আঠাশে
ফেব্রুয়ারী তিনি ডাকযোগে একটা চিঠি পেলেন। মাঝে মাঝে কিছু অজ্ঞাতনামা লোক তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, শত্রুকে বা প্রতিবেশীকে বিপদে ফেলার জন্য, কিংবা দেশের হৃতের জন্য বড় সাহেবের নামে চিঠি লিখে ঘটনাটা জানায়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা
নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। এটা সেই ধরনের কোনো চিঠি হবে, একথা ভেবে ভার্মা সাহেব চিঠির মোড়কটা খুললেন। তাতে লেখনের প্রাচুর্যতা খুব কম। মাত্র দুটি বাক্য লেখা ছিল। বারো তেরোটা শব্দ। বাংলাতে লেখা। ভার্মা সাহেব চোখ
রাখলেন তাতে। দেখলেন তাতে লেখা আছে– দশই মার্চ
রামপুরহাটের মড়িগ্রামের মনোহরের বাড়িতে
ডাকাতি করার ইচ্ছে আছে। আশা করি ওইদিন সদলবলে আপনারাও উপস্থিত থাকবেন। ইতি– পলাতক।
চিঠিটা পেয়ে আর
বিন্দুমাত্র বিলম্ব করলেন না ভার্মা সাহেব। রিডারকে ডেকে
বললেন– এস.ডি.পি.ও. রামপুরহাটকে এখনই সিঁউড়িতে চলে আসতে বলুন।
সিউড়ি থেকে
রামপুরহাটের দূরত্ব বড়জোর পঁচিশ ত্রিশ কিলোমিটার হবে। খবর পেয়ে সাথে সাথে শুভঙ্কর দত্ত রওনা হলেন। এক
ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলেন
সিঁউড়িতে। পুলিশ অফিসে ঢুকতেই ভার্মা সাহেব তার হাতে চিঠিটা দিলেন। চিঠির প্রতিপাদ্য বিষয় পড়া শেষ হলেই ভার্মা
সাহেব বললেন– এখন আপনি বলুন এস.ডি.পি.ও. সাহেব! আপনার
কত ফোর্স অফিসার দরকার? কিন্তু পলাতককে এবার অ্যারেস্ট করতেই হবে। না করতে পারলে কাউকে ছেড়ে দেবো না আমি।
এ ঘটনার ঠিক
একদিন পরে একই ধরনের চিঠি পেল মনোহরের মাড়গ্রামের
বাড়িতে। মনোহর গোয়েল তার বড়বাজারের গদিতে বসে সেই সংবাদটা জেনেছিলেন ফ্যাক্সে। কিন্তু
কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। বলা তো যায় না কার কি
মতলব আছে? ডাকাতির ভয় দেখিয়ে সম্পত্তির হিসেব নিতে চাইছে কিনা, কে জানে? এইসব সাত-পাঁচ ভেবে সোনালীর মাকে বলে দিলেন-
সোনাদানা টাকাপয়সা যেভাবে বাড়িতে রাখা আছে, সেভাবেই থাক। ব্যাংকলকারে রাখতে হবে না। মঙ্গলবার বাড়িতে ফিরে প্রশাসনিক লোকজনের সাথে কথা বলে যা ব্যবস্থা করার করব।
কলকাতার
বড়বাজারের বড় আড়ৎদার মনোহর গোয়েল। দাড়ি কামানোর ব্লেড থেকে শুরু করে কসমেটিক্স ইলেকট্রনিক্স, চাল-ডাল, সবকিছুরই হোলসেল
এজেন্ট। নেতা থেকে দুর্বৃত্ত সকলেই চেনে তাকে এক বাক্যে। তার ডাকে বড় বাজারের বড়কর্তা থেকে শুরু করে
লালবাড়ির রথি-মহারথীরা হাজির হয় সব কাজ ফেলে। কলকাতা যদিও তার মূল উপার্জন স্থল, যদিও গাড়ি-বাড়ি
প্রচুর সম্পত্তি আছে কলকাতায়, তবুও
পিতৃ-পুরুষের বিষয় সম্পত্তি পড়ে আছে বলে মাড়গ্রাম ছাড়তে পারেননি মনোহর। ওখানে
ওর মেয়ে সোনালী এবং স্ত্রী কল্পনা সব দেখাশুনা করে। আশেপাশের আত্মীয়-স্বজন কাজকামের লোকজন আছে। তারাও বিপদাপদে দেখভাল করে।
বড়সাহেবের আদেশ
পেয়ে সরোজমিনে মনোহরের বাড়িটা দেখার জন্য পরেরদিন সশরীরে
হাজির হলেন এস.ডি.পি.ও. সাহেব। কথা বললেন কল্পনা দেবী ও মেয়ে সোনালীর সাথে। ফোনে যোগাযোগ করলেন মনোহরের সাথে। তাকে আশ্বস্ত করে
বললেন–ভয়ের কিছু নেই। খবর পেয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা ইতিমধ্যে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। একটা পুলিশ পিকেটও বসানো
হয়েছে আপনার বাড়ির পাশে। আমিও নিয়মিত ভিজিট করবো।
দশ তারিখ ভোর থেকেই আমি ওখানে
প্রেজেন্ট থাকব। তবে আপনিও সময় করে ৯ তারিখে চলে আসুন। যদি কোন প্লান-প্রোগ্রাম করতে হয়, তাহলে তা করে নেওয়া যাবে।
মনোহরবাবু বললেন
ঠিক আছে, তাই হবে স্যার!
দেখতে দেখতে কটা
দিন কেটে গেল। ৯ তারিখে কর্মচারীদের সব কাজকর্ম বুঝিয়ে
দিয়ে দুপুর দুপুর বার হলো মনোহর।হাওড়া থেকে ট্রেন ধরবে বলে। সঙ্গে ভাইপো
সুনীলও ছিল। টুকিটাকি ফলপাকড়, জলের বোতল, কাজুর প্যাকেট
এসব কিনে নিয়ে পি.আই. অফিসের সামনের দোকানে বসল। সুনীল দু'কাপ কফি নিয়ে
এল। মনোহরের কান দুটো হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে উঠল।
পাশে বসে থাকা
একজন লোক আশেপাশের লোকজনদের উদ্দেশ্য করে বলছে– এইতো মশাই!
