বিজ্ঞান । মাঘ ১৪৩১

  পাখিদের জি পি এস











অরূপ

বন্দ্যোপাধ্যায়

দিল্লি, এন সি আর 



 

অঙ্ক পরীক্ষার খাতায় নম্বর দেখে বুটুনের মন খারাপ। টায়েটুয়ে পাশ। জীবনে এমন খারাপ একটা দিন কেন যে আসে, ভাবে বুটুন। অন্য বিষয়গুলোতে অনেক অনেক নম্বর আসে তার, শুধু অঙ্কের বেলায় কম।

বুটুনদের অঙ্কের ম্যাম খুব কড়া ধাঁচের বুটুনের হাতে খাতা ধরিয়ে দিয়ে চোখ পাকিয়ে শাসিয়েছেনটার্ম পরীক্ষা বলেই তিনি নাকি একটু হাত খুলে নম্বর দিয়েছেন, তাই বুটুন পাশ করে গিয়েছে কিন্তু ফাইনালে তার কপালে নাকি অনেক দুঃখ আছে মনের দুঃখে বিকেলে আর খেলতে যায়নি বুটুন ভাঙা মন নিয়ে সে বাড়ির ছাদে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে

বুটুনদের বাড়িতে অনেক ফুলের গাছ সেখানে একটা ছোট্ট পাখি মেরিগোল্ড ফুলের গাছ থেকে ফুরুত করে উড়ে গিয়ে বসল ছাদের কার্নিশে সেখান থেকে আকাশে উড়ে গেল বিকেল বেলায় পাখিরা ঘরে ফিরছে ঘর বলতে বুটুনদের বাড়ি থেকে দুশো মিটার দূরের একটা বিরাট বটগাছ সেই গাছের ঝাঁকড়া মাথাটা তাদের বাড়ি থেকে দিব্যি দেখা যায় গাছের চারদিকে উড়ে উড়ে বেড়ায় কত নাম না জানা পাখি! শুধু যে দেখা যায় তাই নয়, পাখিদের কিচিরমিচির শব্দও শোনা যায় একটানা ইয়াব্বড় গাছটা প্রায় পাঁচ-ছয় তলা বাড়ির সমান ছোট্ট পাখিটা যে কোন দিকে উড়ে গেল! বড় অদ্ভুত তার গলার রঙ আগে কোনোদিন বুটুন এমন পাখি তাদের বাড়ির ছাদে দেখেনি বুটুন পাখিটাকে অনেক খোঁজার চেষ্টা করেও দেখতে পেল না সে ভাবল, হয়ত বা আমগাছের কোনও অন্ধকার হয়ে আসা ডালে লুকিয়ে পড়েছে পাখিটা

আকাশ দেখতে দেখতে বুটুনের চোখ পড়ল একঝাঁক উড়ে চলা বকের দিকে ঠিক বক নয়, একটু অন্যরকম একটা ঝাঁক চলে যেতে পরপর আরও তিনটে ঝাঁক সেদিকেই উড়ে গেল পাখিদের ধপধপে সাদা ডানায় অস্তগামী সূর্যের লাল হলুদ রঙ মিশে যাচ্ছে ওরা উড়ে চলেছে অনেক উঁচু দিয়ে বট গাছের মাথায় যেসব পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, তাদের চাইতে ওরা আলাদা

পাখিদের চলাচল দেখতে দেখতে বুটুন অঙ্ক পরীক্ষার খাতার কথা ভুলে যায় সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে দেখে, বসার ঘরে বাবা বসে আছে সোফায় বাবাকে দেখেই অঙ্কের খাতার কথা মনে পড়ে যায় বুটুনের এখন পাখিরা হারিয়ে যায় তার মন থেকে

আজ খেলতে যাওয়া হয়নি বুটুন?”, বাবা প্রশ্ন করেন

নামানে ভালো লাগছিল না

হুম, বসো এখানে এখন শীত পড়ছে, বিকেলের দিকে ছাদে গিয়ে ঠাণ্ডা না লাগানোই ভালো তা কেমন চলছে পড়াশুনো?”

