বৈজ্ঞানিকের রান্নাঘর-২ । আষাঢ় ১৪৩১

 
  যার নুন খাই, তার গুণ গাই











অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
দিল্লি, এন সি আর 


 

চিকেন লেগ-রোস্টে কামড় দিয়েই অর্ক মুখটা ব্যাজার করে বলল, “জ্যোৎস্নাদিরোস্টে নুন বেশি হয়ে গেছে। খেতে ভালো হয়েছে যদিও।

         “সে কি দাদা! আমি মাখানোর সময়ে যেমন নুন দিই তেমনই তো দিয়েছি। রিয়াদিদি, তোমারও কি লাগছে?”

         রিয়া সবে এসেছে অর্কদের বাড়ি। কাজেই সে কিছু না বলে খেতে খেতে শুধু ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিল তার নুন বেশি লাগছে না। অর্ক চিকেনের ঠ্যাং চেবাতে চেবাতে মোবাইলে নিউজ পড়ছিল। সে মুখ না তুলে বলল, “কী রে, ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী, মুখে কথা নেই কেন? মা একটা জরুরি অপারেশনে সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে গেছে। যাবার আগে জ্যোৎস্নাদিকে বলে গেছে তোর জন্য চিকেন রোস্ট বানিয়ে দিতে। কেমন লাগছে সেটা তো বলতে হবে, নাকি?”

         “খুব ভালো লাগছে খেতে। তবে নুনটা একটু বেশি। সঙ্গে একটা মেটাল মেটাল টেস্ট মনে হচ্ছে।

      “বৈজ্ঞানিকের পর্যবেক্ষণ একেবারে ঠিক। কিন্তু এর কার্যকারণ তো ব্যাখ্যা করা দরকার! বলতে পারিস কেন এমন হল?” জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী ব্যাপার, তুমি এমন ভেবলে গেলে কেন? আরে মনখারাপ করছ কেন? খেতে ভালো হয়ে যাবে পরের বার। রিয়া তুই বল, খাওয়ার নুনে কী থাকে। জ্যোৎস্নাদি খুব বুদ্ধিমতী, সব বুঝে যাবে।

         “খাওয়ার নুনে নিরানব্বই শতাংশ থাকে সোডিয়াম ক্লোরাইড। কিছুটা সোডিয়াম এলুমিনো সিলিকেট বা ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট মেশানো হয় লবণ যাতে গলে না গিয়ে ঝরঝরে হয়।

         “আমার ছোটবেলায় তো বোতলে নুন রাখলেই গলে জল হয়ে যেত বর্ষার দিনে।বলে ওঠে জ্যোৎস্না

         “এই জন্যই তোমাকে বুদ্ধিমতী বলি। যেমন রিয়া বলল, তখনকার দিনে নুনে ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট থাকত না, তাই বাতাসে যে জলীয় বাষ্প আছে, সেটা শুষে নিয়ে নুন নিজেই ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে যেত। আসলে খাওয়ার নুন মানেই সোডিয়াম ক্লোরাইডের ক্রিস্টাল। সেগুলো জলের অণুর স্পর্শে এসে ভেঙে নেতিয়ে পড়ে। এবার তাহলে আসি জ্যোৎস্নাদির চিকেন রোস্টে কেন নুন বেশি হল, সেই কথায়। এইসব আবার পড়ার সিলেবাসে থাকে না, কাজেই রিয়া তুইও মন দিয়ে শোন

         “সোডিয়াম ক্লোরাইডকে সাধারণ মানুষে লবণ বা সল্ট বলে, কিন্তু এটি হাজার হাজার প্রাকৃতিক সল্টের একটিমাত্র। রিয়া, তুই সল্ট টেস্ট করতিস নিশ্চয়ই স্কুলের ল্যাবে? তুই জানিস ধরে নিলাম। সোডিয়াম ক্লোরাইডে সোডিয়াম হল একটা পজিটিভ আয়ন, ক্লোরাইড র‍্যাডিকাল হল একটি নেগেটিভ আয়ন। দুটি আয়ন জোড়া থাকে যে বাঁধনে তাকে রসায়নের লোকে বলে আয়নিক বন্ডএই আয়নিক বন্ড কিন্তু বিচিত্র বস্তু। তাপের উপর নির্ভর করে তার অবস্থা। তাপ বেশি হলে বা জলীয় বাস্পের সংস্পর্শে এলে ক্রিস্টাল ভেঙে যায়। আরও জটিল কথায় না গিয়ে বলি— এই খাওয়ার নুন বা সোডিয়াম ক্লোরাইড কোথায় কী খেল দেখায় জানতে হবে, তবেই রান্না হবে সুস্বাদু

