অভি শিলিগুড়িতে আসায় রজত হঠাৎ প্ল্যান করে যে এবার দুই বন্ধু শৈলশহর শিলং এডভেঞ্চার প্রিয়। বন্ধুদের সঙ্গে মজা করতে, ঘুরতে খুব ভালোবাসে সে। চাকুরির পাশাপাশি, রজতের নেশা ট্রাভেল ভ্লগ করা। ইতিমধ্যে অনেক ভক্ত-অনুগামীও হয়ে গেছে তার।
ট্রেনের হুইসেল বাজলো। একজোড়া তরুণ ও তরুণী হাঁফাতে-হাঁফাতে অভিকে প্রায়
ধাক্কা দিয়ে ট্রেনে গিয়ে উঠল। সদ্য বিবাহিত দম্পতি হতে পারে। অবশ্য দুশ্চিন্তার
মধ্যে এসব লক্ষ করার সময় নেই অভির। সে ভাবছে এই যাত্রায়
তাহলে আর শিলং যাওয়া হবে না, হয়ত বা রজত ইয়ার্কি মেরে এইসব
প্ল্যান করেছিল। রজতকে বিশ্বাস করা একদম ঠিক হয়নি। মনে-মনে খুব রাগ হচ্ছিল অভির।
ভাবছিল আর কোনওদিনও রজতের কথায় বিশ্বাস করবে না। হাত ঘড়িতে বারবার সময় দেখছিল
সে। ট্রেন ছাড়বে এক্ষুনি। নিরাশ হয়ে অভি লাগেজ নিয়ে ফিরে যাবে বলে ঘুরে দাঁড়ালো।
ঠিক সেই সময়ে ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে, ট্রেনের দরজায় রজতের আবির্ভাব! সে সাথে রজতের জোর চিৎকার, "অভি, আমি এইখানে। লাগেজটা দে। উঠে আয়।"
অভি চমকে উঠল। সে ভাবতে পারছে না হাসবে, না রাগ দেখাবে। রজত আগে
থেকেই ট্রেনে উঠে বসে আছে।
অভি রাগ করে শুধু বলল, "সব সময় এইসব
করা ঠিক নয়।" রজত ছেলে মানুষের মতো হো-হো করে হেসে উঠল। অভি বেশিক্ষন রাগ
করে থাকতে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল দুই বন্ধুর জমজমাট আড্ডা। ট্রেনের
গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আড্ডা আরও জমে উঠল।
অভি তাকিয়ে দেখল দুই সুবেশি তরুণী তার ঠিক উল্টো দিকের বার্থে এসে বসল।
দু’জনের জিন্সের প্যান্ট। একজনের হলুদ
রঙের টপ, আরেকজনের লাল চুড়িদার। মনে হচ্ছে তারা সদ্য
কলেজ পাশ করা। দু’জনেই আড়চোখে রজতের দিকে তাকাচ্ছে। রজত সুপুরুষ। একদম পারফেক্ট
ব্যাচেলর। গায়ের রং ফর্সা। শেভ করা মুখে
নীলচে আভা। অভির চেহারা সাধারণ। তাই তার দিকে তাকাবে এমন আশা সে করে না। কিন্তু
যাকে দেখছে তারা, সে এসব ব্যাপারে উদাসীন, নিজের গল্পে মশগুল। ওই দুই তরুণী যে কামরায়
আছে,
তা যেন সে দেখছেই না।
রজত ট্রাভেল প্ল্যানটা তখন অভিকে বলতে ব্যস্ত, "গুয়াহাটি নেমেই আমরা চলে যাব শিলং। শিলংয়ে একরাত্রি থেকে চলে যাব চেরাপুঞ্জি।
সেখানেই তিন দিন থাকবো।"
চেরাপুঞ্জি শুনেই অভি বলে
উঠল,
"এই ভরা বৃষ্টির মরসুমে চেরাপুঞ্জি?