এখুনি এই বিচ্ছিরি প্রসঙ্গ না তুললেই যেন চলছিল না পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে অবশ্য বুটুনের বাবা কোনোদিন বকাবকি করেন না মায়ের শুধু মুখটা একটু ভার হয় আজ তিনি চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে এসে বাবার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলেন, “বুটুনের ক্লাস টিচার দীপিকা ম্যাম ফোন করেছিল বলল, সব সাবজেক্টে ভালো করলেও অঙ্কে নাকি কোনোরকমে পাশ করেছে বুটুন

বুটুনের বাবা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, “ঠিক আছে একটা বিষয় ম্যানেজ করতে হবে তো? হয়ে যাবে

প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বুটুন বাবাকে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা বাবা, আকাশে অনেক দূরে পাখিরা কোথায় উড়ে যায়?”

কত উঁচু দিয়ে উড়ে যায়, তার উপর নির্ভর করে নিচ দিয়ে যারা যায়, তারা কাছাকাছি বাসায় ফেরে, আর অনেক উপর দিয়ে যারা ওড়ে তারা হল পরিযায়ী পাখি বহুদূর থেকে তারা উড়ে আসে আমাদের দেশে

পরিযায়ী পাখিদের ইংরেজিতে মাইগ্রেটরি বার্ড বলে, তাই তো?”

বুটুনের বাবা ঘাড় নেড়ে বলেন, “হ্যাঁ তাই আমাদের এখানে এখন শীতের সময় আগত যেসব পাখিরা এখানে উড়ে আসে, তারা হলসাইবেরিয়ান ক্রেন, ফ্লেমিংগো, পেলিকানএইসব” 

ওরা প্রতি বছর অন্য দেশ থেকে পথ চিনে উড়ে আসে কী করে?”

বুটুনের বাবা চায়ের কাপ হাত থেকে নামিয়ে রেখে বলেন, “এইটা হল আসল প্রশ্ন মনে হতে পারে যেন ওদের মাথায় কোনও জিপিএস লাগানো আছে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয় এই পরিযায়ী পাখিরা যেমন, সাইবেরিয়া থেকে যে ক্রেনরা শীতের সময়ে উড়ে আসে, তারা প্রায় ৪০০০ মাইল পাড়ি দেয় বেশীরভাগ পরিযায়ী প্রাণী একনাগাড়ে তিরিশ ঘণ্টা উড়তে পারে এতদূর থেকে রাস্তা চিনে কী করেই বা সঠিক জায়গায় পৌঁছয় এই পাখিরা, তা সত্যিই বিস্ময়কর আর ওদের পরিযায়ী হওয়াও কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে

আমাদের গাড়িতে ড্যাসবোর্ডে জিপিএস লাগানো আছে তুমি দেখেছ গাড়িতে কোনও অজানা রাস্তা দিয়ে কোথাও যেতে হলে যেমন আমরা জিপিএস ব্যবহার করে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাই, পাখিদের শরীরেও জিপিএসের মত ব্যবস্থা আছে, যার ফলে দিক খুঁজে নিতে তাদের কোনও অসুবিধা হয় না তবে এখন যা বললাম, খুব সহজে কিন্তু বিজ্ঞানীরা পাখিদের শরীরের এই জিপিএসের হদিস খুঁজে পাননি অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তবেই জানা গিয়েছে এখনো যদিও অনেক সংশয় আছে এই নিয়ে

আমাদের দেশে পাখিরা কোথা থেকে উড়ে আসে বাবা?”

প্রধানত ওরা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা জায়গা থেকে উড়ে আসে আমাদের দেশে শীতের সময় যতই আমরা কাঁপতে থাকি না কেন, এই তাপমাত্রা পরিযায়ী পাখিদের কাছে খুব সামান্য যেমন শীতের সময়ে সাইবেরিয়াতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ে সব জল জমে বরফ হয়ে যায় তাপমাত্রা শূন্যের অনেক নিচে চলে যাওয়ায় সেখানে তারা জল কোথায় পাবে? তাই তারা উড়ে আসে আমাদের দেশে প্রতি বছরেই আসে আবার আমাদের দেশে গরম পড়তে শুরু করলেই পরিযায়ী পাখিরা ফিরে যায় তাদের দেশে অনেকটা বড়দিনের ছুটিতে যেমন আমরা সবাই বেড়াতে যাই, তেমন পাখিরাও বেড়াতে যায় তবে তফাত একটা আছে কী সেটা? পৃথিবীর যেখানে তাপমাত্রা অনেক কম, সেখানে গরমের সময়ে পাখিরা ডিম পাড়ে, ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে পাখিদের বাবা-মা ওদের যত্ন করে বড় করে তোলে সেখানে চারদিক বরফে ঢেকে যাবার আগেই পরিযায়ী পাখিরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে অন্য দেশে পাড়ি দেয়, যেখানে তুলনায় ঠাণ্ডা অনেক কম যেই আমাদের মতো দেশে গরম পড়তে শুরু করে, ওমনি পাখিরা বাচ্চাদের নিয়ে আবার ফিরে যায় ঠাণ্ডা দেশে

