।। ৪।।
অক্টোবর মাস শেষ হতে
চললেও রোদের তাপ কমেনি। তবে ঢিবির একধারে কিছুটা রোদ কম রয়েছে। ছায়ায় বসে গল্প
করার জন্য ওঁরা ঢিবির উপরে উঠেছিল। সামনে অর্ক, তার পিছনে টিপু। তারপরে মৌ। ঢিবিটা বেশ উঁচু।
অর্ক অনর্গল কথা বলতে পারে। আম বাগানে ঝড়ের পরে কিভাবে আম কুড়ানো যায়, দুবছর আগে আম কুড়াতে গিয়ে অর্ককে সাপে কেটেছিল,
কিভাবে সেই বিপদ থেকে
উদ্ধার হয়েছে, সেই গল্প অর্ক
বলে হাঁটতে হাঁটতে বলে চলেছিল। টিপু শুনতে শুনতে ঢিবির উপরে উঠছিল। ওঁদের কারোই
নজর ছিল না মৌ এর দিকে। হঠৎ একটা আর্তনাদ শুনে অর্ক আর টিপু পিছনে ফিরে দেখলো মৌ
নেই। তবে আর্তনাদ যে মৌ এর ছিল তা বুঝতে পেরে ওঁরা ছুটে এলো নীচের দিকে।
তখনই গর্তটা নজরে পড়লো
টিপুর। পাতলা মুলিবাঁশের জাল দিয়ে তার উপরে মাটি বিছিয়ে রাখা হয়েছিল। যাঁরা একাজ
করেছিল, তাঁরা যে সাধারন মানুষের
চোখের আড়াল তৈরি করতে চেয়েছিল, সেটা বুঝতে
অসুবিধ হয়নি টিপুর। মৌ এই নরম মাটিতে পা দিতেই যে গর্তে পড়ে গিয়েছে, টিপু অর্ক দুজনেই বুঝতে পারল। দুজনে মিলে
হাল্কা করে দেওয়া মাটি হাত দিয়ে সরিয়ে নীচের দিকে ঝুঁকে তাকানোর চেষ্টা করলো।
গর্তটা কিছুটা সোজা কুয়োর মতো নেমে নীচের দিকে বেঁকে যাওয়ায় অন্ধকারে মৌকে দেখা
যাচ্ছেনা। তবে ওঁরা নিশ্চিত যে, এই গর্তেই মৌ
পড়েছে।
টিপু সিদ্ধান্ত নিলো,
সে গর্তে নামবে। তবে
গর্তটা কতটা গভীর সেটা আন্দাজ করতে পারছিল না। কিন্তু মৌ কে তো উদ্ধার করতে হবে!
চাই ‘যা থাকে কপালে’ ভেবে নিয়ে অর্ক কিছু ভেবে ওঠার আগে নিজেই গর্তের মধ্যে লাফ
দিল টিপু। যতটা গভীর ভেবেছিল টিপু, গর্তটা ততটা গভীর
নয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পা এর নীচে মাটির স্পর্শ পেল সে। তবে নীচের দিকে গর্তের
বেড় অনেক চওড়া। কিছুক্ষন পরে পাশে ধুপ শব্দের আওয়াজ পেয়ে টিপু বুঝতে পারলো,
অর্ক নীচে নেমে এসেছে।
মাথার উপরে তাকিয়ে টিপু
দেখলো আকাশ দেখা যাচ্ছে। এক চিলতে আলো এসে ঢুকেছে গর্তটার মধ্যে। সেই আলোতে দেখা
যাচ্ছে, গর্তের নীচ থেকে নারকেলের
ছোবড়ার দড়ির তৈরি ঝুলন্ত মই উঠে গিয়েছে উপরের দিকে। টিপু নিজের মনে বললো, ‘তারমানে এখানে নিয়মিত কেউ ওঠানামা করে।’ টিপু
ফিসফিস করে অর্ককে বললো, ‘খবরদার অর্ক,
জোরে কোন শব্দ করবে না।
তোমার কোন কথা বলারও প্রয়োজন নেই।’
গর্তের পাশে আবছা
অন্ধকারে একটি সুরঙ্গের মতো জায়গা নজরে এলো টিপুর। অন্ধকার এখন অনেকটা চোখ সয়ে
গিয়েছে। অর্ককে ওখানেই অপেক্ষা করতে বলে টিপু হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলো সুরঙ্গের
মধ্যে।
সুরঙ্গের মতো পথে ডানদিকে
গিয়ে টিপুর নজরে এলো জায়গাটি বেশ চওড়া। অন্ধকার অখন অনেকটাই চোখ সয়ে গিয়েছে।
