গল্প - ৩ | শ্রাবণ ১৪৩১

 

  চাঁদনি











অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়

পুরুলিয়াপশ্চিম বঙ্গ




 

পাখিটার সাথে আলাপনে থেকে থেকে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে বিন্দি। আদরে আদরে অস্থির করে তুলেছে তার কোমল শরীর। প্রাণের বন্ধুটির সান্নিধ্য ছাড়া এক মুহূর্ত দূরে থাকতে চাইছে না। মনটাই শুধু উতলা। বাবার পদধ্বনি শোনার অপেক্ষায় সজাগ হয়ে আছে ইন্দ্রিয়। বাবা কে নতুন বন্ধুর সাথে পরিচয় না করানো পর্যন্ত তার মনে শান্তি নেই। পাখিটার মুখে একটা লাল লঙ্কা তুলে দিতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ডোরবেলের শব্দে কেঁপে ওঠে আনন্দে। শব্দটা চেনা। বাবা এসে গিয়েছে ভেবে চকিতে উঠে দাঁড়ায়।

খাঁচাটা হাতে ধরে লাফাতে লাফাতে সদর দরজা অবধি হেঁটে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় এক পাশে। খাঁচাটা মাটিতে নামিয়ে রেখে ছিটকিনি খুলে কড়া ধরে টান মারে। দু'চোখে অনুরাগের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। তাকিয়ে দেখে সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। দুরন্ত আবেগে বলে ওঠে, "মা কি এনেছে দেখো! টিয়া পাখি। আমার বন্ধু।" বলেই মাটি থেকে খাঁচাটা তুলে প্রিয় বন্ধুকে বাবার মুখের সামনে মেলে ধরে এক গাল হেসে বলে, "কি মিষ্টি বলো?"

দেবব্রত পাখিটার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিশ্চিত হয়ে বলেন, "টিয়া নয় রেএ তো ময়না।"

            বিন্দি বেণী দুলিয়ে বলে, "ঠোঁট দুটো কী লাল দেখো। কী সুন্দর!" বাবাকে আঁকড়ে ধরে অন্তরের সন্তোষ জানান দিতে চায়।

দেবব্রত বলেন, "আমার বিন্দি সোনাও তো সুন্দর। সে তার বন্ধুর চেয়ে আরও সুন্দর কি করে হবে?"

বিন্দি উজ্জ্বল চাউনি মেলে বলে, "পড়াশোনা করে।"

"ঠিক তাই। তাহলে এবার পাখি রেখে পড়তে বসবে চলো। সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হয়ে এলো। স্কুলে হোমওয়ার্ক কিছু দিয়েছে?" দেবব্রত জানতে চান।

বিন্দি ঘাড় হেলিয়ে বলে, "মাই পেরেন্টস সম্পর্কে ছ'লাইনের একটা প্যারাগ্রাফ লিখতে দিয়েছে। তুমি ইরেজার কিনে এনেছো?"

"এনেছি।" দেবব্রত পকেট থেকে একটা ইরেজার বার করে বিন্দির হাতে ধরিয়ে দিয়ে পা বাড়ান।  বিন্দি দু'পা জড়ো করে একটা লম্বা লাফ দেয়। খাঁচাটা দুলে ওঠে।

পরনের পোশাক বদলে হাত মুখ ধুয়ে জল খাবার খান দেবব্রত। তার পর এক কাপ চা নিয়ে বসেন। খবরের কাগজে ঝলক চোখ বুলিয়ে বিন্দিকে ডাকেন কাছে। আমার পিতা-মাতা এই শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করতে হবে। বিন্দিকে পাশে বসিয়ে কন্যার মননে উৎসাহী সুর বেঁধে দেন। এক এক করে দশটি বাক্য লেখা করান সাদা পাতায়। স্মরণে রাখার উপায়ও বাতলে দেন শিক্ষাজ্ঞানে। মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বলেন, "লেখাটা সাড়ে'ছ লাইনের মতো হল। মুখস্ত করে নে।"

দেবব্রতর দু'চোখ খবরের কাগজের পাতায় নিবদ্ধ। সামনে দোল পূর্ণিমা। রং সম্পর্কে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কৃত্রিম রঙের সংস্পর্শে এলে শিশুদের দেহ কতটা আক্রান্ত হয় লাইনের পর লাইন লিখে গিয়েছেন নিবন্ধকার। এইসব রং কিডনিত্বকশরীরের বিভিন্ন অঙ্গে সরাসরি আক্রমণ করে।

