ড. সুচরিতা চৌধুরী আগরতলা, ত্রিপুরা
| | সাহিত্যের
বিভিন্ন আঙ্গিকে মানুষ যা বলে, তা তার জীবনের অনুভবের সম্পদে সাজানো কারুকাজ। কবিতায়
জীবনের কথা ফুটে উঠে স্পষ্টতায়, আভাসে, রূপকে, ব্যঞ্জনায় বা মৌনতায়। ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের লেখা নিয়ে
স্বতঃস্ফূর্ত কিছু লেখা কিশোর বার্তা'য় প্রকাশিত হয়েছে। এই নিয়ে কিছু কথা লিখতে গিয়ে মনে
হলো- চেতনায় কবিতা আবাস গড়ে- আর, কবিতায় আবাস খুঁজে পায় মন। মোট একশ'র বেশি রচনায়
নিরানব্বই জন মানুষ তাঁদের অনুভব প্রকাশ করেছেন, - একজন মানুষকে ঘিরে বহুজনের এত শ্রদ্ধা-নম্র
ভালোবাসা - সেই না দেখা মানুষটির প্রতি আমাকে প্রণত করেছে। লেখাগুলো পড়তে পড়তে
ভাবতে বাধ্য হয়েছি - মানুষটির প্রতি সবার এত ভালোবাসা তাঁর রচনার মনে ঈর্ষা
জাগাবে নিশ্চয়ই ।
সাধারণত প্রত্যেক
লেখকের রচনার মধ্য দিয়ে উদ্দিষ্ট মানুষটির সম্পর্কে তাঁদের মত ও মনের কথা বলাই এই
ধরনের পর্যালোচনার রীতি। কিন্তু বহু সুধীজন তাঁদের মনের কথা বলেছেন। পরিসরে
স্বল্পতা তো আছেই, সেই সঙ্গে
প্রত্যেকের প্রতি সুবিচার করার ক্ষেত্রে আমার সীমাবদ্ধতাও আছে। তাই, যদি প্রকাশিত
রচনাগুলি নিয়ে একটু অন্য ভাবে আলোচনা করা হয় তবে ভবনীপ্রসাদ মজুমদারের
সাহিত্য-মেধা এবং ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যকে অনেকখানি অনুভব করা যায়।
ভবানীপ্রসাদ
মজুমদার একজন সহৃদয়, সহজ মানুষ
হিসাবেই প্রত্যেক লেখকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁকে কেউ কেউ পিতা তুল্য
সম্পর্কের নিবিড়তায় অনুভব করেছেন, যাঁর কাছে ছাত্র রা সন্তানের মতো, -
নিরহঙ্কার যাঁর অলঙ্কার হয়ে উঠেছে। ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের
ব্যক্তিত্বের এই রূপগুলি প্রায় প্রত্যেক লেখকের নিবেদনের উপচার হয়ে উঠেছে। বেশ
কয়েকজনের কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবক -বন্ধু'র মতো, শ্রদ্ধা ও সখ্যতার এক অনিন্দ্য সুন্দর মেলবন্ধনের উপমা,- তিনি পরম ভরসার
এক আশ্রয়। লেখক হিসাবে এই ভরসা যোগাতে
তিনি ছিলেন অকুন্ঠ। তাই তাঁর কাছে লেখা চাইলে নিরাশ হয় নি কেউ। এমনকি অচেনা
মানুষের কাছ থেকে যদি লেখা চেয়ে ফোনও তিনি পেতেন, তাতেও তাঁর 'আমি'
আহত হতো না।
এতটাই সাহিত্য সেবার মনোভাব তাঁর ছিল যে ফোনে তিনি কবিতা বলেছেন যাতে যারা তাঁর
লেখা চায় তাদের পক্ষে সামনাসামনি যোগাযোগ করার অসুবিধা আছে বলে লেখাটি পেতে তাদের
অসুবিধা না হয়। সত্যিই অভাবনীয় এই অমায়িকতা।
তাঁর ছড়া আর
কবিতা অনায়াসে পাঠক -শ্রোতাকে আকুল করে। ভালোলাগার মধ্যে যে লুকিয়ে থাকে একটা 'বোঝা- না - বোঝা' আকুলতা, সেই কথা বলেছেন
আর বলতে চেয়েছেন অনেকেই। কবির জীবনবোধের
গভীরতার প্রকাশের মুখোমুখি হয়ে পাঠকের মনও ছু্ঁতে চায় সেই অনুভব। এই কবি সেই বোধ
উজ্জীবিত করেন- যে বোধের খোঁজে পথের ধুলো মাখে কত অক্লান্ত পথিক।
ভবানীপ্রসাদ
মজুমদার যে সাম্রাজ্যের অধীশ্বর, তা হলো ছড়া। মূলতঃ শিশু কিশোরদের জীবন-ভূমির প্রতিটি প্রাণ
কণা যেন তাঁর লেখনীতে মূর্তি পেয়েছে। কিশোর বার্তা'র এই সংখ্যার প্রত্যেক লেখক যে কথাটি যথাযোগ্য