         “শাকসবজি রান্নার উপর নুনের প্রভাব, আর মাংস রান্নার উপর নুনের প্রভাব কিন্তু আলাদা। শাকসবজি যখন আমরা রাঁধি, তখন লবণ সবজি থেকে জল বার করে দেয়, ফলে সবজি সিদ্ধ হতে সময় লাগে না। এর কারণ হল গাছেদের প্রোটিনের গঠন। শাকসবজি আমরা রাঁধি সাধারণত জলের স্ফুটনাঙ্কের কাছে—১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এই কাণ্ডটাই উলটো হয়ে যায় মাংসের ক্ষেত্রে। প্রাণীদের শরীরে যে প্রোটিন আছে সেটা আলাদা ধরনের, নুনের প্রভাবে জল বেরিয়ে যায় না, বরং রান্নার সময় মাংস থেকে জল বাইরে বেরোতে বাধা দেয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মাংসের প্রোটিন যদি ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাঁধা হয়, তবেই সেই মাংস নরম তুলতুলে থাকবে। আর তোমার তো জানো, শক্ত ছিবড়ে মাংস খেতে কারও ভালো লাগে না। তাই কম আঁচে অনেকক্ষণ ধরে রাঁধলে মাংস খেতে সুস্বাদু হয়।

         একটা চিকেন লেগ শেষ করে আর একটা হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে অর্ক বলে, “লবণে যে আরও একটা জিনিস মেশানো হয় সেটা কিন্তু তুই বললি না রিয়া। আজকাল বাজারে যেটা খুব চলে…

       “বলতেই যাচ্ছিলাম, আইয়োডাইজড নমক—দেশ কি সেহত, দেশ কি নমক।

      “গুষ্ঠির পিণ্ডি। পুরা দেশকা নহি, স্রেফ… এই রে, দিল্লিওয়ালির পাল্লায় পড়ে আমিও হিন্দিতে বলছি। যাক গে, পুরো দেশের মানুষের স্বাস্থ্য উদ্ধার হয় না ওতে। পাহাড়ে যেসব শাকসবজি আর ছাগল-ভেড়ার মাংস পাওয়া যায় তাতে আয়োডিনের অভাব থাকে। আয়োডিন আমাদের শরীরে থাইরক্সিন হরমোন তৈরি করতে কাজে লাগে। এই হরমোনের অভাবে গলগণ্ড রোগ দেখা যায়

যাই হোক, ভারতবর্ষে ১৯৫০ সালে চিকিৎসকেরা গলগণ্ড রোগের কারণ ধরতে পারেন। তখন লবণে মেশানো শুরু হয় সোডিয়াম আয়োডাইড বা পটাসিয়াম আয়োডাইড। কিন্তু আমরা যারা সমতলে বা সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে থাকি, তাদের সুষম আহারেই আয়োডিন যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। যেমন সামুদ্রিক মাছ, আনারস এবং আরও নানা ফলে। তবে কী, রিয়ার মতো যারা দিল্লির ফাস্ট ফুডের উপর বেশি নির্ভর করে, তাদের জন্য অবশ্যই আয়োডিন লাগবে। নইলে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দেবে

সুস্থ মানুষের শরীরে, যারা দু-বেলা অন্তত শাকসবজি খেয়ে বেঁচে থাকে, তাদের শরীরে অতিরিক্ত আয়োডিন সমস্যাই তৈরি করে, খুব বেশি উপকারে আসে না। এই যে আয়োডিন যুক্ত নুন লাগিয়ে আজ জ্যোৎস্নাদি আমাদের জন্য যত্ন করে চিকেন রোস্ট বানিয়েছে, সেটা অতিরিক্ত নুন বলে মনে হচ্ছে কারণ রোস্ট করা হয় প্রায় ১৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়। সেই ক্ষেত্রে সোডিয়াম বা পটাসিয়াম আয়োডাইড ভেঙে আয়োডিন হয়ে যায় মুক্ত। এই কারণে একটা তেতো স্বাদ আসে মুখে, অনেকটা মনে হয় কোনও মেটাল খেয়ে ফেলছি। তাই রোস্ট করার সময় একটু কম নুন লাগানো বুদ্ধিমানের কাজ। আবার যদি নন-আয়োডাইজড লবণ দিয়ে ম্যারিনেট করে মাংস রোস্ট করা হয়, তবে আর সমস্যা হবে না। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, বড়ো বড়ো হোটেলে কিন্তু খাবার বানাতে গেলে আয়োডিন যুক্ত লবণ ব্যবহার না করে সাদামাটা সোডিয়াম ক্লোরাইড, মানে পুরোনো আমলের লবণ ব্যবহার করেন পাচকেরা।

         “তাহলে তো বাপু একেবারে নুন না দিয়ে রোস্ট করে দিলেই ভালো হবে, নাকি?” জ্যোৎস্না মন্তব্য করে

         “এটা তো তোমার রাগের কথা হল দিদি! প্রাচীনকালে মানুষ জঙ্গলে যে মাংস রোস্ট করে খেত, তাতে নুন লাগানো হত না। এইটা আমি একটা বইতে পড়েছিলাম। আফ্রিকাতে নুন ব্যবহার ছিল না বহুকাল। কারণ, তারা যেসব প্রাণীদের মেরে মাংস খেত, তাদের শরীরেও অনেক নুন থাকত। সেই নুনের প্রভাবে সুসিদ্ধ হয়ে যেত মাংস।রিয়া বলে

