গ্রামটির নাম সুজয়পুর। সবুজ বনানীতে ঘেরা গ্রাম,
এই গ্রামে অনেক লোকজন বাস
করে। গ্রামের বেশির ভাগ লোকের খড় ও টালি দিয়ে বাড়ি। গ্রামের মাঝে একটি প্রাথমিক
বিদ্যালয়, এবং তার একটি বড়
খেলার মাঠ ও আছে। সেই খেলার মাঠে দুটি বট গাছ ও দুটি অশ্বত্থ গাছ আছে।
শোনা যায় অনেকদিন আগে
কোন এক জমিদার তখনকার প্রথা অনুসারে দুটি বট ও দুটি অশ্বত্থ গাছ প্রতিষ্ঠা করে
গেছেন। তবে এই গাছ গুলি এই গ্রামের এক ঐতিহ্য। বট গাছ গুলির চারধারে প্রচুর মোটা
সরু ঝুরি নেমে গেছে। সরু ঝুরি গুলিতে ছেলে মেয়েদের দল হাত ধরে দোল খায়। কিছুদিন
আগে বাচ্চারা ঝুরি ধরে দোল খেতে খেতে একটি বাচ্চা ছেলে এক জায়গা থেকে অন্য এক
জায়গায় ছিটকে পড়ে। তখন তার মাথায় আঘাত লাগে, প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়। তার ফলে সে জ্ঞান
হারিয়ে ফেলে। এই খবর পেয়ে বাড়ির লোক ও অন্যান্য লোকেরা তাকে পাশের গ্রামে এক
ভাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার বাবু রোগীর অবস্থা খারাপ বুঝে তাকে
হসপিটালে নিয়ে যেতে বলে, কিন্তু হসপিটাল
যাওয়ার পথে বাচ্চাটি মারা যায়। পরে মৃত বাচ্চাটিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এলে তার
মা তাকে দেখে শোকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরে হার্ট ফেল করে মারা যায়। তার ফলে
ওখানকার অনেক লোক এই সর্বনাশা বট গাছটিকে কেটে দেবার মনস্থ করে; কিন্তু আবার কিছু লোকের আপত্তিতে গাছ গুলি কাটা
হয়নি। তারপর থেকে ওই ঝুরি গুলি ধরে কোন ছেলে মেয়েরা আর দোল খায় না।
এইভাবে বেশ কিছুদিন কাটার
পর দুটি বানর কোথা থেকে এসে ওই বট গাছগুলোতে আশ্রয় নেয়। তাদেরকে ছেলেমেয়েরা
বিভিন্ন ভাবে উৎপাত করে তাড়ানোর ব্যবস্থা করলে ও তাদেরকে ওই গাছ গুলি থেকে
তাড়াতে পারে না। ক্রমশঃ তাদের পাল বাড়তে থাকে, একদিন এক মধ্যবিত্ত বাড়িতে তার ছেলের
অন্নপ্রাশনে একটি রামায়ণ গানের ব্যবস্থা করেছিল। সেই গান যখন আরম্ভ হয়, তখন থেকে সেই বাড়িতে খড়ের ঘরের উপর প্রচুর
বানর বসেছিল। তাদেরকে শত চেষ্টা করে ও তাড়াতে পারেনি। সমস্ত লোক বেরিয়ে দেখল যে
তারা হাত জোড় করে রামায়ণ গান শুনছে। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো যে যখন
রামায়ণ গান শেষ হলো তখন তারা সবাই চলে গেল। সেই থেকে গ্রামের কোন লোক আর
বানরদেরকে তাড়ায় না।
কিছুদিন বাদে আর একটি
ঘটনা ঘটল। অবনী দাসের বাড়িতে তার একমাত্র শালা দিদির বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। সে
নাকি একটা চাকুরী করে। তাই সে মনে মনে নিজেকে একটু বড় বলে মনে করে। সে যখন এসে
শুনল যে এ- গ্রামে বানরদেরকে সবাই দেবতা জ্ঞানে সন্মান করে, ওখান সে হাসতে শুরু করল। সে একদিন সেই মাঠের
বটগাছ গুলির কাছে গেল। তারপর কতক গুলি ঢিল নিয়ে তাদেরকে মারতে আরম্ভ করল। তখন
