জ্যোতির্ময় দাস

                                                                                                                                                                                                                    ছবি - রাহুল মজুমদার

  ভবানীজেঠুকে নিয়ে
  কিছু কথা, কিছু স্মৃতি










জ্যোতির্ময় দাস


 

শিশুতোষ ছড়াকার, ছন্দের জাদুকর ভবানীপ্রসাদ মজুমদারকে আমি জেঠু বলে ডাকতাম। তিনিও আমাকে জেঠুর মতো স্নেহ করতেন। পরিচয় সেই ২০০৪-০৫ সালে।আজকের পল্লিকথানামে কলকাতা থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশ হত। সেই কাগজে ছোটোদের পাতাসবুজবুড়োনামে পরিচালনা করতেন তিনি। সেখানে লেখা পাঠাতাম। লেখা প্রকাশও হয়েছিল। তারপর একদিন ফোনে পরিচালকের সঙ্গে কথা, পরিচয়। সেই থেকে শুরু। কত কথা, কত আলাপ। ছোটোদের জন্য কীভাবে লিখতে হয়, কীভাবে ছন্দ শিখতে হয় ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা হত।

আগরতলা দু-বার এসেছিলেন। তখনও দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের আড্ডা হয়েছিল। কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটেও বিভিন্ন সময় ভবানীজেঠুর সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন হয়েছি। সে-স্মৃতি বেশি করে মনে পড়ছে আজ। ছড়ার মধ্য দিয়ে হাসি, আনন্দ আর এই ছড়ার মাধ্যমে শিশুর মনোবিকাশে সবসময় মনোযোগী ছিলেন। যখন যে বই ওঁর প্রকাশ পেয়েছ, তখনই সে-খবর পাঠিয়েছেন। অজস্র ছড়া কবিতা লিখেছেন। কিন্তু কোনোদিন নিজের মধ্যে অহংবোধ দেখিনি ভবানীজেঠুর মধ্যে। নীরবে কাজ করেছেন। শিশুসাহিত্যের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক চলে গেলেন। এ অভাব অপূরণীয়

একদিন ওঁকে বলেছিলাম ছোটোদের জন্যে তিনি এত ছড়া লিখেছেন, কিন্তু গল্প লিখেননি কেন। উত্তরে তিনি বলেন, গল্পের কথা যদি ছড়ায় বলা যায় তাহলে গল্প লেখা প্রয়োজন কীসের। সত্যি তাই, ছড়ার মধ্য দিয়েই ভবানীপ্রসাদ মজুমদার ছোটোদের জন্যে অনেক গল্প বলে গেছেন যা বাংলা শিশুতোষ সাহিত্যে অমূল্য সম্পদ

আমরা যা সহজে দেখি তাই তিনি ছড়ায় বেঁধেছেন। তাঁর লেখার হাত যেন এক অপূর্ব মায়াবী জাদুকাঠি। যে জাদুকাঠির সৃষ্টি আপামর বাঙালি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছে, ছুঁয়ে থাকবে আগামী দিনেও। কী না লিখেছেন তিনি, কত বিষয় বৈচিত্র্য ওঁর লেখায় যা অন্য কারোর মধ্যে তেমনটা নেই। একমাত্র ছড়া লিখে পাঠকের হৃদয় জয় করা যায়, তিনিই দেখিয়েছেন

আগরতলা তিনি দু-বার এসেছেন। একবার বেসরকারি অনুষ্ঠানে, আর একবার এসেছেন সরকারি নিমন্ত্রণে আগরতলা বইমেলায়। সেটা সম্ভবত ২০০৬ সালে। মনে পড়ে, আগরতলায় একটি হোটেলে তিনি অবস্থান করেছিলেন। সকালেই ছুটে গিয়েছিলাম দেখা করার জন্য। ওঁর লেখারিনিক ঝিনিক খুশির ঝিলিকবইটি উপহার দিয়েছিলেন। সঙ্গে জমিয়ে ছবি তোলার পর্বও ছিল। আজ এও মনে পড়ছে, কলকাতারএলোমেলোনামে একটা ছোটোদের পত্রিকা আমাকে পত্রিকার দশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সম্মান স্মারক দিয়েছিল। সেটি সঠিক সময়ে আমি নিতে পারিনি। সেই স্মারকটি আমার জন্য সেবার তিনি (ভাবনীজেঠু) নিয়ে এসেছিলেন। সেই বইমেলায় জেঠুর সঙ্গে পা মিলিয়ে ধুলো মেখে বইমেলার মাঠে হেঁটেছিলাম। করেছিলাম খোলামেলা আলোচনা। যত দিন গেছে বুঝেছি, ভাবনীপ্রসাদ আসলে ছিলেন একজন দিলখোলা মানুষ। বড়ো মনের মানুষ। আর ছড়া পড়ে জেনেছি, লিখলেই ছড়া হয় না, এর জন্য দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন

২০০৩ সালে তিনিভূত-পেত্নী জিন্দাবাদনামে একটি ছড়ার বই পাঠককে উপহার দেন। ৬৫টি ছড়ার সংকলন। যে ভূতের কথা শুনলে শিশুরা ভয় পায় সেই ভূতদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-মজায় মেতেছেন তিনি। আসলে ভূত বলে কিছু নেই। সবই কল্পনিক। এই বিষয়টি ছড়ার মাধ্যমে তিনি বলতে চেয়েছেন। শিশুদের মনোবিকাশের তিনি সবসময় খেয়াল রাখতেন। ভূত কখনও শিশুদের মনে ভয়ের বস্তু বা বিষয় না হয়ে উঠে সেজন্য ভূতদের নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। লিখেছেন মজার মজার সব লেখা।—

 

বরং ভূতেরা ভালোসত্যি কি সৎ

নিশুতি নিশিতে দেয় চিনিয়েই পথ

ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে কত কী খাওয়ায়

অতিথিকে ঘরে রেখে নিজেরা দাওয়ায়

শোয়তবু ভূতেদের করো বদনাম?

ভূতেরা ভদ্র অতিরাম রাম রাম।

 

     ভূতদের নিয়ে তিনি লিখেছেনভূতুড়ে স্বরবর্ণ ভূতুড়ে ব্যঞ্জনবর্ণলিখেছেনপেত্নীগীতিলেখাটা এইরকম—

 

চালতা গাছে আলতা পরে

দোলায় কে রোজ পা

আয়রে খোকাআয়রে খুকু

সবাই দেখে যা

 

পেত্নী নাকি শাঁকচুন্নি

নাকি ভূতের মা?

হেঁড়ে গলায় গান জোড়ে জোর

তাঁইরে নাইরে না।

 

     এমনিভাবে একই বিষয়ের উপর বিভিন্ন পরীক্ষামূলক ছড়া লেখায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। আর একটি বিশেষ গুণ ছিল নিজের লেখা ছড়া মুখস্থ বলতে পারা। একের পর এক ছড়া তিনি অনর্গল মুখস্থ বলতে পারতেন। আগরতলায় দুটি অনুষ্ঠানে আমার ওঁর কণ্ঠে ছড়াপাঠ শোনার সুযোগ হয়েছিল। দেখেছি কী সুন্দর করে নিজের লেখা পর পর মুখস্থ বলে যেতে

২০০৫ সালের দিকে ভাবনীপ্রসাদের মজুমদারের লেখাছড়ার ভিড় আবৃত্তিরবইটি সংগ্রহ করেছিলাম। কলকাতার একটি নামি প্রকাশনা বইটির প্রকাশক ছিল। ১০০টির বেশি ছড়া ও কিশোর কবিতা সংকলিত হয়েছিল এই বইয়ে। বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা ছড়া চমকে দিয়েছিল আমার মতো সাধারণ পাঠককে। এত বিষয় বৈচিত্র্য কীভাবে? জানতে চেয়েছিলাম একসময়। বলেছিলেন, ‘চারপাশে যা দেখি বা দেখছি তাই তো লিখছি। আর লিখে আনন্দ পাই তাই লিখি।এই আনন্দকে সঙ্গী করে তিনি নিয়মিত লিখতেন

ছোটোদের নিয়ে, ছোটোদের মনের ভাবনাগুলো তিনি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারতেন। ছোটোদের মনের কথা যা ছোটরা মুখ ফুটে বলতে পারত না, তা তিনি ছড়ায় বলে দিতেন। ছোটোদের দাবিকে ছড়ায় পাঠকের সামনে তুলে ধরতেন। তাই তো তিনি লিখেছেন—

 

ছোটোর দাবি মানতে হবে

ওদের ডেকে আনতে হবে

বুকের ব্যথা জানতে হবে

তাই তো দলে টানতে হবে!

নইলে ওরা খাবেই খাবি

ভাববে বৃথাই হাবিজাবি

ছোটোর দাবিছোটোর দাবি

ছোটোর দাবিছোটোর দাবি

মানতে হবেই ছোটোর দাবি!

 

ছোটোর দাবি শুনতে হবে

শত্রু মেরে ধুনতে হবে

শপথ-সিঁড়ি গুনতে হবে

স্বপ্নের জাল বুনতে হবে!

সফল ফসল তবেই পাবি

প্রাণ খুলে গান সেদিন গাবি

ছোটোর দাবিছোটোর দাবি

ছোটোর দাবিছোটোর দাবি

শুনতে হবেই ছোটোর দাবি!

 

ছোটোর দাবি বুঝতে হবে

ব্যথার কারণ খুঁজতে হবে

বিপদ ট্যাঁকে গুঁজতে হবে

শঠের সঙ্গে যুঝতে হবে!

নইলে কি কেউ মুক্তি পাবি?

গোলকধাঁধায় কোথায় যাবি?

ছোটোর দাবিছোটোর দাবি

ছোটোর দাবিছোটোর দাবি

বুঝতে হবেই ছোটোর দাবি!

 

ছোটোদের স্বপ্ন প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের ইচ্ছে-খুশি মাড়িয়ে দিচ্ছি বড়োরা। তা সহ্য করার মতো নয়। বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ছোটোদের শৈশব নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। তা মেনে নিতে না পেরে তিনি লিখে ফেলেন বাস্তব সামাজিক অবস্থানকে।—

 

হারিয়ে গেলহারিয়ে গেলসবকিছু হায় হারিয়ে গেল

কামাল করার দামাল হাতি স্বপ্নগুলো মাড়িয়ে গেল!

