গল্প - ১ । আষাঢ় ১৪৩১



 মা ও মাধবীলতা









সুমিত্রা পাল

কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ



 

টিফিনবক্স খুলতেই চকচক করে উঠল পৃথার চোখদুটি। মায়ের হাতের সুস্বাদু ফুলকপি আর কড়াইশুঁটির পরোটা সঙ্গে মায়েরই তৈরি করা আমের আচার। প্রিয় বান্ধবী শ্বেতার সঙ্গে চেটেপুটে সব শেষ করার পরে বাংলা পিরিয়ডের জন্য রেডি হয়ে বসল ওরা। 

ক্লাশ সিক্সে পড়ে পৃথা। ওদের স্কুলে বাংলা পড়ান চম্পাদি। হাসিখুশি এই দিদিকে ওরা যেমন ভালবাসে তেমনি তার প্রতি শ্রদ্ধাও অপরিসীম

ক্লাশ শুরু হওয়ার বেল বাজতেই ঝড়ের বেগে ক্লাশে ঢুকলেন চম্পাদি। মুখে রোজকার সেই একরাশ জুঁইফোটা হাসি  

ওরা বই খাতা খুলতে খুলতে ঝটপট রোলকল ও শেষ।   

কিন্তু আজ তিনি পাঠ্যপুস্তকের ধার দিয়েও গেলেন না। বরং বেশ গল্প জুড়ে দিলেন। পড়াশোনা ছাড়া কার কী ভালো লাগে জিজ্ঞেস করতে করতে হঠাৎ বললেন

- ‘জানো আজ স্কুলে আসার পথে এমন সুন্দর একটা দৃশ্য দেখেছি যে চোখদুটোর সঙ্গে মনটাও আমার জুড়িয়ে গেছে

ওরা সবাই উৎসুক হয়ে উঠল দিদিমণির দেখা সেই সুন্দর দৃশ্যের বর্ণনা শোনার জন্য। আসলে অন্য দিদিমণিদের মত নন চম্পাদি। তাঁর পড়ানোর স্টাইলটা যেমন আলাদা, তেমনি বাইরের জগতটাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও সম্পূর্ণ আলাদা। যে সমস্ত জিনিস অন্যদের নজর এড়িয়ে যায় বা নজরেই পড়েনা, সেইসমস্ত জিনিস থেকে তিনি তুলে আনেন মণিমাণিক্য, হীরে, জহরত। কখনো খুঁজে নেন শেখার কোন বিষয়। 

আর সবকিছুই তিনি তাদের সঙ্গে অর্থাৎ তাঁর সব ছাত্রীদের সঙ্গে শেয়ার করবেনই। শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ না রেখে তাদের বোধের জগতটাকে একটু একটু করে গড়ে তুলতে চান তিনি। ওরা সবাই উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে দেখে চম্পাদি উৎসাহিত হয়ে বলতে লাগলেন  

-‘আমাদের আসা যাওয়ার পথে এবড়োথেবড়ো একটি রাস্তা। সেই রাস্তার পাশে বিভিন্ন গাছের পাতা ছাওয়া ছোট্ট একটি ঝুপড়িঘর। সেই ঝুপড়ি ঘরে, ছেড়া একটি মাদুরে শুয়ে এক অসুস্থ মা। আর সেই মাকে ঘিরে শুকনো মুখে, মলিন জামাকাপড়ে বসে আছে তিন ছেলেমেয়ে। ঠিক বসে নেই ওরা! কী অসীম ভালবাসায় তারা মায়ের যত্ন-আত্তি করে চলেছে! কেউ খাইয়ে দিচ্ছে মাকে, তো কেউ পাখা দিয়ে বাতাস করছে। তো কেউ চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।   

আর সেই মা! অসুস্থ হলে কী হবে, তার মুখে এক পরিতৃপ্তির ছাপ। আনন্দের ছাপ। যেন এর চেয়ে জগতে আর কোন সুখ নেই 