রজত হেসে বলল, "বর্ষাতেই
চেরাপুঞ্জির আসল সৌন্দর্য! ভরা বর্ষায় মেঘের দেশ মেঘালয়ে প্রতিটি মুহূর্তে
মেঘেরা আপন ছন্দে খেলা করে। সেটাই তো দেখার জিনিস।"
রজতের শুরু হয়ে গেল তার
ভ্রমণ গুরুর সব বাণী। সে বলেই চলল, " আমরা একটা হোম স্টেতে থাকবো। ভারী বর্ষার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যকে এবার আমরা মন
প্রাণ ঢেলে উপভোগ করব।"
অভি একদম চুপ করে সব শুনছে। মাঝে একটু টিপ্পনী কেটে বলল, "তোর এই কথাবার্তা শুনলে, মেঘালয় সরকার তোকে তাদের
ট্যুরিজমের দায়িত্বটা দিয়ে দেবে।"
গল্পে গল্পে রাত হয়ে গেল।
ট্রেনের রাতের খাবার সেরে দু’জনে শুয়ে পড়ল।
দুই
গুয়াহাটি স্টেশনে ট্রেনটা এক ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছালো। স্টেশনে নেমে রজত বলল, "কিছু চিন্তা করবি না। আমার সব প্ল্যান করা আছে, সব বুক করা আছে, গাড়িও চলে আসবে আমাদের
জন্য।"
অভি বলে উঠল, "তোর সাথে
পাহাড়ে বেড়াতে যাব কত দিনের ইচ্ছে ছিল আমার। অবশেষে আশাটা পূর্ণ হতে
যাচ্ছে।"
সব ব্যবস্থাপনার কথা শুনে অভি খুব খুশি হলো। রজত বলল, "সত্যি, তুই ছুটিটা ম্যানেজ করতে পারায় আমারও বেশ ভালো
লাগছে। ট্রাভেল পার্টনার মনের মতো না হলে ভ্রমণটাই বৃথা হয়ে যায়।"
অভি ঘড়ি দেখল প্রায় দশটা বাজে, কিন্তু তাদের গাড়ির দেখা নেই। রজত বিরক্ত হয়ে বলল, "গাড়ি না এলে সর্বনাশ! নতুন করে গাড়ি ভাড়া করতে হবে।" এমন সময় সামনে এসে
দাঁড়াল এক ব্যক্তি। "আপ কেয়া রজত চৌধুরী হো," লোকটা বলল।
রজত বলে উঠল,"হা, মে হি রজত হু।"
লোকটা বলল, "মে আপ লোগো কা ড্রাইভার।
চলিয়ে মেরে সাথ।"
এই কথা বলেই লোকটা দুটো ভারী লাগেজ কাঁধে নিয়ে চলল। ড্রাইভারটাকে অভির একদম
পছন্দ হলো না। কেমন যেন লোকটা! চোখগুলো কেমন ঘোলাটে। গলার স্বরটাও কেমন যেন ভাঙ্গা, খ্যান খ্যানে। লিকলিকে শরীর। কিন্তু বেশ শক্তি আছে বোঝা গেল। সাদা ধবধবে
বিলাসবহুল গাড়ি। অভি ভাবল যাক তাহলে যাত্রাটা ভালই হবে। গাড়ি চলা শুরু করলো।
সঙ্গে চলছে রজতের বকবকানি। অভির কেন জানি ড্রাইভারটাকে পছন্দ হচ্ছে না। ড্রাইভারটা
খুব অদ্ভুত ধরনের। মুখটা পুরো ঢাকা।
অভি বলল, "ভাইসাব, আপকা নাম কেয়া হে।" ড্রাইভার চুপ, কোনও উত্তর নেই। কিছুক্ষণ পর অভি বলল, "ভাইসাব, গানা চালাইয়ে।"
ড্রাইভার গাড়িতে গান চালিয়ে দিল। পুরানো হিন্দি গান। গাড়ি তখন ডানদিকে
উমিয়াম লেককে রেখে পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছে। এদিকে তাপমাত্রাও একটু একটু কমছে।
মেঘলা আকাশ। হালকা-হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রজতকে অভি ইশারায় ড্রাইভারের হাবভাব
নিয়ে জিজ্ঞেস করায় রজত বলল, "এইসবে মন না
দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে যা।"
রজত ব্যস্ত তার মোবাইলে ভিডিও তুলতে। ওর সেই এক নেশা, ভিডিও করে ভ্লগ করা। মাঝে-মাঝে অভির দিকেও মোবাইলটা তাক করে রেকর্ডিং করছে।
তার সঙ্গে চলছে বকবকানি। এভাবে তারা শিলং পৌঁছে হোটেলে উঠলো। মূল শহরের পুলিশ
বাজার থেকে একটু দূরে তাদের হোটেল। দু'বছর করোনার তাণ্ডব শেষ হওয়ার পর এবার যেন ভ্রমণপিপাসুরা মৌমাছির চাকের মত এসে
ভিড় জমিয়েছে শিলং শহরে। কোথাও খালি জায়গা নেই। গাড়ি থেকে নামার পর লাগেজ
নামিয়ে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার হাওয়া। অভি বেশ অবাক হল।
রজতকে কিছু বলতে যাবে তখনই রজত বলে উঠল "কিছু চিন্তা করবি না, কাল সকালে সে ঠিক চলে আসবে, ওর সব প্ল্যান জানা আছে।"
তিন
সকাল সকাল প্রাতরাশ সেরে সেই গাড়িতে রওনা দিল দুই বন্ধু, চেরাপুঞ্জির উদ্দেশ্যে। এই জায়গায় অভির প্রথম ভ্রমণ। রজতের মনে হয় ডজনের
কাছাকাছি হয়ে যাবে। সব মুখস্ত ওর। গড়গড় করে সব বর্ণনা করে চলছে। সঙ্গে চলছে
মোবাইলে ছবি আর ভিডিও করা। রজত অভিকে বলল, "এবারের ট্রাভেল ভিডিওটা একদম অনন্য করতে হবে। একদম নতুন কনসেপ্ট দিয়ে ভিডিওটা
সাজাবো।"
অভি মনে মনে ভাবছে মানুষের যে কত রকমের নেশা হয়। রজতের এই নেশা পাঁচ ছয় বছরের
পুরানো। বছরে প্রচুর টাকা খরচ করে, তার এই ভ্লগ করার নেশায়।
সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে চললেও অভির মনে কেমন একটা ভয় ভয় করছে। ড্রাইভারের ব্যাপারটা
ওর মাথা থেকে যাচ্ছেই না। কালকের প্রথম দিকের দু’-একটি লাইন ছাড়া আর কোনো কথা
বার্তাতেই সে নেই। সে যেন একটা ভূতুড়ে রোবট।
শিলং-চেরাপুঞ্জি রাস্তার মাঝে ম্যাকডক ব্রিজের উপর গাড়িটা আসতেই রজত
"রোখ রোখ" বলে গাড়িটা থামিয়ে নেমে পড়ল। ডেকে বলল, "অভি! নেমে আয়। খুব সুন্দর একটা ঝর্না আছে পাশেই। চল দেখে আসি।" কথাগুলো
বলেই অভির দিকে মোবাইলটা তাক করে ভিডিও করা শুরু করলো।
রজত অনুরোধ করল, "প্লিজ আবার
একটু গাড়িটা থেকে নেমে, একটু আস্তে আস্তে বেরিয়ে
আয় তো। আবার রিটেক করতে হবে।" অভি জিজ্ঞেস করল,"কেন?"
"এই মুহূর্তটা গুরুত্বপূর্ণ হবে", বলল রজত।
অভি বিরক্তি প্রকাশ করাতে রজত হেসে বলল, "এবারের ভ্লগটা তোকে মূল চরিত্র করেই আমি বানাচ্ছি, তুই খুব ফেমাস হয়ে যাবি।"
অভি গাড়ি থেকে দু’-এক পা দূরে যেতেই হঠাৎ তার কি মনে হল। ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়ির
দিকে তাকাতেই দেখে ড্রাইভার নেই। অভির বুকটা ধড়াস করে উঠল। ড্রাইভার উধাও। গাড়িটা
দাঁড়িয়ে আছে।
অভি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, "রজত, আমাদের ড্রাইভার কোথায়?"
