আদতে বিস্ময়কর
প্রাণী গিরগিটি! নিমেষে রং বদলে নিতে পারে। রহস্যে মোরা সরীসৃপকে কেউ ভয় পায়,
বলে রক্তচোষা। দেখলেই চোখ
বন্ধ করে নেয় অনেকে।
কিন্তু কেন রঙ
বদল করে গিরগিটি? প্রকৃতির বুকে
টিকে থাকার জন্যই ঘন ঘন ত্বকের রঙ পাল্টে নেয়। একটু ছদ্মবেশ ধরা মাত্র, ক্যামোফ্লেজ। ঠিক ছদ্মবেশ নয়। পরিবেশের রং
রূপের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়া। আলাদা করে চেনা যাবে না। শত্রুর চোখে পরিবেশেরই
উপকরণ মনে হবে। অনেক প্রাণী প্রকৃতির রঙের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গা ঢাকা দেয়। গায়ের রং
বদলে নিয়ে ক্যামোফ্লেজ করে। গিরগিটি তেমনই এক নিরীহ প্রাণী। আদৌ ক্ষতিকর, বিষাক্ত কিংবা রক্তচোষা নয়।
কেন করে রঙ বদল?
শরীরের তাপমাত্রা
নিয়ন্ত্রণ, বন্ধুর সঙ্গে
যোগাযোগ, শিকার ধরা,
শত্রু মোকাবেলা ইত্যাদি
বহু উদ্দেশ্যে। পরিবেশের তাপমাত্রা বদলের সঙ্গে নিজের দেহের উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ
করবার কৌশল প্রকৃতি তাকে দেয়নি। তাই টিকে থাকতে হয় বিশেষ উপায়ে।
পরিবেশ গরম কিংবা
ঠাণ্ডা হয়ে গেলে মানুষ, জীবজন্তু মানিয়ে
নিতে চেষ্টা করে। পারেও অনেকটা। তাপ চলাচলের বিজ্ঞানকে কাজে লাগায়। পরিবহণ,
পরিচলন, বিকিরণ, বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ার সাহায্য নেয়। যেমন,
গরমকালে ঘাম হয় শরীর
ঠাণ্ডা রাখতে।
জীবন ধারণের জন্য
প্রয়োজন শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। নইলে বিপদ! কোষের ভিতর থাকা জল খুব
ঠাণ্ডায় জমে যাবে। আবার প্রচণ্ড তাপে শরীরের জল বাষ্পীভূত হয়ে মৃত্যু ডেকে আনবে।
শরীরের তাপ
নিয়ন্ত্রণে রাখতেই গিরগিটির রং বদল। গরমকালে হালকা রং। বেশী পরিমাণ সূর্যালোক
প্রতিফলিত করে দেহ ঠাণ্ডা রাখবে। আর শীতকালে উল্টো রকম। সূর্যের আলো বেশী মাত্রায়
শোষণ করবে। তখন শরীর দেখাবে বাদামি কিংবা খয়েরি।
গিরগিটি, ইংরাজিতে চ্যামেলিওন (chameleon)। প্রাণীটি লিজার্ড (Lizard) শ্রেণীর। বেঁচে
থাকে পাঁচ থেকে আট বছর। বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিনিডা (Chamaeleonidae)। যেমন ভারতীয় গিরগিটির নাম ক্যামেলিও জেলানিকাস (Chamaeleo zeylanicus)। বহু প্রজাতি (species) এদের। দুশোর
বেশী। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের বহু দেশে পাওয়া যায়। প্রাণীদের বলা হয়
এক্টোথার্ম। এক্টো মানে বাইরের, থার্ম মানে তাপ।
বাইরের তাপ নিয়ে তাদের বাঁচতে হয়। তাই এদের রং বদল।
রং বদল হয় দেহের
ত্বকে। কিন্তু কী ভাবে করে? করে শরীরে কোষের
কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটিয়ে। চামড়ার গঠনে বদল এনে। পরিবর্তিত ত্বক বিভিন্ন রঙের
প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