কাগজের পাতা উল্টাতে গিয়ে তাঁর দৃষ্টি ছুঁয়ে যায় বিন্দির খাতার উপর। খাতা পড়ে রয়েছে টেবিলের এক কোণেবিন্দি উধাও। কোথায় গেল মেয়েমেয়ের নাগাল পেতে কানে ঠেকে চাপা কণ্ঠস্বর। তাকিয়ে দেখেন বিন্দি বুক সেলফের পাশটিতে বসে পাখির খাঁচাটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। তার হাতে ধরা একখানা কমলা লেবুর কোয়া। চোখের পলক পড়ছে না।

দেবব্রত ধমকে ওঠেন, "ওখানে কি করছিস?"

বিন্দির হাত কেঁপে যায় বাবার কণ্ঠস্বরে। খোনা গলায় অনুযোগের সুরে বলে, "দেখো নাকিচ্ছু খাচ্ছে না। দুপুর থেকে একটা কিচ্ছু মুখে তোলে নি।"

দেবব্রত সোফা ছেড়ে উঠে এগিয়ে যান খাঁচাটার দিকে। তাকিয়ে দেখেন ময়না নড়ে না। চোখ দুটো স্থির। তিনি ঝুঁকে পাখিটার লেজ ধরে ঝাঁকুনি দেন একবার। ময়না নড়ে ওঠে। দেবব্রত বলেন, "এখন খাবেনা। আজ প্রথম দিন আমাদের বাড়িতে এসেছে। কাল সকালে উঠোনে রেখে আসবি। নতুন সূর্য দেখবে। নীল আকাশ দেখবে। তারপর খাবে। আয়লেখাটা শেষ কর।"

বিন্দির মনে পড়ে যায় দাদাকে। পড়ার ঘরে বসে দাদা পড়ছে। দাদাই বলতে পারে পাখিটার কেমন করে হুঁশ ফেরানো যায়। ভাবতেই এক লাফে উঠে দাঁড়ায় খাঁচা রেখে। মুহূর্তে জরিপ করে নেয় বাবাকে। আদরের বন্ধু সোনা মুখে খাবার তুলবে না মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কাতর দৃষ্টি হেনে বলে বাবাকে, " তুমি কিচ্ছু জানো না। দাদা জানে। আমি যাচ্ছি দাদার কাছে।" বলতে বলতে চকিতে অদৃশ্য হয়ে যায়।

চেয়ারে বসে মুখে বই গুঁজে এক মনে পড়ছিল দীপ্রদীপ। বিন্দিকে গা ঘেঁষে দাঁড়াতে দেখে মুখ তুলে বলল," কিছু বলবি?"

বিন্দির মুখে-চোখে ব্যর্থতার গ্লানি স্পর্শ করেছে। ভারাক্রান্ত গলায় বলে, "পাখিটা কিছু খাচ্ছে না রে দাদা! চোখ দু'টো নেতিয়ে গেছে কেমন। কত কি খেতে দিলাম। একটা কিছু মুখে তুলল না। কি হবে রে দাদানা খেলে শরীরে বল পাবে বল?"

দীপ্রদীপ খোলা বইখানা টেবিলের উপর উল্টে রেখে প্রশ্ন করে, "জল খাইয়েছিলি?"

বিন্দি অপ্রস্তুত গলায় বলে, "জল তো দিইনি দাদা।"

"ওর গলায় শুকিয়ে গেছে। শক্ত খাবার খাবে কি করেওকে জল দে। দেখবি খাবে। এখন যা। আমি পড়ছি।" দীপ্রদীপ নিজেকে আলাদা করে নিতে চায়।

বিন্দির অন্তরে খুশির হিল্লোল ওঠে। দাদা ঠিক কথায় বলেছে। জল চাই। চকিতে ঘর ছেড়ে বেরোতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় দাদার ডাক শুনে। জিজ্ঞেস করে, "কিছু বলবি?"

দীপ্রদীপ সাগ্রহে বলে, "পাখিটার নাম দিবি নাএকটা নাম দিবি তো।"

বিন্দি বিস্ময়ের চোখে তাকায়। উৎফুল্ল হয়ে বলে, "দেবো তো। কি নামে ডাকবো রে দাদা?"

