ইদানিং দু-তিনদিন অন্তর হটাৎ হটাৎ-ই তার উপস্থিতি। ফলস্বরূপ সেপ্টেম্বরের শেষেই শীত বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। বারান্দায় এলেন অনিমেষ রায়। কোনো শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় চিত্রিত হিমেল কুয়াশা সন্ধ্যার নিষ্প্রাণ আলোয় গোধূলি বর্ণে রঞ্জিত। সদ্য ঘটে যাওয়া উন্মাদ পবনের তান্ডবে চারিপাশ শৃঙ্খলাহীন, অগোছালো। নিজের জীবনের সমার্থক প্রতিচ্ছবির সম্মুখীন হয়ে অনিমেষের বৃদ্ধ অক্ষিপুট বুজে এলো। বেশি সময় বাইরে দাঁড়াতে তিনি পারলেন না। সূর্যাস্তের পর পরই ঠান্ডা আরো হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তার দালানে। বাহাত্তর বছর বয়স্ক ক্ষয়ে যাওয়া হাড়গুলো এখন বড্ড শীতকাতুরে। অগোছালো আলনার এক পাশ থেকে বারো বছর আগের অবসর জীবনের সম্মান স্বরূপ পাওয়া শালটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিলেন। আরও ভালো করে জড়াতে হতো কিন্তু তিনি পারলেন না, হেথাহোথা জীর্ণ তাপ্পি মলিন হয়ে পুনরায় আচ্ছাদনের অভাব বোধ করছে। চাইলেও তিনি তার পেনশনের টাকায় একটা নতুন শাল কিনতে পারবেন না।মাসের শেষে চেকের নির্ধারিত জায়গায় কাঁপা হাতের সই করার অনুমতি-ই তার বর্তমানের আর্থিক স্বাধীনতা। ভগ্ন স্বরের দুটো বেশি আকুতি-ও সংসারের নিয়ম নির্ধারণে তার অনধিকার প্রবেশ হয়ে যায়। তারপর ধিকিধিকি আগুন দাবানলে রূপান্তরিত হয় আর সেই নির্মম উত্তাপ থেকে বাদ যায় না তার বছর নয়ের নাতিটি-ও। প্রতিশ্রুতি অগ্রাহ্য করে সাদা ফুলের সমারোহে আলতা সিঁদুর চন্দন চর্চিতা হয়ে যেদিন নিরালা দেবী স্বার্থপরের মতো অনন্ত শান্তির খোঁজে এগিয়ে গেলেন সেইদিনই প্রৌঢ় অনিমেষের বাঁচার স্তম্ভ হয়েছিল তার একমাত্র ছেলের ছেলে, তার একমাত্র নাতি। একটা প্রাণ স্পন্দিত হয় আরেকটি প্রাণের স্পর্শে। নিরালাহীন জীবনে অনিমেষের সেই স্পর্শদাতা ছিল তার দাদুভাই। ভালোবাসা, যত্ন-আত্তিতে জর্জরিত করেও চারজনের সংসারে বাকি দুইজন কুন্ঠাবোধ করতো না তাদের বছর আট নয়ের ছেলেকে ঠাকুরদার সংস্পর্শে না আসতে দিতে। সব মেনে নিয়েছেন অনিমেষ। উপায় নেই তাই হয়ত। এই বয়সে তার আত্মার আত্মা নিরালাদেবীর ছোঁয়ামাখা সংসার ছেড়ে কিছুতেই বৃদ্ধাশ্রমে তিনি যাবেন না। যা খেতে দেয় তাই খান, যা পরতে দেয় তাই পরেন। কিন্তু এই হটাৎ আসা অচেনা ঠান্ডায় খুবই অসুবিধায় পড়েছেন তিনি। পুরোনো শালে কোনোমতে নিজেকে ঢেকে নিলেও পা জোড়া বড্ড কাহিল হয়ে পড়েছে। পুরোনো এক জোড়া মোজা ছিল বটে কিন্তু শতছিদ্রে বামপায়ের বুড়ো আঙুল, ডান পায়ের গোড়ালি আবরণহীন। ঠান্ডায় বড্ড কষ্ট হয় তার। মধ্যবয়সে মাঘ মাসে যখন প্রথম বাবা হলেন, শিশুপুত্রের জন্য রংবেরঙের কত মোজা কিনেছিলেন। নিরালাদেবীর কপট ধমকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, "সারা শরীরে গরম পোশাক না থাকলেও চলবে কিন্তু পা গরম থাকলেই ঠান্ডা জব্দ।" সেই রীতি ছেলে বড় হয়ে অফিস যাওয়া পর্যন্ত চলছে।
