খাবার টেবিলে বসে তরকারির চেহারা দেখে অর্ক মুখ কুঁচকে বলে উঠল, “জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত মোর হয়েছে বিকল…।”
রিয়া মোবাইলে গেম খেলছিল। সে খেলা বন্ধ না করে আনমনা হয়েই উক্তি করল—“তুমি কি সমুদ্রে পাড়ি দেবে নাকি অর্কদা? জল কোথায় পেলে?”
“এই যে, তরকারি আজ ভেসে যায় জলে। কীসের তরকারি উপর থেকে বোঝার উপায় নেই। জ্যোৎস্নাদির আজকাল কাজে একদম মন নেই। সবসময় কীসের যে তাড়া থাকে কে জানে। ক্যাসারলে রুটি বানিয়েছে দেখছি। তবে দিল্লিওয়ালি হয়েও বাংলা সাহিত্যের একটা বিখ্যাত উক্তি কীভাবে বললি, সেটা ভেবে অবাক হচ্ছি। পরের লাইনটা যদি বলতে পারিস, তোকে আমিনিয়ায় মাটন রেজালা আর পরোটা খাওয়াব, পাক্কা।”
“দেখে দেখে চিত্ত মোর হয়েছে বিকল। ঠিক বললাম তো? রবীন্দ্রনাথের লেখা। দেবতার গ্রাস থেকে নেওয়া। তুমি যতটা ভাবো, অতটা অজ্ঞ আমি নই। তাই আমিনিয়ার দাওয়ত আমার কপালে আছেই।”
“একদম, একদম। কাল দুপুরেই বেরিয়ে পড়ব।”
রিয়া মোবাইল টেবিলে নামিয়ে রাখে। তারপর চামচ দিয়ে একটু তরকারি বাটি থেকে তুলে নিয়ে অনুসন্ধানী চোখ দিয়ে জরিপ করে বলে, “হুম। এটা ব্রকোলি, মটরশুঁটি আর আলুর তরকারি। কিন্তু সব তরকারি জলে ডুবন্ত সাবমেরিন যেন এক-একটা।”
“ভালোই বলেছিস। যাই বানাক, খেয়ে নিই চল। আমার আজ একটা শুকনো সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে হবে। একটু তাড়া আছে। তোকে নিয়ে গেলে বোর হবি। তুই বরং শুয়ে শুয়ে পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে চিন্তাভাবনা চালু রাখ। কিংবা বিজ্ঞানী হবার একশো আট উপায় নিয়ে একটা বই লিখে ফ্যাল।”
অর্কর কথায় চটে যায় রিয়া।—“আবার রেজাল্ট রেজাল্ট বলে আমার মাথায় বোঝা না চাপালেই চলছিল না তোমার? কলকাতায় এসে অবধি তোমার পাল্লায় পড়ে মনে হচ্ছে নিউট্রিশন নিয়ে পড়া ছাড়া আমার আর কোনও গতি নেই।”
“ডাহা মিথ্যে বলছিস। তোকে এখুনি এই জলমগ্ন তরকারিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। রান্নার পিছনে বিজ্ঞানের কথা শুনিয়েছি তোকে। তাই বলে কি বলেছি যে, ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির দুনিয়ায় গবেষণা করা যাবে না? যাক গে, ছেড়ে দে বাজে কথা। জলে ডোবা তরকারি দিয়ে রুটি খেতে খেতে বরং আমার কিছু বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের উত্তর দে। পাশ করলে গড়িয়াহাটে ফুচকা খাওয়া পাক্কা। বল পৃথিবীতে কতটা জল আছে।”
“পৃথিবীর তিনভাগ জল, একভাগ স্থল। ছোটবেলা থেকে এটাই পড়েছি। তবে পৃথিবীর উপরিভাগের ৭০ শতাংশ অঞ্চল জলে ঢাকা, বাকি ৩০ শতাংশ জলের বাইরে দেখা যায়। ৯৬.৫ শতাংশ জল আছে সমুদ্রে, সেই জল লোনা। বাকি ৩.৫ শতাংশ জল আটকে আছে হিমবাহে, মেঘে এবং মাটিতে ও মাটির নীচে। এই জল মিষ্টি। পরের প্রশ্ন।”
“ভেরি গুড! এবার বল, খাবারদাবারের কাঁচামালে কতটা জল থাকে।” অর্ক প্রশ্ন করে উত্তরের জন্য খাওয়া থামিয়ে রিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“বেশিরভাগ শাকসবজিতে সাধারণত মোট ওজনের ৭০-৮০ শতাংশ জল থাকে। মাংসে সামান্য কম হয়।”
“সঠিক উত্তর। ফুচকা জিতে নিয়েছিস তুই। যতগুলো পারবি খাবি। এবার ফুচকার জন্য প্রশ্ন নয়। রান্নার জন্য প্রশ্ন। রান্নার সময় জল দেওয়া হয় কেন?”