গেল বুধবারের আগের বুধবারের কথা। পাটনার এক লোকের মুখে
শুনেছি, ওই সাধুবাবা পাটনাতেও ছিলেন কিছুদিন। আর একটা লোকের হাত দেখে সাধুবাবা বলে দিলেন– কোথায় তার বাড়ি।
সে কি করে। তার কটা ছেলে মেয়ে। তার ভাগ্যে কি
ঘটতে চলেছে। এসব কথা কি সাধারণ মানুষ বলতে পারে? এসব ভগবান
প্রদত্ত ক্ষমতা। একটা লোককে তো সেদিন
বলেছিল পলাতকের হাতে তোমার ছেলে খুন হবে। হলও তাই। পলাতকের
ছুরিতে প্রাণ হারালো মহিম গাঙ্গুলীর ছেলে।
তারপর একটু দম
নিয়ে আবার বলল– সাধে কি আর অফিস ফাঁকি দিয়ে এখানে
দাঁড়িয়ে আছি? দেখি সাধুবাবার কৃপায় যদি পঙ্গু ছেলেটার কিছু একটা ব্যবস্থা হয়।
মনোহর অবাক হয়ে
যায় ভদ্রলোকের কথা শুনে। এমনিতে সাধুসন্তের প্রতি বরাবরই একটু দুর্বলতা আছে মনোহরের। বিশ্বাস আছে
প্রগাঢ়। ঠাকুর দিলে সব হয়। তাই
সবিস্ময়ে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন– কার কথা বলছেন আপনি?
মনোহরের কথা শুনে
একগাল হাসি হাসল ভদ্রলোক।
সবিস্ময়ে পাল্টা প্রশ্ন করল– আপনি জয় গুরুর নাম কখনো শোনেননি? তার নাম যদি নাই বা শুনে থাকেন, নিশ্চয়ই গঙ্গা
নদী হেঁটে পার হবার কথা শুনেছেন?
তাতেও মনোহর গাল
হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক বললেন– ২৫শে
বৈশাখ রবিঠাকুরের জন্মদিনে গঙ্গা নদী হেঁটে পার হয়েছিলেন জয়গুরু। সারা কলকাতার লোক দেখল। বাস ট্যাক্সি থামিয়ে, অফিস কাছারি বন্ধ করে, সবাই দেখতে
এসেছিল, আর আপনি মশাই দেখেননি? সেই জয়গুরু আজ এখানে এসেছেন।হাওড়া প্ল্যাটফর্মের বাইরে।তার কৃপা, তার আশীর্বাদ পাবার আশায় এতক্ষণ ধরে লাইন দিয়ে ছিলাম। একটু চা খেতে এখানে
এসেছি।
– তা আপনার জয়গুরু বাবা কত করে প্রণামী নিচ্ছেন? হঠাৎ মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেললেন মনোহর। তার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল ভদ্রলোক। এক সময় হাসি থামিয়ে বলল– জানেন মশাই!
জয়গুরু একটা পয়সাও নেন
না প্রণামীতে। ফলমূল যা পায় তাও বিলিয়ে দেয় গরিবদের।
মনোহরের মনটা
উসখুস করে উঠল।জয়গুরুকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য বাসনা
হল। মনে হল জয়গুরুর কৃপা একবার পেলে পৃথিবীর কেউ কিছু ক্ষতি করতে পারবে না তার। মনহর তার মনের অজান্তে
হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। সবে দুটো পনের।
সাডে তিনটেয় ট্রেন। হাতে এখনো সোয়া এক ঘন্টা আছে। তাহলে জয়গুরুর
আশীর্বাদ নিতে ক্ষতি কি?
ভদ্রলোক বোধহয়
মনোহরের মনের কথা পড়তে পেরেছিলেন। তাই কোনরকম দ্বিধা
দ্বন্দ্ব না করে বলে ফেললেন– মন যখন চেয়েছে, তখন চলুন। কিছু অসুবিধা হবে না। আমার তো একটা লাইন ওখানে দেওয়া আছে। আমার সামনেই দাঁড়িয়ে পড়বেন। এ সুযোগ আর জীবনে পাবেন কিনা, তা কে জানে?
মনোহর আর কিছু
চিন্তাভাবনা না করে সুনীলকে সঙ্গে নিয়ে ভদ্রলোকের সাথে
প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বার হলেন। মিনিট দু'য়ের মধ্যে পৌঁছে
গেলেন সেখানে। লোকের ভিড় দেখে হতভম্ব হলেন মনোহর। এ
যেন একটা ছোটখাটো মেলা বসেছে
হাওড়া স্টেশনের গায়ে। অনেক কষ্টে, অন্যের পিঠের উপর মুখ রেখে একপলক জয়গুরুকে দেখলেন মনোহর। কপালে তিলক লাগিয়ে পদ্মাসনে বসে আছেন জয়গুরু। গায়ে গেরুয়া বসন। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। মাথায় শিবের মতো জট। নিমিলিত চোখ। ভক্তবৃন্দের হাত মুখ দেখে উপদেশ দিচ্ছেন।
ভদ্রলোকের সাথে
লাইনে ঢুকলেন মনোহর। লাইন তো নয়, যেন রাজধানী
এক্সপ্রেস। এ মাথা থেকে ও মাথা দেখা যায়না। মনোহর ভেবে পেলেননা কিভাবে হাত দেখাবেন জয়গুরুকে। পকেট থেকে খৈনির
ডিব্বাটা বার করে বানানো
খৈনি এক চিমটে মুখে দিলেন। ভদ্রলোককে এক চিমটে খৈনি দিতে গেলে ভদ্রলোক মাথা নেড়ে জানালেন খৈনি নেবেন না।
তখন মনোহর বলল–খৈনি খাবে না, ঠিক আছে। পান খাবেন তো?
ভদ্রলোক মাথা
দোলালেন। তখন সুনীলকে ডেকে পান আনতে পাঠালেন মনোহর।
তারপর স্বগতোক্তি করার মতো বললেন– কি আশ্চর্যের কথা একবার ভাবুন। এতক্ষণ আপনার সঙ্গে কাটালাম, অথচ আপনার নামটা জানা হল না।
ভদ্রলোক বললেন–
আমার নাম পরাশর।
কথাটা শুনে হেসে
ফেললেন মনোহর। একসময় হাসি
থামিয়ে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে
বললেন– ছেলে আপনার পঙ্গু হলো কি করে? জন্ম থেকে নাকি…..?
–না মশাই না।
পরাশর প্রতিবাদ করার ভঙ্গিতে বললেন–জন্ম থেকে পঙ্গু নয়। পায়ে গুলি লেগেছিল, তাতেই ওই অবস্থা। ভালো করে হাঁটতে পর্যন্ত পারে না।
সারাক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকে,আর চোখের জল ফেলে।
–কিন্তু গুলিটা
লাগল কি করে? অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে মনোহর গোয়েল জানতে চাইলেন।
–কি আর বলব মশাই!