অন্ধকারে নজরে এলো সেখানে কয়েকটি ছোট ছোট পিচবোর্ডের বাক্স একধারে সাজানো রয়েছে।
সুরঙ্গের উচ্চতা এখানে এতটাই, যে একজন প্রমান
মাপের মানুষ এই পথ দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। সামান্য আলোতেই টিপু দেখলো,কিছু দূরে একটা ছোট মাপের কাঠের দরজা ভেজানো
রয়েছে। দরজাটি সামান্য ফাঁকা। নিশ্চই ঘরের দরজা এটা। কারন ঘরের ভিতরে আলো জ্বলছে,
সেটা টিপু বুঝতে পারছে।
টিপু এবার ভালো করে নজর
দিতে দেখতে পেলো, মৌ দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতরে উঁকি দিচ্ছে। মৌকে দেখে আশ্বস্ত্ব হয়ে টিপু দরজার দিকে এগিয়ে মৌকে
নিয়ে উপরে উঠে পালিয়ে যাবে, ভেবে মৌএর দিকে
এগিয়ে গেলো। মৌ অবশ্য এখনও টিপুকে দেখতে পায়নি। মৌ একমনে মাটিতে বসে ঘরের ভিতরের
দৃশ্য দেখছিল। টিপু এগিয়ে গিয়ে মৌএর মাথার উপর দিয়ে ঘরের ভিতরে নজর দিতেই দেখতে
পেলো, তিনজন লোক ঘরের ভিতরে বসে
দুটো চামড়ার ব্যাগের ভিতরে টাকার বান্ডিল ভরছে। ছাদ নীচু ঘরের একধারে দুটি কালো
রঙের বড় ব্যাটারির থেকে তার লাগানো থাকায় জ্বলছে একটি টিউব লাইট।
লোক দুজন একমনে দুটো
ব্যাগে টাকা ভরে চলেছে। অন্যজন অনেক টাকা থেকে বান্ডিল করে ব্যাগে ঢোকানোর জন্য
ওঁদের হাতে দিচ্ছে। মাটির নীচে এই সুরঙ্গের ঘরে এত টাকা এবং এতটা গোপনের সঙ্গে
এঁরা কেন ভরছে, সেটা ভেবে
পাচ্ছিলনা টিপু। নিজের হৃদপৃন্ডের আওয়াজ যেন নিজের কানে শুনতে পারছিল টিপু।
উত্তেজনায় টিপুর খেয়ালই ছিলনা তাঁর পায়ের কাছে মৌ বসে রয়েছে। মালদায় যে জালনোট
প্রায়ই ধরা পড়ছে, টিপু সেখবর
কলকাতায় বাড়িতে থাকতে টেলিভিশনে দেখেছে। এগুলো কি তবে জালনোট ! বিষয়টি ভালো করে
দেখতে যেতেই টিপুর পা গিয়ে ঠেকলো মৌ এর শরীরে। আর তখনই ঘটলো যত বিপত্তি !
মৌ শরীরে কিছু ঠেকতে ভয়ে
চিৎকার করে উঠে হুড়মুড় করে গিয়ে ঢুকে পড়লো ঘরের ভিতরে। আচমকা ঘরে এক অচেনা বাচ্চা
মেয়েকে ঢুকতে দেখে হকচকিয়ে গেলো ঘরের ভিতরে থাকা তিনজনই। টিপু তখনও দরজার বাইরে
দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিজের এই আচরনে এই দূর্ঘটনা ঘটায় টিপুর মাথা তখন কাজ করছে না! তবে
তাঁর মনে হলো, যেভাবেই হোক,
এই সুরঙ্গ থেকে পালাতে
হবে। যাঁরা মাটির নীচে বসে বান্ডিল বান্ডিল টাকার নোট ব্যাগে ভরছে, তারা আর যাইহোক, ভালো মানুষ হতে পারেনা ! ওদিকে সুরঙ্গের নীচে
এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্কও। তাঁর মন বললো, যেকোন উপায়ে এখান থেকে পালাতে হবে !
যে দুজন টাকার বান্ডিল
ব্যাগের মধ্যে ভরছিল, তাদের একজন মৌকে
ধরে নিতেই, টিপু সুরঙ্গের পথ
দিয়ে ছুটলো উলটো দিকে। তাঁর মনে তখন একটাই চিন্তা, যেভাবে হোক, বাড়ি পৌঁছে মৌএর খবর বাড়ির লোকজনকে দিতে হবে !