তাহলে ওরা রাস্তা চেনে কেমন করে? ওদের তো আর জিপিএস- লাগানো নেই শরীরে!”, বিস্মিত হয় বুটুন

কে বলল নেই? অবশ্যই আছে আমাদের গাড়ির মতো সেখানে ইলেকট্রনিক ডিভাইস নেই, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না তবে আগে জিপিএস-এর ব্যাপারটা একটু বুঝে নিতে হবে জিপিএস মানে হচ্ছেগ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম উপগ্রহের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের সাহায্যে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমরা কোথায় আছি তা জানতে পারি আর যে জায়গায় যেতে চাই, তার অবস্থান জেনে সেই দিকে এগোতে পারি

দিক নির্ণয় করতে লাগে কম্পাস পৃথিবীর একটা চুম্বক ক্ষেত্র আছে তুমি বিজ্ঞান বইতে পড়েছ একদিকে আছে উত্তর মেরু, আর একদিকে আছে দক্ষিণ কম্পাস ব্যবাহার করে দিক খুঁজে নিয়ে নাবিকেরা জলে জাহাজ চালাত সে প্রায় হাজার বছর আগের আবিষ্কার তারপর বিজ্ঞান অনেক উন্নত হল মাথা খাটিয়ে, কম্পাস দেখে, অঙ্ক কষে আর দিক নির্ণয় করার প্রয়োজন রইল না ইলেকট্রনিক যন্ত্রের সাহায্যে খুব সহজেই দিক নির্ণয় করা সহজ হল

এবার আসি পাখিদের কথায় ওরাও স্বাভাবিক নিয়মে অঙ্ক না কষেও পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্র টের পায়, বুঝে নিতে পারে দিক ওদের সহজাত প্রবৃত্তি এটা ঠিক যেভাবে এয়ারোপ্লেন ওঠে আকাশে, দিক খুঁজে নিয়ে উড়ে যায়, তারপর মাটিতে নেমে আসে সঠিক জায়গায়, ঠিক তেমনি ভাবে পাখিরাও পৃথিবীর চুম্বক্ষেত্রের দিক বুঝে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যায়

সহজ প্রশ্ন করে বুটুন, “ওদের জিপিএস তাহলে কোথায় লাগানো থাকে?”

খুব সম্ভবত ঠোঁট আছে জিপিএস চোখে আছে কম্পাস এই দুটো জায়গায় প্রাণী বিশেষজ্ঞরা কিছু চুম্বক ক্ষেত্র অনুধাবন করার মতো চুম্বকধর্মী অণু (যেমন ম্যাগনেটাইট) খুঁজে পেয়েছেন, যাদের সাহায্যে পাখিরা সঠিক দিক বুঝে নেয় চোখের সাহায্যে অবশ্যই এই সব পাখিরা কিছু পরিচিত জায়গা চিহ্নিত করে নেয় পাখিদের চোখ মানুষের চোখের চাইতে প্রায় আটগুণ শক্তিশালী পরিযায়ী পখিরাও বড় কোনও গাছ, বাড়ি বা টিলা তাদের মাথায় চিহ্নিত করে রেখে দিতে পারে তবে শুধু যে পরিযায়ী পাখিরাই পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্র বুঝে নেবার ক্ষমতা রাখে তা কিন্তু নয় সাধারণ পাখি, যেমন পায়রা বা চড়াইরাও নিজেদের বাসা খুঁজে নেয় এই দিক নির্ণয় করার বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হবার জন্য

চোখ বড়বড় করে বুটুন বলে, “আগে তো পায়রারা চিঠিপত্র নিয়ে উড়ে গিয়ে পৌঁছে দিত লোকের হাতে আমি বইতে পড়েছি তাহলে ওদের জিপিএস বেশ শক্তিশালী বলতে হবে!”