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পরাশর বললেন– সবই অদৃষ্টের
লিখন! তা না হলে কি আর এরকম হয়? ক'দিন ধরে শহরে রটে গিয়েছিল
হায়না বার হয়েছে। বাচ্চা ছেলেদের পেট চিরে রক্ত খাচ্ছে। তাই স্ত্রীর কথা শুনে বন্দুকে কার্তুজ ভরে রেখেছিলাম। রাতের
বেলায় ছেলে কখন ঘুম থেকে উঠে বন্দুক নিয়ে খেলা করছিল
জানিনা। বন্দুকের গুলির আওয়াজে আমাদের
ঘুম ভাঙল। দেখলাম ছেলের পা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তারপর অনেক ডাক্তার বদ্যি করলাম। কিছুতেই কিছু হলো না। তাই এসেছি জয়গুরুর কাছে। দেখি জয়গুরু কি বলেন? ওর কৃপায় যদি ছেলেটা সেরে যায়, তাহলে কালীঘাটে জোড়া পাঁঠা বলি দেবো বলে মানত
করেছি।
লাইনটা তখন একদম
সামনে চলে এসেছে। আর একজনের পরে মনোহরের ডাক
পড়বে। ট্রেন ছাড়ার এখনো দশ মিনিট বাকি। তাছাড়া আজকাল দু-চার মিনিট লেট করে ট্রেন ছাড়ে। তাই ট্রেন ধরতে
কোন অসুবিধা হবে না। একথা মনে মনে ভাবলেন মনোহর।
সামনের লোকটার
হাত দেখানো হয়ে যেতেই মনোহর তার ডান হাতটা বাড়িয়ে
দিলেন জয়গুরুর সামনে। তার হাতটা ভাল করে নিরীক্ষণ করে জয়গুরু বললেন– তোর বাড়ি বীরভূমের মড়িগ্রামে না?
– আজ্ঞে হ্যাঁ।
উৎফুল্লিত মনে স্বীকার করেন মনোহর।
– দু'তলা বাড়ি। এক
মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে মোট তিন জনের সংসার। বড়বাজারে
বড় কারবার। আজকের বাড়ি ফিরবি বলে মনস্থ করেছিস।
– হ্যাঁ বাবাজি!
শুনেছি….।
মনোহরের কথা শেষ
হবার আগেই সাধুবাবাজি বললেন– হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছিস। তোর বাড়িতে কাল সকালে পলাতক ডাকাতি করবে। যা, তাড়াতাড়ি চলে
যা। দেখ কি করতে পারিস।
আর একমূহূর্ত
দেরী করেনি মনোহর। এক লাফে জনতার বেড়া ডিঙিয়ে, এদিক ওদিক দিয়ে নিজেকে কাটিয়ে পৌঁছে গেল
প্লাটফর্মে। সাথে সুনীলও। চোখের
সামনে তারা দেখতে পেল ময়ূরাক্ষী এক্সপ্রেস প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেছে। হায় হায়, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল বলে বুক চাপড়াতে থাকলেন মনোহর। পরেরদিন সকাল পাঁচটার আগে রামপুরহাটে যাওয়ার আর কোনো ট্রেন নেই। মাথায় হাত দিয়ে
প্লাটফর্মে বসে পড়লেন
মনোহর।
সারা রাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি মনোহর। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় মাথার চুল ছিড়ছে শুধু। পিপাশায় গলা শুকিয়ে
উঠেছে বারবার। হাপরের মতো
ওঠানামা করছে তার বুকের স্পন্দন। টেলিফোনে সোনালীর মার সাথে যোগাযোগ করতে গিয়েও বারবার ব্যর্থ হলেন। আক্ষেপে, অভিমানে সজোরে দুটো ঘুষি বসিয়ে দিলেন টেবিলে।
মনে মনে ভাবলেন, কোন কুক্ষণে সাধু দর্শনে গিয়েছিলেন তিনি।
ভোরের
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরলেন মনোহর ও সুনীল। রাত থেকে একটা দানাও মুখে
তোলেনি মনোহর। সুনীল এক কাপ চা এনে দিল তাকে। সাথে দুটো
বিস্কুট। তাতে গলাটা ভিজলো বটে, কিন্তু বিষন্নতা
গেল না। সারা রাস্তাটা
আকাশ পাতাল চিন্তা হলো মনোহরের। সুনীলের সাথে কথা বললেন না তেমন ভাবে। ছ'টার ট্রেন পৌঁছল
এগারোটায় রামপুরহাটে। ট্রেন থেকে নেমে
এক মুহূর্ত দেরি না করে একটা ভাড়ার ট্যাক্সি ধরলেন। দাম দস্তুর নিয়ে কি সব বলছিল ড্রাইভার, সেদিকে কর্ণপাত করল না মনোহর। শুধু বললেন জলদি মাড়গ্রাম চলো।
ডাইভার অনুমান
করে নিল বাড়িতে কোন অঘটন ঘটেছে। তাই সে আর দেরী করলো না। গাড়ির এক্সেলেটরে পায়ের চাপ বাড়াল। গাড়ির গতি বৃদ্ধি হল। মোরাম বিছানো রাস্তায় উঁচু-নিচু ছিল বিস্তর। গাড়িতে বসে বারবার মুখ
থুবড়ে পড়ছিল দুজনে। তবুও ড্রাইভারকে আস্তে চালাবার কথা বলল না।
প্রায় একঘন্টা
পরে ট্যাক্সি গিয়ে থামল মনোহরের বাড়ির দোরগোড়ায়। সাথে সাথে এস.ডি.পি.ও. দলবল নিয়ে এগিয়ে গেলেন ট্যাক্সির
দিকে। ট্যাক্সি থেকে দু'জন লোককে নামতে দেখে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। এক জনের মুখ দেখে তো রীতিমতো শিউরে উঠলেন। এ তিনি কাকে দেখছেন চোখের সামনে?