ঘরের ভিতর থেকে তিনজন
লোকের চাপা হুঙ্কার শুনতে পেলো টিপু। সঙ্গে মৌএর চিৎকারও। লোকগুলোর ভাষা পরিস্কার
বুঝতে না পারলেও, মৌ চিৎকার করে
চলেছে, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও’। এবার অন্য একজনের গলা
পরিস্কার শুনলো টিপু। সে বলছে, ‘এই বাচ্চা মেয়েটা
তো এই এলাকার নয়। এ একা আসেনি। সঙ্গে আরও কেউ নিশ্চই আছে। তোরা বস্কে ফোন কর। আমি
বাকিটা দেখছি।’
টিপু বুঝতে পারলো একজন
তাঁর পিছু নিয়েছে। সে আঁধো অন্ধকারের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি দৌঁড়তে পারছিল না। এদিকে
যে পিছু নিয়েছে, সে যে আরও কাছে
চলে এসেছে, সেটা বুঝতে
অসুবিধা হয়নি টিপুর। প্রানপনে সুরঙ্গের মুখের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল সে।
যেখান থেকে সুরঙ্গ শুরু হয়েছে, সেখানে এসে টিপু
দেখলো, অর্ক সেখানেই দাঁড়িয়ে
রয়েছে। এত ঘটনার সে তো কিছুই জানেনা। একটু দেরি হলেই পিছনে আসা লোকটির কাছে ধরা
পড়বে দুজনেই। কাকুতি মিনতি করে টিপু বেশ জোরেই অর্ককে বলে ফেললো, ‘আমরা ধরা পড়ে গিয়েছি। তাড়াতাড়ি আমাদের এখান
থেকে পালাতে হবে। দড়ির মই দিয়ে উপরে ওঠো।’ কথাটি বলেই টিপু নিজেই আগে দড়ির মই বেয়ে
উপরে উঠতে শুরু করলো।
গোটা ঘটনায় অর্কা এতটাই
ঘাবড়ে গিয়েছিল, যে টিপুর ‘ধরা
পড়ে যাওয়া’, ‘পালাতে হবে’ এসব
কথায় ঘাবড়ে গিয়ে অর্ক দড়ির মই বেয়ে উপড়ে উঠতে গিয়ে পা হড়্কে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে
গেলো। টিপু তখন মই বেয়ে অনেকটা উপরে উঠে এসেছে। নীচের দিকে তাকিয়ে টিপু দেখলো,
অর্ক মাটিতে পড়ে রয়েছে,
তাঁকে ধাওয়া করে আসা
লুঙ্গি পড়া খালি গায়ের লোকটি ক্রুর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে দেখছে।
টিপু কোন মতনে দড়ির মই
দিয়ে ঢিবির উপরে উঠে ঢিবির মাটির ঢালের জন্য দ্রুত নেমে যাচ্ছিল আম বাগানের দিকে।
পিছনে ফিরে টিপু দেখলো, তাঁকে ধাওয়া করা
লোকটিও উপরে উঠে এসেছে। বিকালের সূর্যের আলোয় তাঁর হাতে চক্চক করছে কালো রঙের
পিস্তল। মুহুর্তে টিপুর কান ফাটানো আওয়াজের সঙ্গে পাশের আম গাছের গুড়িতে কি যেন
এসে লাগলো। টিপু বুঝতে পারলো, তাঁকে ধাওয়া করা
লোকটি হাতের পিস্তল থেকে গুলি ছুঁড়ছে। টিপু দৌঁড়ের স্প্রিড আরও বাড়িয়ে দিল।
।। ৫ ।।
সমীরবাবুর বাড়ির ল্যান্ড
ফোনটি বেজে উঠলো সন্ধ্যা ঘন হওয়ার ঠিক আগে। টিপুর মুখে ততক্ষনে সমস্ত ঘটনা শুনে
নিয়েছেন বাড়ির লোকেরা। সমীরবাবুর স্ত্রী- অর্কের মা ছেলের জন্য দুঃশ্চিন্তা শুরু