"একটু ভাবতে দে আমায়। তুইও ভাব।" দীপ্রদীপ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দু'জনেরই চোখের পাতা পড়ে না। গভীর চিন্তায় মগ্ন। কয়েক মুহূর্ত পার হতেই দীপ্রদীপ নাম বলে একটা। সঙ্গে সঙ্গে তা বাতিল করে দেয় বিন্দি। প্রস্তাবক হয়ে বিন্দিও নাম জুড়ে দেয় একখানা। "ধ্যতএটা বাজে নাম।" বলে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে দীপ্রদীপ। পরপর কয়েকটা নাম উত্থাপন করে দু'জনে। তাৎক্ষণিক বাতিলও হয়ে যায় মনঃপুত না হওয়ায়। যখন দুজনেরই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছে প্রায়বিন্দিকে চমকে দিয়ে দীপ্রদীপ উত্তেজিত গলায় বলে উঠে, " ইউরেকা! পেয়েছি!"

"বল বল"বিন্দি ততোধিক উচ্ছ্বাসে জানতে চায়।

"তিতলি। তিতলি নাম রাখ ওর।"

"দাদাএটা ঝিলিকদির বোনের নাম। অন্য নাম বল।"

নামকরণে সফলতা আসে না। পাঁচ দিন পরেও মনের মতো কোনও নামই স্থির করতে পারে না দু'জনে। বিন্দি পাখিটার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আদর করে। গল্প করে। বই খুলে ছড়া পাঠ করে শোনায়।  পলকা খাঁচাটার নরম তার বেঁকিয়ে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে খেতে দেয়। পাখিটাও থেকে থেকে উঠে আসে তার হাতের উপর। বন্ধুকে কাছ ছাড়া করতে চায়না বিন্দি। ও যে প্রাণের চেয়ে আপনার। সারাক্ষণের সাথী।

আজ পূর্ণিমা। এই শুভ দিনে জন্ম হয়েছিল বিন্দির। সকাল হতে সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছে বাড়িতে। দেবব্রত টিভিতে খবর শুনছিলেন। স্বাগতা পাশে এসে কাঁধে হাত রাখতেই বললেন, "আজ খাওয়া-দাওয়া কি হবে বলোএকটু পরেই বাজারে যাব। কি কিনে আনতে হবে লিখে জানাও আমাকে।"

স্বাগতা চায়ের কাপ স্বামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, "খাসির মাংস আনো। পনির নেবে। বড় বড় রসগোল্লা নেবে। শুভ কাজে দই হল শুভ। নিশ্চয়ই কিনে আনবে। বিন্দির দশ-বারো জন বন্ধু আসছে। সেই মতো হিসেব করে জিনিসগুলো কিনবে। আমি ফর্দ তৈরি করে দিচ্ছি একটা।"

দেবব্রত টিভির সাউন্ড মিউট করে মুচকি হেসে বলেন, "আজ সারপ্রাইজ দেব বিন্দিকে। একটা বিশাল বড় পুতুল কিনে আনব। অনেক বড়। এখন কিছু বোলো না ওকে।"

স্বাগতা স্বামীর পাশটিতে বসে বলেন, "একটা বড় খাঁচা কিনে আনবে তো। ছোট খাঁচাটায় পাখিটার লেজ বেরিয়ে আসছে।"

দেবব্রত মাথা নাড়েন, "খাঁচা আমি আনছি না স্বাগতা। আমি অন্য কিছু ভেবে রেখেছি। টয়লেটের পাশের ছোট রুমটা পরিষ্কার করে পাখিটাকে ওখানে রাখব। বড় জায়গা পেয়ে ঘুরতে ফিরতে পারবে। উড়ে উঠে আসতে পারবে মাচায়। নেট দিয়ে ঘিরে দেবো জানলাটা। খাঁচা শব্দটা উচ্চারণ করতে আমার অসহ্য লাগে।"

স্বামীকে আড়ষ্ট চোখে দেখছিলেন স্বাগতা। দেবব্রত পাখিটার মুক্তির পক্ষে সরব হয়েছিলেন গত কয়েকদিন। গাছের পাখি গাছে থাকবেবাতাসের আবর্তে ঘুরপাক খাবেএমনটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু তার প্রতি বিন্দির অগাধ প্রেমমমতা তাঁর অন্তরাত্মাকেও স্পর্শ করেছিল। স্বামীর মুখের পানে তাকিয়ে বললেন, "তোমার ভাবনা ভাল। বিন্দি কোথায়ওকে তো দেখছি না।"