পুরোনো কথা ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। ব্যথাতুর হৃদয়ে জামার আস্তিনে চোখ মুছলেন অনিমেষ।ঘরে সাড়ে ছয় ফুট বাই চার ফুটের একটি খাটিয়া ছাড়া বসার জায়গা বলতে ছোট একটা বেতের মোড়া। বয়স সেটারও কম হলো না, এই বুড়ো হাড়ের ভারে মচমচ শব্দ করে এখন। তাতেই বসলেন অনিমেষ। হাতে ধরা মোজা পায়ে গলিয়ে ছিটেফোঁটাও আরাম অনুভব করলেন না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই খাবার টেবিলে ভীরু স্বরে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেই বসলেন, "খোকা, জানি সারাদিন কাজের চাপে খুবই ক্লান্ত থাকিস, তাও বলছি....মানে... শীতটা হটাৎ-ই বেশ পড়েছে, পায়েও আজকাল ব্যথা করে.. মানে..... মানে একটু কম শীত থাকলেও কিছুদিন চালিয়ে নিতাম..... আসলে...."
-" এত ধানাই পানাই না করে কি বলতে চাও বলো।" নতুন গন্ধ লেগে থাকা পুল ওভারের চেনটা টেনে নিল অনিমেষ রায়ের খোকা বছর চল্লিশের রিতেশ রায়।
-"দেখো, হয়তো কিছু ধান্দা আছে।" গরম দুধ চুমুক দিতে দিতে বাহারি শীত বস্ত্রে আপাদমস্তক সজ্জিত বৌমা নীলা কৌতূহলী।
-"বাবান, তুমি কিন্তু দুধ একটুও ফেলবে না। এই শীতে শরীর শক্ত করবে।" ছেলের মুখের কাছে দুধের গ্লাস ধরে নীলা বলে চললো, "আপনাকে আর দিলাম না বাবা, এই বয়সে দুধ হজম করতে পারবেন না, পেট ফেট খারাপ করে বসবেন.... তখন আবার হাজার ঝামেলা.... ঔষুধ কেনো.... এটা করো... ওটা করো....."
-" ঠিকই বলেছো বৌমা। থাক, আমার সত্যি পেটে সহ্য হবে না।" নীলার সুচতুর ভাষনের মাঝপথেই ছেদ টানলেন অনিমেষ।
নড়বড়ে অশক্ত দাঁতে শুকনো রুটি পাটালি কোনমতে অর্ধচিবিয়ে উঠে পড়লেন তিনি। নিজের ঘরের অভিমুখে কয়েক পা এগোতেই রিতেশের পিছু ডাক, "বাবা কাল চেকে সই করে দিও, পরশু তিন তারিখ।"
পুরু চশমার কাঁচে ঢাকা ঘোলাটে মলিন চোখদুটো ভিজে গেল। করুণ কণ্ঠের আর্তি,
"খোকা আমায় একজোড়া মোজা এনে দিবি ।"
-"মাসের টাকা আসতে না আসতেই খরচ করানোর ফন্দি! বদমাশ বুড়ো!" গজগজ করতে করতে নীলা অনিমেষের আদরের নাতি বাবানের পিঠে এক চড় কষালো, "তুমি না খেয়ে বসে আছো কেন? ঠান্ডা হবার আগে দুধটা শেষ করো।"
এই শুরু হলো। তার ওপর সমস্ত রাগের অত্যাচার এখন সহ্য করতে হবে ক্লাস ফোরে পড়া ছোট্ট বাবানকে। ছোট ছেলেটাও আজকাল কেমন যেন জেদী হয়ে যাচ্ছে । এমন অমানবিক পরিবেশে কার বা শৈশব থাকে ।
"সব নিয়তি। তোমার আগে যে কেন আমি চলে গেলাম না! তাই তো কথা ছিল নিরালা। এসে একবার দেখে যাও তোমার যত্নের মানুষটিকে ।"
