সে বহুকাল আগের কথা। মিজোরামের পাহাড় ঘেঁষে এক গাঁ, তার মোড়লের নাম রালেকা। মোড়লের ছেলে সেনেরইয়া খুব সাহসী বীর। কিন্তু জুমচাষে তার মন বসে না, ছেলেবেলা থেকেই বনজঙ্গল আর শিকারে উৎসাহ বেশি। সে দক্ষ তিরন্দাজ, অনায়াসে লক্ষ্যভেদে পারদর্শী।
এক শীতের সকালে টাক্কাল আর তির-ধনুক নিয়ে বনে গেল সেনেরইয়া। ওঁত পেতে রইল শিকারের জন্যে। চেষ্টা করে বিশাল আকৃতির এক বুনো শুয়োর মেরেও ফেলল একসময়, টেনে নিয়ে এল গাঁয়ে। সেদিন গাঁয়ে মহা ভোজ হল। সবাই জানে, সেনেরইয়া শিকারে গেলে খালি হাতে ফেরে না। আশেপাশের গাঁয়েও তার শিকারের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে ততদিনে।
সেনেরইয়ার বাপ-মায়ের বয়স হয়েছে। তারা চায় ছেলে এবার বিয়ে-থা করে সংসারী হোক। সেনেরইয়া তাতে রাজি নয়। শেষে অনেক কাকুতিমিনতির পর সে নিমরাজি হয়। তবে শর্ত একটাই, পাত্রী সে নিজে দেখে পছন্দ করবে।
ওদিকে পড়শি গাঁয়ের মোড়ল জিয়ালুঙ্গার অসামান্যা রূপসী এক মেয়ে আছে, নাম জলখিপরি। তার যেমন রূপ, তেমনি গুণ। সেলাই বলো রে, বোনাই বলো রে, নাচ বলো রে, গান বলো রে—সবেতেই সমান পারদর্শী সে।
সেই গাঁয়ের এক অনুষ্ঠানে জলখিপরিকে দেখে পছন্দ হয় সেনেরইয়ার। বাপ-মাকে এসে জানায়, সে পাত্রী স্থির করে ফেলেছে। রালেকাও মেয়ের পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত আহ্লাদিত হয়ে জিয়ালুঙ্গার কাছে প্রস্তাব পাঠাল। কিন্তু পুরোনো শত্রুতার জেরে জিয়ালুঙ্গা পত্রপাঠ সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল।
সেনেরইয়া তাতে মনঃক্ষুণ্ণ হলেও উৎসাহ হারাল না। সে এবার নিজেই প্রস্তাব নিয়ে গিয়ে হাজির হল জিয়ালুঙ্গার কাছে। জিয়ালুঙ্গা এইবারে অমন বীর জোয়ানের মুখের ওপর না বলতে পারল না। তবে শর্ত রাখল। কী শর্ত? না, তাকে একটি লাল ঘণ্টা এনে দিতে হবে।
সেনেরইয়া জানতে চায়—“কেমন লাল ঘণ্টা?”
জিয়ালুঙ্গা ব্যাখ্যা করল—“তুইবুয়ান নদী তো চেনো। নদীর পাড়ে থিচুই নামে এক বুড়ি থাকে। তার কাছেই আছে সেই ঘণ্টা। এটি আমার চাই। এনে দিতে পারলে তবেই জলখিপরিকে বিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।”
সেনেরইয়া পরদিনই বাপ-মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গাঁ ছেড়ে। বেশ ক’দিন হেঁটে গিয়ে পৌঁছল তুইবুয়ান নদীর পাড়ে। খুঁজে বের করল বৃদ্ধাকে। তারপর খুলে বলল সব। বৃদ্ধা এই অচেনা ছেলেটির আচার-ব্যবহারে অত্যন্ত মুগ্ধ হল। লাল ঘণ্টাটি সেনেরইয়াকে দিতে রাজি হল সে। তবে বৃদ্ধাও শর্ত রাখল—“প্রতিদিন এক বুনো শুয়োর এসে আমার ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে যায়। তুমি বাবা সেটিকে জব্দ করতে পারো যদি তবেই ঘণ্টাটি দিতে পারি আমি।”
সেনেরইয়া আর কী করে? শর্তে রাজি হওয়া ছাড়া উপায় তো আর নেই কিছু। সে বৃদ্ধার জুমে গিয়ে ফাঁদ পেতে এল। তারপর পাশের ঝোপের আড়ালে মাচা বেঁধে তাতেই রাতে শোওয়ার তোড়জোড় করল।
গভীর রাতে জুম থেকে বুনো শুয়োরের প্রবল গোঙানির শব্দ ভেসে এল। সেনেরইয়া দৌড়ে গিয়ে দেখে মস্ত এক শুয়োর ফাঁদে পড়েছে। তাকে দেখেই তেড়ে এল সেই দুশমন। তবে শক্ত ফাঁদ ভেদ করতে পারল না। সেনেরইয়া অনেক ধ্বস্তাধ্বস্তির পর একটা কান কেটে ফেলতে সক্ষম হল শুয়োরটির। তারপর দৌড়ে চলল বৃদ্ধার টংঘরের দিকে খবর দিতে।