এদিকে বাড়ির
সামনে পুলিশের লোকজন দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন মনোহর।
অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল তার। তাহলে কি কোনো অঘটন ঘটে গেছে তার বাড়িতে? না হলে সাতসকালে তার বাড়িতে এত পুলিশ এসেছে কেন? মনের মধ্যে
আশঙ্কা জাগলেও কিঞ্চিৎ ভরসা ছিল তাতে। যদি সত্যিই
কিছু ঘটনা ঘটত, তাহলে পুলিশরা গোঁফে তেল লাগিয়ে এখানে বসে থাকত না। লাজ লজ্জার খাতিরে কিংবা সামাজিক
দায়বদ্ধতার কথা ভেবে পলাতক
পিছু নিত নিশ্চয়ই।
আর শুভঙ্করবাবুর
চমকে ওঠার কারণ ছিল অন্য। মনোহর বাবুর আদলে আর একজন মনোহরকে দেখে গুলিয়ে
ফেলেছিলেন সব। মাস তিনেক আগে এস.ডি.পি.ও হিসাবে রামপুরহাটের চার্জ নিয়ে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে মনোহরকে
কোনদিন দেখেননি তিনি। তবে ফোনে কথা হয়েছে কয়েকবার। বাড়ির অ্যালবামে মনোহরের ছবি দেখে মনোহর সম্বন্ধে একটা
ধারণা তৈরি হয়েছিল মাথার
ভিতরে। সকালবেলা সুট কোট পরে ওই বাড়ি থেকে বার হয়ে তাকে বলেছিল– স্যার! আমার সঙ্গে কিছু ফোর্স দিন। সোনাদানা, টাকাপয়সা
এস.বি.আই ব্যাংকের লকারে রেখে আসি। সে কথা শুনে আপত্তি করেননি তিনি। বড়বাবুর তত্ত্বাবধানে ২০ জন ফোর্স দিয়ে মনোহরকে পাঠিয়েছিলেন রামপুরহাটে। হঠাৎ সুট কোট ছেড়ে, ধুতি পাঞ্জাবি
পরে এ আবার কোন মনোহর এলো? ইনি মনোহরের কোন জমজ ভাই নয় তো? তাই উৎকণ্ঠার অবসান কাটাতে নিজের পরিচয় দিয়ে
অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে শুভঙ্করবাবু জিজ্ঞাসা করলেন– আপনাকে তো ঠিক চিনতে
পারলাম না?
– আমি মনোহর
গোয়েল স্যার! এস.ডি.পি.ও. সাহেবের গলার স্বর চিনতে পেরে মনোহর বললেন– আমাকে স্যার তিনবার ফোন করেছিলেন আপনি। ৯ তারিখ রাত্রে বাড়ি ফিরতে আদেশ করেছিলেন। সেই মতো কাল বার হয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে হাওড়ায় গতকাল আটকে
পড়েছিলাম। বাড়িতে ফিরতে
পারিনি।
চোখ কপালে তুলে
অস্ফুট স্বরে স্বগতোক্তি করা স্বরে শুভঙ্কর বাবু বললেন– তার মানে?
মনের মধ্যে তখন
প্রচন্ড ঝড় বইছে শুভঙ্করবাবুর। তাহলে যে লোকটা বড়বাবুর
সঙ্গে অ্যাটাচি নিয়ে বার হল সে তাহলে কে? পলাতক নয়তো? ওই লোকটাই তো ওই বাড়ি থেকে বার হয়েছিল। কখন
সে ওই বাড়িতে ঢুকেছিল কে জানে? তাছাড়া এ ভুল
তার হতে পারে, কিন্তু এ ভুল তার স্ত্রী কন্যা কি করে? একথা ভেবে তখন
মনোহর ও সুনীলকে নিয়ে তিনি ঢুকলেন তাদের বাড়িতে।
তালা ভেঙে শোবার ঘরে ঢুকে দেখলেন হাতপা বাঁধা অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে মনোহরের স্ত্রী-কন্যা। তাদের মুখে বাঁধা আছে কাপড়ে। দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মনোহর। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন এস.ডি.পি.ও. সাহেব। মনে মনে
ভাবলেন, কি বোকামিটাই না করেছেন তিনি! এখন বড় সাহেবকে কি জবাব দিবেন তিনি?
ঘোর কাটতেই হঠাৎ
মোবাইল ফোনটায় বটম টিপতে শুরু করলেন। কানে ধরে রিংয়ের
আওয়াজ শুনলেন। আওয়াজ থামতেই বললেন–
বড়বাবু! এস.ডি.পি.ও.
বলছি। যে লোকটাকে এস্কর্ট করে নিয়ে গেলেন, ও লোকটা মনোহর নয়। ও আসলে পলাতক। ওকে ধরো।
– কি চলে গেছে? কোন দিকে গেছে? ওয়ারলেসে সব
থানাকে বলে দাও, সবাই যেন রাস্তায় নামে। যেখানেই থাকে, এনিহাউ পলাতককে…...।
পলাতকের গল্প
শুনতে শুনতে একটা অন্য জগতে চলে গিয়েছিলেন অলোক মিত্র।
ভাবছিলেন পলাতকের ক্ষুরধার বুদ্ধির কথা। যতীন দারোগার মুখের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন তিনি। আনন্দে, খুশিতে কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে যতীন
দারোগার মুখ। মনে হল ডাকু পলাতকের গর্বে যেন গর্বিত
তার চোখ-মুখ। কারণটা তার অজানা নয়। ছেলেবেলা থেকেই পলাতককে তিনি দেখে আসছেন।
পলাতকের প্রতি তার একটা দুর্বলতা কাজ করে। এটা তার বহিঃপ্রকাশ। তবে সেই প্রসঙ্গে
না গিয়ে যতীন দারোগাকে শুধালেন– আপনার জয়গুরু, পরাশর তাহলে
পলাতকেরই লোক ছিল?
যতীন দারোগা সে
কথা শুনে হেসে বললেন– তা তো অবশ্যই স্যার! ছেলেটা মাথায়
বুদ্ধি রাখে খুব। বড় সাহেব সেদিন পলাতক সম্বন্ধে যে ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন, সে ঘটনাটি তো
আপনি এস.ডি.পি.ও. রামপুরহাট
থাকাকালীন ঘটেছিল।
গভীর একটা
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অলক মিত্র বললেন– হ্যাঁ। সেবারে প্রাক্তন ইস্কুল মাস্টার সেজে ফাঁপা লাঠির মধ্যে মণিমুক্তো
হিরে নিয়ে পালিয়েছিল পলাতক। সে গল্প
একদিন আপনাকে ডিটেলসে বলব। কিন্তু পলাশের পলাতক হয়ে ওঠার
কাহিনি আমি আপনার মুখে শুনব।
– ঠিক আছে স্যার!
