এমন অনেক কালজয়ী
পঙক্তিমালার জনক, সুকুমার রায় ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের
পর যাঁর লেখা পড়তে পড়তে নতুন আর এক ছড়ার বিশ্বে পৌঁছে গেলাম আপামর বাংলাভাষী,
তিনি আমাদের বুকের কাছাকাছি বাস করা এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব ছড়ার
রাজা ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। ছড়া তাঁর গৃহপোষ্য, ছন্দ তাঁর
হাতের পুতুল—আঙুলের সুতোয় নাচে। এমন শ্রুতিনন্দন ও মনোরম অনায়াস শব্দচয়ন
তুলনারহিত। যেমন তিনি শিশুমনের সম্রাট, তেমনই বড়োদের
মনোভূমির বেতাজ বাদশা। ছড়া-প্রিয় সকলেই এ-কথা মানবেন যে তিনি ছড়া লেখার সময়
বোধ হয় তাঁর নিজ পরিধেয় পোশাকের পকেট থেকে মুঠো মুঠো শব্দ বের করে লেখেন। এত
অনায়াস তাঁর ছড়া লেখার ভঙ্গিমা। কোথাও একবিন্দু তাল-লয়-ছন্দ-মাত্রার খামতি অতি
নিন্দুকও খুঁজে বের করতে পারবেন না। ভাব-ভাষা-বিষয়বস্তুর দিক থেকেও যেমন প্রতিটি
লেখা অনন্য, তেমনি সামাজিক অন্যায়-অবিচারের প্রতি তাঁর
শ্লেষ প্রস্ফুটিত হয় সমসাময়িক লেখাতে।
এমনি কুড়ি হাজারের উপরে
লেখা ছড়ার জনক যার মধ্যে বারো হাজারের অধিক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত, এই লেখকের সঙ্গে দেখা হওয়া আমার মতো খুচরো সাহিত্যানুরাগী তো
বটেই, অন্য সকলের কাছেও পরম সৌভাগ্যের। সে-দিনটার কথা আমার
হিরণ্ময় স্মৃতির পাতায় আজীবন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
১৯৯৪ সাল। আমি তখন কলকাতার
বেকবাগান এলাকার ফিফটিন লোয়ার রেঞ্জে অবস্থিত ‘ওভারল্যান্ড দৈনিক’ পত্রিকার মূল কার্যালয়ের
চারতলার অফিসে চার নম্বর পেজ ইনচার্জ হিসাবে কর্মরত। মধ্যমগ্রামের অফিস থেকে মাস
খানেক হল হেড অফিসে জয়েন করেছি। একটা ঘরে আমি আর চিত্রশিল্পী রমাদা তখন পাশাপাশি
দুজনে দুটো টেবিলে বসে কাজ করি। রমাদা সারাক্ষণ বসে ছবি আঁকেন। গল্প-কবিতার
ইলাস্ট্রেশন করেন। আর আমি চিঠিপত্র বিভাগ দেখি। ওভারল্যান্ড পত্রিকার চার নম্বর
পেজটি সম্পূর্ণ চিঠিপত্রে ভরা থাকত। প্রতিটি লেখাই চিঠি কম প্রবন্ধ বেশি ছিল।
যাঁদের লেখা তখন সম্পাদনা করেছি, আজ সেই সমস্ত চিঠি লেখকদের
অনেককে বড়ো বড়ো প্রাবন্ধিক বা লেখক হিসেবে দেখতে পাচ্ছি।
তো যাই হোক, একদিন দুপুরে টিফিনের পর রমাদা আর আমি কাজ কম থাকায় বসে গল্প
করছি। এমন সময় এক দীর্ঘদেহী সুঠাম অতি সৌম্যদর্শন স্যুটেড-বুটেড উজ্জ্বল চোখের এক
ব্যক্তি হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন। রমাদাও হাসিমুখে তাঁকে আপ্যায়ন করলেন। এরপর তিনি
আমার দিকে তাকাতেই রমাদা আমার বিষয়ে বলে আমাকে বললেন, “ইনি
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।”