ওদিকে আটকা পড়া শুয়োর কান্না জুড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। সেই শুনে তাদের দলনেতা এসে হাজির হয়ে দেখে দলের সবচাইতে বড়ো শুয়োরটাই ধরা পড়েছে ফাঁদে। সে ভেবে দেখল, অমন শক্তিশালী সদস্য হারালে তো দলের মহাবিপদ। তাড়াতাড়ি করল কী, ছোট্ট এক ছানাকে ফাঁদে রেখে দিয়ে বড়ো শুয়োরটিকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল সে।
পরদিন দিনের আলো ফুটলে বৃদ্ধা আর সেনেরইয়া এসে হাজির হল জুমে। ফাঁদে পড়া ছোট্ট এক শূকরছানা দেখে তো বৃদ্ধা রেগে কাঁই। সেনেরইয়াও ভীষণ অবাক। তাকে একচোট গালমন্দ করে ফিরে গেল বৃদ্ধা।
সেনেরইয়া জুমেই দাঁড়িয়ে রইল গুম হয়ে। রহস্যটা পরিষ্কার হচ্ছে না। রাতে ফাঁদে পড়ল দত্যির মতো এক শুয়োর আর সকাল হতেই সে হয়ে গেল ছোট্ট এক ছানা! এ কেমন রহস্য? মনে মনে একটা ফন্দি আঁটল সেনেরইয়া। ছানাটাকে ছেড়ে দিল সে। ছাড়া পেয়েই ছানা দিল দৌড়। সেনেরইয়াও পিছু নিল তার।
বনজঙ্গল ভেঙে একসময় নিজের ডেরায় গিয়ে ঢুকল ছানাটি। তাকে দেখে বাকি সব শুয়োরেরাও বেরিয়ে এল চারদিক থেকে। সেনেরইয়াকে দেখে তো সবাই তাজ্জব। শূকর দলনেতা সামনে এসে দাঁড়াল তার। সেনেরইয়া বীর দর্পে হুকুম দিল—“যে বড়ো শুয়োরটি আমার ফাঁদে পড়েছিল, তাকে বের করে দাও।”
শূকর দলনেতা না বোঝার ভান করে সওয়াল করল, “বড়ো শুয়োর মানে? এই তো ছানাটার পিছু ধাওয়া করে এলে তুমি। বড়ো শুয়োর আবার পেলে কোথা?”
সেনেরইয়া সময় নষ্ট করে না। সোজা বলে, “বেশ, তোমার দলের সবাইকে সামনে এসে সার দিয়ে দাঁড়াতে বলো তবে। আমার ধরা শুয়োর আমি ঠিক চিনে নেব। তার একটা কান কেটে রেখেছি আমি।”
শূকর দলনেতাও তর্ক জুড়ে। সে কিছুতেই দলের সবাইকে একত্রে হাজির করবে না। এমনি সময় কথা কাটাকাটি শুনে কোত্থেকে এসে হাজির হল সেই কানকাটা শুয়োর। ব্যস, দলনেতার মুখ চুন। অগত্যা সেটিকে তুলে দিতে বাধ্য হল সেনেরইয়ার হাতে। সেনেরইয়াও শুয়োরটিকে নিয়ে বৃদ্ধার কাছে ফিরে গেল। বৃদ্ধা অত্যন্ত খুশি হয়ে লাল ঘণ্টাটি সঁপে দিল তার হাতে।
সেনেরইয়াও কাল বিলম্ব না করে ছোটে নিজের গাঁয়ের পথে। গাঁয়ের কাছাকাছি পৌঁছেই ঘণ্টাটি বাজাতে শুরু করে সে। সেই শব্দে যে যেখানে ছিল দৌড়ে আসতে লাগল তাকে অভ্যর্থনা জানাবে বলে। সেনেরইয়ারও তর সইছে না আর—কতক্ষণে সে ঘণ্টাটি তুলে দেবে জিয়ালুঙ্গার হাতে। নিজের গাঁ পেরিয়ে দ্বিগুণ বেগে সে ছুটে চলল হবু শ্বশুরবাড়ির পথে।
ঠিক তক্ষুনি ঘটে গেল এক বিপদ। খানিক আগেই একপশলা বৃষ্টি হওয়াতে পা পিছলে সেনেরইয়া পড়ে গেল পাহাড়ের নীচে। ঘণ্টাটি লাফিয়ে গিয়ে পড়ল এক ছড়ায়। সেনেরইয়াও চোখের পলকে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। তারপর গভীরে ডুব দিয়ে ঘণ্টা খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে হাজির হল নাগরাজ্যে। সেখানে নাগেদের রাজার বাস। সেনেরইয়াদেরই গোত্রপতি সে। নাগরাজ ঘণ্টা খুঁজে এনে তুলে দিল সেনেরইয়ার হাতে। তারপর সঙ্গে করে নিয়ে চলল জিয়ালুঙ্গার কাছে।
জিয়ালুঙ্গা তো লাল ঘণ্টা হাতে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। সঙ্গে সঙ্গে দিনক্ষণ স্থির করে ফেলল মেয়ের বিয়ের। তারপর মহা ধুমধাম করে একদিন বিয়ে হয়ে গেল সেনেরইয়া আর জলখিপরির।
পাহাড়ের যেখান থেকে ঘণ্টাটি পড়ে গিয়েছিল, সেই জায়গাটার নাম হল ডারলন থালং। সেখানকার অধিবাসীরা পরিচিত হল ডারলন নামে। এই-ই বর্তমানের এক শ্রেণির আদিবাসীদের ডার্লং উপাধির উৎপত্তি।
(ত্রিপুরদেশের লোককাহিনি)