আমি ফাঁক পেলেই ঘটনাটা আপনাকে শোনাব। কারণ পলাতক আমার ব্যস্তময় জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল
একসময়।
।। পর্ব : সাত ।।
খবরের অপেক্ষায়
ছিলেন যতীন দারোগা। প্রতিদিন নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন
সোর্সদের সাথে। স্থানীয় লোকজনের
সাথে ভাল-মন্দ জিজ্ঞাসা করার ফাঁকে কৌশলে
খবর নিতেন তিনি। কিন্তু কোথাও কিছু কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন
না। আলিপুর থেকে বড়সাহেব খুব চাপ দিচ্ছিলেন বড়বাবুকে। কেন অঞ্জলিকে খুঁজে বার করা যাচ্ছে না? কেন পলাশকে ধরা হচ্ছে না? তার কৈফিয়ত দিতে
দিতে নাজেহাল হয়ে পড়েছিলেন বড়বাবু ইমতিয়াজ খান।
নিজেও খবর রাখছিলেন নানাভাবে। কিন্তু কপাল তাদের মোটেই সুখকর ছিল না।
এখনকার জমানার
মতো তখন তো আর হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না। তাই সংবাদ পেতে এবং দিতে বিলম্ব হত
বিস্তর। তবুও কোনও মতেই হাল ছেড়ে
দেওয়ার পাত্র ছিলেন না যতীন দারোগা। নিয়মিত হাটে, বাজারে, সম্ভাব্য গোপন স্থানে তিনি হাজির হতেন। রেইড
করতেন। খোঁজখবর নিতেন।
একদিন একজন সোর্স
এসে খবর দিল যতীন দারোগাকে। 'স্যার! পলাশের আজ বাড়ি ফেরার কথা আছে।'
যতীন দারোগা
শুধালেন- কোথা থেকে আসবে?
সোর্স বলল-
ক্যানিং থেকে।
- কোন পথ দিয়ে
আসবে?
-ওপারের
গোসাবাঘাট থেকে নৌকায় চাপবে বলে জানতে পেরেছি।
- ক'টা নাগাদ আসতে পারে? উদ্বেগের সাথে
সোর্সের কাছে জানতে চাইলেন যতীন
দারোগা!
- কোন ঠিক নেই
স্যার! তবে এটা ঠিক, আজ সে ফিরছে।
পকেট থেকে একটা
পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে সোর্সকে দিলেন যতীন দারোগা।
তারপর বললেন- চলে যা গোসাবার
ঘাটে। ইশারা করে ছেলেটাকে চিনিয়ে
দিস আমাকে।
- ঠিক আছে স্যার!
এ কথা বলে মাথা নেড়ে চলে গেল সোর্স।
মনে মনে একটা ছক
কষে নিলেন যতীন দারোগা। সাদা পোশাকের দুজন ফোর্সকে বলে
রাখলেন। খবর দিলেন লঞ্চের ড্রাইভারকে। খেয়ে-দেয়ে বিকেল বেলায় যখন থানা থেকে বের হবেন, তখন বড়বাবুর সাথে দেখা। হতবিস্ময়ে তিনি শুধালেন- কোথায় চললে যতীন?
- স্যার! আপনাকে
বলা হয়নি। পলাশের একটা খবর পেয়েছি, দেখি কী করতে
পারি?
বড়বাবু উৎসাহিত
হয়ে বললেন- ঠিক আছে। ব্যটাকে পেলে বেঁধে নিয়ে এস থানায়।
ওর জন্য আমাদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। অনেক কথা শুনতে
হচ্ছে।
প্রত্যুত্তরে
যতীন দারোগা বললেন- সে কথা বলতে স্যার! আমি থানার লঞ্চটা
নিয়ে ওপারের গোসাবা ঘাটে যাচ্ছি। যদি কোন খবর-টবর থাকে জানাবেন স্যার! আর আমাদের কাজ হলে আমরা ফিরে আসব স্যার।
পলাশের বয়স কম।
ওকে ধরতে গেলে খুব একটা জোর-জবরদস্তি করতে হবে না।
দুজন ফোর্স যথেষ্ট। তাই আর দেরি না করে উঠে পড়লেন লঞ্চে।
আধঘণ্টার মধ্যে লঞ্চ পৌঁছে গেল গোসাবা ঘাটে। ধারে কাছে আর কোনো ঘাট নেই। যা দু-একটা ছোটখাটো ঘাট আছে, সেখানে নৌকা লঞ্চ ভেড়ে না। যারা নিত্যপ্রয়োজনে যাতায়াত করে তারা এই গোসাবা
ঘাটটাই ব্যবহার করে। ঘাট থেকে নেমে যতীন দারোগা দুজন
কনস্টবলকে নিয়ে একটা চায়ের
দোকানে গিয়ে বসলেন। খবরের কাগজটা নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকেন। কিন্তু চোখ দুটো তার পড়ে থাকে সোর্সর দিকে।
দেখতে দেখতে
সময়ের কাঁটা ঘুরে যায় অনেকটা। মনের মধ্যে বিরক্তি এসে জড়ো
হয়। কিন্তু উঠতে পারেননা দোকান ছেড়ে। চা দোকানির চোখে ধরা পড়ে ব্যাপারটা। সাদা পোশাকে থাকলেও যতীন দারোগাকে
চিনতে পারে। উৎসাহের সাথে তাই জিজ্ঞাসা করে- আজ কেউ
আসবে নাকি স্যার?
গোসাবা থানায়
ভিজিটে এলে ছোট-বড় সব সাহেবকেই এই পথ দিয়ে যেতে হয়।
এতদিন চা-দোকানি তাই দেখে আসছে। তাই এই প্রশ্ন। সেই প্রশ্ন অনুধাবন করে যতীন দারোগা চাপা স্বরে বললেন- আলিপুর
থেকে অ্যাডিশনাল সাহেবের আসার কথা আছে, তাই অপেক্ষা করছি। তা তুমি একটু চা খাওয়াও দেখি।
দোকানি ভালো করে
তিন কাপ চা বানিয়ে দিল। সাথে বিস্কুটও দিল। ধীরে ধীরে
চা বিস্কুট খেলেন যতীন দারোগা। দেখতে দেখতে সূর্য ঢলে পড়লো পশ্চিমাকাশে। না, আর দেরী করা উচিৎ
হবেনা। বড়বাবু তাদের ফেরার অপেক্ষায়
খুব চিন্তা করছেন। এসব কথা ভেবে যতীন দারোগা উঠে দাঁড়ালেন। আর ঠিক সেইসময় চোখের ইশারায় সোর্স তাকে ডাকল। যতীনদারোগা ফোর্স
দুজনকে সাথে নিয়ে তার কাছে পৌঁছে গেলেন। সোর্স অস্ফুট স্বরে বলল- সামনের লাল জামা পরে যে ছেলেটা লঞ্চ ধরবে বলে যাচ্ছে, ওই পলাশ।
যতীন দারোগা আর
দেরি করলেন না। তড়িৎ গতিতে ছেলেটির কাছে পৌঁছে, পেছন দিক থেকে
তার কাঁধে হাত রেখে বললেন- পলাশ!
ছেলেটি পিছনের
দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে যতীন দারোগাকে দেখে অস্ফুট স্বরে বলল- হ্যাঁ, আমি পলাশ।
- কচুবেড়েতে
বাড়ি?
