বিহুর বাবা বাঁকুড়া জেলার ফরেস্ট রেঞ্জের ফরেস্ট অফিসার। সিমলাপালে সরকারি বন বাংলোতে সপরিবারে থাকেন। বিহু ওনার একমাত্র ছেলে। শুধুমাত্র ভিডিও গেম আর কম্পিউটারের যান্ত্রিক দুনিয়া ছেলে সীমাবদ্ধ থাকুক তা চান না বিহুর বাবা বসন্ত রায়। তাই ছেলে পরিবেশের প্রতিটা জিনিসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকুক তাই চান ওর বাবা।
বিহুর প্রিয়
বন্ধু সাঁওতাল পাড়ার চিকু মুণ্ডা। আসলে চিকুর মা বিহুদের বাড়িতে রান্নার কাজ করে, সেই থেকে বিহু আর
চিকুর বন্ধুত্ব। চিকু সবসময় একটা
তীর ধনুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বিহু ওকে সাবধান করে-"চিকু তোর ঐ অস্ত্র দিয়ে তুই
বনের পাখি মারবি না।"
চিকু
বলল-"না গো বিহু দাদা আমি পাত্থরে মেরে টিপ ট ঠিক করি।"
বিহু আশ্চর্য হয়ে
বলল-"তুই তীর ছোঁড়ার সময় বুড়ো আঙুল ব্যবহার করিস না কেন?"
"আমরা সাঁওতাল
জাতির কেউই করি না গো। ঐ একলব্য ছিল্ল না? ওর মেষ্টর ওর বুড়ো আঙুল চেঁয়েছিল্ল। ও তা কেটে দিঁয়েছিল্ল, ও তো আমাদের
জাতির ছিল্ল, তার লেগেই এই
রীতি।"
চিকুর কথার
উত্তরে বিহু বলল-"আমি মহাভারতের গল্পে পড়েছি। অর্জুনকে শ্রেষ্ঠ বীর প্রমাণ
করার জন্য ঐ কাজ করা হয়েছিল। অত্যন্ত অন্যায় হয়েছিল।"
চিকু
বলল-"সেই লেগেই ওর দুঃখে আমরা দুখী।"
চিকুদের বাড়িতে
বেড়াতে এল বুড়াং,মেঘালয়ের এক প্রত্যন্ত
গ্রামে ওর বাড়ি। ও মানুষের কথ্য ভাষায় কথা বলে না। পাখিদের মতো শিস দিয়ে কথা বলে।
চিকু নিজের
বক্তব্য বুড়াংকে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়। বুড়াং এক গাছ থেকে অন্য গাছে বাঁদরের
মতো ঝুলে ঝুলে চলে যেতেও পারে। এ কাজে অবশ্য চিকুও পটু। ওদের এই বিশেষ ক্ষমতা
দেখে মাঝে মাঝে ভেবলে যায় বিহু। একদিন চিকুর সঙ্গে বুড়াং এল বিহুদের বাড়িতে। বিহুর
কম্পিউটারটা দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ল বুড়াং, প্রথমে আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইল যে ওটা একটা ভয় পাওয়ার
মতো জিনিস, একটা অন্য
পৃথিবী। আস্তে আস্তে ওকে হাতে ধরে বিহু দেখিয়ে দিল যে ওটা বাধ্য পোষ্যের মতো, যে ওটা নিয়ে কাজ
করে ও তার কথা শোনে। এইবার বুড়াং নিজে নিজে কম্পিউটার চালাচ্ছে ও যা দেখছে তাতেই
খিলখিল করে হাসছে। এ দৃশ্য বিহুর মা চিত্রার ভাল লাগলেও বিহুকে সাবধান করলেন-
"দেখো, এলোমেলো
টেপাটেপিতে কম্পিউটারটা খারাপ হয়ে না যায়।"
বুড়াং ইঙ্গিত
বোঝে, তাই বিহুর মায়ের
বারণ বুঝতে ওর সময় লাগল না। এক লাফে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। চিকুও ওর পেছন ধরে
বাইরে এসে বিহুকে ডেকে নিল। চিকু উৎসাহ নিয়ে বলল-"রাজা দেখতে যাবে বিহু দাদা?"