    একটু থেমে চম্পাদি বললেন

-‘আসলে জানো, সবসময় ছেলেমেয়েদের জন্য মায়েদের আর্তি, মায়েদের সেবাযত্ন দেখেই অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু আজ এই দৃশ্যটি দেখে আমির খসরুর সেই বিখ্যাত লাইনটি মনে পড়ছিল-পৃথিবীতে যদি স্বর্গ কোথাও থাকে তবে তা এখানে এখানে এখানে 

তারপর বলেছিলেন-যখনই সুযোগ পাবে, মায়ের জন্য কিছু করার চেষ্টা করবে। জানি, প্রত্যেকেই নিজের মাকে ভালোবাসো। কিন্তু ছোট ছোট এইসব ভালবাসা প্রদর্শন মায়েদের আনন্দকে দ্বিগুণ করে তোলে 

সেই থেকে দিদির কথাই ঘুরছিল পৃথার মাথায়। ভাবছিল সে, কী করা যায় মায়ের জন্য! আজ তো আবার মায়ের জন্মদিন। এই বিশেষ দিনটিতে মাকে কী দেওয়া যায় তাই ভাবছিল সে।   

ভাবতে ভাবতেই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল সে। হয়তো একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। খেয়াল করেনি রোজকার গলি ছেড়ে অন্য একটি সে গলিতে ঢুকে পড়েছে। আর ঢুকতেই মিষ্টি একটা গন্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। বড্ড চেনা এই গন্ধটা মুহূর্তেই মন ভালো করে দিল তার।  

এদিক ওদিক তাকাতে নজরে পড়ল মাধবীলতা ফুলের গাছটিকে। নিচের দিকে হেলে পড়া গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা আর গোলাপি ফুলে এমনভাবে ছেয়ে আছে গাছটি যে পাতাগুলিও ঢাকা পড়ে গেছে। এই ফুল তার মায়ের বড় প্রিয়, বড় পছন্দের। 

সেই ছোট্টবেলা থেকে মায়ের আঁচলে এই ফুলের গন্ধ। আর তাই, যেখানেই মাধবীলতা ফুলের গাছ দেখে, তার মায়ের কথা মনে হয়। মনে হয়, মা যেন তাঁর আঁচল বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। 

আজ গাছটিকে হঠাৎ দুহাতে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হল তার। মনে হল- এই ফুলে ভরা সম্পূর্ণ গাছটিই, যদি সে মাকে উপহার দিতে পারত!  

কিন্তু নাহ্, তা সম্ভব নয়

তার বদলে, খুব সন্তর্পণে বেশ কয়েকগুচ্ছ মাধবীলতা পেড়ে নিল সে। খুব যত্নের সঙ্গে ফুলগুলি শালপাতায় মুড়ে, একেবারে বুকের কাছটায় ধরে ধীর পায়ে হেঁটে নিয়ে এল বাড়িতে।  

বেল বাজাতেই দরজা খুললেন মা। এ-ত দেরি কেন জিজ্ঞেস করতে গিয়ে চোখ পড়ে দিয়ার বুকের কাছে ধরা ফুলগুলোর দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গেই খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে ওঠেন তিনি

-‘এ-তো-ও, এ-তো-ও মাধবীলতা ফুল’!   

অঞ্জলিবদ্ধ দু-হাতে শালপাতার ঠোঙাটা সে মায়ের দিকে তুলে ধরে। বলে 

- ‘তুমি ভালবাস, তাই তোমার জন্য এনেছি। আই লাভ ইউ মা  ক্ষণিকের জন্য মায়ের চোখে অবাক বিস্ময়। হয়তো ছলছলও করে উঠল চোখদুটো। পরক্ষণেই সজোরে চেপে ধরলেন তাকে বুকে। 

বললেন-আজ, এই প্রথমবার, আমার জন্মদিনে পৃথিবীর সেরা উপহার পেলাম আমি। 

-লাভ ইউ টু মাই চাইল্ড  

পৃথার চোখের কোণ দুটো আনন্দে চিক চিক করে উঠল।