বস্তুর রং নির্ভর করে
পদার্থটি কোন্ ধরণের আলোর প্রতিফলন ঘটায়। বস্তুর রং আদতে প্রতিফলিত আলোক রশ্মি।
গিরগিটি কোন্
রঙের প্রতিফলন ঘটায়? এককথায়, অনেক রং। নির্বিষ, বিস্ময়কর প্রাণীটি তৈরি করতে পারে হরেক রং।
রহস্য লুকিয়ে ওদের ত্বকে। চামড়াটাই বিশেষ ধরণের। থাকে অনেকগুলো (তিনটে) স্তর আর
সেখানে থাকে রঞ্জকগ্রন্থি (chromatophore)।
ত্বকের বাইরের
স্তরে জ্যান্থোফোর (xanthophore), লাল আর হলুদ রঙ
তৈরি করে। মাঝের স্তরে ইরিডোফোর (iridophore), নীল রঙের জন্য দায়ী। এর অন্য নাম গুয়ানোফোর (guanophores)। বর্ণহীন গুয়ানিন কেলাস (guanine crystal) থাকে, তাই এমন নাম। ন্যানো আকারের গুয়ানিন কেলাসের মধ্যেই স্বল্প দৈর্ঘের আলো
প্রতিফলিত (reflected) হয়। ফলে তৈরি হয়
নীল রঙের রশ্মি।
তৃতীয় স্তরে থাকে
মেলানোসোম (melanosome), কোষের অংশ বিশেষ
(organelle)। বিশেষ কাজে দক্ষ। কালো রঙের রঞ্জক পদার্থ
মেলানোফোর (melanophore) নিঃসরণ করতে
পারে। রং বদলের নেপথ্যে মূল ভূমিকা মেলানোফোরের। প্রসঙ্গক্রমে, মানুষের ত্বকে থাকে মেলানিন। তৈরি করে
মেলানোসাইট নামের কোষ। মেলানিন বহু আক্রমণ থেক আমাদের ত্বককে রক্ষা করে। মেলানিন
কিন্তু মেলানোফোর নয়।
গিরগিটির ত্বকের
মেলানোফোর তারকা আকৃতির। তার বিস্তার সব গুলো স্তর জুড়ে। আর এর মধ্যেই মজুত থাকে
মেলানোসোম। এরা যখন এক জায়গায় না থেকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন ত্বকের রং কালো (dark)। আর তারার কেন্দ্রে একত্রিত হলে ত্বক হয়ে যায় হালকা রঙের।
মেলানোসোমের
বিস্তার অনেকটা অঞ্চল জুড়ে। বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থগুলোকে ঢেকে দিতে পারে। ঢেকে
দেওয়ার তারতম্য অনুযাযী মানে আচ্ছাদনের রকমফেরে ত্বকের রঙ বদলে যায়। কালো, লাল আর হলুদ রং বিভিন্ন ভাবে মিশিয়ে বহু রঙের
শেড তৈরি করা যায়। গিরগিটি তেমন করতে পারে। শুধু তাই নয়, রঞ্জক পদার্থগুলো আবার মিশে গিয়ে হারিয়ে যায়
না।
ন্যানো আকারের
ক্ষুদ্র রঞ্জককণা গুলো ছোট ছোট থলির মধ্যে ভরা থাকে। ত্বকের বিভিন্ন স্তর
সঙ্কুচিত-প্রসারিত হয়। ফলে চামড়ার বিভিন্ন অংশে রঞ্জক পদার্থের ঘনত্ব বদলে যেতে
থাকে। আলাদা আলাদা রং সৃষ্টি হয়। নীল আর সাদা রঙ তৈরি হয় যখন ইরিডিফোরের গুয়ানিন
কেলাস (guanine crystal) গুলোয় আলোর
বিচ্ছুরণ কিংবা প্রতিফলন হয়।
বলা হয়েছে,
তাপমাত্রা বদলের জন্য ঘটে
গিরগিটির রং বদল। ত্বকে থাকে গ্রাহক বা রিসেপ্টর (receptor) অনু। রিসেপটর বাইরের তাপমাত্রা অনুভব করে
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে সিগন্যাল পাঠায়। সেখান থেকে সংকেত আসে। তার ফলেই ঘটে যায়
ত্বকের রং বদল। অবশ্য এই কাজে জিনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গিরগিটির ত্বকে