         “মরা পশুদের শরীরে নুন?” প্রশ্ন করে জ্যোৎস্না

         “হ্যাঁ, তোমার শরীরেও তো নুন আছে, নাকি? রোজ যা খাও, সেই নুন শরীরেও জমা হয়। তবে বন্য প্রাণীদের শরীরে নুন আসে শাকসবজি থেকে। সেইসব খেয়েই তো তারা বড়ো হয়! আবার নুনের স্বাদ একটা অভ্যাসের মতো। যদি কম নুন খাওয়া অভ্যেস করে ফেলো, তবে নুন বেশি খাওয়ার প্রয়োজনই হবে না।অর্ক উঠে গিয়ে বেসিনে হাত ধোয়

জানো অর্কদা, আমি পড়েছিলাম, আমাদের মুখের লালায় ০.৪ শতাংশ লবণ থাকে। খাবারে এর চাইতে কম মাত্রায় নুন হলে বিস্বাদ লাগে।রিয়া প্লেটের উপর তিন নম্বর চিকেনের ঠ্যাং তুলবে কি না ভাবতে ভাবতে বলে

         “আলুনি লাগে দিদিভাই? তাই বলছ তো?”

         “আলুনি আবার কী? জানি না তো! কোনও খাবার?”

         “ওরে না রে দিল্লিওয়ালি! আলুনি মানে হল খাবারে নুন কম হলে বাঙালিরা বলে আলুনি’!” চেঁচিয়ে ওঠে অর্ক

         “যাক, একটা শব্দ শেখা গেল আজ। আলুনি… আলুনি…আওড়াতে থাকে রিয়া

         অর্ক টেবিলে ফিরে এসে চায়ের কেটলি থেকে ব্ল্যাক-টি ঢালতে ঢালতে বলে, “খাবারে যদি ০.৫ থেকে ১.০ শতাংশ নুন থাকে, তাহলে আমাদের জিভ তাকে স্বাদু বলে মেনে নিয়ে মাথায় সিগন্যাল পাঠায়। তবে সেই সিগন্যাল যাবার জন্য আবার লাগবে সোডিয়াম। সোডিয়াম আয়ন হচ্ছে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের, মানে নার্ভাস সিস্টেমের ডাকপিয়ন—যার কাজ হল সংবাদ ঠিকঠাক পৌঁছে দেওয়া।

         “আফ্রিকাতে নুন ছাড়া মাংস পুড়িয়ে এখনও খায় লোকে?” সরল প্রশ্ন করে জ্যোৎস্না

         “না গো, সেই দিন আর নেই। এখন মানুষ ওখানেও নুন খায় খুব। কিন্তু এককালে ওই দেশে নুন আমদানি করেছিল ইউরোপিয়ানরা। তারা তো আর আফ্রিকার লোকের মতো হান্টার গ্যাদারার, মানে শিকারি ছিল না। শাকসবজি খেয়ে থাকত, শহরে মানুষ হত। রান্না মাংসে উপস্থিত নুন তাদের জিভ ধরতেই পারত না। সঙ্গে করে নুন নিয়ে আফ্রিকায় যেত ইউরোপীয়রা। তারপর আফ্রিকাতেও নুনের চাহিদা বাড়ল। খুলে গেল বিরাট নুনের বাজার। সে-সব বড়ো কথা। মোদ্দা ব্যাপার যা দাঁড়াল, নুনের ব্যবহার রোস্ট করার সময় কমাতে হবে। সবচাইতে ভালো হয় যদি কাঁচা মাংস ম্যারিনেট করার আগে কিছুক্ষণ নুনের দ্রবণে ফেলে রাখা যায়। তাহলে নুন ধীরে ধীরে মাংসের ভিতর ঢুকে যাবে, আর রান্নার সময়ে সেই নুন মাংসের ভিতর থেকে জল বেরোতে দেবে না।

         জ্যোৎস্না উঠে পড়ে বলে, “অনেক কিছু শিখে গেলাম দাদা। পরের বার রান্নার সময় মনে রাখব।

         “সে তুমি মনে রেখো, কিন্তু কথায় আছে যার নুন খাই, তার গুণ গাই। এই যে আজ আমরা তোমার গুণ গাইলাম না, তুমি কিন্তু তাতে কিছু মনে করবে না। এই যে আমার বোনটি দিল্লি থেকে এসেছে, এর বড়ো ইচ্ছে বিজ্ঞানী হবার। তাই ওর উপর একটু দাদাগিরি করছিলাম। দিল্লি ফিরে যাবার আগে একদিন আমাদের চিকেন টিক্কা করে খাওয়াবে। তাহলেই পেয়ে যাব আমার গুরুদক্ষিণা।

         “আর আমি তোমাকে কাল চাউমিন রান্না করে খাইয়ে দক্ষিণা দিয়ে দেব দাদা।বলেই জ্যোৎস্না প্রায় ছুটে বেরিয়ে যায় খাওয়ার টেবিলের সামনে দিয়ে