মর্যাদায় উল্লেখ করতে চেয়েছেন তা হলো - শিশু-কিশোরদের মনের চাহিদা বোঝার অসাধারণ
ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর রচনার একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে ছোটদের মনের
কথা। সেই কথাকে তিনি কখনো ছন্দের বাঁধনে আবার কখনো সাবলীল কথায় রূপ দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল তাঁর শব্দের ব্যবহার। ছড়ায় বলা কথাগুলি তিনি যে
সত্যের জোর দিয়ে প্রকাশ করছেন, তার যোগ্য সঙ্গত করেছে তাঁর শব্দের ভান্ডার। শ্রদ্ধা
নিবেদনের এই রচনা গুলিতে প্রত্যেক লেখক অকুণ্ঠ ভাবে তাঁদের এই অনুভবের কথা উল্লেখ
করেছেন। প্রত্যেকের মনে কবির প্রতি ছিল অসীম মুগ্ধতা - যার কেন্দ্র হলো
ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের গভীর জীবনবোধ। অভিভাবকের দৃষ্টি থেকে লিখেছেন অনেকেই, তাঁরা কৃতজ্ঞতা
প্রকাশ করেছেন তাঁদের সন্তানদের শৈশবের আবহ এমন সম্পদের ছোঁয়া পেয়েছে বলে।
ভারতের ভৌগলিক সীমার বাইরে থেকে লিখেছেন একজন মা তার আনন্দের অনুভূতির কথা,- সে আনন্দের উৎস
এই কবির ছড়া আর কবিতা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা
তাদের ভালো লাগা আর ভালবাসার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এই সংখ্যার প্রতিটি লেখায়।
কবির তীক্ষ্ণ মনন ক্ষমতা,
দূর বীক্ষনের
দক্ষতা এবং স্পষ্ট কথনের দৃঢ়তা তাঁর সাহিত্যকে সব মানুষের কথায় পরিণত করেছে। ছোট
ছোট ছেলে মেয়েদের যে এক বিশাল মনের জগৎ থাকে, সেখানে যে বাস করে
ভবিষ্যৎ স্বপ্নের এক কারিগর, তাদের সুখ- দুঃখের কথা বুঝতে পারা যে কত জরুরি, কত যে
গুরুত্বপূর্ণ তাদের মনোসঙ্গী হওয়া - সেই কথা এত সরস - তীব্রতায় তিনি বলেছেন,- যার স্বীকৃতি
প্রত্যেক লেখকের নিবেদনে অনন্য মাত্রা পেয়েছে। সেইসঙ্গে তাঁর রচনা এই সময়ের
হয়েও এই সময়কে অতিক্রম করে এগিয়ে নিয়ে গেছে পাঠকের মানস বৃত্তি।
একটু অন্য ভাবে
বলেছেন তাঁর কথা - যাঁরা ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের জীবন পঞ্জী পাঠকের কাছে পৌঁছে
দিয়েছেন। এটা একটা অত্যন্ত মূল্যবান পদক্ষেপ, যা যেকোন আগ্রহী পাঠক এবং গবেষকদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ
সম্পদ হয়ে থাকবে।
আলোচনা শেষ করার
আগে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাই কিশোর বার্তা'র এই সংখ্যার সম্পাদককে, যিনি এই অসামান্য উদ্যোগ নিয়েছেন। এই সংখ্যার একটি
উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বিষয় বৈচিত্র্য। একজন মানুষকে নিয়ে লেখা হলেও
প্রত্যেক লেখক তাঁর নিজস্ব অনুভবের প্রকাশে বিশিষ্টতা দাবী করতে পারেন। বিভিন্ন
দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষটিকে এবং তাঁর রচনাকে ভেবে দেখার এই প্রয়াসটি সম্পাদক
মহাশয়ের এক অসাধারণ পরিকল্পনা - যা বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে।
এভাবেই মানুষেরা
একে অপরের হাতে হাত রেখে সত্য ও সুন্দরের যাত্রা অব্যাহত রাখুক - শুভেচ্ছা রইল।
........
গভীর কৃতজ্ঞতা -
লেখাটি 'ত্রিপুরা দর্পণ' থেকে নেওয়া হয়েছে।
- সম্পাদক
সূ চি প ত্র
|