দেবব্রত ভোরবেলায় বাইরের খোলা বারান্দায় গ্রিলের খাঁজে খাঁচাটাকে ঝুলিয়ে রেখে এসেছিলেন। টিভি বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখেন বিন্দি বাঁ হাত দিয়ে খাঁচাটা বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে আছে। ডান হাতখানা খাঁচার ভিতর ঢুকিয়ে পাখিটার ডানা ধরে টান মারছে ক্রমাগত। পাখিটাও থেকে থেকে চিৎকার জুড়েছে বেসুর গলায়।

দেবব্রত কিছুক্ষণ আগে বিন্দিকে শাসিয়ে বলেছিলেন পাখি ছেড়ে পড়তে বসতে। বিন্দির অবজ্ঞা তার মধ্যে উত্তেজনার উদ্রেক ঘটাচ্ছিল। বই সরিয়ে রেখে খামখেয়ালিপনা তাঁর পছন্দ নয়। মেয়ের রঙ্গ দেখে অস্থির হয়ে বলে উঠলেন, "বিশাল ফাঁক করে দিলি খাঁচাটায়। পাখি পালাবে।"

বিন্দির জেদ চেপেছে অল্পক্ষণের জন্য হলেও তার বন্ধুকে করতলে দাঁড় করাবে। বন্ধু পালিয়ে যাবে কথাটায় তার একাগ্রতায় ভাঙ্গন ধরে। ভয়ও পায় একটুখানি। খাঁচাটাকে দু'হাত দিয়ে বুকের মাঝে চেপে ধরে শঙ্কিত গলায় বলে, "না পালাবে না। আমার কাছে থাকবে।"

দেবব্রত উত্তেজিত হয়ে বলেন, "হ্যাঁ পালাবে।" বিন্দির অধ্যয়ন বিমুখতা তাঁর মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার ঘটাচ্ছিল।

বিন্দির দু'চোখের কোল বেয়ে নেমে আসে অশ্রু। খাচাটার উপর গাল ছুঁইয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, " আমাকে বন্ধুর কাছে থাকতে দাও বাবা!"

দেবব্রত বিন্দির বাজু টেনে ধরে ঝাঁকুনি দেন একবার। উত্তেজিত হয়ে বলেন, "এখন বন্ধুর সাথে খেলার সময় নয়। তোর পরীক্ষার আর দু'হপ্তা বাকি। এইভাবে সময় নষ্ট করলে তোর পড়ার মান নেমে যাবে নিচে। রেজাল্ট খারাপ হলে তোর নিজেরই লজ্জা লাগবে তখন। খাঁচাটা রেখে আমার সাথে আয়। আমি পড়াব তোকে।"

বিন্দি বাবার উত্তেজনার কারণ বুঝে উঠতে পারে না। আপনার উদ্যমে কোথাও ঘাটতি নেই। অংকে একশ'তে একশ নম্বর অর্জন করার ক্ষমতা রাখে। তাহলে বাবা এত চিন্তিত কেননিজের জন্মদিনে প্রাণ ভরে আদরও করতে পারবে না বন্ধুকে। খাঁচার গায়ে মুখ এনে চুক চুক শব্দ তুলে স্নেহ ছড়াতে চায়। ময়নাও নিজের ঠোঁট দুটো বিন্দির ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরে কেঁউ কেঁউ শব্দ তুলে সাড়া দেয় মিষ্টি স্বরে। বিন্দি বন্ধুর দিকে চোখ পাকিয়ে বলে, " একদম দুষ্টুমি করবে না। আজ তোমাকে কেক খাওয়াব। আমি চললাম। লক্ষীটি হয়ে থাকবে।"

