লোককথা (চিন) । জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

 রক্তে রাঙ্গা পাহাড়











সঞ্জয় কর্মকার
মোরবি, গুজরাট




 

চিনদেশের হেইলং নদীর তীরে অনেক অনেকদিন আগে ছিল ডাউর উপজাতির বাস। শিকারির জাত এঁরা। শিকারই ছিল প্রধান জীবিকা। তারা চাষবাসও করত। জমির তো অভাব ছিল না নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ খোলা জমি। যার যতটা দরকার সেই পরিবার ততটা জমি নিয়ে নিত। বেশ মজার না? এদের বাড়িরও বিশেষত্ব আছে। বাড়ির পেছন দিকে পাহাড় আর সামনে ঝিরঝির করে বয়ে যাওয়া নদী থাকবেই থাকবে! আজ এই উপজাতির লোকেরা বেশির ভাগই মঙ্গোলিয়ায় থাকে। কিছু থাকে চিনের হেইলং প্রদেশে।

         অনেকদিন আগে এই ডাউরদের মধ্যে এক শিকারি ছিল খুবই বীর এবং শক্তিশালী। প্রকান্ড তার শরীর। বজ্রমুষ্ঠিতে অসম্ভব জোর। তীরধনুকে অব্যর্থ নিশানা। বুক ভর্তি সাহস। আর তার ছিল প্রভুভক্ত এক ঘোড়া শুনতে হয়ত আশ্চর্য লাগবে, এই ঘোড়ার ভাষা কেউ বুঝুক না বুঝুক, শিকারি ঠিকই বুঝতে পারত

        শিকারি সকালে শিকার করতে বের হয়, দিনের শেষে ফিরে আসে। বউ তার ঘরের কাজ সামলায়। বউয়ের খুব শিগগিরই বাচ্ছা হবে তাই শিকারির মনে খুব আনন্দ। কিন্তু রোজকার দিনচর্চায় একদিন হঠাৎ ছেদ পড়ল। শিকারি সকালবেলা বের হল ঠিকই, কিন্তু একটু পরেই মুখ গোমড়া করে ঘরে ফিরে এলো

        বউ চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?"

        “ভয়ংকর এক ঘটনার কথা শুনলাম," ভারী গলায় বলল শিকারি

        এরপর শিকারি যা বলল, তা শুনে সত্যিই গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। পশ্চিম দিকে বহু দিনের পথ গেলে এক বিশাল পর্বত পড়বে। যার উত্তর-পশ্চিম দিশায় এক সাংঘাতিক নিষ্ঠুর রাজার রাজ্য। এমন নিষ্ঠুরতা কল্পনাও করা যায় না। রাজা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গায়ের জোরে উপজাতিদের শাসন করেন। রাজার বিচিত্র সখ হল প্রতিদিন সকালে তিনি একশ বালক এবং দুপুরে একশ বালিকার বলি চড়ান। এখানেই শেষ নয়। সন্ধেবেলাতেও রাজার রক্ত দেখার নেশা। তখন পঞ্চাশজন বৃদ্ধ এবং পঞ্চাশজন বৃদ্ধার প্রাণ যায়। রাজ্যের সাধারণ প্রজা কেউ রাজার ওপর খুশি নয়। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারে না। যে প্রতিবাদ করব, সকলের আগে তার প্রাণ যাবে

        সব শুনে শিকারির বউ বলল, “এর কি কোনও বিহিত হয় না?"

       “কিছু তো করতেই হবে," বলল শিকারি, “আজ নয় নিজের রাজ্যের প্রজাদের মারছে। কিন্তু একদিন নিজের রাজ্যেও মানুষ কমে যাবে। তখন পাশের রাজ্য আক্রমণ করবে। সুতরাং এ শুধু তাঁর রাজ্যের সমস্যা নয়, আমাদের সকলের সমস্যা!"

        “কথাটা ঠিকই। কিন্তু কী করা যায় কিছু ভেবেছ কি?"