করে দিয়েছেন। টিপুকে সঙ্গে নিয়ে সমীরবাবু, শংকরবাবু আর উত্তমবাবু ওই ঢিবির দিকে রওনা হয়েছেন কিছুক্ষন আগেই। সমীরবাবুর
বাড়ি জুড়ে উদ্বেগের ঝড় চলছে। টিপুর মা বারবার শুধু বলে চলেছেন, ‘কেন যে মালদায় ঘুরতে এলাম। আমাদের জন্যই আজ
ছেলে মেয়ে দুটো এই ঝামেলায় পড়লো’, এই ধরনের কথা।
টিপুর মুখে সমস্ত ঘটনা
শুনে, এমনকি ওঁকে লক্ষ্য করে যে
গুলি ছোড়া হয়েছে, সব জানতে পেরেই
সমীরবাবু প্রথমে ফোন করেছিলেন স্থানীয় থানাতে। টিপুর সঙ্গে ওঁনারা সেই আম বাগানের
ঢিবির দিকে রওনা হওয়ার আগে সমীরবাবু তাঁর স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলেন, থানা থেকে পুলিশ এলে জানিয়ে দিতে যে তাঁরা
টিপুকে সঙ্গে করে মা বাগানের পিছনের ঢিবির দিকে গিয়েছেন। পুলিশও যেন সেখানেই যায়।
বাড়ির ল্যান্ড ফোন বাজতেই
সমীরবাবুর স্ত্রীর পরামর্শে ফোন ধরলেন, টিপুর মা আমিতাদেবী। তিনি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই অপর দিক থেকে শুনতে পেলেন
হাড় হিম করা ওপাড়ের কর্কশ কন্ঠশ্বর। এক পুরুষ আওয়াজ বললো, ‘তাহলে পুলিশে খবরও দেওয়া হয়ে গিয়েছে! কিন্তু
কোন লাভ যে হবেনা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ফল হবে মারাত্মক! ছেলে মেয়ে দুটোই আমাদের
কব্জায় আছে। ওঁদের ছাড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে যেতে দশ লক্ষ টাকা কোথায়, কিভাবে দিতে হবে, পরে সেটা আমরাই জানাচ্ছি! অমিতাদেবী ‘আপনি কে,
কোথা থেকে বলছেন’ বললেও
সেকথা শোনার আগেই ওপাড়ে সশব্দে ফোন কেটে দেওয়া হয়েছে। অমিতাদেবী সঙ্গের দুই
মহিলাকে বললেন, ‘মনে হয়
কিডন্যাপারদের ফোন ছিল ! অর্ক আর মৌ এর জন্য দশ লক্ষ টাকা মুক্তিপন দাবি করছে।
আবারও ফোন করবে বলেছে। আমরা যে ইতিমধ্যেই পুলিশকে জানিয়েছি, শুনলাম সেই খবরও ওদের জানা !’
অমিতাদেবীর কথা শুনে
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন অর্কের মা। সুমিত্রাদেবীও এবার মেয়ের কথা ভেবে চোখের জল ধরে
রাখতে পারলেন না। সুমিত্রাদেবী তবুও চোখের জল মুছে অর্কের মাকে সান্তনা দিলেন,
‘আপনি কিছু ভাববেন না
দিদি ! কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে !’
অর্কের মা প্রলাপের মতো
বকে চলেছেন, ‘আমার ছেলেকে যদি
বদমাশ লোকগুলো খুন করে তবে কি হবে ! ও মা গো ! এ কি সর্বনাশ হলো গো ! আমাকে এই বিপদ
থেকে উদ্ধার করো ভগবান !
পুলিশের জিপের স্টিয়ারিং
ঘোরাতে ঘোরাতে থানার ওসি পরেশ দেবনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওঁদের কি কোন ফোন এসেছিল ! কোন টাকা পয়সার কথা
কি বলেছে ? কিছু কি জানতে
পেরেছেন !’
