গল্প - ১ । অগ্রহায়ণ ১৪৩১





   ভ্রমণ বিভ্রাট  











সমিত রায় চৌধুরী

আগরতলা, ত্রিপুরা




 

অশোক ও যতীন লাগেজ নিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। রাত দশটা বাজে। আটটায় ট্রেন আসার কথা ছিল। ট্রেন লেট। কাল ভোরে কলকাতায় পৌঁছে দু’জনেরই অফিস যাওয়ার কথা।

যতীন ছটফট করতে-করতে বলল "দেখলি আমাদের দুর্ভাগ্যটা। ট্রেন এখনো এলো না। কাল কিভাবে যে অফিস করবো। লজঝড়ে জিপে বসে সারা শরীরে ব্যথা করছে।"

অশোক লাগেজগুলোকে নিয়ে একটা বেঞ্চে বসলো। আর যতীন প্লাটফর্মের এই মাথা থেকে ওই মাথা হাঁটছে। আজ বিকেল বেলায় ওরা দুই বন্ধু গ্যাংটক ভ্রমণ সেরে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ফিরেছে। দুই বন্ধু প্রায়ই তিন চার দিন ছুটি পেলে এমন ছোটখাট ভ্রমণ সেরে নেয়। এই যাত্রাটা তাদের মোটেই ভাল ছিল না। সিকিমে প্রচন্ড বৃষ্টি। রাস্তায় ধস। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। ভোর সকালে গ্যাংটক থেকে রওনা হয়েছিল। পাহাড় লাইনে ধস পড়ে অনেকটা দেরি হয়ে গেল স্টেশনে পৌঁছাতে। এখন তাদের আর শরীর দিচ্ছে না।

যতীন অশোকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, "ভাই ট্রেনে চেপেই আমি ঘুমিয়ে পড়বো। আমি খুব ক্লান্ত। এরমধ্যে দেহে ফুয়েলও নেই।"

আজ তাদের খাওয়া-দাওয়াও ভালো হয়নি। অশোক এমনিতে ধীর-স্থির ছেলে। যতীনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, "কি আর করবি। একটু ধৈর্য ধর। আমাদের ট্রেনটা তো ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে। এক্ষুনি চলে আসবে।"

তখনই তাদের নির্ধারিত ট্রেনটির ঘোষণা মাইকে শোনা গেল। ট্রেনটা থামার আগেই তাদের নির্ধারিত কামরাটির আন্দাজ করে দুই বন্ধু প্লাটফর্মের একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল।

অশোক যতীনকে বলল, "তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। ট্রেন কিন্তু এখানে মাত্র পাঁচ মিনিট দাঁড়াবে।"

একদম দু'ঘণ্টা দশ মিনিট লেট করে ট্রেনটি এসে দাঁড়াল প্লাটফর্মে। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে দেখতে পেল তাদের বি-ওয়ান কামরাটা অনেক দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যতীনের সেদিকে লক্ষই নেই। সে ছোটাছুটি শুরু করল।

অশোক যতীনকে বলল, "এই! এদিকে আমার সাথে আয়।" এদিকে যতীনের ট্রলি ব্যাগের হ্যান্ডেল গেল ভেঙে। যতীন রাগে গজগজ করতে করতে বলল, "ধুস আজ আমার ভাগ্যটাই খারাপ। সবকিছু যেন আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে রে।" বলতে-বলতে লাগেজটাকে বগলদাবা করে অশোকের পেছনে পেছনে ছুটলো যতীন