“ফ্রাই করতে গেলে জল লাগে না। তরকারি বা মাংস রান্না করতে গেলে জল না দিলে পুড়ে যায়, তাই।”
“সে তো বটেই। তবে পুড়ে যাবার কারণ খুঁটিয়ে দেখে নিতে হবে। যেসব কড়াইতে আমরা রান্না করে থাকি, সেগুলো হল ধাতু দিয়ে তৈরি। যেমন অ্যালুমিনিয়াম বা লোহা। স্টোভে পাত্র বসালে খুব তাড়াতাড়ি পাত্র গরম হয়ে যায়, কারণ ধাতু উত্তম তাপ পরিবাহী। সেই উত্তাপ সঙ্গে সঙ্গে পাত্রে রাখা শাকসবজিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। কাজেই পাত্রের সঙ্গে লেগে থাকা শাকসবজির আবরণ বেশি গরম হয়ে সেই অংশ শুধু বেশি তাপ লেগে পুড়ে যায়, যদি আমরা নাড়াচাড়া না করি। নাড়াচাড়া করলেও কিন্তু স্টোভের তাপ শাকসবজিতে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। কড়াইতে রান্না করা বস্তুগুলোর সঙ্গে বাতাস লেগে থাকে। বাতাস তাপ অপরিবাহী। কিন্তু রান্নায় জল দিলে সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। জল কড়াইয়ের ধাতু থেকে তাপ শুষে নিয়ে সব শাকসবজিতে সমানভাবে তাপ ছড়িয়ে দেয়, কারণ তাপ পরিচালন বা কনভেকশনে জলের কোনও জুড়ি নেই। আবার জল তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। জলের স্ফুটনাঙ্ক ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি নয় বলেই কড়াইতে তাপমাত্রা এর কম থাকে।”
“আবার প্রেশার কুকারে রান্না করলে জলের স্ফুটনাঙ্ক বেড়ে যায়। কারণ, প্রেশার কুকারে চাপ বেড়ে গিয়ে তাপমাত্রাও বাড়ে।” বিজ্ঞের মতো মন্তব্য করে রিয়া।
“সাবাশ! তোর ভালো রেজাল্ট করা কেউ আটকাতে পারবে না। তাপমাত্রা বেড়ে যায় বলেই আবার প্রেশার কুকারে রান্না তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। কিন্তু কড়াইতে রান্না আর প্রেশার কুকারে রান্নার স্বাদে তফাত থাকে। সেই কারণেই মাংস রান্না প্রেশার কুকারে না করাই ভালো।
“জলের একটা বিশেষ গুণ আছে, সেটা হল তার স্পেসিফিক হিট। এটা তুই ছোটবেলায় পড়েছিস বিজ্ঞান বইতে…”
অর্কর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রিয়া বলে, “জলের স্পেসিফিক হিট সবচাইতে বেশি। তাই অন্য তরলের চাইতে জল গরম হতে সময় বেশি লাগে। যে-কোনো ধাতুর ক্ষেত্রে এই স্পেসিফিক হিট অনেক কম। তাই লোহা বা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি কড়াই থেকে তাপ শুষে নিতে তার অনেক সময় লাগে।”
“গুড গার্ল! স্পেসিপফিক হিট বেশি হওয়ায় রান্না হতে সময় নিলেও শাকসবজি পুড়ে যায় না। এবার আসা যাক জলের আর একটা গুণের কথায়। জলের অণুতে দুটি অক্সিজেন এবং একটি হাইড্রোজেনের পরমাণু আছে—স্কুলের বাচ্চারাও জানে। জলের অণুর গঠনের কারণে তার হাইড্রোজেন পরমাণুর দিকটা হয় পজিটিভলি চার্জড আর অক্সিজেনের পরমাণুর দিকে থাকে নেগেটিভ চার্জ। অক্সিজেন যে ইলেকট্রন ছিনতাই করতে অতি ওস্তাদ সেটা আমরা জানি। কাজেই তাপের উপস্থিতিতে অন্য প্রোটিন বা রাসায়নিক যৌগ থেকে ইলেকট্রন ছিনিয়ে নিয়ে দারুণ সব বিক্রিয়া ঘটায়। এই বিক্রিয়ার ফলে খাবারে কিটোন জাতীয় যৌগ তৈরি হয়। বারো ক্লাসের ছাত্র মানেই জানা আছে, কিটোনের নানারকম গন্ধ আছে। রান্নার কড়াইতে এই কিটোনের উপস্থিতি খাদ্যের স্বাদকে বদলে দেয়। আর একদিকে পরিস্রুত জল দিয়ে রান্না করলে বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগকে খাবারে সংরক্ষণ করার সহজ হয়।”
“কিন্তু অর্কদা, রান্নার সময় শাকসবজিতে মশলা দেবার পর সঙ্গে সঙ্গে জল ঢালা হয় না। রান্নাটাকে কষাতে হয়। বেশ একটা তেল তেল ভাব এলে তবেই জল ঢালা হয়। কেন?”