মাথা দুলয়ে পলাশ
বলল-- হ্যাঁ, কিন্তু কেন?
সে কথার কোন
উত্তর না দিয়ে যতীন দারোগা বললেন- তুই আমাদের সাথে, আমাদের লঞ্চে যাবি। তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে।
ছোট হলেও পলাশ
বুঝে যায় সে পুলিশের খপ্পরে পড়েছে। তাই সাফাই দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল- কিন্তু স্যার! আমি তো কোন অপরাধ
করিনি।
যতীন দারোগা
বললেন- সেটা বোঝা যাবে থানাতে গেলে।
এ কথা বলে তার
হাতটা ধরে জোর করে যতীন দারোগা তাকে নিয়ে গেলেন
নিজেদের লঞ্চে। একরাশ বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে দেখল লঞ্চের অন্যান্য যাত্রীরা। কেউ দেখলো সাদা পোশাকে পুলিশের
দাদাগিরি। কেউ দেখলো অভিযুক্ত
পলাশকে। কেউ কেউ ধন্ধে পড়ে গেল। এতোটুকু একটা ছেলেকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন? কি অপরাধ করেছে সে?
গোসাবা ঘাট থেকে
থানাঘাটে লঞ্চটা যখন পৌঁছল, তখন রাত প্রায় সাতটা। বড়বাবু থানায় তার চেম্বারে বসে ছিলেন।
যতীন দারোগা পলাশকে সাথে নিয়ে তার চেম্বারে ঢুকে
বললেন- স্যার! এই আপনার পলাশ।
বড়বাবু পলাশের
দিকে তাকিয়ে আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে দেখলেন। সহজ-সরল চোখ মুখ। একেবারে ভাবলেশহীন।
দেখে মনে হলো না, সে কোনো কুকাজ করতে পারে। তবুও মনের সংশয় কাটাতে পলাশের চোখে চোখ রেখেশুধালেন- অঞ্জলিকে চিনিস?
কয়েক মুহূর্ত
চিন্তা ভাবনা করে পলাশ বলল- কেন চিনব না
স্যার? অঞ্জলি আমার বোন, কাকার মেয়ে।
- সে এখন কোথায়?
- তা আমি জানি না
স্যার! আমি কদিন বাড়িতে ছিলাম না। অঞ্জলি থাকলে, বাড়িতেই থাকবে। কোথায় যাবে স্যার?
- শুনছি, তাকে নাকি তুই নিয়ে গেছিস কোথাও?
- এ কথা কে বলল
স্যার? আমি তো ক্যানিংয়ের একটা চায়ের দোকানে কাজ
করছিলাম।
- কেন মিথ্যে কথা
বলছিস? ধমক দিয়ে বড়বাবু বললেন- সত্যি কথা বল। সত্যি কথা বললে তোকে ছেড়ে দেব। না হলে জেলের ঘানি টানাব।
সম্ভাব্য বিপদের
কথা শুনে টলটল করে উঠলো পলাশের দুচোখের জল। নিঃশব্দে সেই
চোখের জল গড়িয়ে পড়ল তার দুই গন্ডুস বেয়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলল- আমি কিছুই জানিনা স্যার! কেউ আমার নামে মিথ্যে করে অভিযোগ করেছে।
প্রায় দু'ঘণ্টা ধরে নানাভাবে পলাশকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, কিন্তু অঞ্জলির সম্বন্ধে
কোন ফলপ্রসু সংবাদ পাওয়া গেল না পলাশের কাছ থেকে। উপরন্তু পলাশের কথা ভেরিফাই করার জন্য ওসি ক্যানিংয়ের সাথে যোগাযোগ করলেন বড়বাবু। তার কাছ থেকে জানতে পারলেন, ঘটনার দিন থেকে সে ওই
চা দোকানে কাজ করছে। তাহলে মাস্টারমশাই মিছিমিছি তার নামে কেন অভিযোগ করল? কি তার উদ্দেশ্য? এই মিথ্যা
অভিযোগের প্রমাণটাই বা
কোথায়? একটা সিধেসাধা ছেলেকে কারণ ছাড়া মিছেমিছি পাঠিয়ে দেবেন জেলে? আবার না পাঠিয়ে
দিলে তো উপায় নেই। যেভাবে মন্টুমাস্টার যঁকের
মতো পিছনে লেগে আছে, একটু কিছু নড়বড়
হলেই তাদের জেলে যেতে হবে। ঘোর সংকটের মধ্যে পড়ে
গেলেন বড়বাবু! এখন কি করবে যতীন
দারোগা? অঞ্জলিকে যে পলাশ অসৎ উদ্দেশ্যে কোথাও নিয়ে যায়নি, কোথাও রেখে আসেনি, তার প্রমাণ কোথায়? সেই প্রমাণ খুঁজে বার করতে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। জিজ্ঞাসাবাদে যদি কাজ
না হয়, তাহলে তার থার্ডডিগ্রী
প্রয়োগ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না। কিন্তু থার্ড
ডিগ্রি প্রয়োগ করতে বিবেকে বাধলো বড়বাবুর। তিনি পলাশকে কাছে বসিয়ে অনেক ভাল মন্দ কথা বললেন। একসময় জিজ্ঞাসা
করলেন-- তোর কাকার সাথে তোদের বিবাদ কেন? কেন তোর কাকা তোর
নামে এত বড় একটা মিথ্যা অভিযোগ করল? এর পিছনে কি কারণ থাকতে পারে?
পলাশ বলল- আমি তা
বলতে পারবো না স্যার! তবে একটা সন্দেহের কথা
আপনাকে বলতে পারি। আমি বেশ কয়েকদিন ভোম্বলদার পিছনে ঘুরছিলাম। ভোম্বলদা আমাকে চায়ের দোকানের চাকরিটা করে দিয়েছে। কিন্তু কাকার তা সহ্য হচ্ছিল না। আমাকে বারবার
নিষেধ করছিল ভোম্বলের সাথে মিশবিনা। আমার মনে হয় আমার বাবার খুন হবার ব্যাপারে কিংবা অন্যকিছু ব্যাপারে ভোম্বলদা কিছু জানতে
পারে। তা না হলে তার সঙ্গে
মেলা মেশা করা নিয়ে কাকা নিষেধ করবে কেন?
- কিন্তু অঞ্জলির
ব্যাপারটা তো আমরা বুঝতে পারছি না। যতীন দারোগা বললেন-
তোর সাথে অঞ্জলি যাইনি তো, সে কোথায় গেছে? জলজ্যান্ত কর্পুরের মত উবে গেল নাকি?