হাঁফাতে-হাঁফাতে দুজনে গিয়ে বি-ওয়ান এর দরজায় লাগেজগুলো রাখল। যাত্রী ওঠা-নামার মধ্যে ঠেসে-ঠুসে কোনওরকমে ট্রেনে উঠল দুজন। স্লিপার ক্লাসে তাদের রিজার্ভ করা টিকিট। অশোক উপরের বার্থে। এই একই সীটে যতীনের হচ্ছে নিচের বার্থটা। অশোক হিসেব কষে দেখল এখানে তাদের দুজনের ছাড়া আরেকজন যাত্রীর থাকার কথা। কিন্তু এখানে বসে আছেন দুজন। ওরা স্বামী-স্ত্রী হবে। বয়স্ক হবেন দুজনেই। ওরা মনে হয় আগের স্টেশন থেকে ট্রেনে আছেন। স্ত্রীর মুখটা ঘোমটা দিয়ে ঢাকা। স্বামীর বয়স পঞ্চাশোর্ধ হবে।  দেখতে বেশ নাদুস - নুদুস আরামপ্রিয় লোক লাগছেমোটাসোটা ভদ্রলোকটি লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে জানলার ধারের সীটে দিব্যি পা তুলে বসে আছেন।

অশোক বেশ ভদ্রভাবে বলল, "আমাদের দুজনের সীট আছে এখানে।"

সঙ্গে-সঙ্গেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন, "বসুন বসুন। আমার সীটটা মাঝের বার্থেউনি হচ্ছেন আমার স্ত্রী। একটা জরুরী কাজে কলকাতা যাচ্ছি। স্ত্রীর টিকিটটা করতে পারেনি বুঝলেন।"

 অশোক বলল, "ওমা! তাহলে যাবেন কিভাবে টিটি আসবেন তো।"

 ভদ্রলোক একটা হাসি দিয়ে বলল "সে দেখা যাবে। বিপদে পড়েই তো যাচ্ছি। কিছু আর করার নেই।"

বয়স্ক লোক দেখে অশোক আর কিছু বলেনি। যতীন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। অশোক তার হাত চেপে কিছু বলতে বারণ করল। তবু যতীন রাগে বিরক্ত হয়ে একটু বলে উঠলো, "তাহলে আমি ঘুমাবো কিভাবে

 ভদ্রলোক খুব বিনয়ের স্বরে বলল, "তা আপনাদের অসুবিধা হবে না। আমার স্ত্রীকে মাঝেরটাতে তুলে আমি আপনাদের পায়ের নিচে বসে থাকবো। আর আপনার উচ্চতা তো এত বেশি নয়, সে আমার হয়ে যাবে।" তা শুনে তো যতীন আরও তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে যেন ঘোমটার মধ্য থেকে একটা হাসির ফিক্ শব্দ বেরিয়ে আসলো।

যতীন এমনিতে একটু বেঁটে, কিন্তু তার উচ্চতা নিয়ে কেউ কিছু বললে ও বেজায় চটে যায়। যাই হোক আজ তার সেই এনার্জি নেই ঝগড়া করার। একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে সহ্য করল। তাছাড়া লোকটাকে বেশ ভদ্রগোছের মনে হল। তাই আর বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না। লোকটি টিফিন বাক্স থেকে খাওয়া বের করে খাচ্ছেনএকবার অশোক ও যতীনকে বললেন, "একটু খেয়ে দেখুন। আমার স্ত্রীর হাতের তালশাঁসের সন্দেশ। বেশ ভালো খেতে।"

অশোক ও যতীনের পেটে খিদে থাকলেও চক্ষুলজ্জায় না বলল। যতীন যদিও হাতটা বাড়াতে গিয়েও অশোকের না শুনে আর বাড়াতে পারল না।

এর মধ্যে তারা দুজনে লাগেজগুলোকে চেন দিয়ে বেঁধে নিয়েছে। ট্রেনের রাতের খাবারের সময় শেষ। অন্য যাত্রীরা ঘুমের আয়োজন করছে। অশোক আর  বসে থাকতে না পেরে উপরের বার্থে চলে গেল। শরীরের উপর প্রচন্ড ধকল। সে ঘুমিয়ে পরল। যতীন বেচারা বসে রইল। বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করল,"দাদা আর কতক্ষণউনাকে মাঝেরটাতেই তুলে দিন। আর না হলে আমি চলে যাই।"

"ভাই আমি তো বিপদে পড়েছি। একটু সহ্য করুন। টিটি মশাই চলে যাক, তারপর সব ঠিক করে দিচ্ছি।" ভদ্রলোক কাকুতি-মিনতি করে বললেন।