সূক্ষ্ম স্মৃতির রুক্ষ গীতির দুঃখ বুকের বাড়িয়ে গেল

হারিয়ে গেলহারিয়ে গেলসবকিছু হায় হারিয়ে গেল

কোমল কমল কিশোর শিশুর স্বপ্নগুলো মাড়িয়ে গেল!

কেজি বিশেক বইয়ের বোঝা কেজি টুয়ের শিশুর কাঁধে

হাতছানি দেয় সুনীল আকাশদুঃখী হৃদয় গুমরে কাঁদে!

লাটাই-ঘুড়িআচার চুরিবিষণ্ণ মন নাড়িয়ে গেল

হারিয়ে গেলহারিয়ে গেলসবকিছু হায় হারিয়ে গেল

সূক্ষ্ম স্মৃতির রুক্ষ গীতির দুঃখ বুকের বাড়িয়ে গেল!

 

তিনি বার বার চেয়েছেন স্বপ্নের সঙ্গে খেলতে খেলতে ছোটোরা বড়ো হয়ে উঠুক। ছোটোরা স্বপ্ন দেখে মনের ডানা মেলুক। সফলতার সিঁড়ি হোক মনের মতো স্বপ্ন। ছোটোরা মনের মতো বড়ো হলে এ-দেশ এগিয়ে যাবে। ছোটোরা বড়ো হয়ে এ-দেশকে এগিয়ে নিয়ে বিশ্বের দরবারে। তাই তিনি ছড়ায় এই স্বপ্নের কথা বলেছেন।—

 

স্বপ্নের দেশ ডাকে মাঝরাতে ফুল হয়ে ফুটতে

জাফরানি জ্যোৎস্নার জাজিম বিছানো মাঠে ছুটতে

বন্দিত-নন্দিত-ছন্দিত আকাশটা ধরতে

দোস্তিতে-মস্তিতে-স্বস্তিতে সুখ হয়ে ঝরতে

ঝিরিঝিরি ঝিরিঝিরি

পেরিয়ে স্বপ্ন-সিঁড়ি

এক-দুই-তিন-চারপাঁচ-ছয়-সাত-আটনয়-দশ

সফলতা ছুঁয়ে যাবেসব বাধা নুয়ে যাবেহবে বশ।

 

কতশত বিষয় নিয়ে তিনি ছড়া লিখেছেন তার ইয়ত্তা নেই। হাসি, মজা, রূপকথা তো আছেই, সঙ্গে আছে সমাজ বাস্তবতা। মধুর ছন্দের দোলায় তিনি শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে এক আনন্দ জগৎ রচনা করেছেন তিনি। যে জগতে শুধুমাত্র ছোটোরা বিচরণ করেছে তা নয়, সব বয়সের সকলেই এই আনন্দের দোলায় দুলেছেন। মানুষের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে লঘু চালে লিখেছেন অনেক লেখা। এইরকম একটি।—

 

কেউবা হাসেন চাপা হাসি

কেউ মাপাকেউ মুচকি

কেউবা বৃহৎলম্বা-টানা

কেউবা ক্ষুদ্রপুঁচকি!

 

কেউবা হাসেন কোমল হাসি

কেউবা কঠিনগমগম

কেউ হাসে খুব বিশ্রী-বেদম

শুনলেই গা-ছমছম!

 

কেউবা হাসেন দেঁতো হাসি

বের করে সব দন্ত,

তেতো হাসিবেতো হাসি

নেই তো হাসির অন্ত!

 

কেউবা হাসেন কপট হাসি

কেউবা চিকন-মিষ্টি,

হাসির ঘটায়হাস্য-ছটায়

ছড়ায় হাসির বিষ্টি!

 

কেউবা হাসেন বজ্রহাসি

শুনেই পিলে চমকায়,

কেউ হাসে জোর দম ফাটানো

ঠিক যেন যম ধমকায়!

 

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার বহু পত্রিকায় লিখেছেন। একবার কথায় কথায় বলেছিলেন, একবার পুজোর সময় তিনি ১০০টি শারদীয়া সংখ্যায় লিখেছেন। শুনে থ বনে যাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু এটাই ছিল বাস্তব। অসংখ্য ছড়া গ্রন্থের আকার পায়নি। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে নিজের মধ্যে একপ্রকার অনীহা ছিল। কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে অনীহা একদমই ছিল না। জীবনে বহু সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু পাঠকের ভালোবাসাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার জেনেছেন। সত্যি তাই, ভাবনীপ্রসাদ মজুমদার আজীবন বেঁচে থাকবেন পাঠকের ভালোবাসায়। পাঠকের অন্তরে

 

লক্ষ ছড়ার স্রষ্টা ভবানীপ্রসাদের ইচ্ছে,

তাঁর ছড়া বেঁচে থাকুক সবার মুখে-মুখে

 

<