রজত অভির কথায় কর্ণপাত না-করেই হাত ধরে টেনে বলল,"আরে চলতো সামনে দশ মিনিট হাঁটলেই ডুআন সিং ফলস। তার অদ্ভুত সৌন্দর্য। আর এইসব
ছাড় তো, ড্রাইভার আছে কোনও দিকে, এইসব চিন্তা করবি না, ফিরে আসবে। তুই চল।"
রজত পাগলের মত শুধু ভিডিও রেকর্ডিং করে যাচ্ছে। আর অভি অসহায়ের মতো রজতের
সঙ্গে সঙ্গে চলছে। ক্যামেরা ওর দিকে ঘুরালে রজতের মন রাখার জন্য জোর করে একটু
হাসছে।
ফিরে আসার পথে রজত বারবার জোর করায়
ব্রিজের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা খাদের দিকে চলে গিয়েছে সে দিকে অল্প একটু নামবে বলে
পা বাড়িয়েছে অভি। অনায়াসেই কয়েক মিটার নেমে আবার উঠে আসবে সে, এমনটা ভেবেই হাঁটছিল। হঠাৎ হাত দশেক দূরে
যেখানে গাড়িটা দাঁড়িয়ে সেখান থেকে একটা পাথর গড়িয়ে নিচের দিকে নামতে
লাগল। এই পাথরটা ভাগ্যিস হাত দশেক দূর দিয়ে গেছে, না হলে যে কি হত! শিউরে উঠল সে। ভয়ে তার মাথা কাজ করছে না যেন।
তাড়াতাড়ি উঠে এল অভি। গাড়ির কাছে এসে দেখে ড্রাইভার গাড়িতে বসা। গাড়ি
আবার চেরাপুঞ্জির দিকে চলা শুরু করল।
অভির অস্বস্তিটা সমানে মনের মধ্যে খচখচ করছে। মনে মনে ভাবছে এইবার ভ্রমণে
আসাটা মনে হয় ভাল হয়নি। সে যেন একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছে। মনের কথাগুলো সে কাউকে
বলতেও পারছে না।
রজত বলে উঠল,"আমরা
চেরাপুঞ্জি এসে গেছি। আর পনেরো মিনিটের
রাস্তা, সেভেন সিস্টার্স ফলস সামনেই।" তখনই গাড়িটা বাঁক নিল। মূল রাস্তা থেকে গাড়িটা
বাঁদিকে ছোট রাস্তা ধরল। আঁকাবাঁকা রাস্তা পাশে শুধু খোলা ঘাসে ভরা উঁচু-নিচু মাঠ।
বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশটা মনে হচ্ছে মেঘের ভারে ভেঙে পড়বে। রাস্তার মধ্যে দিয়ে
কুয়াশার মতো মেঘগুলোকে ভেদ করে গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে। অভি রজতকে জিজ্ঞেস করল, "এত নির্জন রাস্তা দিয়ে কোথায় যাচ্ছি?"
