দেবীস্মিতা দেব



  ছড়া সম্রাট ভবানীপ্রসাদ              মজুমদার









দেবীস্মিতা দেব




 

ছেলে আমার খুব সিরিয়াস কথায় কথায় হাসে না
জানেন দাদাআমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।

সত্যিই তাই। কার ছেলের বা মেয়েরই আজকাল বাংলাটা ঠিকভাবে আসে? ছেলেমেয়ে তো বাদই দিলাম, মা-বাবাদেরও কি ঠিকভাবে আসে? বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি এই সবকটা ভাষা মিলিয়ে যেন একটা জগাখিচুড়ি ভাষার ব্যবহারিক চর্চা। এই আক্ষেপই হয়তো তাই এতটা সাবলীলভাবেবাংলাটা ঠিক আসে নাকবিতাটির পঙক্তি হয়ে উঠে এসেছে আমাদের সকলের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের আবেগময় লেখনীতে

ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের লেখা আমরা যারা একটু-আধটু বা অনেকটাই পড়েছি, তারা সকলেই জানি কী সুন্দরভাবে সমাজের কত গুরুগম্ভীর বিষয়আশয়কে তিনি আপাতদৃষ্টিতে কতটা সহজ সরল আর মজাদারভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেন। ওরকমই একটা খুব মজাদার ছড়ার মাধ্যমেই ভবানীপ্রসাদের ছড়ার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সেই ছড়াটার নামছাগলের কাণ্ডআমি তখন স্কুলে পড়ি। বেশ অনেকটাই ছোটো। স্বপ্ন-স্বপ্ন আকাশ-আকাশ নদী-নদী আর আলো-আলো আমার জীবন। কোন ক্লাস এখন যদিও তা একেবারেই মনে নেই। ছড়াটার বিষয়বস্তু ছিল এই যে, একটা ছাগল কিনা একবার একটা পুরো উলের গোলাকে ফুল ভেবে মুখে পুরে নিয়েছিল। আর ছাগলের যে কোনও কিছুতেই কোনো অরুচি নেই তা তো আমাদের সবারই জানা। ওই কথায় বলে না, ‘ছাগলে কী না খায়’—ওই আর কি। তো সেই ছাগলটিও লোভে পড়েই হোক কিংবা ভুল করেই হোক একটা উলের গোলা খেয়ে নিয়েছিল। সে কী কাণ্ড, সে কী কাণ্ড! বাড়ির সবাই এই নিয়ে ভেবে ভেবে অস্থির। তো হল কী, সে-বছরেরই মাঘ মাসের শীতে সেই ছাগলের কোল আলো করে এল একটি ফুটফুটে ছাগলের বাচ্চা। জন্মসূত্রে যে কিনা গায়ে আবার সেই উলেরই বোনা একটা সোয়েটার পরা। যাঁর কল্পনার স্তর এমন আকাশছোঁয়া, তাঁর লেখা পড়ে চাইলেও কি কখনও ভোলা যায়? তাই এখনও আমার মনে থেকে গেছে সেই অত্যাশ্চার্য ছড়াটা। এটাই হল তাঁর জাদুমাখা কলমের আকর্ষণীয় মাহাত্ম্য। একবার পড়লে সেটা আদপে মনে থেকেই যায়। সেই থেকে ওই একটিমাত্র ছড়া পড়েই আমি তাঁর লেখার প্রেমে পড়ে গেছিলাম। তারপর থেকে তাঁর লেখা কখনও চোখে পড়েছে আর যে-কোনো কারণ দেখিয়ে সে-লেখা আমি এড়িয়ে চলে গেছি, সে এখনও অবধি আমার অন্তত সাধ্যে কুলোয়নি। এমনই তাঁর লেখার বাঁধুনি

