'উত্তর মেঘ' আবাসনের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে গ্যারেজ। আবাসনের অধিকাংশ আবাসিকেরই নিজেদের গাড়ি আছে। মোটামুটি সমভ্রান্ত লোকের বাস। আবাসনে ঢোকার মুখে চওড়া লোহার গেট পেরিয়ে সিকিউরিটি গার্ড অফিস। অতিথি অভ্যাগতদের সেই অফিস রেজিস্টারে নামের সাথে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য লেখানোর পরে, তাদের আবাসনে প্রবেশের অধিকার মেলে। আবাসনের চারপাশে বিভিন্ন প্রকারের গাছের সমারোহ, আবাসনটিকে আরো সুন্দর করে তুলেছে।
সর্বজিৎ সেন, 'উত্তর মেঘ' আবাসনের পরিচালন কমিটির সেক্রেটারি । কলকাতার বুকে দু-দুটো গারমেস্টস এর বিজনেস । ব্যবসার খাতিরে প্রতিদিন সকাল দশটার মধ্যে বেরোতে হয়। আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হচ্ছে তাকে ।
- গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে ঠিক বেরোনোর মুখে রাস্তার ওপর একটি ছোট্ট ছেলের কথায় গাড়ি থামিয়ে দিলেন।
- স্যার, আমি আপনার সাথে দেখা করতেই এসেছি। কিন্তু গেটের দারোয়ানরা আমাকে ঢুকতে দেয়নি । তাই ছেলেটাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে সর্বজিৎ বাবু বললেন, শোনো, আমি খুব ব্যস্ত আছি, তুমি কাল সকালে আমার বাড়ি চলে এসো, কেমন!
- কিন্তু আমাকে তো দারোয়ানরা আটকে দেবে।
- না, না কাল আর তোমাকে আটকাবে না। নাম বললেই ছেড়ে দেবে।
- আমার নাম তো ঋজু । ঋজু মণ্ডল । ওই কলপাড়ের বস্তিতে থাকি । ঋজু বেশ
স্ফূর্তিতেই কথাগুলো বলল।
- ঠিক আছে, কাল সব শুনব! ঋজুকে কথা দিয়ে সর্বজিৎ বাবু এগিয়ে গেলেন। সর্বজিৎ বাবুর গাড়িটা মিলিয়ে যাওয়া অবধি ঋজু সেদিকেই চেয়ে রইল।
পরদিন সকালে মর্নিংওয়াক সেরে ফেরার মুখে সর্বজিৎ বাবু দেখেন, আবাসনের গেটে ঋজু দাড়িয়ে।
-আরে এত সকালে তুমি চলে এসেছ! আচ্ছা বলো, আমার কাছে কেন এসেছ?
- স্যার, আমি জানতে পেরেছি বাবুদা কয়েকদিনের জন্য ছুটিতে গেছে।
-হ্যাঁ, বাবু তো আমার গাড়ি ধোওয়ার কাজ করে। তুমি বাবুকে চিনলে কী করে?
সর্বজিতবাবু ঋজুর কাছে জানতে চাইলেন ।
- বাবুদা তো কলপাড়ের কাছেই থাকে৷ বাবুদা আমাকে খুব ভালবাসে। বাবুদা এলে জিজ্ঞেস করবেন। স্যার, বলছিলাম বাবুদা না আসা অবধি আমি রোজ সকালে এসে আপনার গাড়ি ধুয়ে দেব।
- তুমি এত ছোট ছেলে, পারবে কি অতবড় একটা গাড়ি ধুতে।
- পারব, ভাল ভাবেই পারব তারজন্য অবশ্য আমাকে কোন টাকা দিতে হবে না। ঋজু খুব জোর দিয়ে বলল।
- তার মানে? তুমি বিনা পয়সায় কাজ করবে, তা কি করে হয়! সর্বজিৎ বাবুর গলায় কৌতুহলের সুর ।
- ঠিক আছে আমার টাকাটা বাবুদাকে দিয়ে দেবেন। তারপর বাবুদা যা দেবে আমি তাই নেব। সর্বজিৎ বাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন ঋজুর দিকে। আজ এইরকম একটা অবক্ষয়ের যুগে এমন একটি নির্লোভ ছেলে, সর্বজিৎ বাবুকে বিস্মিত করে তুলল।
- তুমি যে গাড়ি ধোওয়ার কাজ করবে, তোমার বাবুদা জানে?
