গল্প - ৫ । অগ্রহায়ণ ১৪৩১



        কুঁজি বুড়ি ও কচ্ছপ 











সনৎ ঘোষ
হাওড়া, পশ্চিম বঙ্গ



 

তাল দিঘির ঘাটে এসে কুঁজি বুড়ি অবাক, কে যেন কাদছে!  ঘাটের এক প্রান্ত থেকে মৃদু স্বরে সেই কান্নার শব্দ। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে সে, কান্নাটা ঠিক কোন দিক থেকে আসছে! পুবের ঝোপের দিকে তাকায়, না সেদিক থেকে তো নয়, দক্ষিণে তালসারি শুনশান। ঘাটের আশপাশে তো কেউ নেই, তাহলে জলের ভেতর থেকে কি! ভুত প্রেত কিছু নয়তো!

এতোদিন এই দিঘিতে সে আসছে  কত নেমেছে দিঘির জলে মাছ ধরেছে এমন অলুক্ষণে কান্না তো শোনে নি কখনো। দিঘির  ঘাটে যেতে কেমন ভয় করছে আজ। তবুও সাহস করে লাঠির ঠক ঠক  ভরে খানিকটা পাড়ের দিকে এগিয়ে বলে  উঠে, ভরদুপুরে কে কাঁদো বাছা! আর কাঁদছো ই বা কেন! আর দেখা ই বা দিচ্ছো না কেন! কুঁজি বুড়ি সকালে দিঘিতে ছিপ ফেলে যায়, দুপুর বেলা সেই বড়শি তোলে। যা মাছ পায় তাই দিয়ে রান্না হয়। মাছ ছাড়া খালি হাতে কোন দিন ফেরে নি কুঁজি। বড় বউ ছোট বউ মিলে উঠানে পাতার জ্বালে ভাত ডাল বসিয়ে কুঁজিকে তাড়া দেয় কই গো মা দিঘিতে যাও। তখনি কুঁজি দিঘি থেকে বড়শি তুলতে আসেলাঠিটা শক্ত করে ধরে ঘাটের কাছে আসে, পাড়ে গেঁথে রাখা ছিপের লাঠিটা  থর থর করে কাঁপছে। কুঁজি বুঝতে পারে আজ নিশ্চয় বড় কোন মাছ গেঁথেছে। এতোক্ষণে নিশ্চিত হয় কুঁজি, কান্নাটা জলের তলা থেকেই আসছে  ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে যে রকমটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে ঠিক সেরকম। মাছেরা কি কাঁদে! ছিপের কাছে যেতেই ভেসে ওঠে ছিপে গাঁথা কাছিমটা, আমায় ছেড়ে দাও কুঁজি বুড়ি, আমায় ছেড়ে দাও। আমায় মেরো না। কুঁজি বুঝতে পারে আজ আর বড়শিতে কোন মাছ গাঁথে নি, গেঁথেছে এই কচ্ছপ। কিন্তু বড়শিতে কচ্ছপ গাঁথাটা তো শুভ কিছু নয়। হায় হায় করে ওঠে কুঁজি আমার একি সব্যনাশ হলো। কিন্তু কচ্ছপ কাদছে কেমন করে! তাহলে কি মায়া কচ্ছপ! কচ্ছপ এবার বলে ওঠে না না কুঁজি বুড়ি আমি মায়া কচ্ছপ নয়। তবে আমি মানুষের মনের কথা পড়তে পারি, মানুষের কথা বুঝতে পারি। তুমি আমাকে বড়শি থেকে খুলে দাও, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। একি! এ কচ্ছপ দেখি আমার নাম ও জানে। তা তুমি আমাকে কিভাবে সাহায্য করবে শুনি? আমি  তোমার মোহর চোর ধরে দিতে পারি

এই তুমি কি করে জানলে আমার মোহর চুরি যাচ্ছে? বললাম না আমি মানুষের মনের কথা পড়তে পারি। তাই তো দেখছি! কি ভাবছো কুঁজি বুড়ি! আমাকে মেরো না, ছেড়ে দাও আমায়। তোমায় এখুনি ছেড়ে দিচ্ছি কচ্ছপ, এখন বলো, কে কিভাবে আমার মোহর চুরি করছে! আমি তো নিঃশ্ব হয়ে যাচ্ছি। কিছুতেই চোর ধরতে পারছি না। হায় হায় আমার এক কলসি মোহরএখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। দাড়াও আগে তোমার মুখ থেকে আটকানো বড়শিটা খুলে দিই, সত্যি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আঃ আমায় বাচালে তুমি কুঁজি । 

হ্যাঁ এবার বলো কচ্ছপ কে সেই চোর? তার চোদ্দ গুষ্টিকে আমি ছাড়বো না। শেয়ালে খাওয়াবো সাপে কাটাবো

না না কুঁজি ওভাবে নয়, একটু ধৈর্য ধরো। চোর ঠিক ধরা পড়বে। 

      তোমার মোহর চোর কে আমি চিনি, কিন্তু তুমি তো চেনো না। তোমায় তাকে হাতে নাতে ধরতে হবে

এই এই শোন, তুমি মোহর চোরকে চিনলে কেমন করে?

