গল্প - ৩ । জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


 মা ও ঘুড়ি









মামুন সরকার
গাজীপুর, বাংলাদেশ




 

বাজান আমি গেলাম। ঘুম ভাঙলে ওধুষডা ঠিক মত খাইয়ো। বেলা ডুবার  আগেই আবার ফিররা আসমু। তুমি কিন্তু বাজান ঘর থাইকা বাইরে যাইও না। আমি গেলাম।

ছেলে বিছানা থেকে এক লাফে ওঠে বসে। চোখ কচলাতে কচলাতে বলে- তোমার যহন খুশি আইসো। আমার গুড্ডি কিনার টাকা দিয়া যাও

বাজান। তোমার শরীল ভালা না। সারারাইত জ্বরে কাঁপছো। তোমার রইদে যাওন নিষেধ। অসুখ ভালা অইলে ঘুড্ডি কিন্না দিমুনে।

না, আইজই কিন্না দিবা। প্রতিদিন এক কতা কইবা না। একলা একা ঘরে শুইয়া থাকতে আর ভালা লাগে না। আমার অসুখ সহজে ভালা অইব না।

এমন কতা কইতে নাই বাজান। আল্লা বেজার অইব। শুইয়া শুইয়া আল্লারে ডাকো আর কও, আমার অসুখ ভালা কইরা দেও।

আইচছা কইমুনে। অহন তুমি ঘুড্ডি আর সুতা কিনার টাকা দিয়া যাও। 

মা  মায়া ভরা চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন- পাগলামী করে না বাজান। সাহেবের বাড়ির বিরানি গরম কইরা রাখছি। মুখ ধুইয়া খাও। তার কিছুবাদে ওধুষডা খাইয়ো। আমি যাই দেরি অইয়া যাইতাছে।

কথা শেষ করে মা দরজায় পা রাখেতেই ছেলে কিরমন দৌঁড়ে এসে মায়ের আঁচল চেপে ধরে বলে- কও। টাকা দিবা নি? নাইলে তুমারে মাইরা লামু…

মা আঁচল থেকে হাত ছাড়িয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন- না দিমু না। না দিলে কি করবি?

কিরমন দু'হাত একত্র করে আঁচল ছারেনা।

মা চোখের পানি ছেড়ে মাথাটা ছেলের কাছে নিয়ে বলেন- তয়, খাড়াইয়া আছছ ক্যান, নে মার। আমি তো মরবারই চাই। আমি আর বাঁচতে চাইনা।

ছেলে কিরমন চুপ হয়ে যায়। মায়ের কথায় তার বুকের ভেতরে একটা কষ্ট উঁকি দেয়। সবার বাবা আছে।  তার মা ছাড়া কেউ নেই। কাউকে যখন বাবা বলে ডাকতে শুনে তার খুব কষ্ট হয়। বাবা কি জিনিস বা বাবার আদর কেমন  কিরমনের  তা জানা নেই। মা- ই তার বাবা। মা যখন ওকে বাজান বলে ডাকে, ওর খুব আনন্দ লাগে। তাই সব আবদার মায়ের কাছে। মায়ের সাথে তার খুনসুটি নিত্যদিনের। ছেলের সব আবদার পূরণ করতে না পারলেও সাহেবদের বাড়ি ভালো খাবারটা তার জন্যে নিয়ে আসে। সে খাবার কিরমন মজা করে খায়। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর  সে আবদার করেছিল বিরানি খাবে। মা সে রাতে দোকান থেকে বিরানি কিনে এনেছিল। আর গতরাতে এক সাহেবের বাড়ি থেকে দুইবাটি বিরানি নিয়ে এসেছে। সাথে মাংসের পরিমানও অনেক। জ্বরের তীব্রতা বেশি থাকায় রাতে কিরমনের বিরানি খাওয়া হয়নি। সকালে তা গরম করে বাটিতে রেখেছে, যাতে পেট ভরে খেতে পারে। কিন্তু আজ সকালটা অন্যরকম হয়ে গেল। কিরমনকে একটি ঘুড়ি আর সুতা কিনে দেয়ার আবদার অনেক দিনের। দেই, দিচ্ছি বলে আর কিনে দেয়া হয়নি।

কথা বলতে বলতে মায়ের চোখের কয়েক ফোটা গরম জল কিরমনের মাথায় পড়তেই সে মা'কে জড়িয়ে ধরে বলে- না। তোমারে মারন যাইব না। তোমারে মারলে আমি একলা অইয়া যামু। তুমি না থাকলে আমারে দেখবো কেডা। যাও। কামে যাও। তোমার কাছে আর ঘুড্ডি চাইমু না।

মা চোখের পানি আঁচলে মুছে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন- যা, বিরানি খাইয়া  একটু সময় পর ওষুধ খাইয়া ঘুম দে। ভালা ঘুম অইলে গায়ে জোর বাড়বো।