পুলিশের গাড়িতে চেপে বাড়ি
ফিরছিলেন শংকরবাবুরা। সঙ্গে টিপুও ছিল। মাটির সেই ঢিবির নীচে জাল নোট কারবারিদের
গোপন আস্তানার হদিশ পেলেও পাওয়া যায়নি মৌ বা অর্ককে। বাড়ি থেকে পাওয়া মোবাইল ফোনে
সমীরবাবু কিছুক্ষন আগেই কিডন্যাপারদের কথা শুনেছেন। কিন্তু পুলিশের ওসি পরেশ
দেবনাথ নিজের কাজে ব্যস্ত থাকার কারনে সেই কথা এখনও বলে ওঠার সুযোগ করতে পারেননি
সমীরবাবু। এমনিতে যত বিপদই হোক, পেশায় হাইস্কুলের
শিক্ষকরা পুলিশের বিষয় পারতপক্ষে এড়িয়ে চলেন, সমীরবাবু তার ব্যতিক্রম নন।
।। ৬ ।।
সন্ধ্যার আগেই আম বাগানের
পিছনের ঢিবির কাছে পৌঁছনোর কিছুক্ষনের মধ্যেই থানা থেকে বিশাল পুলিশের দল নিয়ে
হাজির হয়েছিলেন পরেশবাবু। বিকালের আলোতে ঢিবির চারদিক ঘুরে পুলিশের দল আবিস্কার
করলো এক জায়গায় আলগাভাবে ঘাসের চাঁপ দিয়ে গর্ত বন্ধ করা রয়েছে। সেগুলি খুব সহজেই
পুলিশ কর্মীরা সরিয়ে দেওয়ার পরে দেখা গেল আরও একটি কাঠের দরজা। দরজাটি পুরানো
দিনের। তবে আকারে অনেকটাই ছোট এবং শক্তপোক্ত ধরনের। টিপু বুঝতে পারলো, ওই সুরঙ্গ ছাড়াও আরও একটি আলাদা পথ রয়েছে ঐ
মাটির নীচের ঘরে ঢোকার। তবে পুলিশ কর্মীরা পরেশবাবুকে জানালেন, দরজাটি ভিতরের দিক থেকে বন্ধ করা রয়েছে। ওসি
পরেশবাবু বললেন, ‘সদর থেকে ডি এস
পি সাহেব আসছেন। তার আগেই আমরা ভিতরে ঢুকে তল্লাসীর কাজ শুরু করে দেই। তবে আপনারা
দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকুন। সবাই সরতর্ক থাকবেন। আমিও আসছি আপনাদের সঙ্গে।’
পরেশবাবুর নির্দেশ পাওয়া
মাত্রই পুলিশ কর্মীরা দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যেই সেটা ভেঙে
গেল। টিপুর সঙ্গে পুলিশ বাহিনী সহ সবাই ভিতরে ঢুকলেন। সেই ঘর এখন একদম অন্ধকার।
কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। পরেশবাবু সহ তিনজন পুলিশ কর্মী ইলেক্ট্রিক চার্জারের বড়
টর্চ জ্বাললেন। আলোয় নজরে এলো কালো কালো সেই ব্যাটারি, যার সাহায্য তখন এখানে টিউব লাইট জ্বলছিল।
টর্চের আলোয় সবার নজরে এলো, ঘরের ভিতরে তিনটি
চামড়ার ব্যাগ রয়েছে। যেগু্লো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এগুলোর ঠেসে কিছু ভর্তি করা হয়েছে। একটি
ব্যাগের চেন খুলতেই পরেশবাবু বলে উঠলেন, ‘সর্বনাশ ! এ যে সব দু-হাজার টাকার নোটের বান্ডিলে ভর্তি !’
তাঁর কথা শুনে বাকি পুলিশ
কর্মী, অফিসাররা এগিয়ে গেলেন
সেদিকে। অন্য সহকর্মীদের আলোর সাহায্য নিয়ে নিজের টর্চটা নিবিয়ে দুহাতে সব ক’টি
ব্যাগ খুলে টাকার বান্ডিল গুলি ব্যাগের ভিতর থেকে বের করে আনলেন। একটি ব্যাগে
পাওয়া গেল দু হাজার টাকার নোটের বান্ডিল, বাকি দুটোতে পাঁচশো টাকার নোটের বান্ডিল। পরেশবাবু টর্চের আলোয় দু ধরনের টাকা
গুলিই মিলিয়ে দেখলেন, সব নোটের নম্বর
এক। সেটার দিকে নজর যাওয়ায় পরেশবাবু নিজেই খুব ধীরে ধীরে বললেন, ‘এগুলো তো জাল নোট বলে মনে হচ্ছে ! এটা কি তবে
জাল নোট মজুদ করার ডেরা !’
