যাওয়া শৈশব নিয়ে আর একটা ছড়ায় লিখেছেন—
‘কোথায় গেল লাটাই আমার, কোথায় রঙিন ঘুড়ি
বাবা মায়ের ইচ্ছে পূরণ
করতে হুড়োহুড়ি...
স্বপ্ন গেছে চুরি আমার, স্বপ্ন গেছে চুরি।’
সত্যিই তো, আজকাল এত পড়া আর প্রতিযোগিতার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের
কোমল প্রবৃত্তিগুলো। দিন দিন তারা হয়ে পড়ছে অসহায়। মানবিক গুণগুলো হারিয়ে শিশুরা
হয়ে পড়ছে রোবট। অথচ তাদেরও যে একটা আলাদা জীবন রয়েছে, যে-জীবনটা
তাদের নিজেদের মতো করে কাটাবার কথা, খেলার কথা। সেই সময় আমরা
তাদের তুলে দিচ্ছি বইয়ের ব্যাগ। অথচ—
‘ভালো করে তাকিয়ে কেউই দ্যাখে না সেই
শিশুর দিকে ফিরে
আলো-আশার আকাশটা তার কালো
মেঘেই যাচ্ছে ঢেকে ধীরে।’
আর এই সকল শিশুদের কথাই
সহজ-সরল ছন্দে ছড়া-কবিতায় লিখে ভবানীপ্রসাদ হয়ে ওঠেছেন শিশুদের প্রিয় কবি, ছড়াকার। শিশুদের কথা শিশুদের মতো করে কবি লিখেছেন বলেই কবির
যে-কোনো ছড়া আজকাল স্কুলে বা কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিশুরা বেছে নেয় আবৃত্তির
জন্য। ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের এইসব ছড়া আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে অন্তত সবার কাছে একটাই
বার্তা পৌঁছে দিতে চায় তারা—প্লিজ আমাদের স্বপ্ন তোমরা চুরি কোরো না। আমাদেরকে
আমাদের মতো বাচঁতে দাও, আমাদেরও যে ‘ভালো
লাগে নাচ গান, মজা খুশি হাসি।’
শিশু মনের অপার বিস্ময়, স্বপ্ন-জীবন কবি তাঁর রচিত বিভিন্ন কবিতায়, ছড়ায় যেমনভাবে চিত্রিত করেছেন, তাঁর মতো এমন করে আর
কেউ পারেননি। প্রতিটি ছড়া-কবিতায় মনস্তত্ত্বের জটিল বিশ্লেষণ নেই, নেই কাহিনির মারপ্যাঁচ, আছে সহজ-সরল জীবনের কথা যা
তিন থেকে তেরো-সহ আশি বছরের সকল কবিতাপ্রেমীদের পছন্দ।
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার তাঁর
লেখা বইয়ের জন্য পেয়েছেন অনেক জনপ্রিয় ও গৌরবময় পুরস্কার। কবির লেখা আমাদের শুধু
আনন্দ দান করে না, আমাদের মানসিক শক্তি ও স্ফূর্তি আনে।
আমরা যারা তাঁর প্রিয়
পাঠক, তারা আশা করব, কবি আবার সুচিকিৎসার
মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠুন ও আবার নতুন করে কলম ধরুন। ইতিমধ্যে আমাদের আশেপাশের জগতে
অনেক কিছু বদলে গেছে; রোজ কত কিছু ঘটে চলেছে। তার বিরুদ্ধে
যদি তিনি কলম ধরেন তবে শিশুদের আরও বিকাশ ঘটবে বলেই আমাদের আশা। কবির লেখা কথাগুলো
হবে সত্যি—
‘জীবনের
সব জেদ, জাত-পাত
ভেদাভেদ দ্বেষ রেশ শেষ হোক
আলো
আশা ভালোবাসা দিয়ে ঠাসা পৃথিবীটা একটাই দেশ হোক।’