বানর গুলি প্রাণ ভয়ে পাশাপাশি অন্য গাছে চলে গেল।
এই ভাবে সে কারণে অকারণে
তাদের উপর অত্যাচার করতে লাগল। একদিন
তাদের একটি বাচ্চাকে প্রচুর মারা মারি ও করল। তখন তারা সেই লোকটির বাসা লক্ষ্য
রাখল, একদিন বিকালে সেই ভদ্রলোক
বাইরের চেয়ারে বসে আরাম করে চা পান করছে, তখন দুটি বানর হঠাৎ এসে তার চায়ের কাপ হাত থেকে নিয়ে ফেলে দিল। তখন লোকটি
খুব রেগে গেল। সে এই অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
একদিন সে কতকগুলি ফটকা
নিয়ে এসে সেই মাঠের মাঝে গিয়ে ফাটাতে শুরু করল। ভয়ে বানর গুলি পালাতে আরম্ভ করল
। হঠাৎ একটি বাচ্চা বানর গাছ থেকে পড়ে যেতেই তাকে লাঠির আঘাতে মেরে দিলেন।
কিছুক্ষণ পরে সমস্ত বানর গুলি ওই লোকটিকে ঘিরে ফেলল। তিনি তখন কোথাও পালাবার পথ পেলেন
না। আট দশ টি বানর মিলে তাঁর সমস্ত জামা কাপড় ছিঁড়ে দিল এবং চড় মেরে মেরে তাঁকে
প্রায় আধ মরা করে ফেলল। যখন তাঁর আধ মরা অবস্থা,তখন তারা সেই স্থান ত্যাগ করল। গ্রামের লোক
দেখতে পেয়ে তাঁর জামাই বাবুকে খবর দিল। জামাই বাবু তাঁকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে
গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে ভাল করল। এইসব পর পর
ঘটে যাওয়ার পর বানর গুলিকে ফসল নষ্ট করলে ও কেউ কিছু বলে না।
এই ভাবে কিছু দিন যাওয়ার
পর হঠাৎ সেই অবনী দাসের মেয়ের বিয়ের দিন পাকা হয়ে গেল। মেয়ের কলকাতায় বিয়ে
হবে, পাত্রের বড় ব্যাবসা আছে।
তাই অবনী বাবু কিছু জমি জমা বিক্রী করে সোনার গহনা ও বেশ কিছু নগদ পয়সা বর পণ
হিসেবে দিবে বলে সব ঠিক ঠাক করে নিল। এইসব কথা কানাকানি হতেই একদিন রাত্রে এক
ডাকাত দল সেই বাড়িতে চড়াও হলো। অবনী বাবুর বাড়ি সেই মাঠের গাছ গুলির ধার দিয়ে
যেতে ও আসতে হয়। আর কোন ধার দিয়ে যাওয়ার ও আসার রাস্তা নেই। বানর গুলি বুঝতে
পারল যে গ্রামে ডাকাত দল এসেছে। তখন তারা সারিবদ্ধ ভাবে গোটা রাস্তা ঘিরে রাখল। আর
গাছের উপরে কিছু বানর রইল। যখন ডাকাতরা সমস্ত গহনা ও টাকা পয়সা নিয়ে সেই রাস্তা
ধরে আসছিল, তখন সমস্ত বানরের
দল রাস্তা ঘিরে রাখল, ডাকাতরা প্রথমে
হকচকিয়ে গেল। এদিকে গ্রামবাসীরা ডাকাতদের পিছু তাড়া করল। ডাকাতরা প্রথমে শূন্যে
গুলি চালাল। গাছের উপর থেকে বানর গুলি ঝুপ ঝাপ করে এক একটি ডাকাতের ঘাড়ের উপর
পড়ল এবং এলো পাথাড়ি ভাবে চড় চাপড় মারত লাগল। বানর দের এলো পাথাড়ি আক্রমণে
তারা আহত হলো। শেষে গ্রামবাসীদের হাতে তারা ধরা পড়ল। কিন্তু প্রথমের গুলিতে চারটি
বানর মারা পড়ল।
অবোধ পশুরা তাদের জীবন
দিয়ে অবনী বাবুর মেয়ের বিবাহের সমস্ত গহনা ও টাকা পয়সা উদ্ধার করে দিল। যদি ও
সভ্য মানুষের দল আজ পূর্ব পুরুষদের সমন্ধে সম্পুর্ণ অস্বীকার করলে ও কিছু ইতিহাস
তাদের চির দিনই সত্যের ধ্বজা উড়িয়ে যাবে হয়তো।