বলতে-বলতেই টিটি মশাই চলে আসলেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই বেশ পটু। টিটি কে দূর থেকে দেখেই স্ত্রী চলে গেলেন বাথরুমে। যেন ইশারায় ইশারায় কাজ করছে। প্রায় দশ মিনিট। যতক্ষণ টিটি ছিলেন ততক্ষণ স্ত্রীর দেখার নেই। যাক ভালোয় ভালোয় টিটিমশাই চলে গেলেন। সবই ঠিকঠাক ছিল। ভদ্রলোকের স্ত্রীও চলে আসলেন। ভদ্রলোক হেসে বললেন, "ভগবান সহায়। এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। আপনি বাথরুমে যাবেন না? আপনি যান। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সব গুছিয়ে দেব।"

যতীন মনে মনে ভাবল স্বামী-স্ত্রী আচ্ছা পাবলিক তো। ট্রেনে এভাবে হামেশাই উঠে থাকেন মনে হয়। এইসব নিয়ে আর বেশি চিন্তা না করে যতীন মনে মনে ভাবলো যাক এখন তাহলে শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া যাবে। যতীন ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে চলে গেল।

"একি কাণ্ড! আরে মশাই উঠুন। আপনি কি করছেন এটা?" 

হঠাৎ যতীনের উচ্চস্বরে কথা শুনে অশোকও উপর থেকে উঁকি মারলো। যতীন বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখে মাঝখানের বার্থে স্ত্রীকে উঠিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক লোয়ার বার্থে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। চাদর মুড়ি দিয়ে বেশ আয়েশ করে ঘুমিয়ে আছেন। হাঁড়ির মতো স্থূলকায় পেটটা যেন সীট থেকে বেরিয়ে পড়ছে। ট্রেনে তখন লাইট নেভানো সবদিকে। হইচই শুনে পাশের এক যাত্রী বলল, "আরে দাদা চিৎকার দিচ্ছেন কেন? এখানে ঝগড়া করবেন না। নিজেদের মধ্যে মিটমাট করুন।"

তখন ভদ্রলোকের স্ত্রীও ক্যান ক্যান করে কি একটা বলে উঠলো। মহিলার এই শব্দ শুনে যতীন একটু দমে গেল। যতীন জানে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে মহিলাদের সঙ্গে ঝগড়া করা খুবই বিপদজনক।

যতীন অসহায়ের মতো দাড়িয়ে রইল। কী করবে সে এখনএখন টিটি মশাইকেও সে পাবে কোথায়! এইবার তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। যতীন বলল, "লোকটার কান্ডজ্ঞান দেখলে অশোক?" রাগে গজগজ করতে করতে যতীন আরও বললো,"এইজন্যই কারোর উপকার করতে নেই।"

চাদরের নিচ থেকে লোকটি বলল, "বয়স্ক লোকদের সম্মান দেওয়া শেখেননি আপনি?"

যতীন বলল,"আমার সীট আপনি দখল করে আছেন মশাই লজ্জা করে না আপনার?"

 লোকটি আবার উত্তর দিল, "সীটে কি আপনার নাম লেখা আছে মশাই?"

যতীন বলল, "আরে আচ্ছা লোক তো। আমার টিকিট আছে।"

লোকটা আবার বলল "সে তাহলে টিকিটটা আপনার সীটে তো আপনার নাম লেখা নেই।"

অশোক বলল, "বন্ধু তুই উপরে চলে আয় আমি নিচে গিয়ে বসছি।" এতে যতীনের যেন মান-সম্মানের আঘাত লাগলো। সে দমবার পাত্র নয়। 