- একটা কথা বলব
স্যার! কিছুটা ইতস্ততঃ করে পলাশ বললো কথাটা।
বড়বাবু বললেন-
বল কি বলতে চাস।
-আমাকে স্যার
দূটো দিন সময় দেবেন? আমি খুঁজে এসে
বলতে পারি।
যতীন দারোগা
মৃদুহেসে বললেন- তোকে ছেড়ে দিয়ে
আমরা হাত কামড়াব নাকি? উপর থেকে প্রচন্ড চাপ আছে। তোকে জেলে না পাঠানো পর্যন্ত আমাদের একটুও স্বস্তি নেই।
-তাহলে আর কি করব
স্যার? খুব নিরাশ হয়ে পলাশ বলল- জেলের ভাত যখন আমাকে খেতেই হবে, তখন আর এসব কথা
বলে লাভ কি? তবে অঞ্জলি একদিন না একদিন ফিরে আসবে বাড়িতে। সেদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে
দেখে নেবেন, আমি সত্যি কিছু জানি কিনা?
পলাশ আরও অনেক
কথাই বলল। তারপর পলাশকে পাশের রুমে পাঠিয়ে যতীন
দারোগার সাথে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আলাপ আলোচনা করলেন বড়বাবু। অবশেষে ভালো-মন্দ বিচার
করে পলাশকে ছেড়ে দিয়ে জুয়া খেলতে চাইলেন
বড়বাবু। পলাশের সরলতা, সত্যকথা বলার
অভিলাষ, খুব আকৃষ্ট করেছিল
বড়বাবুকে। সর্বোপরি সে একটা অনাথ ছেলে। তার পিছনে কেউ নেই। যে তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবে। এসব কথা
চিন্তা ভাবনা করে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। তাই
যতীন দারোগার সাথে প্ল্যান-প্রোগ্রাম
করে পলাশকে চেম্বারে ডেকে বললেন- তোকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি, তবে একটা শর্ত
আছে। দুদিনের মধ্যে যদি অঞ্জলির কোন খোঁজখবর না পাস, তাহলে থানাতে এসে আমাদেরকে বলতে হবে। পরবর্তী পদক্ষেপে আমরা কি করব না করব সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করব।
পলাশ বলল- আমি
রাজি স্যার!
সেই রাতেই যতীন
দারোগা তাকে খাইয়ে দাইয়ে ছেড়ে এলেন গোসাবাঘাটে।
নমস্কার জানিয়ে পলাশ হারিয়ে গেল অন্ধকারে। পলাশের এই ধরা পড়ার খবরটা কেমন করে যেন চাউর হয়ে গেল। সেকথা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে
মন্টু মাস্টারের কানে গিয়ে পৌঁছল। পলাশ ধরা পড়েছে সেই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল তার মন। সেই খুশিতে কেসের
সাক্ষীদের ডেকে জলযোগ
সহকারে চা বিস্কুট খাওয়ালেন মন্টুবাবু। পুলিশের কাছে সাক্ষী হিসেবে তাদের কি কি বলতে হবে তারও মহড়া দিলেন। হাতে গুজে দিলেন প্রণামী
টাকা। আর মনে মনে ভাবলেন যত বেশি দিন পলাশ জেলের ভিতর থাকবে, ততদিন তার মঙ্গল।
তার পথ থাকবে কন্টকহীন। তবে এই দুটো দিন ভুলেও থানাতে পা রাখবে না মন্টুবাবু। থানায় গেলে তাকে দেখে তার ভাইপো পলাশ খুব
কান্নাকাটি করবে। আমাকে বাঁচাও বলে চোখের জল ফেলবে। তাতে তার অসুবিধে হবে। তাকে ছাড়িয়ে আনতে না পারলে, পরে তাকেই দোষারোপ
করবে পলাশ। তার চেয়ে কিছু জানতে পারেনি বলে দোষ এড়ানো যাবে।
এদিকে
মুক্তবিহঙ্গ পলাশ পরদিন সন্ধ্যাবেলায় ফিরে এলো থানাতে। তাকে দেখে উৎফুল্লতায় ভরে উঠলো যতীন দারোগার মন। চোখে মুখে আনন্দের বান বয়ে গেল বড়বাবুর। তথাকথিত অপরাধী পলাশকে
বিশ্বাস করে তারা যে ভুল
করেনি, সে কথা উপলব্ধি হল। পলাশ যে তাদের কথা রেখেছে, তা দেখে খুব খুশি
হলো তারা। কিন্তু কি সংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে পলাশ? তা জানার জন্য
উদগ্রীব হলো তাদের মন।
পলাশ বলল- স্যার
অঞ্জলিকে আমি দেখে এসেছি কাঁঠালবেড়িয়া গ্রামে। স্কুলের মাঠে খেলা করছে সে। ওখানে ওর মামার বাড়ি। শুনলাম
কাকা নাকি ওকে রেখে এসেছে ওখানে।
- তা তুই ওকে
সঙ্গে করে নিয়ে এলি না কেন? মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেললেন যতীন দারোগা।
- অঞ্জলীকে নিয়ে
আসতে গেলে আরও একটা গোল বেধে যেত ওখানে। আরো একটা
কেস করে দিত ক্যানিং থানাতে।
একথা শুনে পলাশের
দিকে তাকিয়ে বড়বাবু বললেন- আরে পলাশ! ওখানে গেলে
অঞ্জলিকে পাওয়া যাবে তো?
- কেন পাওয়া
যাবে না স্যার? বেশ জোর গলায় পলাশ বলল।
- তাহলে এক কাজ
কর, ছোটবাবুর কাছে আজ রাতে এখানে থেকে যা। কাল ভোরবেলা
ছোটবাবুকে সাথে নিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়বি কাঁঠালবেরিয়া
গ্রামে যাবার জন্য। সেখান থেকে অঞ্জলিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে ছোটবাবু। অঞ্জলিকে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করব। সে যদি
বলে তুই কিছুই জানিস না, তাহলে তুই মুক্তি পাবি। না হলে সোজা জেল। কথাটা মনে রাখিস।
বড়বাবুর কথা
শুনে মাথা নেড়ে সায় দিল পলাশ। সেই রাতে যতীন দারোগার সাথে খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ল। যতীন দারোগা
তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে অনেক কথা জেনে
নিলেন। ভোরের সূর্য উঠতে না উঠতেই সাদা
পোশাকের পুলিশ ও পলাশকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন যতীন দারোগা।
পলাশ এরেস্ট
হয়েছে শুনে মনে মনে যতটা খুশি হয়েছিলেন মন্টুবাবু, তারচেয়ে অনেক
বেশি ক্ষুব্ধ হলেন তিনি। তাঁর সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠল। রাঙা হয়ে উঠল তার দুই চোখ। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন পুলিশ
প্রশাসনের প্রতি। বড়বাবুর
প্রতি। তিনি ভেবেছিলেন তার মেয়ে অঞ্জলিকে অপহরণের দায়ে পলাশকে পাঠিয়ে দেবে আলিপুর কোর্টে। কিন্তু তা না করে
তাকে নাকি ছেড়ে দিয়েছে বড়বাবু। এত বড় দুঃসাহস!