থাকে দুই ধরনের ইরিডোফোর (iridophore)। অদ্ভুত ক্রিয়াকর্ম এই
কোষের। অসংখ্য প্রোটিন প্লেট পরপর সাজান থাকে কোষের ভিতর। এগুলোই রঙের প্রতিফলন
ঘটায়। মানে কাজ করে মাল্টি লেয়ার ফিফ্লেক্টর (Multilayer reflector) হিসাবে।
যখন উত্তেজনা
বিহীন অবস্থা, মানে টেনশন ফ্রি,
তখন ইরিডোফোর কোষগুলোর
অবস্থান পরস্পরের কাছাকাছি। এমন অবস্থায় ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রশ্মির প্রতিফলন হয়।
নীল রঙ ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের। তাই রং তখন নীল।
আর কোষ যখন
উত্তেজিত থাকে? শত্রু মোকাবেলা
কিংবা শিকার ধরায় ব্যস্ত? এমন অবস্থায়
ইরিডোফোর কোষগুলোর পারস্পরিক দূরত্ব বেড়ে যায়। তখন দীর্ঘ তরঙ্গের রশ্মির (লাল,
কমলা, হলুদ) প্রতিফলন ঘটে।
আশ্চর্য কথা!
শুধু রং নয়, রঙের ঔজ্বল্যও
বদলাতে পারে গিরগিটি। পুরুষ গিরগিটি, সঙ্গিনী আকর্ষণ করতে এমন করে। বলা হয়েছে, প্রাণীটি ত্বকের রং বদলে নেয় বহু কারণে। পোকা
মাকড় শিকার করা, নিজেদের মধ্যে
ভাব আদান-প্রদান, অন্য গিরগিটিকে
ভয় দেখানো।
বাইরের তাপমাত্রা,
আলোর পরিমাণ অনুভব করে
এরা নিজদের রং বদলায়। আধুনিক গবেষণা জানিয়েছে নতুন তথ্য। রাতের ঘুমন্ত গিরগিটি,
গায়ে গাঢ় রঙ; শরীরে টর্চের আলো ফেলতেই সেই অংশ হালকা রঙের
হয়ে গেল।
গিরগিটির রং
পরিবর্তনের রহস্য জানা সম্ভব হয়েছে অনেকটাই। কিন্তু এর মূলে জিনের সক্রিয় ভুমিকার
কথা তেমন ভাবে জানা যায়নি।
রং বদলের রহস্য
উদ্ধার হয়েছে একশ বছরের গবেষণায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিজ্ঞানী
ফ্র্যাঙ্ক কার্লটন প্রথম জানিয়েছিলেন (১৯০৩), রং পরিবর্তনকারী প্রাণীদের ত্বকে থাকে এক ধরণের
রঞ্জক কোষ (Proceedings of the American Academy of Arts and Sciences,
Vol. 39, No. 10, Dec. 1903)। এরপর গবেষণা হয়েছে বিস্তর। ইদানীং জেনেছি অভিনব
আবিস্কারের কথা। কোরিয়ার বিজ্ঞানিরা তৈরি করে ফেলেছেন রং বদলানো ত্বক (Nature
Communications volume 12, Article number: 4658 (2021)।
গিরগিটির মত
রংবদল কি মানুষ করতে পারবে? পারবে। অসংখ্য
আয়না আর অপটিক্যাল যন্ত্র নিয়ে যদি চলাফেরা করা যায়। ইদানীং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়
গাছের পাতায় রঙে পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়েছে।
বহু তথ্য অজানা।
বিবর্তন প্রক্রিয়ায় লক্ষ লক্ষ বছর ধরে গিরগিটি শিখেছে ত্বকের রং বদলের কৌশল। ত্বক
শরীরের বৃহত্তম অঙ্গ। তাকেই প্রথমে বাইরের আঘাত সামাল দিতে হয়। ত্বক সংক্রান্ত
গবেষণার বিরাম নেই। রং পরিবর্তন, জিনের ভূমিকা
ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞান ভবিষ্যতে বহু রোগ
মোকাবিলায় সাহায্যকারী ভূমিকা নিতে পারবে।