খাওয়ায় দেও।

খাওয়ায় দিতে পারমু না। আমি তোর মা না। মা রে কেউ মাইরা ফালাইতে চায় না।

ধুর। কি যে কও তুমি। তুমিই  আমার মা, তুমিই আমার বাবা। তোমারে মারলে আমি বাঁচমুনি। ডর দেখাছি। যাতে তুমি আমারে ঘুড্ডি আর সুতা কিন্না দেও। অহন কও খাওয়ায় দিবা কি না।

আমার সময় নাই। দেরি অইলে বিবিসাব রাগ করবো।

আইচ্ছা যাও। আমি নিজেই খামুনে।

মা ঘরে  ঢুকে বাটি থেকে কিছু বিরানি একটা প্লেটে নিয়ে কয়েক লোকমা কিরমনের মুখে তুলে দিয়ে বলেন- নে থালাডা ধর। আস্তেধীরে সবডা বিরানি খাবি।

কিরমন আর কথা না বাড়িয়ে বিরানির প্লেট হাতে নিয়ে নিজেই খেতে শুরু করে। মা ছেলের কপালে একটা প্রীতির চুম এঁকে কাজে ছুটে আর বলেন-  বাজান, মনে কইরা ওষুধ কিন্তু খাইয়ো।

কিরমন অনেক সময় নিয়ে বিরানি খাওয়া শেষ করে। আজ অনেকদিন পর তৃপ্তিসহ খেতে পেরে ধোয়া হাত পেটে ঘষতে ঘষতে বলে- আলহামদুলিল্লাহ, শুকরিয়া তোমার দরবারে। মনে লয় তুমি আমার অসুখ ভালা কইরা দিছো। 

কিরমনের বয়স বারো ছাড়িয়ে তেরোতে পরেছে। তিন বছরের শেষের দিকে বাবাকে হারিয়েছে। তাই বাবার আদর তেমন মনে নেই। ওর বাবা ছিল রিক্সা চালক। এক রোড দুর্ঘটনায় মারা যায়। থাকে খিলগাঁও রেল বস্তিতে। চার বছর বয়সে মা কিরমনকে এক এতিমখানায় দিয়ে দেয়। ইচ্ছে ছিল হাফেজ হবে। মেধা শক্তি তেমন ভালো না। বারবার পড়েও কোনো পড়া মগজে ধরে রাখতে পারে না। তাছাড়া কিরমন বারো মাসে তেরো  রোগে ভোগে। এতিমখানায় উন্নত চিকিৎসার ব্যাবস্থা নেই। সব রোগের মেডিসিন নাপা। অসুখের খবর পেলে মা গিয়ে কিরমনকে নিয়ে আসে চিকিৎসার জন্য। অসুখ ভালো হলে আবার দিয়ে আসে। রোগা স্বাস্থ্য নিয়ে গত আট বছরে নামাজের নিয়মকানুন, কোরআন পড়াসহ ফাইভ পাস করেছে। মা ছেলের ফাইভ পাসে খুব খুশি এবং আশাবাদি ছেলে একদিন হাফেজ হবে। মা দু'তিনটি বাসা বাড়িতে ঘর ঝাড়পোছা, কাটাবাছা ও কাপড় কাঁচার কাজ করে। মাসে যা আয় হয় তার বেশিরভাগ টাকা ছেলের চিকিৎসার পিছনে চলে যায়। ভবিষ্যৎ একটাই ছেলে শিক্ষিত হলে একদিন কষ্টের প্রতিদান সুখ মিলবে।

কিরমন খাবার খেয়ে ঘুম যায়। একঘুমে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। চোখেমুখে পানি দিয়ে বাইরে এসে দাড়ায়।  হেমন্তের বিকেল। মৃদুল ঝিরঝির বাতাসে শীতের আগমন বার্তা। আশপাশের প্রতিটি বাড়ির ছাদে রঙবেরঙের ঘুড়ি উড়ছে। কিরমনেরও খুব ইচ্ছে ঘুড়ির সুতা ছেড়ে আকাশ দেখবে। মাদ্রাসায় চলে গেলে আর ঘুড়ি উড়ানো হবে না। কঠোর নিয়মের মধ্যে থাকতে হয় সেখানে। ইচ্ছে থাকলেও অনেককিছু পূরণ হয় না। সে চোখ রাখে বাড়ির ছাদে। কোনো ঘুড়ি সুতা কেটে মিটিতে পরে কি না। সুতা কাটলেও ঘুড়ি থাকে তার ধরাছোঁয়ার বাইরে।

দীর্ঘসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে মাথা ব্যাথা শুরু হয়। সে বস্তিঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে চোখবুজে থাকে। 

সন্ধ্যার একটু পর মা একটা ঘুড়ি আর নাটাই হাতে ঘরে ঢুকে লাইট জ্বেলে দেখেন কিরমন ঘুমোচ্ছে। গায়ে হাত রেখে জ্বর পরখ করেন। জ্বর নেই। শরীর বেশ ঠান্ডা। ঘুমোচ্ছে বলে ছেলেকে না ডেকে ঘুড়ি নাটাই ঘরের এককোনায় ঝুলিয়ে রাখেন। রাতের খাবারের আয়োজন শেষ করে ছেলেকে ডাকেন- বাজান, ওঠো। মেলা রাইত অইছে। ভাত আর ওষুধ খাইয়া আবার ঘুমাইয়ো।

মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে কিরমনের। ঘরের কোনে নাটাই ঘুড়ি দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠে। রাতের খাবার রেখে নাটাই ঘুড়ি হাতে নিয়ে মা'কে সাথে করে ঘরের বাইরে এসে দাড়ায়। গোল একটা চাঁদ পুবাকাশে ঝুলছে। জোছনা আর নিয়নবাতির আলোতে অন্যরকম এক আলোর জগৎ। বস্তিঘরের পাশেই এক চিলতে খোলা মাঠ। মায়ের হাতে ঘুড়ি দিয়ে কিরমন বলে-

মা, ঘুড্ডি ওড়াইয়া দেও।

বাজান, রাইতের বেলা কেউ ঘুড্ডি ওড়ায়?

কেউ না ওড়াইলে নাই। আমি ওড়ামু।

ছেলের পাগলামীতে মা বিরক্ত হন না। ছেলের কথামত ঘুড়ি আকাশে ঠেলে দেন। কিরমন একটু দৌঁড়ে ঘুড়িকে বাতাসের পিঠে উঠিয়ে সুতা ছাড়তে থাকে। ঘুড়ি অনেক উপরে বাতাসে ভাসতে থাকে। জোছনা আর নিয়নবাতির আলোছায়ায় ঘুড়ি অস্পষ্ট দেখা যায়। কিরমন নাটাই হাতে মা'কে জড়িয়ে ধরে বলে- মা, তুমি হইলা দুনিয়ার সেরা মা। অহন কও দেখি ঘুড্ডি পাইলা কই?

কই আর পামু। এক সাহেবের পোলারে জিগাইলাম- বাজান, ঘুড্ডি কই থাইক্যা কিন্না আনেন? জবাবে সে জানতে চাইলো– খালা আপনে ঘুড্ডি দিয়া কি করবেন?

কইলাম- আমার পোলা কিরমন, তার ঘুড্ডি ওড়ানের খুব সখ। প্রতিদিন বায়না ধরে, কিন্তু কিন্না দিতে পারি না। একটা ঘুড্ডি আর নাটাই পাইলে আমার পোলা খুব খুশি অইত। গরীব মানুষ, কন দেখি একটা ঘুড্ডির দাম কত অইব। সাহেবের পোলা তার ঘুড্ডি আরা নাটাই দিয়া কইলো- নেন, আমার ঘুড্ডি আর নাটাই আপনার পোলারে দিলাম। টাকা দিতে চাইলাম নিলো না। কইলো- সে একটা কিন্না নিব।

কিরমন বলে- সাহেবের পোলা খুব ভালা মানুষ।

মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন- আমি যহন তোমার মত ছোড আছিলামআমিও গুড্ডি ওড়াইছি।

এইডা কি কও মা। তুমি মাইয়া মানুষ, তুমি গুড্ডি ওড়াইবা ক্যান। তুমি খেলবা কুতকুত বৌচি।

কুতকুত বৌচিও খেলছি। পাড়ার পোলারা যহন গুড্ডি লইয়া মাঠে যাইত, আমিও যাইতাম। সুতা ছিঁড়া গুড্ডির পিছে অনেক দৌঁড়াইছি। কোনদিন গুড্ডি ধরতে পারি নাই।

তুমি দেহি আমার মত। সাহেবের পোলাপানরা যহন ছাদে গুড্ডি ওড়ায়, আমি আকাশ পানে চাইয়া থাকি। কোনসম গুড্ডির সুতা কাটব। সুতা কাটে কিন্তু আমি ধরতে পারি না। বাড়ির দেয়াল ডিঙাইতে গেলে গুড্ডি আমার নাগালের বাইরে চইল্লা যায়। ধরতে পারলে তোমারে নাটাই আর গুড্ডি কিন্না দিতে কইতাম না। 

ঘুড্ডিতো দিলাম। লেখা-পড়া কিন্তু ভালা করতে অইব।

মানুষ য্যান কয় আমার বাজান শিক্ষত অইছে।

মা ছেলের কথার মাঝে নাটাই ঘুরাতে গিয়ে বুঝতে পারে ঘুড়ির সুতা ছিঁড়ে গেছে। ঘুড়ির কোন ছায়া আকাশে নেই। জোছনার আলোয় মা দেখতে পান হাসিখুশি কিরমনের সাদা মুখ কালো হয়ে গেছে। ছেলে কিছু বলার আগে মা বলেন- মন খারাপ কইরো না বাজান।

অসুখ ভালা অইলে আবার ঘুড্ডি কিন্না দিমু।

কিরমন কোন কথা বলে না। ঘুড়ি হারানোর কষ্টের নোনাজল মায়ের শাড়ির আঁচলে মুছে মা'কে জড়িয়ে ধরে।