এখানে যে জাল নোট মজুদ
রয়েছে, টিপু সেটা আগেই আন্দাজ
করেছিল। সে বাড়িতে ফিরে সেকথা জানালেও সমীরবাবু পুলিশকে খবর দেওয়ার সময় মৌ আর
অর্ককে আটকে রাখার কথাটাকেই শুধু জানিয়েছিলেন। এখন পুলিশ এসে জাল নোটের বিষয়টা
জানতে পেরেছে।
পরেশবাবু পুলিশের নিজস্ব
কথা বলার মাধ্যম থেকে সাংকেতিক ভাষায় সমস্ত বিষয়টি জেলা পুলিশের উপর মহলে জানালেন।
সেই কথা শেষ করে পরেশবাবু বললেন, ‘ বড় সাহেব আরও
ফোর্স নিয়ে এখানে কিছুক্ষনের মধ্যেই এসে পৌঁছবেন।’
ঢিবির ভিতরের ঘরটি এবং
সুরঙ্গ ভালোভাবে তল্লাসী চালালো পুলিশের টিম। ঢিবির যে গর্ত দিয়ে টিপু ভিতরে
নেমেছিল, সেখানেও হাজির
হলেন থানার ওসি পরেশবাবু। টিপু তাঁকে উত্তেজিতভাবে জানালো, ‘এখানে নারকেলের দড়ির তৈরি দড়ির মই ঝোলানো ছিল।
এখন নেই। নিশ্চয়ই ওঁরা খুলে নিয়ে গিয়েছে।’
এই খোঁজ খবরের মধ্যেই
জেলার পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে এসে হাজির হলেন। এস পির কাছে দুজন বাচ্চা ছেলে মেয়েকে
কিডন্যাপ যেমন বড় বিষয়, তার চেয়েও বড়
বিষয় হলো গৌড়ের মতো এলাকায় জাল নোট জমা করার আখরার হদিশ খুঁজে পাওয়ার ঘটনা। এসপি
থানার ওসি পরেশ বাবুকে বললেন, ‘ওঁনাদের বলে
দিয়েছেন তো, বাড়িতে যদি
মুক্তিপন দাবি করে কোন ফোন আসে যেন তখনই পুলিশকে ইনর্ফম করেন!’ কথাগুলি হচ্ছিল
সমীরবাবুর সামনেই। তিনি মুক্তিপন চেয়ে ফোন আসার কথা বেমালুম চেপে গিয়ে এস পিকে
শুধু অনুরোধ করলেন, ‘যেভাবেই হোক স্যর,
ছেলেমেয়ে দুটোকে উদ্ধারের
ব্যবস্থা করে দিন।’ এস পি একটু বিরক্ত হয়েই সমীরবাবুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায়
বললেন, ‘পুলিশ তো তদন্ত করছে।
তদন্তে আপনাদের সহযোগীতা প্রয়োজন। পুলিশের তদন্তে সাহায্য করুন।’
যেভাবে মাটির ঢিবির নীচে
সুরঙ্গ কেটে লোকের চোখের আড়ালে ঘর বানিয়ে সেখান থেকে জাল নোটের কারবার ফেঁদে
বসেছিল দুস্কৃতিরা, এস পি দেখে অবাক
হলেন। তিনি নিজের সঙ্গে আনা পুলিশ নিয়ে ফের মাটির নীচের সব ঘর ঘুরে দেখার ইচ্ছে
প্রকাশ করতেই, থানার ওসি ব্যস্ত
হয়ে পড়লেন। তার আগে টিপুর কথা ওসির কাছে শুনে ওঁর সঙ্গেও কথা বলেছেন এস পি। টিপুও
সব কথা জানিয়েছে। কিভাবে এখানে তাঁরা এসেছিল, কিভাবে সুরঙ্গ আবিস্কার করেছিল, কিভাবে মৌ আর অর্ক ওই লোকগুলোর কাছে ধরা পড়েছে
– কোন কথাই গোপন করেনি সে। এস পি আরও টর্চের আলো নিয়ে ফের ঘরে ঢুকে তাজ্জব হয়ে
গেলেন। এই মাটির নীচের কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ঘরে যে দুস্কৃতিদের নিয়মিত যাতায়াত
ছিল, সেটা বুঝতে পারলেন। কারন
তাঁদের ব্যবহার করা বেশ কিছু জামা কাপড়, ব্যবহার করা জিনিষ, জুতো সেখানে রাখা
রয়েছে। এস পি ঘরের ভিতরে মজুদ করা জামা কাপড়ের দিকে টর্চের আলো ফেলে ভালো করে
দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর নজরে এলো, জামা কাপড়ের নীচে
কিছু একটা পাতলা মতো জিনিষ চকচক করছে। তিনি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে কাপড় সরাতেই দেখতে
পেলেন একটি ল্যাপটপ। ল্যাপটপটিকে হাতে তুলে আরও কিছু খোঁজার চেষ্টা করেও পেলেন না।
এক হাতে ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপটির সুইচ অন্ করতেই সেটি চালু হয়ে গেলো।
ল্যাপটপটির সঙ্গে চার্জারের তার লাগানোই রয়েছে। উৎসাহে এস পির চোখ চক্চক করে
উঠলো। আর কিছু ক্লু না পেয়ে ঘরের ভিতরে থাকা জামা-জুতোগুলিকে থানায় নিয়ে যাওয়ার
নির্দেশ ও সি কে দিইয়ে ল্যাপটপটি সঙ্গে করে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন এস পি।
গাড়িতে চেপে বসার আগে ও সি পরেশবাবুকে এখানে কয়েকজন পুলিশ দিন-রাত পোষ্টিং করার
নির্দেশ দিতে ভুললেন না। এস পি রওনা দিতেই টিপুদের সঙ্গে নিয়ে সমীরবাবুর বাড়ির
দিকে নিজেই জিপ চালিয়ে রওনা হলেন পরেশবাবু। পথে সমীরবাবুর মোবাইল ফোন বেজে উঠতেই, নম্বর দেখেই সমিরবাবু ভয়ে ভয়ে ও সিকে জানালেন,
‘স্যর, বাড়ি থেকে ফোন করেছে !’