"না না ওটা করতে হবে না। আমি দেখে নিচ্ছি," বলে সে সেই লোকটির পায়ের পাশেই কোনভাবে বসলো। নিরুপায়, পরাজিত, লজ্জিত হয়ে ভাবছে কি করবে। কিন্তু কিছুতো আর করার নেই তার কাছে। রাগে যেন তার কান্না পাচ্ছিল। এর মধ্যে শুরু হলো সেই লোকটার নাক ডাকার শব্দ। স্বামী স্ত্রী দুজনে যেন পালা করে নাক ডাকছে। লোকটার বয়স কম হলে আজ যতীনের সাথে মারামারি হয়ে যেত। যতীনের এইসব অবস্থায় মারামারি করে অভ্যাস আছে। রাগের চোটে যতীন লোকটার পায়ের দিকে ঠেলা দিয়ে জায়গা করে বসতে যায়। এমনি লোকটা তার পাগুলো সোজা করে প্রায় যতীনকে সীট থেকে ফেলে দেওয়ার উপক্রম করে তোলে।

মাঝরাতে তো শুরু হলো আরো বিপদ। একে তো সোজা হয়ে বসতে পারছে না তার ওপর লোকটার শুরু হলো বায়ু নির্গমন। হিরোশিমা-নাগাসাকি পরমাণু বোমার তুল্য শব্দের দুর্গন্ধ বায়ু যেন বায়ু দূষণের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল। নাক ডাকার তালে তালে লোকটার পেটের তরঙ্গ দেখে নন্টে-ফন্টের পিসেমশাইয়ের পেটের উঠানামার কথা যেন মনে হচ্ছিল যতীনের।  

যতীনের নাকে যেন মাঝে মাঝে তালশাঁসের গন্ধও এসে লাগছিল। বাধ্য হয়ে যতীন গিয়ে বসলো ট্রেনের দরজায়। রাতটা মনে হয় এভাবে কাটাতে হবে তার। ট্রেন থামা অব্দি স্বামী-স্ত্রী মিলে দুই সীট দখল করে নাক ডেকে বেশ আয়েশ করে ঘুমিয়ে চলল।

অবশেষে ট্রেন এসে থামল শিয়ালদহ স্টেশনে। যতীন যেন নামার জন্য খুবই উদগ্রীব। লাগেজ নিয়ে একদম দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো। ট্রেন থামতেই যতীন অশোককে তাড়া দিতে শুরু করল,"চল ভাই। তাড়াতাড়ি চল। নেমে পড় জলদি।"

যতীনের তাড়া খেয়ে অশোকও তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল। প্লাটফর্মে ভিড়ের মধ্যে এখন যতীন এগিয়ে যাচ্ছে আগে আর পেছনে অশোক।

হঠাৎ অশোক লক্ষ্য করলো যতীনের ডানহাতে বগলদাবা করা তার লাগেজ আর বাঁ হাতে যতীনের স্পোর্টস শু জোড়া।

অশোক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল "আরে শু জুতো হাতে কেনতুই কার চটি পড়ে চলছিস? এ দেখছি পিউর লেদারের দামি চটি।

যতীন বিজয়ীর মত হেসে বলল, "ওই ব্যাটার চটি পড়ে চলে এসেছি। এখন মজা বুঝবে সে। কাল রাতের পাপের শাস্তি দিয়ে আসলাম ব্যাটাকে।" খেক খেক করে আরো হেসে বলল, "চল চল তাড়াতাড়ি স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়ি।"

যতীন হনহন করে হাঁটছেঅশোক পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখল তাদের সহযাত্রী সেই স্থূলকায় ভদ্রলোক রোদে তপ্ত প্লাটফর্মে লাফিয়ে-লাফিয়ে হাঁটছেন। খালি পা, হাঁড়ির মত পেট দুলছে, পেছনে সমস্ত লাগেজ নিয়ে মহিলা হাসফাস করে হাঁটছেনমাথার ঘোমটা খসে পড়েছে

    এতক্ষণ মনটা ব্যাজার হয়েছিল অশোকেরও রাতের আরাম আয়েশ করে যতীনকে কষ্ট দেওয়ার পর এখন খালি পায়ে নেঁচে-কুঁদে চলার মজাটা টের পাক ব্যাটা ফিক করে হেসে ফেলল অশোকও। 


<
সূ চি প ত্র