রজত উত্তর দিল,"নির্জন
জায়গায় গিয়ে তো আমরা তিন দিন আরামে থাকবো। ওইখানে মোবাইল কাজ করে না। বাইরের
দুনিয়া থেকে একদম বিচ্ছিন্ন। ভারী সুন্দর জায়গা।" একথা শুনে তো অভির পিলে
চমকাল। ওর অফিস থেকে তো প্রায়ই বস ওকে ফোন করে। সরকারি চাকরি বলে কথা। বস্ না
পেলে তো ওকে অনেক কথা শুনতে হবে। এইসব ভাবতে-ভাবতে অভি দেখল গাড়ি এসে থামল খুব
সুন্দর একটা একতলা বাড়ির সামনে। বাগানের মাঝখান দিয়ে গাড়িটা গিয়ে দাঁড়াল
বাড়িটার মূল দরজার সামনে। সব খুব সুন্দর, সাজানো বাগানের মত। বাড়িটার পাশ দিয়ে পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে। বাড়ির সমান্তরালে
যেন বিস্তীর্ণ মেঘের সাগর। কালচে সাদা মেঘের গালিচার মত। কিন্তু আশেপাশে কোনও
মানুষ দেখতে পেল না। সব যেন খুব শুনশান।
গাড়ি থেকে নেমেই রজত ডাক
দিল,
"আশু কাকা, তুমি কোথায়? আমরা চলে এসেছি।" রজত অভিকে বলল, "আমি এই বাড়িতে আগেও থেকেছি। আশুতোষ মন্ডল এই বাড়ির কেয়ারটেকার। উনার সাথে
আমার ভারি বন্ধুত্ব। উনি সব ব্যবস্থা করে দেন।"
রজত আবার পিছু ফিরে ড্রাইভারের সঙ্গে কী কথায় মজে গেল! রজত ফিরে এসে বলল,"ড্রাইভার বলছে আবার ম্যাকডক ব্রিজের কাছে কাল নিয়ে যাবে আমাদের। ওর কি একটা
জিনিস নাকি ফেলে এসেছে।"
চার
কাঠের বাড়িটার বারান্দায় অভি বসে বসে চা আর পকোড়া খাচ্ছে। রজতের চা ঠাণ্ডা
হয়ে গেছে। ওর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। রজত হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের ঢাল ধরে ধরে মেঘের
গালিচার ভিডিও করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে অভির দিকেও মোবাইলটা তাক করে রেকর্ডিং করে
যাচ্ছে। আশু কাকার সাথে অভির বেশ গল্প জমেছে। অভি ড্রাইভারের রহস্যজনক ঘটনাটাও আশু
কাকাকে বলল। তার এই গল্প শুনে আশু কাকাকে যেন একটু চিন্তিত মনে হল।
কথা প্রসঙ্গে আশু কাকা বলল, "এর মধ্যে এই
এলাকায় একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে।" অভি জানতে চাইল, ঘটনাটা কী।
আশুকাকা বলতে থাকল, "গত সপ্তাহে
শিলং-চেরাপুঞ্জি রাস্তায় একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটেছিল।"
অভি বলল, "কি হয়েছিল? এমনটা তো কিছু শুনিনি।"
আশু কাকা বলল, "আপনাদের মতোই দু’জন টুরিস্ট একটা সাদা গাড়ি করে চেরাপুঞ্জি আসছিল। গাড়ির
ড্রাইভারের প্রথম ট্রিপ ছিল সেটা।"
অভি গভীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করল, "এরপর?"
আশু কাকা বলে উঠল,"ওই ম্যাকডক
ব্রিজের পাশে গাড়ি শুদ্ধ সবাই পাহাড়ের খাদে পড়ে গিয়েছিল। সেই গাড়ির ধ্বংসাবশেষ আর
আরোহীদের দেহ ভারী বর্ষার জন্য এখনো অব্দি খুঁজে পাওয়া যায়নি।" আশু কাকা
আরও বলল, "গ্রামের মানুষেরা বলে ওই
ড্রাইভারের আত্মা নাকি চেরাপুঞ্জির পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওই রাস্তায়
নাকি অনেকে ড্রাইভার ছাড়া একটা সাদা গাড়িকে চলতে দেখেছে। শোনা যায়, একদল ট্যুরিস্ট নাকি একবার ওই গাড়িতে উঠেছিল এরপর তাদের আর হদিস পাওয়া
যায়নি।"
অভির হাত থেকে আধ খাওয়া পকোড়াটা ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। তার মন বলছিল এখানে
খারাপ কিছু একটা ঘটবে। কিন্তু রজতের সঙ্গে কথা বলার কোনও জো নেই। সে তার নিজস্ব
ভ্রমণ ভিডিও নিয়ে ব্যস্ত।
সন্ধ্যা হতে হতে আবহাওয়া বেশ খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ চলে
যাচ্ছে। শুরু হল ভারী বৃষ্টিপাত, সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকানো।
আশু কাকা বলল,"বাবু আপনারা
রাতে কী খাবেন? আমি রান্না করে দিয়ে বাড়ি চলে যাব। রাত্রে
আপনারা বাইরে বেরোবেন না। দিনকাল ভাল নয়।"
রজত বলে উঠল, "আরে বাবা, এখন তো মাত্র সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। রাতের খাবার খেতে ঢের দেরী।"
আশু কাকা বলল, "বাবু আমাকে
সন্ধ্যা সাতটার আগে বাড়ি পৌঁছাতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি রান্না
করে নেব।"
অভি বলল, "তুমি এই বাড়িতে থাকবে না? শুধু আমরা দু’জনে থাকবো?"