    “আমি মনস্থির করে ফেলেছি। এই শয়তান রাজার সাথে আমি আমৃত্যু লড়ব। রাজার মৃত্যু না হলে কারো রক্ষা নেই।"

    পরের দিন সকালবেলায় পেটপুরে খাবার খেয়ে নিলো শিকারি। তারপর তীরধনুক কাঁধে চাপিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল সে। বউকে বলে গেল, “লড়াই কতদিন চলবে তা জানি না। কুড়ি বছর চলতে পারে আবার তিরিশ বছরও চলতে পারে। ততদিন তুমি আমার সন্তানকে মানুষ কোরো। যদি বাঁচি তাহলে ফিরে এসে তার মুখ দেখব।"

       সূর্য অস্ত যাবার দিশায় চলেছে সে। দিনে চলে, রাতে জিরোয়। এইভাবে জানি না কত দিন কত মাস কেটে গেল। তারপর একদিন শিকারি হাজির হল বিশালকায় এক ত্রিকূট পাহাড়ের সামনে। ত্রিকূট পাহাড় হল তিন চূড়োওয়ালা পাহাড়। পাহাড়ের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল শিকারি। কাছে গিয়ে বিভৎস এক দৃশ্যের সম্মুখীন হল সে। রক্তের এক ধারা নদীর স্রোতের মতো পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে

        এমন দৃশ্য দেখলে কার না শরীরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে? মনে হয় এখনই গিয়ে নিষ্ঠুর রাজার মুন্ডসুদ্ধ ছিঁড়ে নিই! কিন্তু রাগ করলে চলবে না। দীর্ঘ ক'মাসের পথশ্রমে শিকারি তখন ক্লান্ত। এই অবস্থায় লড়াই হলে রাজার জেতার সম্ভাবনাই বেশি। এখন তাই এক দীর্ঘ গভীর ঘুম দরকার। সুতরাং পাহাড়ের পাদদেশে শুয়ে পড়ল শিকারি। ঘুমের সময় কেউ বিরক্ত না করে, তাই তীরগুলোকে নিজের চারপাশ ঘিরে মাটিতে পুঁতে দিল বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে ভেতরে কেউ শুয়ে আছে

        সে দেশের রাজাও সদাই সন্ত্রস্ত। তার সর্বদা চিন্তা রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা না দেয়। রাজার সেনা তাই চারিদিকেই টহল দিচ্ছে। তেমনই এক সেনাদল টহল দিচ্ছে পাহাড়ের আশেপাশে। অবাক হয়ে তারা দেখল পাহাড়ের পাদদেশে রাতারাতি জঙ্গল গজিয়ে গেছে। আরও অবাক কান্ড জঙ্গলের মাঝে রাতারাতি এক টিলাও গজিয়ে গেছে! তারা আসলে ভাবেনি, ওই বিশাল জঙ্গল হল শিকারির পোঁতা তীর আর টিলাটি হল শিকারির প্রকান্ড ঘুমন্ত শরীর!

        সৈন্যদল তো তৎক্ষণাৎ কুড়ুল-তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জঙ্গল কাটতে। মানুষের শোরগোল আর অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল শিকারির। সে ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখে রাজার সেনাদল কুচ কুচ করে তার তীর কাটতে শুরু করে দিয়েছে

        আর সময় নষ্ট করল না সে, মুহূর্তে একদলা মাটি ছুঁড়ে মারল তাদের পানে। আশ্চর্যের বিষয়, শিকারির ছোঁড়া মাটির দলা পলক ফেলতেই বিশাল একখন্ড পাথরের টুকরোয় পরিবর্তিত হল। সেই পাথরের আঘাতে কতজনের যে কোমর ভাঙ্গল আর কতজন প্রাণ হারাল, তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই! নিমেষে সেনাদল ছত্রভঙ্গ!

        যারা বেঁচেছিল, তারা রাজার কাছে সংবাদ দিতে গেল। দলপতির হাঁটু ঠকঠক করে কাঁপছিল। কম্পিত স্বরে সে বলল, “মহারাজ, পাহাড়ের পূবদিকে এক ভয়ংকর শত্রু দেখা দিয়েছে!"

     রাজা অগ্নিচক্ষু করে বললেন, “তোমাকে কি এই সংবাদ নিয়ে আসার জন্য পাঠানো হয়েছিল সেখানে? এই কে আছিস গর্দান নে ব্যাটার!"