- না, বাবুদাকে কিছু বলিনি, তবে বাবুদা কিছু মনে করবে না। বরং বলবে, ভালই করেছিস্, সাহেবের গাড়িটা এতদিন পরিষ্কার রেখেছিস ঋজুর কথা শেষ না হতেই সর্বজিৎ বাবু মানিব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে বললেন, - এই নাও, যাওয়ার সময় একটু চা বিখুট খেয়ে যেও।
- না স্যার, আমি রুটি আর চা খেয়ে বেরিয়েছি। টাকা আমার লাগবে না। ছোট্ট
ছেলেটার সততা আর দৃঢ়চেতা মনোভাবে সর্বজিতৎবাবু আরো একবার অবাক হয়ে গেলেন।
যথারীতি সপ্তাহে চারদিন সকালে এসে সর্বজিৎবাবুর গাড়ি ধোয় ঋজু। আবাসনের কল থেকেই প্লাস্টিকের বালতিতে জলভরে আনে সে। তারপর একটা মোটা তোয়ালে সেই জলে ভিজিয়ে গাড়িটা মুছতে থাকে। তার কাজে এতটুকু ফাকি নেই প্রথম দুদিন সর্বজিৎ বাবু ঋজুর কাজ দেখে একেবারে মুগ্ধ ৷ এতটুকু ছেলে, অথচ কাজের প্রতি তার কি নিষ্ঠা, কি যত্ব। তিনি মনে মনে স্থির করে ফেলেন, যতই আপত্তি করুক । মাস গেলে ছেলেটার হাতে শ পাঁচেক টাকা তুলে দেবেনই। আজ গাড়ি ধুতে ধুতেই হঠাৎ যেন ঋজুর মনটা
ভাল হয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেক দিন পর মাকে খুব সুস্থ লেগেছে তার। গত সপ্তাহের সবটাই কেটেছে মার অসুস্থতা নিয়ে। মা আর ছেলের সংসারে অভাব যেন নিত্যসঙ্গী। কোন রকমে খাবার জোটে তো পথ্যি জোটে না, পথ্যি জোটে তো খাবার জোটে না। এই ছোট্ট জীবনে কোন দুঃখ ঋজুকে ছুঁতে পারে না।
একমাত্র মায়ের কিছু হলে সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। আর্থিক টানাটানিতে সেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে তার অনেক সময় লেগে যায়। মায়ের একটু শরীর খারাপ হলেই সে ডাক্তার ভৌমিকের কাছে ছুটে যায়।
সেদিনও সে মাকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারবাধুর কাছে গিয়েছিল। পরীক্ষা করে ডাক্তার বাবু বলেছিলেন, সর্দিটা বুকে ভালই বসে গেছে। সারতে সময় লাগবে। তারপর দুটো দামী ওষুষের নাম লিখে দিয়ে বলেছিলেন, সবগুলো ওষুধ ঠিকমতো না খেলে অসুখ সারবে না। ডাক্তার বাধুর নির্দেশ মতো ওষুধ খেয়ে আজ সকালে তার মা একেবারে সুস্থ হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আজ হয়তো তাকে কাজে বেরোতে হবে।
সপ্তাহে চারদিন সকালে গাড়ি ধোওয়ার কাজের কথাটা ঋজু আজই প্রথম জানালো তার মাকে। বাবুদা ছুটি থেকে ফিরে এলে তাকে আর এই কাজ করতে হবে না। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই ঋজুর গাড়ি ধোওয়া শেষ হয়ে যায়। তারপর আবাসনের স্টোররুমে বালতি, মগ আর তোয়ালেটা রেখে দিয়ে বাড়ির পথে সে পা বাড়ায় ।
বাবুর মতই ছেলেটার কাজও খুব পরিষ্কার। দুদিন তার কাজ করার ধরন দেখেই সর্বজিৎ সেন বুঝেছেন, কাজের প্রতি ছেলেটার যত্ন ও আগ্রহ দুইই আছে। একটা কথা ভেবে তার খুব আশ্চর্য লাগে, টাকা পয়সার প্রতি ছেলেটার কোন লোভ নেই। মা ছাড়া আপন বলতে আর কেউ নেই। তিন সপ্তাহ হয়ে গেল, ঘড়ির কাটা ধরে কাজ করতে আসে ছেলেটা। সময়ের এতটুকু নড়চড় হয় না। সর্বজিৎ সেন আর স্ত্রীবিদিশার ভারী ইচ্ছে ছেলেটা হাতে কলমে কিছু শিখুক। স্ত্রীর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে সর্বজিৎ সেন বলেছেন, ঋজুর কতই বা আর বয়স। সবে ক্লাস সেভেন। মাধ্যমিক পাশের পর একটা ব্যবস্থা উনি করবেন, সেইরকম একটা পরিকল্পনা তারও আছে।
যেদিন থেকে ঋজু কাজে লেগেছে, সেইদিন থেকে সপ্তাহে চারদিন বিদিশাই সকালের জলখাবার করে রাখে ঋজুর জন্য। ঋজু প্রথমে রাজী হয়নি, কিন্তু