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার হলেন একজন স্বনামধন্য বাঙালি কবি ও ছড়াকার। তাঁর আর একটি জনপ্রিয় লেখা হল, ‘আ-মরি বাংলাভাষামাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই লেখার মাধ্যমে বাংলাভাষার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন তিনি। আমরা সৌভাগ্যবান যে আমরা শুনতে পাই এ-যাবৎ বহু বাচিক শিল্পী তাঁর এই কবিতাটিকে ভালোবেসে তাঁদের নিজ নিজ কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন

তিনি একবিংশ শতকের একজন প্রথম সারির অন্যতম ছড়াকার। তিনি এখন পর্যন্ত কুড়ি হাজারেরও বেশি ছড়া লিখেছেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাওড়া জেলার জগাছা থানার অন্তর্গত দাশনগরের কাছে দক্ষিণ শানপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম শ্রীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র মজুমদার ও মায়ের নাম শ্রীমতী নিরুপমা দেবী

প্রসঙ্গক্রমে তাঁর লেখা আর একটি মর্মস্পর্শী কবিতার কথা আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। সেটি হচ্ছেস্বাধীনতার মানেএই কবিতায় দেশের শ্রমজীবী শ্রেণির ছেলেমেয়েদের দৈনিক জীবনধারণের প্রতি তাঁর যে গভীর আর্তি, তা খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এই কবিতায় তিনি আমাদের এই স্বাধীন দেশের বাস্তব চিত্রটি লেখার মাধ্যমে এমন সুচারুরূপে তুলে ধরেছেন যে পাঠককুলকে এক করুণ ও রূঢ় বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছেন। তাই এই কবিতাটির পঙক্তিগুলোর সঙ্গে একাত্ম হতে গিয়ে নিজেদেরই অজান্তে ভিজে গিয়েছে আমাদের দু-চোখের পাতা

সকলের মনোগ্রাহী ছড়া-কবিতা লেখার পাশাপাশি পেশাগত দিক দিয়ে তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক। পরবর্তীতে তিনি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে সাহিত্য সাধনাই যেন হল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। ছড়া-কবিতা নিয়ে নিরন্তর তাঁর নানাধরনের বিষয় নির্বাচন থেকে শুরু করে তাঁর পরিবেশনা করবার ধরন সত্যিই আমাদের মুগ্ধ করবার পাশাপাশি খুব অবাকও করে। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫০ পেরিয়েছে অনেক দিন। সেই প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছেমজার ছড়া’, ‘সোনালি ছড়া’, ‘রুপোলি ছড়া’, ‘ছন্দে গাঁথা এ-কলকাতা’, ‘কলকাতা তোর খোল খাতা’, ‘ছড়াছড়ি গড়াগড়ি’, ‘ভূত-পেত্নী জিন্দাবাদ’, ‘নাম তাঁর সুকুমার’, ‘ছড়ায় ছড়ায় সত্যজিৎ’, ‘রবীন্দ্রনাথ নইলে অনাথ’, ‘নাও ফুল নজরুল’, ‘ফুল-ফল-গাছ পশু-পাখি-মাছ’, ‘যাচাইকরা বাছাই ছড়া’, ‘হাসতে হাসতে ভাসতে ভাসতে’, ‘মিঠেকড়া পশুর ছড়া’, ‘মিঠেকড়া পাখির ছড়া’, ‘মিঠেকড়া মাছের ছড়া’, ‘মিঠেকড়া খেলার ছড়া’, ‘মিঠেকড়া ভূতের ছড়া’—শুধু এগুলোই নয়, রয়েছে আরও কত কত। তাঁর প্রকাশিত বিভিন্ন ক্যাসেট ও সিডির মধ্যে রয়েছেগানে-গানে মজার ছড়া’, ‘গানে গানে আরো ছড়া’, ‘ছড়ার মেলা ছড়ার খেলা’, ‘ছড়াছড়ি গড়াগড়ি’, ‘ছড়ার গাড়ি দিচ্ছে পাড়ি’, ‘ছড়ার হাট জমজমাট’, ‘মিঠেকড়া পুজোর ছড়াইত্যাদি