        রাজার আদেশে আরও বড় এক সৈন্যদল ছুটল শিকারিকে ধরে আনতে। কিন্তু তাকে হারায় কার সাধ্য! শিকারির হাতে মার খেয়ে সকলেরই অবস্থা বলার মতো নয়। যারা এই লড়াই দেখেছিল তারা বলে একটা মাছের গায়ে যতগুলো আঁশ হয়, শিকারির মার খেয়ে প্রতিটি সৈনিকের গায়ে ততগুলোই আঘাতের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল

      তারপর লড়াইয়ে নামলেন স্বয়ং রাজা। সঙ্গে তার অন্তহীন সৈন্যদল। যেদিকে তাকাও খোলা তলোয়ার হাতে সৈন্য। পাহাড়ের পাদদেশে শিকারিকে ঘিরে ফেলল তারা। শিকারি তখন তীরধনুক হাতে নিল। সাঁ সাঁ করে তীর ছোঁড়ে শিকারি আর শয়ে শয়ে সৈন্য কাটা পড়ে। কিন্তু যত তীর ছোটে সৈন্য সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। এইভাবে লড়াই করতে করতে শিকারি একসময় দেখল তার তূণে একটা মাত্র তীর পড়ে আছে। শেষ তীরটা সে ছুঁড়তে যাবে, এমন সময় শিকারির মনে হল বিশ্বস্ত ঘোড়া তাকে কিছু বলতে চাইছে। কি বলছে? মন দিয়ে শুনল সে

        ঘোড়া বলছে, “মালিক, এমন ভুল ভুলেও করবেন না! রাজাকে মারার জন্য তীরটি বাঁচিয়ে রাখুন। রাজাকে মারা কিন্তু সহজ নয়। ওপর দিকে তাকিয়ে দেখুন। লোহিতবর্ণের ঈগলের ডিমে রয়েছে রাজার প্রাণ। ডিম ভাঙ্গলে তবেই রাজাকে তীর দিয়ে মারতে পারবেন।"

        কথাটা মিথ্যে নয়। ওপর দিকে তাকিয়ে শিকারি দেখল গাছের মগডালে সত্যিই এক ঈগলের বাসা। যদিও বাসাটা ভাঙ্গাচোরা। তরতর করে গাছ বেয়ে উঠে গেল শিকারি। লাল রঙের ডিমটা নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল রাজার উদ্দেশ্যে

        শিকারির হাতে ডিম দেখে রাজার মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। শিকারির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন রাজা। বললেন, “দয়া করো। তুমি আমার সমস্ত রাজ্য নিয়ে নাও, কিন্তু ডিমটা ভেঙ্গে দিয়ো না!"

        উত্তরে শিকারি বলল, “তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার মতো ভুল কি আমি করি!" এই না বলে হাতের মুঠোয় ডিমটা ভেঙ্গে ফেলল সে। তারপর তীরের এক আঘাতে রাজার ভবলীলা সাঙ্গ করল

        রাজার মৃত্যু হয়েছে। রাজার সেনা ছত্রভঙ্গ হয়েছে। চারদিকে রক্তের ছড়াছড়ি। পাহাড়ের ওপর থেকেও রক্তের একটা স্রোত তখনও নামছে। কোথা থেকে আসছে এই রক্তধারা? খোঁজ নিয়ে দেখতে হয়। শিকারি এবার ঘোড়া ছুটিয়ে দিল সেদিকে

        পাহাড়ের চূড়ায় একটা গুহা। সেই গুহামুখ থেকে রক্তধারা নামছে। ভেতরে ঢুকে যে দৃশ্য দেখল শিকারি তা বড়ই অমানবিক। পাথরের দেওয়ালে আংটার সাথে লোহার শেকলে বাঁধা শত শত অর্ধমৃত মানুষ। কেউ বা একেবারেই মৃত। এরা সকলে বিদ্রোহী সৈন্য যারা রাজার অন্যায় সমর্থন করেনি। শিকারির সাহায্যে সকলেই মুক্তি পেল

      শত্রুর শেষ রাখতে নেই। শিকারি এবারে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে। গন্তব্যস্থানের কাছাকাছিই পৌঁছে গিয়েছিল সে। শিকারির নজর তার। আকাশে উড়ে চলেছে লাল রঙের একটা ছোট্ট পাখি। এমন পাখি শিকারি জীবনে দেখেনি। এই পাখির কথাও আগে কখনও শোনেনি সে। সুতরাং সাধারণ পাখি এ নয়। লাল রঙের ডিমের কথা শিকারির মনে পড়ল। পাখিটাকে চোখের আড়াল করলে চলবে না