‘ধরুন, ধরুন, কি বলছে বাড়ির লোক সেটা শুনে আমাকে জানান !’
সমীরবাবু ফোনে কথা বলেই
বললেন, ‘স্যর, ওঁরা টাকার অংক প্রচুর বাড়িয়ে দিয়েছে। ওত টাকা
কোন দিন চোখেই দেখিনি ! কিভাবে দেবো! ওঁরা যে আমাদের ছেলে আর মেয়েটাকে প্রানে
মেরে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে !’
‘টাকার অংক বাড়িয়েছে !
মানে ?’ ও সি পরেশবাবু জানতে
চাইলেন বেশ অবাক হয়েই।
‘মানে স্যর,’ সামান্য তোত্লালেন
সমীরবাবু, ‘এর আগেও ওরা ফোন
করেছিল। তখন দশ লক্ষ টাকা চেয়েছিল। টেনশনে আর জাল নোটের চক্করে আপনাকে বিরক্ত করতে
চাইনি বলে ভেবেছিলাম, পরে বলবো !
কিন্তু আবার ফোন করেছিল। এখন তো বিশ লক্ষ দাবি করছে স্যর !’
‘আপনি এস পি সাহেবকে জানালেন না ব্যাপারটা ! আমাকেও এখন বলছেন!! সত্যি,
আপনাদের লোকদের জন্যই
পুলিশ ঠিক মতো কাজ করতে পারে না! আগে জানলে যে কত উপকার হতো সেটা আপনাকে বোঝাবো
কি ভাবে!’ পরেশবাবু রেগে গিয়ে বললেন। এতসব ঘটনা ঘটে গিয়েছে, সঙ্গে থেকেও নিজেদের টেনশনে জানতেই পারেননি
টিপুর বাবা মেসোরা। এমনকি টিপুও একবার সমীরবাবুকে মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেখেছে।
কিন্তু জালনোটের ঘাঁটি আবিস্কারের উৎসাহে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি।
।। ৭ ।।
ঘুলঘুলি দিয়ে আলো দেখেই
অর্ক বুঝেছিল পাশের ঘরে লোক রয়েছে। এই ঘরের একপাশে মৌ হাত বাঁধা অবস্থায় বসে
রয়েছে। অর্কের হাত পিছন মুড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েছে হরিয়া নামের লোকটি। বাইরে যে
অন্ধকার হয়ে গিয়েছে, অর্ক সেটা আন্দাজ
করতে পেরেছে। এতক্ষনে অর্ক, মৌ ওঁদের যাঁরা
বন্দি করে রেখেছে, সেই তিনজনের নাম
জেনে গিয়েছে। মৌকে যে ঘরের ভিতরে ধরেছিল, তাঁর নাম হারুন। টিপুর পিছনে ঢিবির উপরে উঠে যে ধাওয়া করতে গিয়েও ধরতে পারেনি,
তাঁকে দুলাল নামে ডাকতে
শুনেছে অন্যজনের নাম সুলতান।
দুপুরে ওই সুরঙ্গ থেকে
দড়ির মই বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করেও পারেনি অর্ক। সুলতান তাঁর ডান হাত চেপে ধরে
টেনে ওই কৃত্রিম ঘরের ভিতরে টেনে নিয়ে বন্দি করেছিল। তখন দুলালকে উদ্দেশ্যে বলেছিল,
‘ওই ব্যাটা পালিয়ে গেলো।
এটাকে ধরতে পারলাম। ছেলে মেয়ে দুটোকে বেঁধে রাখ।’ দুজনকে বেঁধে রেখে অন্যদিকে গিয়ে
দুলাল টেলিফোনে কোন কথা বলে ফিরে এসে হারুনকে জানিয়েছে, ‘বস্কে সব ঘটনা ফোন করে জানিয়েছি। বস্ বলেছে,
দুজনকেই ডেরায় নিয়ে
যেতে।’
হারুন বললো, ‘পাশের আম বাগানের পিছনের জঙ্গলে গাড়ি রাখা আছে।
আমাদের বেশি সময় এখানে নষ্ট করা ঠিক হবেনা। আমাদের এখুনি বেরিয়ে যাওয়া উচিত।’