দুপুরে টি-ব্রেকে অফিসের সহকর্মীরা দল বেঁধে যখন ক্যান্টিনে চা খেতে যায় নিজের চেয়ারে বসে দেবব্রত বই পড়েন। আজ মন পড়ে আছে বাড়িতে। বসে বসে ভাবছিলেন স্কুল ছুটির দিনে দীপ্র মা'কে সাথে করে এতক্ষণ নিশ্চয় ড্রয়িং রুমের সাজসজ্জায় মেতে উঠেছে। অফিস থেকে বেরিয়ে বাজারে গিয়ে একটা কোল জুড়ানো অপূর্ব পুতুল কিনবেন বিন্দির জন্য। আইসক্রিম কিনবেন। শিশু সাহিত্যিকের লেখা বই কিনবেন একটা। ঘট আর আম পল্লব কিনে নিয়ে যাবেন সাথে।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। ঠিক চারটের সময় স্কুটার স্ট্যান্ড থেকে স্কুটার বার করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ক্রয় তালিকায়। তারপর কারখানার প্রধান ফটক ছুঁয়ে বেরিয়ে এলেন বড় রাস্তায়।

দোলের দিনও কারখানায় কাজ হয়েছে। বাড়ি ফেরার জন্য উদ্দীপনা ছিল। বাড়ির দরজায় পা রাখতে গিয়ে সবুজ রং লাগল দু'চোখে। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন বিন্দি এখনই লাফাতে লাফাতে এসে দরজা খুলে বলবে আইসক্রিম এনেছো বাপি?

ডোরবেল স্পর্শ করতেই গতি ভঙ্গি বদলে গেল তাঁর। কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। ছিটকিনি খোলার শব্দে টানটান হয়ে উঠল শরীর।

কোথায় বিন্দিসামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বাগতা। দৃষ্টিতে যন্ত্রণা জড়িয়ে রয়েছে। দেবব্রত হেসে জিজ্ঞেস করেন, "বিন্দি কোথায়?"

"ভেতরে আছেএসো। জিনিসগুলো দাও আমার হাতে।" স্বাগতার অন্তরের যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে অধরের কোনায় কোনায়। মৃদু কাঁপতে থাকে ঠোঁট দুটো।

"এনি প্রবলেম?" দেবব্রত স্বাগতার কাঁধে হাত রাখেন।

"ভেতরে এসোবলছি।"

"বলো বলোকি হয়েছে?"

স্বাগতা কেমন করে সত্য উদঘাটন করেন স্বামীকেবিন্দি স্কুল থেকে ফেরার পর যে কাণ্ড বাধিয়েছে কেমন করে ব্যক্ত করেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলেন, "পাখিটা খাঁচা থেকে উড়ে গিয়েছে!"

দেবব্রত ক'পল তাকিয়ে থাকেন অন্যমনস্ক হয়ে। জড়তা এসে যাওয়ার আগে নিজেকে সামলে বলেন, "আমি চাইনা জন্মদিনের আনন্দ ম্লান হয়ে যাক।"

স্বাগত অস্থির হয়ে বলেন, "যাও গিয়ে মেয়েকে শান্ত করো। ও যখন থেকে জেনেছে বন্ধু হারিয়ে গেছে কেঁদেই চলেছে সারাক্ষণ। ওকে সামলাও।"

দেবব্রত আনমনে ঘরে ঢুকে এগিয়ে যান বেসিনের দিকে। সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করেন। তারপর মনের গতি বদলে একসময় পা রাখেন নিজেদের বেডরুমের অভ্যন্তরে।

বিন্দি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। হৃদয়ের হাহাকার স্তব্ধ হয়ে রয়েছে চোখের গহনে। পাথর হয়ে গিয়েছে মেয়েটা।

দেবব্রত স্নেহবশে মেয়ের মাথায় হাত রেখে চুলে বিলে কেটে দেয়। আদর জড়ানো গলায় বলেন, "ওঠ মাদেখ আমি তোর জন্য কি নিয়ে এসেছি।"

বিন্দি নড়ে ওঠে একবার। বালিশে মুখ গুঁজে স্থাণুবৎ হয়ে থাকে। দেবব্রত বলেন, "তোর জন্য একটা জায়ান্ট পুতুল এনেছি। তুই দেখলে পরে না ভালোবেসে থাকতেই পারবি না। বই এনেছি একটা। এই বই পড়ার পর তোর বন্ধুকে ফিরে পাবি। পাখিদের কথা লেখা আছে। ওঠচেয়ে দেখ।"

বিন্দি ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে একবার।

দেবব্রত বলেন, "তুইতো বুদ্ধিমতী মেয়েরে মা। তুই কি জানিস তোর বন্ধু তার মায়ের কাছে চলে গেছে। রানী বাঁধে সারি দিয়ে যে অর্জুন গাছগুলো আছেওইখানে। ঝিলের ধারে। যাবি ওর কাছে?"