“খুব ভালো প্রশ্ন। আগে কড়াইতে সামান্য তেল ঢেলে তবেই আমরা শাকসবজি দিই। তারপর সামান্য ভেজে নেওয়া হয়। এরপর মশলা দেওয়া হয়। প্রথমেই তেল শুষে নেয় কাঁচা শাকসবজি, কারণ তাদের গায়ে অসংখ্য ক্যাপিলারি টিউব আছে। ক্যাপিলারি নিশ্চয়ই তোর জানা আছে। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম খালি চোখে না দেখতে পাওয়া সব নল, যা দিয়ে জীবন্ত গাছে জল আর অন্যান্য মিনারাল চলাফেরা করে। তেলগুলো সেইসব টিউবে ঢুকে পড়ে। তারপর কড়াইতে তাপ বাড়তে থাকলে সবজির টিস্যুগুলো ভেঙে যায়। কাজেই সব কোষের পাঁচিল ভেঙে গিয়ে তেল আর জল সব মিশে যায়। কড়াইতে ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দ হতে থাকে। কারণ জলে আর তেলে মিশ খায় না। মিলমিশ হবে কী করে? জল হল পোলার, আর তেল একটা নন-পোলার যৌগ—মানে প্রথমটাতে তড়িৎ-ধর্ম আছে, দ্বিতীয়টায় নেই।”
“কিন্তু বেশি জল দিয়ে যে তরকারির বারোটা বাজিয়েছে জ্যোৎস্নাদি, এটা কেন হল সেটা বোঝাও।” বলে রিয়া।
“কারণ একটাই। রান্নার কড়াইতে যেসব সুন্দর খুশবুদার কিটোন তৈরি হয়েছিল, সব জলে গুলে গিয়ে অতিরিক্ত পাতলা হয়ে গিয়েছে, ফলে রান্নার স্বাদ আসেনি। রান্নার সময় জলের পরিমাণের দিকে লক্ষ রাখা খুবই প্রয়োজন। আমাদের ভারতীয়রা গ্রেভির প্রতি একটু বেশি আগ্রহী। গ্রেভি অবশ্যই জল ছাড়া বানানো সম্ভব নয়। কিন্তু মাত্রাছাড়া জল দিলে সব স্বাদ-গন্ধ কেড়ে নেয় সেই জলই।
“এবার ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী, আমাকে যেতে হবে বাইরে। কাল আমরা যাচ্ছি আমিনিয়ায় খেতে। রেজালা আর পরোটা যা বানায় না ওখানে!” চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে অর্ক।
মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে রিয়া উত্তেজিত গলায় বলে, “কাল আমাদের বারো ক্লাসের রেজাল্ট বেরোবে অর্কদা!”
অর্ক একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলে, “আর আমাদের বাড়িতে একজন দারুণ রেজাল্ট করবে জানি। আর সে যে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে, সেটাও সত্যি। তাহলে কাল যাওয়া হচ্ছে এসপ্ল্যানেডে আমিনিয়া রেস্তোরাঁয়, ঠিক আছে?”