ততক্ষনে দুলাল ফিরে
এসেছে। টিপুকে যে সে ধরতে পারেনি, সেটা নিয়ে আফসোস
করছিল। তিনজন তাড়াতাড়ি ওঁদের কাপড় জামা দিয়ে অর্ক আর মৌ এর চোখ আর মুখ বেঁধে দিল।
সুলতান বাকি দুজনকে নির্দেশ দিল, ‘এখানে বাইরের
দরজা বন্ধ করে দড়ির মই দিয়ে উপরে উঠে মই তুলে নেবো। আর গর্তের মুখ ফের মাটি চাপা
দিয়ে চলে যাবো।’
প্রথমে ওঁদের কেউ একজন
মৌকে কাঁধে তুলে নিয়েছিল। অর্কর চোখ বাঁধা থাকায় দেখতে পারছিল না। মৌ এর গলার
চিৎকারে আন্দাজ করেছিল। মৌ অস্পষ্টভাবে বলছিল, ‘আমাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দাও। আমার ব্যাথা
লাগছে।’ এরপরেই হারুনের ধমক শুনেছিল অর্ক।
‘এই মেয়ে চুপ কর। বেশি জোরে কথা বললে কিন্তু আরও শক্ত করে মুখ বেঁধে দেবো,’
গলাটা যে দুলালের ছিল,
সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিল
অর্ক। এরপরে অর্ককে ধরে কেউ শুন্যে তুলে নিলেও সে কোন কথা বলেনি। সে টের পেয়েছিল,
দড়ির মই দিয়ে তাঁকে নিয়ে
উপরে উঠছে সুলতান। হারুন দড়ি দিইয়ে উঠতে উঠতে বললো, ‘গাড়িটা সামনের দিকে নিয়ে এসেছিস তো !’
গাড়ি চালিয়ে ওঁদেরকে
দূরের কোথাও নিয়ে এসেছে ওঁরা তিনজন। অনেকক্ষন গাড়ি চলার পরে ওঁদের নামিয়ে হাঁটিয়ে
একটা বাড়ির ভিতরের ঘরে নিয়ে এলো সুলতান আর দুলাল। সুলতান আর দুলালই ওঁদের চোখ,
মুখের বাঁধন খুলে দেয়।
হারুন তখনই এসে খবর দিল, ‘বস্ এসেছে !’
অর্ক দেখলো, চেক লুঙ্গি পরে মোটা কালো চেহারার একজন এসে ঘরে
ঢুকেছে। অর্কের দিকে তাকিয়ে কালো চেহারা নির্দেশ দিলো, ‘তোদের বাড়িতে কি ফোন আছে? থাকলে ফোন নম্বর বল্!’ বিকট চেহারার সঙ্গে
কর্কশ গলার স্বর শুনে ঘাবড়ে গিয়ে অর্ক বাড়ির ল্যান্ড নম্বরটা বলে দিল।
ফোন নম্বরটা লিখে নিয়ে
‘বস্’ বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিন সাকরেদকে বলো, ‘এদের আটকে রাখ। খেতে দিস। এঁদের নিয়ে অন্য
প্ল্যান মাথায় এসেছে। দেখিস যেন কোনভাবে পালাতে না পারে !’ ওদেরকে ঘরের ভিতরে
বসিয়ে রেখে চারজনই বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজা বন্ধ করে দিল। আবার ঘর বন্দি হয়ে
পড়লো মৌ আর অর্ক। এবার আবার অচেনা আজানা নতুন জায়গাতে। ঘরের ভিতরে এক কোনে একটা
মোটা কাঠের ডান্ডা রয়েছে। শেটা নজর এড়ায়নি অর্কের।
এই ঘরের ভিতরে যে
ইলেক্ট্রিকের আলো টিমটিম করে জ্বলছিল, সেটাও ওঁরা চলে যাওয়ার পরে নিবে গেলো। ওঁরাই নিবিয়ে দিল। দরজাও বাইরে থেকে
বন্ধ। শুধু ঘুলঘুলি দিয়ে পাশের ঘরের যেটুকু আলো আসছিল, তাতে মৌ – অর্ক নিজেদেরকে ছায়ার মতো দেখতে
পাচ্ছে শুধু।...