আশু কাকা বলল, "আমি ভোরবেলায়
চলে আসবো। আমার ঘরে আমার স্ত্রী একা থাকে।"
রজত মুচকি হেসে বলল, "আশুকাকা তোমার ঠিকানা এইখানে কি করে হল।"
আশুকাকা ভাবুক হয়ে উত্তর
দিল,
"জলপাইগুড়িতে ভাগ্যের সন্ধানে তখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি
আমি। কোনও কাজই করার মতো পেলাম না। ঘুরতে-ঘুরতে চলে এলাম এখানে। অদ্ভুতভাবে পরিচয়
হল রুডির সঙ্গে। দু’জনের ভাষা আলাদা, কেউ কারোর কথা ভাল বুঝি না। সেই শেষে জীবনসঙ্গিনী হলো আমার। সে আরেক কাহিনী।
পরে বলব।"
আশুকাকা আবার বলল, "আজকাল অশরীরী
আত্মার কথা চাউর হওয়াতে সকলেই ভয় পায়। রুডি পাহাড়ের রহস্য জানে, সেও ভয় পায়।"
রজত কথাটায় পাত্তা না দিয়ে বলে উঠল," আশু কাকা তুমি রুটি আর কষা মাংস রান্না করো। মাংসটা একটু ঝাল করে করবে।
আর-একটা ফ্লাক্সে চা করে দিয়ে চলে যাও। আজ রাতে আমরা একটু মজা করব," কথাটা বলে রজত শুধু-শুধু হো হো করে হাসতে লাগল।
রজত অভিকে বলল, "তুই এত ভয়
পাবি না, আমরা দু’জনে তো আছি। এই বাড়িতে আমি আরও থেকেছি।
রাত্রে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বো আমরা। ভোরবেলা মর্নিং ওয়াকে বেরোবো।"
অভির আর কিছুই বলার রইল না। কিন্তু তার ভিতরে এক প্রবল অস্বস্তি কাজ করছিল।
উল্টো দিকে রজত ততটাই সাবলীল। সে একাই একশ। জমিয়ে গল্প করছে। তখন ঘড়িতে রাত
সাড়ে আটটা। টিভিটাও চলছে না। হালকা-হালকা ঠান্ডা। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি চলছে।
হঠাৎ বাইরের অলিন্দে এক বিরাট বিকট আওয়াজ শোনা গেল। রজত আর অভি চমকে উঠে বাইরে
বেরিয়ে এল। তারা দেখল, শুধু তাদের ঘরে আলো জ্বলছে
আর বাইরে সব অন্ধকার। অভি আর রজত তাদের মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
রজত ডাক দিল, "আশু কাকা ও আশু
কাকা, তুমি কোথায়? কিসের আওয়াজ?" হঠাৎ অভি
ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো।
অভির খুব কাছে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে আশু কাকা। অদ্ভুতভাবে ভাঙ্গা গলায়
আশু কাকা বলে উঠল, "রান্না হয়ে
গেছে, আমি আসি।"
আশু কাকার চোখের পলক পড়ছে না। কেমন যেন খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটছে। এই দু’
তিন ঘন্টার মধ্যে কি করে এতো পরিবর্তন! যেন উনি না, অন্য কেউ ভর করেছে উনার উপর। আশু কাকা খকখক করে কাশছিল। কাশির চোটে তার পিঠটা
কেমন বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিল। শো শো করে বাতাস টেনে নিচ্ছিল বুকের ভেতর। শীত তেমন নেই
তবু আশু কাকার গায়ে মাথায় জড়ানো মোটা কালো চাদর। হঠাৎ কি হল আশু কাকার? তার গলার স্বরটাও এমন বিকৃত কি করে হলো? কেমন যেন ভাঙা খ্যান খ্যানে স্বরে কথা বলছিল। অনেকটা তাদের ড্রাইভারের মতো।
রজত আবার বলে উঠল, "আশু কাকা তোমার
কি হলো?" এইবার রজতের স্বরেও যেন
আতঙ্ক ও ভয়ের ছাপ।
