রাহুল মজুমদার

স্মরণ অনুষ্ঠানে  শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

 ভবানীপ্রসাদ মজুমদারকে   চিনি না









রাহুল মজুমদার





 

                                                                                                                           ছবি -  রাহুল মজুমদার


ভবানীপ্রসাদ মজুমদারকে আমি চিনি না। অমন একজন বিটকেল লোককে চিনতে চাইও না। যে-মানুষ যখন-তখন যেখানে-সেখানে অন্ত্যমিল, ছন্দ ঠিক রেখে মুহূর্তে যে-কোনো বিষয়ের উপর অনবদ্য রসে টইটম্বুর ছড়া লিখে ফেলতে পারেণ, যাঁর ছড়ার জন্য ছবি আঁকতে গিয়ে প্রথমেই মিনিট কুড়ি পেট চেপে হেসে গড়াগড়ি দিয়ে চোয়াল ব্যথা হয়ে যায়, সে-মানুষ বিটকেল নয় তো কী! বয়সে মাত্র দু-মাসের বড়ো হলেও মানুষটা প্রতিভায়, জীবন সংগ্রামে আমাদের মধ্যে কয়েকশো বছরের তফাত। এমন মানুষকে কেন চিনতে যাব বলুন দেখি!

সামনাসামনি দেখলে যাঁকে নিপাট সোজাসাপটা ভদ্রলোক মনে হয়, সেই মানুষটা যে সর্বক্ষণ নিজের ভিতরে হাসির বুদ্ধিদীপ্ত অ্যাটম বোমা নিয়ে ঘুরে বেড়ান, কে বুঝবে! সুকুমার রায়ের পর এত মজা আর আনন্দ আর কারও লেখায় পাইনি। ভবানীপ্রসাদ মজুমদার মার্কা বুড়োটে নামধারীর হাত থেকে এমন ছেলেমানুষীভরা উজ্জ্বল উচ্ছ্বল অথচ সদর্থক ছড়া বেরোয়!সন্দেশ’-এর পাতায় হাসির আনন্দনাড়ু বিলোনো ছড়াগুলো পড়ে ভাবতুম, বেশ শিবরাম চক্রবর্তীর মতো নাদুসনুদুস অভিজ্ঞ কেউ। পরিচয় হতে (কবে কোথায় প্রথম পরিচয় কিসসু মনে নেই, মনে হয় আজন্ম) দেখি, এ তো নেহাতই আমার বয়সি! ভবানীদার ছড়া পড়লেই মজাদার ছবিগুলো হুশ করে চোখের সামনে ভেসে উঠে নাচতে আরম্ভ করত; তুলি-কলম দিয়ে কাগজে নামতে একটুও সময় নিত না। যেমন—


হালুম হুলুমপাচ্ছো মালুম

আমিই হলুম বাঘ!

সারা দেহেই হলুদ কালোয়

দেখছ ডোরা দাগ!

হালুম হুলুমনয়কো জুলুম

ভয় পেলে খুব মনে?

আমিই হলুম জাতীয় পশু

নিবাস সোঁদরবনে!

হালুম হুলুমচিবিয়ে খালুম

এই দেখো নখ-দাঁত!

আমার সাথে লড়তে এলে

হবেই কুপোকাৎ!

 

     ভবানীদার ছড়ার ছবি আঁকতে আঁকতে, নানান আড্ডায় পাশে বসতে বসতে কবে যে বিচ্ছিরি রকমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গিয়েছি, টেরই পাইনি। এমন হয়েছিল, দু-দিন দেখা না হলে মনটা নিমপাতার মতো তেতো হয়ে উঠত। যে-কোনো আড্ডায় ভবানীদা চুপচাপ বসে থাকতেন, কিন্তু মোক্ষম চুটকিটা (চুটকি বলা উচিত কি?) আসত ওঁর তরফ থেকেই।

    একবার এক সন্দেশী সভায় জলযোগের আয়োজন ছিল। সুস্বাদু জলখাবারের মধ্যে ল্যাংচাটা কোনও কারণে সামান্য টকে গিয়েছিল। ভদ্রতার খাতিরে সকলেই উচ্চবাচ্য না করে খেয়ে নিল। সভাশেষে বাইরে বেরিয়ে ভবানীদা হাওয়ায় মন্তব্য ভাসিয়ে দিলেন, ‘সাউথ ইন্ডিয়ান ল্যাংচা কেমন লাগল?’

যে-কোনো মানুষের নাম শুনেই মুহূর্তে তার নাম নিয়ে ছড়া বানানোর আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ওঁর

সুকুমার রায় শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে গ্রাহকদেরযেমন খুশি সাজোহয়েছিল। ভরতদার ছোটো ছেলে ছোট্ট দিব্যেন্দু সেজেছিল ছায়াধরা বুড়ো। ওর ঢোকার সময় ভবানীদা চটজলদি লিখে ঘোষণা করলেন—



 

    জীবনে প্রচুর লড়াইয়ের ক্ষত থাকলেও, কখনও মুখে-চোখে তার আভাসটুকুও ফুটতে দিতেন না। ওঁর ছড়া আশ্চর্যরকমের প্রাণবন্ত, আশার আশ্বাসে ভরা