বিদিশার কাছে তার কোন আপত্তি টেকেনি।
ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা । কলিং বেলটা বেজে উঠতেই সর্বজিৎ সেন টাইমস অফ ইন্ডিয়া পেপারটা সেন্টার টেবিলে রেখে দরজাটা খুলে দিলেন। দরজার ওপারে ঋজু দাড়িয়ে।
- আরে আয় আয় ভেতরে আয়। আদেশ পেয়ে ঘরে প্রবেশ করে ঋজু।
- স্যার, আমার তো একমাস হয়ে গেল। পরশুদিন থেকে বাবুদা কাজে যোগ দেবে। আমি আর আসব না।
কিন্তু সর্বজিৎ সেন লক্ষ্য ঝরলেন, ঋজু চোখে মুখে একটা ভয়ের ছায়া।
-কি হয়েছে ঋজু? কিছু হারিয়েছে? খজুকে প্রশ্ন করেন তিনি ৷
- না, আমার কিছু হারায়নি। হারিয়েছিল আপনার। আমি জেনেশুনে অপরাধ করেছি। আমাকে আপনি শান্তি দিন।
- তোর কথার মাথা-মুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি হয়েছে আমাকে বল। ঋজু ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। ভেতর ভেতর মনটাকে সে শক্ত করে নেয়। তারপর সাহস করে প্যান্টের পকেট থেকে একটা দামী মানিব্যাগ বের করে সর্বজিৎ সেনের হাতে তুলে দেয়।
- স্যার, এটা আপনার হারিয়ে-যাওয়া মানিব্যাগ। একমাস আগে রাত নটা নাগাদ রাতের রুটি নিয়ে আপনাদের আবাসনের পাশ দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় এই মানিব্যাগটা পেয়েছিলাম। খুলে দেখলাম, ব্যাগের ভেতর আপনার ছবি আর সাড়ে ছশো টাকা। সেদিন রাতেই মানিব্যাগটা আপনাকে ফেরত দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেইসময় মায়ের শরীর এত খারাপ যে আমি পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। চিকিৎসার জন্য ঘরে টাকা ছিল না। এ টাকাগুলো আমি আমার অসুস্থ মায়ের জন্য খরচ করেছি। সাড়ে ছশো টাকা ফিরিয়ে দিতে পারব না জেনে বাবুদার এই কাজটা করলাম। মা এখন আগের মত সুস্থ হয়ে গেছে। এবার আপনি যে শাস্তি দেবেন, আমি মাথা পেতে নেব। কথাগুলো বলে ঋজু সর্বজিৎ সেনের পায়ে লুটিয়ে পড়ল। দুহাতে ঋজুকে তুলে ধরে তিনি বললেন -
- আরে ওঠ ওঠ। তুই কত বড় কাজ করেছিস জানিস? মায়ের সেবা করেছিস। এর চেয়ে বড় আর মহৎ কাজ যে কিছুই হয় না। সাড়ে ছশো টাকা দিয়ে আমি হয়তো ভালো ভালো কিছু খাবার কিনে খেতে পারতাম। কিন্তু সেই টাকাটা এত সুন্দর একটা কাজে লাগল জেনে আমার মন ভরে গেল । এখন বুঝতে পারছি, সাড়ে ছশো টাকার বিনিময়ে তুই একমাস বাবুর কাজটা বিনা পারিশ্রমিকে করে গেলি। তোর নাম ঋজু। ঋজু মানে কি জানিস ? ঋজু মানে সোজা। তুই খুব সোজা ছেলে। তর চিন্তাধারা, মানসিকতায় কোন বক্রতা নেই। আজকের দিনে সোজা মানুষ তো প্রায় হারিয়েই গেছে। আজীবন দেবদারু গাছের মত শিরদাঁড়া সোজা করে থাকবি দেখবি তুই কোনদিন হারবি না।
দুজনের কথাবার্তার মাঝে হঠাৎ সর্বজিৎ সেনের স্ত্রী বিদিশা ঋজুর জলখাবার নিয়ে হাজির ।
- আমি ভেতর থেকে তোমাদের সব কথাই শুনেছি। ঋজু তো তার পরিশ্রমের একটা টাকাও নেবে না বলেই দিয়েছে । তা ওর এই সততা, স্বচ্ছ মানসিকতার কি মুল্য দেবে ঠিক করেছ?
স্ত্রীর প্রশ্নে সর্বজিৎ সেন হাসতে হাসতে বলেন- শোন, আমি তোর লেখাপড়ার সব ভার নিলাম।
“আমি চাই তুই লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হ'। জলখাবার খেয়ে এখন চল, আমার কোম্পানির কিছু জামা প্যান্ট তোকে উপহার দেব। তুই নিতে অস্বীকার করিস না।
কথা গুলো বলে সবজিৎ সেন পরম মমতায় ঋজুকে বুকের ভেতর টেনে নিলেন।
আর সেই মুহূর্তে জীবনের কঠোর রোদে তেতে পুড়ে যাওয়া ঋজুর মনপ্রাণ যেন বিশাল বটগাছের শীতল ছায়ায় জুড়িয়ে গেল।