"সাবধানে থাকবেন রাতটা," কেমন যেন একটু
ব্যঙ্গ করে বলল আশু কাকা। তারপর অন্ধকার ঠেলে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল।
রজত ও অভি তার পেছনে পেছনে বারান্দায় এসে দেখল আশু কাকা উধাও। বাইরে ভীষণ
অন্ধকার, অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। বিদ্যুতের আলোয় সামনের
বাগানটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আশু কাকা কোথাও নেই। সে যেন অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে।
সবকিছু কেমন যেন রহস্যময়, ভুতুড়ে বলে মনে হল অভির।
কিন্তু এত কিছুর পরেও রজতের মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং চলছে। তাতে অভির মেজাজ খারাপ
হতে লাগল। সে বলে উঠল, "আরে ধুর, এসব বন্ধ কর রজত। চল কোন গাড়ি ডেকে এনে এখনই এখান থেকে পালাই।"
রজত বলল, "আরে পাগল, এখন কোথায় গাড়ি পাবি? আজ এখানেই থাকতে হবে
রে।"
পাঁচ
রজত অভিকে সাহস দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলল ঠিকই, তবু তার আত্মবিশ্বাসে কোথায় যেন চিড় ধরেছে। বিশ্রী একটা অস্বস্তি যেন কাটছে
না দুজনের মধ্যে। তারা ঠিক করল তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়বে। কিন্তু ঘুমানোর সময়
দেখা গেল আরেক বিপত্তি। রজত আলো জ্বালিয়ে একেবারেই ঘুমোতে পারে না, আর অভি ভয়ের চোটে আলো নিভিয়ে ঘুমোতে চাইলো না। এই নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে
লেগে গেল বাকবিতণ্ডা। দুই বন্ধুই অনড়। শেষে ঠিক হলো দুইজন আলাদা আলাদা দুই ঘরে
থাকবে। রজত পাশের ঘরে গিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। অভি বেচারা দরজা-জানালা ভালো
করে বন্ধ করে, আলো জ্বালিয়ে বসে রইল। আজ রাতে ভয়ে তার ঘুম
আসবে না। কিন্তু সে টের পেল না কখন ক্লান্তিতে তার দুই চোখ বন্ধ হয়ে এল।
তখন রাত কয়টা বাজে ঠিক জানা নেই। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটায় অভির হঠাৎ ঘুম ভেঙে
গেল। সে খেয়াল করল ঘরের আলো নিভে আছে। জানালার পর্দাটা বাইরের বাতাসে দুলছে।
কিসের যেন একটা জোরালো আলো জানালা দিয়ে এসে পড়েছে। অভি ভয়ে ভয়ে জানালার দিকে
এগিয়ে গেল। সে তো খুব ভালো করে জানালাটা লাগিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। তাহলে জানালাটা
খুলে গেল কিভাবে। অভি পর্দাটা সরাবে না রজত কে ডাকবে তা ভাবতে ভাবতে জানালার
পর্দাটা সরিয়ে ফেলল। তখনই হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকানির আলো! ওই আলোতে সে দেখতে পেল
সামনের শুনশান বাগানে দাঁড়িয়ে আছে একটা সাদা ধবধবে গাড়ি।। তার মনে পড়ল, আশুকাকা বলেছিল সাদা গাড়িটিই এক্সিডেন্ট করেছে। এটি কি সেই গাড়িটি? গাড়িটির বাঁদিকে জানালার কাচটি কী ভাঙ্গা? দরজার দিকে যেন একটু রং-চটা, ফ্রন্টগার্ডটা চ্যাপ্টা।