এবার মুখ তুলে তাকায় বিন্দি। অপলক চেয়ে থাকে বাবার মুখপানে।

দেবব্রত বলেন, "আমি দেখেছি রানী বাঁধের গাছগুলোয় পাখিদের মায়েরা উড়ে উড়ে নিজেদের বাসা তৈরি করে। তোর বন্ধুর মা-ও তো তাকে নিয়ে চলে গেছে নিজের বাসায়। কথা দিচ্ছি আগামীকাল সকালে তোকে দেখিয়ে নিয়ে আসব তোর বন্ধুকে। আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে আকাশে। চাঁদের কনায় টলটল করবে আকাশের তারাগুলো। ওই কিরণ শরীরে ধারণ করে এক মা লীন হয়ে যাবে সন্তানের মনোরঞ্জনে। তোর বন্ধুই তো তার মায়ের চাঁদনি।"

বিন্দি চিক্কন চোখ দুটো মেলে দেখতে থাকে বাবাকে। তার মন ভাল হয়ে যায় বাবার কথা শুনে। চাঁদনির অর্থ কি সে জানেনা। বাবার হাতের আঙ্গুলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, "চাঁদনির মা'কে আমি দেখেছি বাপি।"

দেবব্রত অভিভূত গলায় বলেন, "তাই বুঝিকোথায় দেখলি?"

বিন্দি জানলার বাইরের দেওয়ালটার দিকে আঙুল তুলে বলে, "ওখানে এসে বসত রোজ‌। রোজ সকালে এসে শিস দিয়ে ডাকত।"

দেবব্রত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। পলকা খাঁচাটা ফাঁক হয়ে গেছিল মনে করাতে চান না। বিন্দির অন্তর্বেদনায় প্রলেপ দেওয়া দরকার। জন্মদিনের অনুষ্ঠান স্মরণীয় করে রাখতে হবে। আর কিছুক্ষণ পরে আসতে শুরু করবে তার স্কুলের বন্ধুরা। পরিস্থিতি সহজ করে না দিলে বিন্দির কষ্টের উপশম হবে না এমনই কিছু চিন্তা করে বলেন," এরপর থেকে চাঁদনি সারাক্ষণ তার মায়ের পাশটিতে থাকবে। তুইও তো তোর মায়ের চাঁদনি। ধর তোকে তোর মায়ের কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ছোট্ট ঘুপচি ঘরটার ভেতর তোকে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খাওয়ার সময় হলে খাবার পাচ্ছিস। জল খেতে পাচ্ছিস। তোর স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একমাস তুই ঘুপচি ঘরে বন্দী। ওখানে একা একা থাকতে পারবি?"

মায়ের মুখখানি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বিন্দির বুকের ভেতরটা কনকন করে ওঠে। মা যে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে থাকা শান্তির উপকূল। বাবার হাতখানা আঁকড়ে ধরে বলে, "অন্য কথা বলো।"

দেবব্রত বিন্দির গাল টিপে দিয়ে বলেন, "চাঁদনি এখন থেকে রোজ তার মায়ের সাথে গাছে গাছে ঘুরে বেড়াবে। কাল রানী বাঁধে গিয়ে দেখবি ঝাঁকে ঝাঁকে চাঁদনি তাদের সবুজ ডানা মেলে গাছগুলোর মাথায় লুটোপুটি খাচ্ছে। কী আনন্দ ওদের। কত সুখী ওরা!"

বিন্দির দু'ঠোঁটে নরম হাসি ফুটে ওঠে। খাট থেকে নেমে দু'পা হেঁটে গিয়ে পুতুলটাকে তুলে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বলে, "খুব সুন্দর!"

দেবব্রত ঘর অলংকরণের দায়িত্ব সঁপে দিয়েছিলেন দীপ্র কে। বিন্দির হাত ধরে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখেন রজনীগন্ধাগোলাপ আর শ্বেত পদ্মে সাজানো হয়েছে চারপাশ। ঝিলমিল করছে ঘরখানা। একটা পিস-বোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে দেওয়ালে। সেখানে কোনও সুকুমার শিল্পী সোনালী কাগজ কেটে বড় বড় অক্ষরে লিখে দিয়েছে 'নবম বর্ষে পদার্পণ। শুভ জন্মদিন বিন্দি।'