এত বড় বেইমানি! তাকে কোন খবর না
দিয়ে ইচ্ছেমতো পুলিশরাজ চালিয়ে যাচ্ছে বড়বাবু! রাগে সারা শরীরটা জ্বলে ওঠে
মন্টু মাস্টারের। একটা বিহিত করতে হবে। না হলে এই ধরনের
কাজ করেই চলবে বড়বাবু। তার মতো ছোটখাটো পঞ্চায়েত
সদস্যদের কেয়ার করবে না। এর জন্য তাকে সবক শেখাতে হবে। আর সবক শেখাতে হলে জনগণকে সাথে নিয়ে থানা ঘেরাও করতে হবে। এসব কথা ভেবে গ্রামের বেশকিছু লোকজনকে একত্রিত করলেন মন্টুবাবু। সরকারি ইস্কিমের কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে তাদের
হাতে গোপনে গুঁজে দিলেন।
তারপর একটা লঞ্চ ভাড়া করে বিকেলবেলায় পৌঁছে গেলেন থানায়।
থানায় পৌঁছে
সমবেত স্বরে 'জবাব চাই' 'জবাব দাও' বলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন। মাতলা নদীর উচ্ছ্বাস তরঙ্গের মত সেই
চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল সারা গোসাবাথানা জুড়ে। সেই ঢেউ
আছড়ে পড়ল আশেপাশের দশটা গ্রামে।
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে থানায় এসে বসলেন বড়বাবু। তাকে দেখে চিৎকারের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। ক্ষোভে ফেটে পড়তে
চাইল মানুষজন। বড়বাবু কথা বলার জন্য ডেকে পাঠালেন
মন্টুবাবুকো। মন্টুবাবু পাঁচ সাতজন অসভ্য বর্বর নিয়ে ঢুকলেন বড়বাবুর চেম্বারে।
বড়বাবু জানতে চাইলেন-
কিসের জন্য থানার সামনে এরকম চিৎকার চেচামেচি? কিসের জবাব পেতে
চায় মন্টুবাবুরা?
মন্টুবাবু বললেন-
আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি, আমার মেয়ে অপহরণ কেসে অভিযুক্ত পলাশকে ধরে জেলে না পাঠিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। আমার মেয়ে এখনো কেন উদ্ধার হল না? কেন আসামীকে জেলে পাঠানো হলো না? তার জবাব চাই
আমরা।
- আপনারা ভুল
সংবাদ পেয়েছেন। অত্যন্ত বুঝে শুনে, সতর্কতার সাথে বড়বাবু বললেন- পলাশকে আমরা ছেড়ে দিইনি। পলাশ আমাদের কাষ্টডিতে আছে। তাকে ছাড়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
- তাহলে সে গেলো
কোথায়? তাকে তো থানায় দেখছিনা। মন্টুবাবুর সাথে আসা সুবল দাস বলে একটি লোক মন্তব্য করল।
এসব নিয়ে যখন
বাকবিতণ্ডা চলছিল, তখন অঞ্জলিকে
সাথে নিয়ে থানায় ঢুকলেন
যতীন দারোগা। মেয়েকে সামনে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন মন্টুবাবু। তিনি ভেবে পেলেন না কিভাবে তার মেয়ের খোঁজ পেল
পুলিশ? যতীন দারোগা বললেন- এই আপনার মেয়ে। কাল ওকে
কোর্টে পাঠিয়ে দেব।
যতীন দারোগার কথা
শুনে ঘোর কাটে মন্টুবাবুর। তাহলে কি অঞ্জলি সত্যকথাটা বলে
দিয়েছে যতীনবাবুকে? ব্যাপারটা
যেভাবেই হোক ধামাচাপা দিতে হবে।
মেয়েকে আলাদা করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে হবে। একথা ভেবে মন্টুবাবু বললেন- আজ আমি ওকে
বাড়িতে নিয়ে যাই স্যার! কাল সকালে আপনার কাছে এনে
দেব স্যার। একা বাচ্চা মেয়ে, এখানে রাত কাটাবে কিভাবে? তাছাড়া….।
- তাছাড়া…. ওকে
নিয়ে আর আপনাকে ভাবতে হবে না মন্টুবাবু। মন্টুবাবুর মুখের
কথা কেড়ে নিয়ে যতীন দারোগা বললেন- ও আসল সত্য কথাটা বলে দিয়েছে আমাদের কাছে। পলাশ অঞ্জলিকে নিয়ে গিয়ে
কোথাও তোলেনি। অঞ্জলিকে ওর মামার বাড়িতে রেখে আসেনি।
ভাইপোর নামে কেস করার জন্য
আপনি ওকে রেখে এসে ছিলেন। মেয়ের মুখে সে কাহিনি শুনবেন নাকি?
সম্পূর্ণ দোষটা
তার ঘাড়ে চাপাচ্ছে দেখে আর চুপ করে থাকতে পারলেন না
মন্টুবাবু। রাজনীতির পোড় খাওয়া মানুষ। পঞ্চায়েত সদস্য। দাবার ঘুঁটি চালতে তিনি সিদ্ধহস্ত। সাথে সাথে তাই প্রতিবাদ
করে তিনি বললেন- এ কখনোই হতে
পারেনা। অঞ্জলিকে আপনারা ভয় দেখিয়ে আপনাদের উদ্দেশ্য
সিদ্ধি করতে চাইছেন। অঞ্জলিকে আপনাদের হাতে আমি ছেড়ে দিয়ে যাব না। দরকার হলে আমরা এখনি যোগাযোগ করে আপনাদের সুপিরিওর অফিসারদের জানাব। দরকার পড়লে থানা ভাঙচুর
করে নিয়ে যাব আমার
মেয়েকে।
যতীন দারোগার
সত্যভাষণে এক অন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হল। চিৎকার-চেঁচামেচি, হৈ হট্টগোল শুরু হল থানার মধ্যে। শুরু হলো
ভাঙচুর। উপায়ন্তর না দেখে
বড়সাহেবের আদেশ মতো অঞ্জলিকে তুলে দিতে হলো তার বাবার কাছে।