ছোটোদের ছড়া লিখতেন দু-হাত ভরে। কাউকে না বলতে পারতেন না; আবদার করেই কত অনামি পত্রিকা ওঁর কাছ থেকে ছড়া পেয়ে যেত। পুজোর সময় তো শ-দেড়েকের ওপর ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়া বাংলা এমনকি বাংলার বাইরের প্রচুর পত্রিকার পাতায় ঝলমল করত। এইসব ছড়ার সিংহভাগই ছিল অনর্থনৈতিক। এমনই ছিল ওঁর খ্যাতি যে, খামের ওপর বা পোস্টকার্ডে শুধুভবানীপ্রসাদ মজুমদার, হাওড়ালিখলেই সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে যেত

ভবানীদা যে শুধু অনবদ্য ছোটোদের মজার ছড়া লিখতেন, এমন নয়; সিরিয়াস ছড়া, বড়োদের ছড়া-কবিতা সবই এমন দুর্দান্ত লিখতেন যে, পড়ে পরাণ ভরে গালাগালি দিয়ে মনে সুখ পাব, তার উপায় ছিল না

 



 পুরস্কার যে কততা বোধ হয় উনি নিজেও জানেন না

ভবানীদার ভুবনজোড়া পরিচিতি অবশ্য ছোটোদের মজাদার ছড়ার জাদুকর হিসেবেই। এত ভালো তাঁর ছড়া যে, সুকুমার রায় জন্মশতবার্ষিকীতে সন্দেশ-এর তরফ থেকে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় ওঁর গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন সুকুমার রায় পদক। এ ছাড়া অন্যান্য পুরস্কার যে কত, তা বোধ হয় উনি নিজেও জানেন না। পুরস্কার আর সংবর্ধনায় ঢেকে যাবার দাখিল, তবু ওঁর ব্যবহারে কোনও তফাত নেই। ওঁর জনপ্রিয়তা এমনই তুঙ্গে যে, কোনও জায়গায় মজুমদার পদবি শুনলেই প্রশ্ন ছুটে আসে—ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কেউ হন?

ভবানীদা বেঁচে থাকুক তাঁর ছড়ায় তাঁর লেখায়, ওঁর ছড়া-কবিতা পড়ে আনন্দিত হোক, হাসতে হাসতে পেট চেপে গড়াগড়ি দিক

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার কেমন মানুষ? ওঁর একটা বইয়ের নামেই বলা যায়— যাঁর কথায় কথায় ছড়া হয়ে যায়এমন একটা মানুষকে চেনা কি আমার কম্মো! তাই তো বললাম, ভবানীপ্রসাদ মজুমদারকে আমি চিনি না

 


ভবানীদার ছোট মেয়ে মনোমিতা আর ওর মেয়ে, আমি, আমার স্ত্রী সুপর্ণা আর ভবানীদার বড় মেয়ে মধুমিতা।

আর একবারের কথা। নলিনীদির (দাশ; সন্দেশ-এর ছোটো সম্পাদিকা, সত্যজিৎ রায়ের পিসতুতো দিদি) ছেলে বাবুয়াদার (অমিতানন্দ দাশ) বউভাত হয়েছিল ত্যাগরাজ হলে। সন্দেশ-এর তরফে অনেকেই আমন্ত্রিত। কেউ একজন সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে ভবানীদার পরিচয় করিয়ে দিতেই উনি বলে উঠলেনআরে, আপনি তো মশাই ছেলেমানুষ দেখছি। আপনার ছড়া পড়ে ভাবতুম ভারিভার্তিক কেউ। বলে সন্দেশ-এ প্রকাশিত ভবানীদার প্রথম ছড়ার উল্লেখ করে পুরোটা আবৃত্তি করে গেলেন। আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি

বেশ কিছুক্ষণ গল্পগাছার পর খাওয়ার জন্য ডাক পড়ল। আত্মীয়তার সূত্রে অপর্ণা সেন ছোট্ট কঙ্কনাকে নিয়ে এসেছিলেন। উনি মেয়েকে নিয়ে একই ব্যাচে বসেছিলেন ভবানীদার ঠিক উলটোদিকে। (এই প্রসঙ্গে বলি, আমার বাঁদিকেই বসেছিল কঙ্কনা, আর তার পাশেই অপর্ণাদেবী) খাওয়া শেষ হবার পর আমাদেরই একজন ভবানীদাকে জিজ্ঞেস করল, “অপর্ণা সেনকে কেমন দেখলে?”

ভবানীদার নির্বিকার উত্তরএকটা লুচিও তো কম খাইনি। রসের কী সূক্ষ্ম প্রকাশ!






 

...

 

আমাদের প্রিয় সাহিত্যিক শিশিরকুমার মজুমদারের শতবর্ষে 'শিশিরকুমার মজুমদার শতবর্ষ পদ'-এর জন্য অবশ্যম্ভাবীভাবে যে নামটা উঠে এসেছিল, সেটা ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। হঠাৎই ভবানীপ্রসাদ পরমলোকে চলে যাওয়ায় ওঁর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে সেই পদকপ্রাপ্তির সংবাদ ঘোষণা করা হয়। নির্দিষ্ট সন্ধ্যায় পদক তুলে দেওয়া হলো ওঁর স্ত্রী পদ্মাদেবীর-র হাতে।পদক তাঁর হাতে তুলে দেন সন্দেশ সম্পাদক সন্দীপ রায় 

 ^  সন্দেশ সম্পাদক সন্দীপ রায় এর পাতা দেখতে ক্লিক করুণ- 

 

<