বিহু ওর অজ্ঞতায়
হেসে বলল-"ধুর, আমাদের দেশে এখন
রাজা আছে নাকি রে? আমাদের দেশ
গণতান্ত্রিক দেশ। ভোটের মাধ্যমে দেশ কারা চালাবে তা ঠিক হয়।"
চিকু বলল-"এ
রাজা সে রাজা লয়। সে রাজাদের বংশধর। আমাদের সমাজকে এক রাখার উৎসব। ছাতা পরব, শাল কাঠের আগায়
সাদা কাপড় দিঁয়ে ছাতা বানানো হয়, তারপর তা ফুল
দিয়ে সাজানো হয়। এই উৎসবে ঐ রাজা আসে সেজেগুজ্যে। মেলা দোকান বসে। এমনইতে এখন ঐ
রাজা পেরাইমারির অঙ্কের মেষ্টর।"
রাজা আর মেলা
দেখার আনন্দে বুড়াং কয়েকটা ডিগবাজি দিয়ে নিল। এরমধ্যে বিহু একদিন চিকুদের গ্রামে
গিয়ে ওদের সঙ্গে বনভোজন করেছিল। ভাত ছাড়াও কাঠের আঁচে ঝলসানো শূয়রের মাংস ছিল।
প্রথমে বিহু ভয়তে
তা খেতেই চায় নি। পরে কিসব মশলা মাখিয়ে চিকু দিতে স্বাদ নিয়ে বুঝল এ তাদের
বারবিকিউয়ের মতো। এসব খাবার খাওয়ার কথা বাড়িতে আর বলে নি বিহু। ছাতা পরবের দিনে
চিকু ওদের প্রথা মতো নতুন জামা গায়ে দেয়। ওর দেখাদেখি বিহুও দুর্গাপুজোয় পেয়ে তুলে
রাখা একটা নতুন জামা পরে নেয়। দুজনে বহু খোঁজাখুঁজি করেও বুড়াংকে দেখতে পায় না।
পরবের মাঠে দাঁড়িয়ে ওরা রাজকীয় শোভাযাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এমন সময় ওরা
দেখে রাজা অরুণ সিং দেওর পাশে পাশে রাজকীয় পোশাক পরে বুড়াং হাঁটছে। তবে ওর পোশাক
রাজার মতো নয়, ওরটা মেঘালয়ের
জনজাতির রাজকীয় পোশাক। চিকুর মনে পড়ল, আরে! বুড়াংরা তো মেঘালয়ের জনজাতির রাজ বংশ। তাই
রাজারাজড়াদের কথা শুনে ওর রাজরক্তও নেচে উঠেছে। তবে কপাল খুব ভাল। বুড়াংয়ের
কাণ্ডকারখানা দেখে মজা পেয়ে ওরাও ওকে শোভাযাত্রার অংশ করে নিয়েছে। ওর মাথাতেও
সুদৃশ্য ছাতা ধরা হয়েছে। অপরূপ সারল্য ওর মুখে জ্যোতি চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। গুচ্ছ
চুল রাংতায় জড়ানো, কোমরে কোমরবন্ধ।
চিকুর বন্ধু যে রাজা পদবাচ্য হয়েছে এই আনন্দে ও দিশেহারা। বিহুরও বুড়াংয়ের আচার
আচরণ বেশ লাগছে। হঠাৎ চিকুরা স্থান কাল পাত্র ভুলে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল-"জয় রাজা
বুড়াংয়ের জয়।" বুড়াংও এমন ভাব করল যেন ও সত্যিকারের রাজা। এইবার
ভলান্টিয়াররা বুড়াংকে সরিয়ে দিয়ে বলল-"তোর নোটঙ্গি যা করার করে নিয়েছিস, এবার বাড়ি
যা।"
বেচারির রাজা
সাজার আয়ু যে এত স্বল্প সময় তা ও জানত না। গলার মালা খুলে ফেলে একটা পাশবিক চিৎকার
করে ছুট লাগালো। বিহু আর চিকু ওর পেছনে দৌড়োতে দৌড়োতে সমানে বলে চলেছে- "এই
রাজা থাম, থাম.. থাম
বলছি।"