বন্ধু, ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে কবে যে প্রথম
দেখা হয়েছিল সে-কথা আজ আর আমার মনে নেই। আসলে ওর সঙ্গে প্রথম আলাপের পর থেকেই ও
খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল আমার। সে কারণেও হতে পারে প্রথম দিনের স্মৃতি আজ চাপা
পড়ে গেছে। তবে সেই দিনটার কথা ওর মনে আছে কি না তা জানি না। আমরা প্রায় সমবয়সি।
বয়েসের নিরিখে আমি ওর থেকে একটু বড়ো হব। তবে ও ছিল লেখায় বড়ো। আর এ-কথা ওকে
বললেই ও বলত, “আমি লেখায় বড়ো আর তুমি লেখায় দড়। তুমি
মিষ্টি মিষ্টি লেখো।”
যাক সে-কথা।
ছড়া লেখার সুবাদে ওর সঙ্গে আমার আলাপ। ছয়ের দশক থেকে নিয়মিত ওর লেখার ওপর আমার
নজর ছিল। বিশেষ করে, বিশেষ বিশেষ
দিনগুলোর কথা। যেমন, ২৩ জানুয়ারি, ২৬
জানুয়ারি, সরস্বতী পুজো, দোল উৎসব,
চড়কপুজো, ১ বৈশাখ, ২৫
বৈশাখ মানে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন, নজরুল, বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র, রথের
মেলা, ঝুলনযাত্রা, জন্মাষ্টমী, স্বাধীনতা দিবস, মহরম, ঈদ,
বিশ্বকর্মা পুজো, দুর্গাপুজো, কালীপুজো, ভাইফোঁটা ইত্যাদি বিষয়ভিত্তিক ছড়া—কোনও
কিছুই ওর কলম থেকে বাদ যেত না। কাগজ খুললেই দেখতাম ভবানীর ছড়া। খবরের কাগজে
সপ্তাহে একটা দিনে একটা করে ছোটাদের পাতা থাকত। কখনও বৃহস্পতিবার, কখনও শনিবার, কখনও রবিবার। সেসব পাতা ছোটোদের মনোমতো
করে সাজিয়ে তুলতেন তখনকার দিনের বাঘা বাঘা সম্পাদকেরা। পাতাগুলোর পছন্দসই একটা
নামও থাকত। যেমন বসুমতীতে ‘ছোটোদের পাতা’, যুগান্তরে ‘ছোটোদের পাততাড়ি’, আনন্দবাজারের ‘আনন্দমেলা’, সত্যযুগে
ছিল ‘নয়া পাঠশালা’ ইত্যাদি। পাতাগুলোর
পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বিশু মুখোপাধ্যায় (বেকুশর্ম), অখিল
নিয়োগী (স্বপনবুড়ো), হরেন ঘটক (মাস্টারদা) বিমল ঘোষ
(মৌমাছি)-দের মতন সব ব্যক্তিত্ব। এঁরাই ছিলেন প্রকৃত শিশুসাহিত্যিক। ওঁরাই মানুষ
হওয়ার মূল শিক্ষার বীজ তখন থেকেই ছোটোদের মনে বপন করে দিতেন।
এত কথা বলার
কারণ হচ্ছে, ওইসব কাগজে
লেখা দিয়ে তখন সিংহভাগ দায়িত্ব বহন করত ভবানী। কখনও নামে, কখনও
বেনামে, কখনও ছদ্মনামে লিখে তখন পাতা সম্পাদকের পাতা সাজাতে
সাহায্য করে গেছে। আমার মনে হয়, ভবানী বোধ হয় নিজেও জানে না
যে ওর কতগুলো ছদ্মনাম। ও সেইসব সম্পাদকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল। এসবের
পাশাপাশি ওর লেখা দেখতাম সন্দেশ, শুকতারা, রামধনু, মৌচাক, পক্ষীরাজ
ইত্যাদি পত্রপত্রিকায়।
তবে সবচেয়ে
আশ্চর্যের কথা হল যে ভবানী সাবলীলভাবে অজস্র ছড়া লিখে যেতে পারে। তাই আজ ওর
ভাঁড়ারে জমা হয়ে গেছে কুড়ি হাজারেরও বেশি ছড়া।
ভবানী ছিল
ভীষণ আড্ডাবাজ। আড্ডা দেবার জন্য চারটে বাজতে না বাজতেই ও এসে হাজির হত আমার
অফিসে। পাঁচটা বাজতেই অফিস থেকে বেরিয়ে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে যেতাম কলেজ স্ট্রিটে।