আমি বুঝে গেলাম, ইনিই সেই ছন্দের রাজা ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। যাঁর লেখা পড়তে
পড়তে দু-এক লাইন লেখালেখি করছি তখন। এরপর আমি দু-হাত জোড় করতেই উনি তাঁর লম্বা
হাতটি ধরবার জন্য বাড়িয়ে দিলেন। আমি সেই ছন্দঝরা আঙুলগুলো ধরে সেই মুহূর্তে কী
যে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম সেদিন তা বোঝাতে পারব না। রমাদা চায়ের অর্ডার দিলেন।
প্রায় ঘণ্টা খানেক তুমুল আড্ডা হল আমাদের। লেখালেখির কথা, লেখক-জীবনের
টুকিটাকি ঘটনার কথা—আরও কত কী। অত বড়ো মাপের মানুষ, কিন্তু
কত সাধারণভাবে মিশে গেলেন আমার সঙ্গে। সেদিন মনে হয়েছিল, বড়ো
মানুষেরা এমনই হন। তাঁদের অন্তর্নিহিত মহত্বই তাঁদের বড়ো হতে সাহায্য করে।
সেদিন জানতে পেরেছিলাম, তিনি একই পত্রিকাতে ছোটোদের বিভাগ দেখেন। সেদিন ছিল বুধবার।
আজও মনে আছে এই কারণে যে উনি প্রতি বুধবারে অফিসে এসে পেজ দেখতেন। সেদিন রমাদার
কাছে এসেছিলেন তাঁর পেজের ইলাস্ট্রেশন নিয়ে আলোচনা করতে।
সেই থেকে প্রায়শই দেখা হত
আমাদের। নানান কথা হত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বছর
খানেকের মধ্যেই ওভারল্যান্ড পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর থেকে দেখাশোনার আর সুযোগ
ছিল না। কলকাতা থেকে অনেক দূরের মফস্সলে বসবাসের কারণে।
ইদানীং কলকাতা-কেন্দ্রিক
সাহিত্যসভাগুলিতে যাতায়াত বেড়ে যাবার ফলে আবার একটু দেখা হচ্ছিল। শেষ দেখা
হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কে.পি বসু মেমোরিয়াল হলে নিখিল ভারত শিশু
সাহিত্য সংসদ আহুত একটি অনুষ্ঠানে। তাও প্রাক-করোনা কালে। সেই সুঠাম মানুষটিকে
কতকটা অশক্ত দেখেছিলাম সেদিন। দেখলাম নিষ্ঠুর সময় কীভাবে সবকিছুকে ক্রমশ
ক্ষয়িষ্ণু করে। চিনতে পেরেছিলেন আমাকে।
বর্তমানে অসুস্থতার কারণে
একটি পা হারিয়ে একরকম গৃহবন্দি হয়ে আছেন তিনি।
ভবানীদা, প্রিয় ছড়ার রাজা, আপনি সুস্থ হয়ে
দীর্ঘদিন আমাদের মাঝে থাকুন। আরও লিখুন। আমরা আপনার বাধ্য ছাত্র হয়ে আপনার সামনে
হাঁটু মুড়ে বসে তালিম নিতে চাই—আরও অনেক দিন।
সব শেষে তাঁর কাছে শেখা
ছড়ায় তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি—
...
নামটি জানি ঠিক ভবানী হাওড়াতে তাঁর বাস,
গড়িয়ে ছড়া ছড়িয়ে ছড়া বেড়ান বারোমাস।
মুক্তো গেঁথে যুক্ত করেন ছড়ার যত ছন্দ,
ছোট্ট শিশু বৃদ্ধ যিশু সবার তাই পছন্দ।
ছড়ায় হাসেন অপর্ণা সেন কিংবা সত্যজিৎ,
‘রবীন্দ্রনাথ নইলে অনাথ’ বলেন সুনিশ্চিত।
হাসলে তিনি হিরের খনি লেখেন মজার ছড়া,
অবিচার আর মিথ্যাচারে লেখেন মিঠেকড়া।
‘কোলকাতা তোর খোল খাতা’ দেখ কার ছড়াটা হিট,
ভরদুপুরে বাজার ঘুরে বলছে কলেজ স্ট্রিট।
সবাই চিনি ছড়ার খনি দুই পার বাংলার,
ইচ্ছামতীর ছড়ার সেতু ভবানী মজুমদার।
|