        উড়তে উড়তে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলে সেই পাখি। শিকারিও পিছু ধাওয়া করে চলেছে। রাণীমহলের কাছে এসে পাখিটা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথায় যে গেল, কিছুই বোঝা গেল না। শিকারির মনে হল প্রথমে রাণীমহলেই খোঁজ করে দেখা যাক। রাণীর শোয়ার ঘরে কে যেন রিনরিন স্বরে গান গায়। উঁকি মেরে দেখল শিকারি। লাল রঙের সেই পাখি অদ্ভুত এক গান গেয়ে চলেছে। পাখি গাইছিল

        “মন দিয়ে শোনো, বলি রাজার কুমার;

        রাজা মারা গেছে তার হয়েছে যে হার!

        দোলনায় শোওয়া আর চুষিকাঠি ছাড়ো

        এইবারে দশ দিনে এক ফুট বাড়ো

        প্রতিক্ষণে প্রতিপলে অতিদ্রুত বেড়ে

        প্রতিশোধ নাও তুমি শিকারিকে মেরে!"

        শিকারির বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না। ঘরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। হলুদ রঙের চুলের এক মহিলা রাজকুমারকে দোলনায় দোলাচ্ছিল। শিকারি ঘরে ঢুকতেই বিপদের আশঙ্কায় দোলনাটাকে ঠেলে দিল সে। বলল, “পালাও রাজকুমার! আমি শত্রুকে আটকে রাখছি।"

        দুধের শিশু রাজকুমারও কী সাংঘাতিক! এক লাফে দোলনা থেকে নেমে পেছনের দরজা দিয়ে ছুটে পালাল সে। মুহূর্ত মধ্যে ঘোড়ায় চড়ে সে অদৃশ্য হয়ে গেল

        শিকারিকে আটকানো মহিলার সাধ্য ছিল না। কিন্তু ততক্ষণে রাজকুমার প্রাসাদ ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছে। সৌভাগ্যের বিষয়, রাজপ্রাসাদের দেওয়ালে তীরধনুক টাঙ্গানো ছিল শিকারি তার থেকে চারখানা তীর বেছে নিল। তারপর ছুটিয়ে দিল তার ঘোড়া!

        টগবগ করে ছুটে চলেছে ঘোড়া

        “মালিক, শুনছ কি তুমি?" চলতে চলতে বলছে ঘোড়া

        “শুনছি," জবাব দিল শিকারি

      “মন দিয়ে শোনো তাহলে। রাজকুমারকে সাধারণ পদ্ধতিতে মারতে পারবে না তুমি। যে ঘোড়ায় চড়ে সে পালাচ্ছে, সেই ঘোড়ার ল্যাজে আছে একটা মাত্র সাদা চুল। সেখানেই আছে রাজকুমারের প্রাণ।"

  শিকারির ঘোড়া খুবই দ্রুতগতির। সুতরাং কিছুক্ষন পর রাজকুমারকে সে পেয়ে গেল হাতের মুঠোয়। শিকারির ছোঁড়া এক তীরের আঘাতে খসে পড়ল ঘোড়ার ল্যাজ। তারপর রাজকুমারকে মারা কী এমন কঠিন কাজ!

        যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। রাজ্যের প্রবীণ সেনাপতি ছিলেন রাজার শ্বশুরমশাই। রাজার মৃত্যুর বদলা নেওয়ার জন্য তিনি শহরের পশ্চিম তোরণের কাছে সৈন্য একত্রিত করছিলেন। কিন্তু শিকারির আঘাতে কারোর জারিজুরিই খাটল না। কিছু সৈন্য মারা গেল, বাকিরা রণে ভঙ্গ দিল। সেনাপতি শ্বশুরমশাই মারা গেলেন শিকারির তীরের আঘাতে

        এইভাবে শয়তান রাজার শাসন শেষ হল। তারপর কত বছর পরে খুশির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিল রাজ্যের প্রজারা। শিকারির কাজ শেষ হয়েছে। এবার সে ঘরে ফিরে যাবে সেখানে তার জন্যে অপেক্ষায় রয়েছে তার স্ত্রী, আর তার শিশুপুত্র