সেখানেও জমত আড্ডা। বইয়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হলে আমরা দুজনে রাস্তার ধারে পাঁচিলে
বসে বসে চালাতাম আড্ডা। আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল সব ছড়া-কেন্দ্রিক। কার ছড়া এখন
ভালো হচ্ছে, কে ভালো লিখছে
ধারাবাহিকভাবে, কার লেখা হচ্ছে না, কী
কী ধরনের লেখা লিখলে ভালো হয়—এরকম আরও কত কিছু। এই আড্ডার সঙ্গে চলত টুকিটাকি
খাওয়াদাওয়া।
একবার কয়েক
বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে ভবানীর হাতে দিয়ে বলি, “তুমি যাও, পাঁচজনের জন্য খাবার নিয়ে এসো।”
কিছুক্ষণ
পরে ভবানী আমাদের জন্য পাঁচটা প্যাকেট এনে পাঁচজনের হাতে ধরিয়ে দিল। আমরা তো
প্যাকেট খুলেই অবাক। সকলেই হেসে মরি। প্যাকেটে দেখি একটা রঙিন দানাদার, একটা দরবেশ, একটা
আড়াই প্যাঁচের ছোটো জিলিপি, একটা শুকনো গজা আর মুগের
লাড্ডু। ও গম্ভীরভাবে বলল, “নাও, সবাই
খেয়ে নাও।”
আসলে ও যে
স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সেই ইস্কুলের
ছাত্রদের জন্য টিফিন নিয়ে এসেছে। সত্যি কথা ছড়া-সাহিত্যে ও তো প্রধান শিক্ষক
বটেই। এতে কারও কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। এখনও আমি একটা লেখা লিখে ওকে শুনিয়ে
দিই। এই ফাঁকে একটা কথা বলে রাখি, ভবানীর প্রিয় খাবার ছিল
গরম গরম তেলেভাজা। মনে হয় কলেজ স্ট্রিটে, আমহার্স্ট স্ট্রিট,
সুকিয়া স্ট্রিটে এমন কোনও দোকান নেই যেখানে আমরা মুড়ি-তেলেভাজা
খাইনি।
একবার হল কী, ভবানী একজায়গায় আমাকে দাঁড়াতে বলেছে,
আমি সেখানে সময়মতো পৌঁছে গেছি। কিন্তু ভবানীর পাত্তা নেই। হঠাৎ দেখি
একটু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভবানী শালপাতায় কীসব খাচ্ছে। আমি চুপিসারে ওর কাছে
যাওয়ায় ও খুব লজ্জা পেল। শিশুসুলভ মুখ করে বলল, “দেখলাম গরম
গরম ছানাবড়া ভাজছে। আমি আর লোভ সামলাতে পারলাম না। তুমি আসছ না দেখে আমি এক পাতা
ছানাবড়া খেয়ে নিলাম।”
এরকম একদিন
কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের ধারে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। আমরা কেউ ঘড়ি
পরতাম না। তাই বুঝতে পারছি না যে কত রাত্রি হয়েছে। এমন সময় এক মিনিবাসের হেল্পার
বাস থেকে নেমে এসে আমাকে বলল, “গল্প পড়ে হবে, উঠে আসুন, এটাই
কিন্তু লাস্ট বাস।”
তখন শুনি
প্রায় দশটা বাজে।
ভবানীকে
নিয়ে লিখতে বসলে এরকম ছুটকো-ছাটকা অনেক কথা এলোমেলোভাবে ভেসে আসে। একবার সন্দেশের
অনুষ্ঠানে আমার ও ভবানীর ওপর সঞ্চালনার দায়িত্ব পড়েছিল। অনুষ্ঠান হচ্ছিল
রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের হলঘরে। সেখানে লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায় ও নলিনী দাস—সন্দেশের তিন
সম্পাদকই উপস্থিত ছিলেন। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হছে। সঞ্চালনার দায়িত্ব নিয়ে
ভবানী তখন একে একে সব সন্দেশী ছেলেমেয়েদের নাম নিয়ে ছড়া কেটে কেটে মঞ্চে ডাকছে।
যেমন একটা বলি—
‘বৃষ্টিতে আজ হল