সেই টাই তো বলবো, তার আগে চাতালে উঠে একটু বসি। হাত পা গুলো টনটন করছে, ঠোঁট দুটো ও কেটে গেছে। তুমি ও ঘাটের কয়েক ধাপ নেমে এসো চুপি চুপি বলি এবার কি করতে হবে

হ্যাঁ কচ্ছপ তাই বলো, এই বসলাম

সেদিন তোমার ছোট বউ বড় বউ আর দুই  ছেলে মিলে শলা করছিল ঘাটের এই চাতালে এসে। মা মোহর কোথায় লুকিয়ে রাখে খোঁজ করতে হবে। বুড়ি খুব কিপটে, ঘাটের দিকে পা যাচ্ছে এখনো মোহর জমিয়ে কি করবে শুনি! মলে শান্তি পাই

তা শুনে তেতে আগুন হয়ে ওঠে কুঁজি, বটে তাহলে ওরাই আমার মোহর চুরি করে! আর তলে তলে আমায় মারার ফন্দি আঁটে! সব কটাকে শেয়ালে খাওয়াবো। 

আরে থামো থামো কুঁজি এতো রেগে গেলে চলবে না! আসল চোর কে ধরতে হবে তোমাকে

কেন চার জনেই তো শলা করেছিল বললে

হ্যাঁ চারজন শলা করেছে বটে, কিন্তু চুরি করেছে তো একজন

কে সে! বলো আমাকে। 

বললাম তো চোর তোমাকেই ধরতে হবে। 

ঠিক আছে তাই হবে

তাহলে, তুমি একটু দাঁড়াও আসছি আমি, এই বলে কচ্ছপ জলের তলায় ডুব দিল। জলের ভেতর থেকে একটা বুদবুদ উঠতে লাগলো, কিছুক্ষণ পর জলে ভেসে উঠলো কচ্ছপ আবার, মুখে একটা গুগলি তুলে কুঁজি বুড়ির হাতে দিয়ে বললো এটা জাদু গুগলি, এই তোমার চোর ধরিয়ে দেবে। একে একদিন  তোমার মোহরের কলসির মধ্যে রেখো। দেখো কেউ না বুঝতে পারে।  এরপর থেকে যে এই মোহরের কলসির মধ্যে হাত ঢোকাবে, সে আর কখনো কলসি থেকে হাত বের করতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না চিৎকার করে বলবে আমিই চোর ততক্ষণ পর্যন্ত এই যাদু গুগলি কলসির ভেতর থেকে হাত বের হতে দেবে না। 

তাই নাকি! দাও কচ্ছপ দাও, আমাকে ঐ যাদু গুগলিটা দাও। 

এই নাও কুঁজি বুড়ি, ধরো। আজই বাড়ি গিয়ে মোহরের কলসিতে রেখো। 

হ্যাঁ হ্যাঁ, চললাম কচ্ছপ

ঠিক আছে কাল আবার এসো কিন্তু

আসবো আসবো কচ্ছপ এবার থেকে আমি রোজ তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবো

পরদিনই কুঁজি বুড়ি এলো দিঘির ঘাটে, এবার তার বড়শিতে গেঁথেছে বড় একটা বোয়াল মাছ। কথামত ডাক দিলো কুঁজি, কচ্ছপ ও কচ্ছপ কোথায় তুমি। কুঁজির ডাক শুনে জলের ওপর ভেসে ওঠে কচ্ছপ। কি গো কুঁজি, আজ একটু তাড়াতাড়ি এসেছো যে!  বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে

তোমাকেই তো বলতেএলাম তোমার যাদু গুগলিতে কাজ হয়েছে কচ্ছপ। চোর ধরা পড়েছে, সে কি চীৎকার! যেই জিঞ্জেস করলাম কে চুরি করেছে আমার মোহর অমনি বড় বউ চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘আমি মা, আমি সেই চোর। আমায় ছেড়ে দাও। আর কখনো করবো না। কি করবো! বাচ্ছা মেয়ে করে ফেলেছে। তাই ক্ষমা করেই দিলাম ওকে। তবে চুরি যাওয়া অনেকটা মোহর ই ফিরে পেয়েছি। সবই তোমার জন্য কচ্ছপ, তোমার ঐ যাদু গুগলির জন্যই। 

    ঠিক আছে এবার তাহলে ঐ যাদু গুগলিকে দিঘির জলে ছেড়ে দাও। ওর ছানারা মা র পথ চেয়ে বসে আছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ কচ্ছপ ওকে সঙ্গে করেই এনেছি। যাও যাদু গুগলি  যাওতুমি তোমার আস্তানায় ফিরে যাও। আজ তাহলে চললাম কচ্ছপ, আবার কাল আসবো