বাবা সায় দিয়ে বলেন, “অবশ্যই শক্তিশালী সেইজন্য পোষা পায়রারা সারাদিন পর ঠিক বাসায় ফিরে আসে চিঠি পৌঁছে দেবার দায়িত্বটা তারা ভালই পালন করতে পারত দিক ভুল না করেই

বুটুন প্রশ্ন করে, “পাখিদের বাচ্চারা হারিয়ে যায় না এই চলাচলের সময়ে?”

বুটুনের বাবা হেসে ফেলে বলেন, “বাচ্চাদের নিয়ে ভয় তো থাকেই সবার, সে পাখিই হোক কী মানুষ! এই যেমন সকালে মা তোমাকে বাসে তুলে দিয়ে আসেন যাতে তুমি হারিয়ে না যাও কিন্তু যেই তুমি আর একটু বড় হবে, একা একাই স্কুল বাসে উঠে যাবে, তখন মায়ের দরকার হবে না ঠাণ্ডার দেশ থেকে বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে আসার সময়ে পাখিরা তাদের ট্রেনিং দেয়, কী করে পথ চিনতে হবে, কী করেই বা বাঁচাতে হবে নিজেকে বিপদ থেকে ফেরার সময়ে দেখা যায়, বাচ্চারা একটু আলাদা হয়ে বাবা মায়ের সাথে ফিরে যায় মানে তখন তারা বেশ বড় হয়ে গিয়েছে

কিন্তু বাবা, আকাশের অত উঁচুতে কী বিপদ হতে পারে?”

ঈগল পাখি ছোঁ মেরে ওদের ধরে খেয়ে নিতে পারে, বা মাটি থেকে উড়ে আসা একটা এয়ারপ্লেনের সাথে ধাক্কা খেতে পারে খিদে আর জলতেষ্টা পেলে বা উড়তে উড়তে হাঁপিয়ে গেলে মাটিতে নেমে আসতে হয় পাখিদের মাটিতে বা জলাশয়ে অনেক শিকারি ওদের মেরে খেয়ে ফেলতে পারে…”

তাই কি ওরা দল বেঁধে থাকে বাবা?”

একদম তাই, দল মানেই একতা সুখে বা বিপদে একসাথে থাকাই মঙ্গল একজন পাখি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, গোটা দলটাই তখন মাটিতে উপযুক্ত জায়গা দেখে নেমে পড়ে

বুটুনের মনে প্রশ্নেরা ভিড় করে, “আমাদের শরীরে যদি জিপিএস লাগানো থাকত, কী মজাই না হত, বলো বাবা!”

এখন হয়ত আমরা সেই ক্ষমতা হারিয়েছিকিন্তু বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, লক্ষ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা থেকে রওনা দিয়ে মানুষ ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীতে খাবার আর জলের সন্ধানে যখন এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় তারা যাতায়াত করত তখন স্বাভাবিক ছিল আকাশের তারা আর পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্র বুঝে নিয়ে রাস্তা পাড়ি দেওয়া যত প্রকৃতি থেকে মানুষ বিছিন্ন হয়েছে, তত তার সহজাত অনুভূতি হারিয়ে গিয়েছে

আচ্ছা এবার অনেক গল্প হল এবার আমাকে একটু বিশ্রাম নিতে হবে একদিন নাহয় আমরা কোনও পাখিরালয়ে বেড়াতে গিয়ে দেখে আসব পরিযায়ী পাখিদের যদি অঙ্কে ভালো রেজাল্ট হয়, তবে তো ফাইনাল পরীক্ষার পরেই যাওয়া যেতে পারে

পাখিদের খুব কাছ থেকে দেখার আশায় বুটুন ভাবে, আজ অঙ্কের সব হোম ওয়ার্ক এখুনি বসে করে নিতে হবে পাখিরা যদি রাস্তা চিনে যাতায়াত করতে পারে এক দেশ থেকে আর এক দেশে, তবে বুটুনের পক্ষে অঙ্কে ভালো রেজাল্ট করা কোনও ব্যাপারই না


 

আরও পড়ুন  -





 

আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো

 


 




 

ইনডাকশন কুকারের কেরামতি

 











 







 

খাবারের গায়ে কেন টক টক গন্ধ

 



জল শুধু জল



ফ্রাই, কিন্তু ড্রাই নয়



যার নুন খাই, তার গুণ গাই



কুসুমে কুসুমে  


 

<
সূ চি প ত্র