বুঝি সব বানচালই
ছড়া পড়তে
আসছে এবার পাঞ্চালী।’
এরকম
তিরিশ-চল্লিশ জনের নামের তাৎক্ষণিক ছড়া কেটে বানিয়ে বানিরে ভবানী অনর্গল বলে
গেল। এ এক অদ্ভুত ক্ষমতা। যা শুধু ভবানীরই আছে মনে হয়।
যত দূর মনে
পড়ে, ১৯৮৮ সালে ‘অবন মহল’
প্রেক্ষাগৃহে ওকে ‘সুকুমার রায় স্মারক
পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। সে-বছর সুকুমার রায় নামাঙ্কিত
স্বর্ণপদক ভবানীর গলায় পরিয়ে দেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।
দীর্ঘ চল্লিশ
বছরে আমরা অনেক আড্ডা দিয়েছি, ঘুরে বেড়িয়েছি। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় প্রায়শই আমরা অনুষ্ঠান
করতে যেতাম। কখনও পুরুলিয়া, কখনও মেদিনীপুর, কখনও সুন্দরবন। বাইরে গিয়ে রাত কাটাতে হলে আমরা একই ঘরে থাকতাম। কত কথা,
কত গল্প হত রাত জেগে জেগে।
এবারে একটা
গল্প বলে এখনকার মতো শেষ করব এই লেখা।
মাস কয়েক
আগে ভবানী ও আমি এক অনুষ্ঠানের জন্য গিয়েছিলাম সুন্দরবনে। তিনটেয় ছিল অনুষ্ঠান।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল ওঁরা আমাদের পাঁচটার মধ্যেই ছেড়ে দেবেন। যেন আমরা
সেইদিনই ফিরতে পারি। সেইমতো তিনটের আগেই আমরা ওখানে পৌঁছে গেছি। দেখা গেল পাঁচটা
বাজতে চলেছে, কিন্তু
অনুষ্ঠান শুরু হল না। আমরা তখন মঞ্চে বসে ছিলাম। একজন বিশেষ অতিথি না আসায় ওঁরা
অনুষ্ঠান শুরু করতে পারছিলেন না। ভবানী তখন ছটফট করছে আর ঘনঘন সময় জিজ্ঞেস করছে।
তারপরেই হল আসল ঘটনা। হঠাৎ দেখি আমার পাশে ভবানী নেই। বাথরুম যাবে একজনকে বলে
মঞ্চের বাইরে গিয়েছে। ওর আর ফেরার নাম নেই। মাইকে বার বার বলা হচ্ছে, ‘ভবানীপ্রসাদ মজুমদার আপনি যেখানেই থাকুন মঞ্চে চলে আসুন। এক্ষুনি অনুষ্ঠান
শুরু হচ্ছে।’ কিন্তু ভবানীর পাত্তা নেই। মোবাইলে যাতে কেউ
ফোন না করতে পারে, তাই ও মোবাইলটাকে সুইচড-অফ করে রেখেছে। কী
সাংঘাতিক লোক রে বাবা! আমাকেও কিছু না বলে বেপাত্তা হল! ভবানীর খোঁজে চারদিকে
লোকজন পাঠানো হল। কেউ কেউ ফুট কাটছেন, ‘দেখুন বাঘের পেটে গেল
কি না।’ আমি ওদের হাসতে হাসতে বলি, ভবানীর
সামনে বাঘ এলে ও বাঘকে ধরে ছড়া শুনিয়ে দেবে। যাই হোক, ভবানীকে
তো আর তখন পাওয়া গেল না। অনুষ্ঠান ভবানী ছাড়াই শুরু হল। আমি প্রথমদিকে কিছু কথা
কিছু ছড়া বলেই ফেরার পথ ধরলাম। আমি ফিরে এসে ওকে বললাম, “কী
ব্যাপার! না বলে চলে এলে যে? আমাকে তুমি বিপদে ফেলে দিলে।”
ও সহাস্যে
বলল, “ভাই, আমার খুব ভয়
করছিল। যদি রাত্রে আটকে রাখে, তাই বড়ো রাস্তায় এসে দেখি
একটা বাস দাঁড়িয়ে রিপেয়ার করছে কিছু। ওদের বলি বাসটা কখন ছাড়বে? পরের বাস ক’টায় আছে ভাই? চারদিকে
তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। ওরা বলল, এইটাই শেষ বাস, ক্যানিং যাওয়ার আর কোনও বাস নেই। তাই আমি ওই বাসটায় চেপে এলাম। রূপক,
ভাই তুমি কিছু মনে কোরো না। ক্ষমা করে দাও এবার।”
আমি তখন
গভীর গলায় ভবানীকে বলি, “জানো, বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।”