অভিমানে ঠোঁট ফুলে গেল অনিমেষের । এই অভিব্যক্তি তাকে লুকিয়ে রাখতে হয় ছেলে বৌমার নজর থেকে। না হলে হয়তো আবারও শুনতে হবে,
" বুড়ো বয়সে মরা বৌয়ের প্রতি প্রেম জেগেছে ।"
কাঁথা গায়ে টেনে বালিশে হেলান দিয়ে বসে সবে ঝিমোতে শুরু করেছেন অমনি বাবানের আদরের ছোঁয়া ।
"দাদাভাই......", কোলে বসে আদুল হাতে বাবান জাপটে ধরেছে তাকে ।
আহা, কি উত্তাপ! দুটি কোমল হাত তার শরীরের লীনতাপ শোষণ করে উত্তপ্ত করলো । এ যেন নুইয়ে পড়া মেরুদণ্ডের সমর্থ হবার তাগিদ, এ যেন ছানি পড়া দুটি চোখের স্পষ্ট দেখতে চাওয়ার তাগিদ, এ যেন বৃদ্ধ বয়সে আবার নতুন করে বাঁচার তাগিদ। খড়ি ওঠা, কুঁচকে যাওয়া জীর্ণ চামড়া ঢাকা শীর্ণ হাতে বাবানকে নিজের আলগা শক্তি দিয়ে কাছে করে নিলেন অনিমেষ।
"দাদাভাই, তুমি এই বিস্কুট খাও । এটা মিল্ক বিস্কুট। আমি টিভিতে দেখেছি এটা দুধ দিয়ে বানায়।", প্যাকেট থেকে একটা বিস্কুট বের করে ঠাকুরদার দিকে এগিয়ে দিলো বাবান।
"খাও দাদাভাই, এটা আমার টিফিনের। বাপি, মা জানবে না। তুমি খাও।"
নিজেকে সামলাতে পারলেন না অনিমেষ। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উত্থিত প্রগাঢ় তৃপ্তি তার গাল ভাসিয়ে দিলো । আনন্দে-ও চোখে জল আসে! বাবানের কপালে দাদাভাইয়ের স্নেহের চুম্বন।
পরেরদিন কাটলো ছেলে বৌমার শত কর্মব্যস্ততার মধ্যে। তার পরেরদিন-ও ওদের কর্মব্যস্ততায় মুখর। এত কর্মচঞ্চলতার মধ্যে-ও বাবার পেনশনের টাকায় কেনা নিজের জন্য বিলেতি সুগন্ধি, নীলার পশমের মাফলার, বাবানের জোড়া দস্তানা নতুন ঠিকানা পেলো রিতেশের আলমারিতে। শুধু অর্থের অভাবে মোজা জোড়া অনিমেষের দালান পর্যন্ত পৌঁছালো না। শীতের প্রাক্কালে অবিবেচকের মতো বৃষ্টির আসা যাওয়ায় উষ্ণতা আরও কমলো, ঠান্ডা আরও বাড়লো। পুরোনো দরজার নীচ দিয়ে আসা আলগা উত্তরে বাতাসে পরাস্ত অনিমেষের সহ্য ক্ষমতা। দুটি পায়ের অসহ্য ব্যথায় জর্জরিত অনিমেষ। ব্যস্ত ছেলেকে দুই একদিন পরপর মনে যে তিনি করান নি তা না, কিন্তু মোজার কথা শুনলেই রিতেশের দুটো কান বিকলাঙ্গ হয়ে যায়।
চার দেয়ালের মধ্যে ঘটতে থাকা অন্যায়, অমানবিকতা বাবানের মানসিক বয়সকে করেছে পরিপক্ক। দাদাভাইয়ের নিষ্পলক করুণ দৃষ্টি তার কচি মনে খোদাই করেছে প্রতিবাদের অক্ষর। বড় হয়ে দাদাভাইকে ভালো রাখার তাগিদে মনোযোগ বেড়েছে পড়াশুনায়। টিফিন পিরিয়ডে-ও মন পড়ে থাকে বইয়ের পাতার ভাঁজে ভাঁজে ।
"ভালো চাকরি শুধু না, ভালো মানুষ-ও হতে হবে ।" জেনারেল নলেজের ক্লাসে সুচরিতা মিসের বলা এই কথা বাবানের ঠোঁটস্থ, কন্ঠস্থ, মুখস্থ ।
"কেউ কাউকে কষ্ট দিচ্ছে দেখলে ভালো মানুষেরা কি করে, মিস?"