মনে হচ্ছে যেন সেই দুর্ঘটনাগ্রস্ত
গাড়িটিই দাঁড়ানো। মাথা দপদপ করতে লাগল তার।
গাড়িটির হেড লাইটের আলো যেন তার জানালার দিকেই তাক করা। অভির শিরদাঁড়া দিয়ে
এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। ভয়ে তার যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। বুকে
প্রচন্ড চিনচিন ব্যথা শুরু হল। অভির ঘাম বেরুচ্ছে। তখনই জানলার সামনে এক চেনা মুখ।
তাদের গাড়ির সেই রহস্যময় ড্রাইভার। খ্যান খ্যানে গলায় বলে উঠলো "সাবজী, কহি ঘুমনে জানা হ্যায়?" প্রচন্ড আতঙ্কে
অভির চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটা অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ করতে করতে সে মাটিতে
লুটিয়ে পড়ল। বা হাত ও বা পা টা কেমন বেঁকে গেলো! সারা দেহ তার ছটফট করতে লাগল।
অভির এই অবস্থা দেখে ড্রাইভারটি 'সাবজী' বলে চিৎকার করে খোলা জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে
লাফিয়ে ঢুকলো। চিৎকার করে ডাকতে থাকল, "রজতজি আপ কাহা হে, জলদি আইয়ে।"
দরজার ওপাশ থেকে রজতও চিৎকার করতে থাকল, "অভি অভি দরজাটা খোল।" ড্রাইভার গিয়ে দরজাটা খুলতেই রজত ও আশু বাবু ঘরে
ঢুকে মেঝেতে লুটিয়ে পড়া অভিকে বিছানার উপর পাঁজাকোলা করে তুলে আনল। রজত চিৎকার
করে বলতে লাগল, "অভি চোখ খোল, আমি এসে গেছি। ভয়ের কিছু নেই। আমি সব খুলে বলছি। তুই শুধু একবার চোখ খুলে
তাকা। কিন্তু অভি সাড়া দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না।" আশু বাবু বললেন, "তাড়াতাড়ি একে হাসপাতালে নেওয়া দরকার, ভয় পেয়ে মনে হয় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।"
রজত, আশু বাবু ও ড্রাইভার অভিকে ধরাধরি করে গাড়িতে
তুলে হাসপাতালের দিকে রওনা হল। অভির শরীরটা তখন কেমন ছেড়ে দিয়েছে।
রজতের কোলে অভির মাথা। রজত অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে নিজের মনে ভাবতে লাগল যে এসবই
তো তার সাজানো পরিকল্পনা ছিলো। ভিডিও ভ্লগ করার জন্য কী করে সে এত বড় ঝুঁকি নিয়ে
ফেলল। অভিকে এত বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিল। আশুবাবু এবং ড্রাইভার তার ভাড়া করা
অভিনেতা এবং তারা তারই পরিকল্পনার অংশীদার, অভি বুঝতেই পারেনি। এই বাড়িতেও সব জায়গায় ক্যামেরা বসানো সে কারণেই।
রজত পাগলের মত বিলাপ করতে করতে বলল "অভি চোখ খোল, তোর কিছু হলে আমার সব শেষ। তোর মাকে আমি কি করে মুখ দেখাবো। ভেবেছিলাম
হানাবাড়ির ভিডিওতে তোর অকৃত্রিম আতঙ্ক সবার সামনে তুলে ধরবো। আমাকে মাফ কর
ভাই।" রজতের এইসব চিন্তা-ভাবনা অনুশোচনা অভিকে স্পর্শ করতে পারছে কই? সে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে আছে গাড়িতে। রজতের দু’চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল।
গাড়ি এসে থামল পাহাড়ি গ্রামীণ হাসপাতালের সামনে।