লেখালেখির জগতে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও পেয়েছেন অজস্র সম্মাননা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সাহিত্যরত্ন পুরস্কার, উপেন্দ্রকিশোর স্মৃতি পুরস্কার, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ছড়া-সাহিত্য পুরস্কার, সুকুমার রায় শতবার্ষিকী পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, দক্ষিণবঙ্গ সাহিত্য পুরস্কার, কফিহাউস সাহিত্য পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ শিল্পী সংসদ পুরস্কার, সুকান্ত পুরস্কার, যোগীন্দ্রনাথ সরকার স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, শৈশব সাহিত্য সম্মান, কিশোর ভারতী পত্রিকা প্রদত্ত রজতজয়ন্তীবর্ষ বিশেষ স্মারক সম্মান, ফণিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার, সুলেখা পুরস্কার, কবিরত্ন সাহিত্য সম্মান, নেতাজী পুরস্কার, নেতাজী যুব পুরস্কার, স্টারলাইন অ্যাওয়ার্ড, সারা বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলন পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্যিক সংসদ পুরস্কার, উৎসব স্বর্ণ-পদক, ধূমকেতু স্বর্ণপদক, শৈশব সাহিত্য সম্মান, শাশ্বত সাহিত্য সম্মান, হরেন ঘটক স্মৃতি পুরস্কার, ছোটো নদী পুরস্কার, চয়ন সাহিত্য পুরস্কার, নয়ন সাহিত্য পুরস্কার, আনন্দবিচিত্রা পুরস্কার, কৃষ্টি সাহিত্য সম্মান, তিতলি সাহিত্য সম্মান, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী স্মারক সম্মান, নিখিল ভারত শিশুসাহিত্য সম্মেলন পুরস্কার, মল্লভূম পুরস্কার, স্বরবৃত্ত পুরস্কার, অমৃতকমল পুরস্কার, লোকসংস্কৃতি পরিষদ পুরস্কার, তেপান্তর পুরস্কার, সংহতি সাহিত্য সম্মান, কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্ত স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি

এত এত পুরস্কার, সম্মান আর মানুষের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ যাঁর জীবন, জীবদ্দশায় কিংবদন্তি এমন একজন প্রণম্য মনীষীর জন্য আপনাআপনি আমাদের অন্তরের গভীরতম স্থান থেকে শুধুই বেরিয়ে আসে শ্রদ্ধা। আর এভাবেই তাঁর জাদু কলমের স্পর্শে তিনি স্বমহিমায় আমাদের সকলের কাছে হয়ে ওঠেন অন্যতম প্রিয় ছড়ার রাজা কিংবা জনপ্রিয় ছড়া সম্রাট

 

   

ছড়ার রাজা

দেবীস্মিতা দেব


এক যে আছেন ছড়ার রাজা ছন্দে বোনেন স্বপ্নপুর,

সেই পুরেতে ভাসলে এ মন হয় নিমেষে ক্লান্তি দূর।


হাওড়া জেলার দাশনগরের দক্ষিণ শানপুরেতে,

জন্মেছিলেন, আজকে সবার থাকেন হৃদয় জুড়ে যে।


একটি ছড়া জমজমাটি, অন্যটি তাঁর মিষ্টি খুব,

একটি ছড়া আপনভোলা কল্পনাতে দেয় রে ডুব।


একটি ছড়া নীতির কথা দিচ্ছে জানান সবদিকে,

অন্যটি সে জীবনমুখী, পড়েই যাপন নাও শিখে।


লেখেন তিনি মনভোলানো হাজারো এমন ছড়া যে,

হাসি মজার কোনোটা তার কিংবা মিঠেকড়া রে।


তাঁর ছড়াকে করবে হেলা এই ভুবনে সাধ্যি কার?

বড়ো ছোটো সবার প্রিয় ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।

  

  

  

<