ক্লাস ফোরের ছাত্রের অভিজ্ঞতা মোড়া প্রশ্নে মিসের সপ্রতিভ উত্তর ,
"প্রতিবাদ করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে। তোমরা 'মনীষীদের আত্মজীবনী' বইটা মন দিয়ে পড়বে, তাহলেই বুঝতে পারবে।"
ঘুম ভাঙতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন অনিমেষ। জানলার কতযুগের সাথী নিরালার শাড়ি দিয়ে বানানো পর্দার ছেঁড়া ফাঁক দিয়ে তাকালেন বাইরে। বিকেলের আকাশে সন্ধ্যের ধীর আগমন । পুরোনো গন্ধ লেগে থাকা একদা কর্মব্যস্ত হাত ঘড়িটিতে তখন পৌনে ছয়টা। বাবান কেন এলো না! তিনটের সময় স্কুল ফেরত বাড়ি এসেই দাদুভাই আর দাদাভাইয়ের আদরের সাক্ষাৎ হবেই। নীলার অপত্তিকে অগ্রাহ্য করতে বাবান-ও আজকাল ভালোই শিখেছে। তবে আজ কি হলো! বাবানের অপেক্ষাতেই ছিলেন কিন্তু কখন যে দুচোখের পাতা বুজে গিয়েছিল তিনি বুঝতেই পারেন নি। ইদানীং ঘুমিয়ে পড়লে সারা জগৎ অসাড় হয়ে যায়, এমনই গভীর ঘুম। হয়তো শেষ ঘুমানোর আগাম প্রস্তুতি ।
"দাদুভাই, ও দাদুভাই.......", বাবানের খোঁজে একফালি বিছানা থেকে নামতে যেতেই অবাক হলেন অনিমেষ। তার দুই পায়ে সাদা ধবধবে নতুন উলের মোজা । বাম পায়ের আর ডান পায়ের মোজা অদল বদল। হতভম্ব অনিমেষ। রিতেশ আর নীলা পছন্দ করে বিয়ের পর ঘরে ঢোকার অনুমতির সময়ই যা প্রণাম করেছিলো, তারপর সব সৌজন্যবোধ হারিয়েছে। তবে মোজা জোড়া এলো কি করে! বিস্মিত অনিমেষ চারিপাশে তাকাতেই দেখতে পেলেন দরজার আড়ালে দুটি দুষ্ট চোখের মিটিমিটি হাসি। কোনো সম্ভাষণের আগেই অনিমেষের ফুরিয়ে যাওয়া বুকে বাবানের সাহসী ঝাঁপ। শূন্য হৃদয় পূর্ণ হলো। জন্মদিনে পাওয়া টাকায় গাড়ি দাদাকে বলে তার কেনা প্রথম উপহার তারই দাদাভাইয়ের জন্য। চোখ থেকে চশমা খুলে বালিশের নিচে রাখা নিরালা দেবীর ছবির ওপর মাথা রাখলেন অনিমেষ। আর্দ্র চোখে সিক্ত হলো সাদাকালো দিনের ফ্রেমে বাঁধা উজ্জ্বল মুহূর্ত। হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন একমাত্র পুত্র সন্তানের জন্য নিজের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করা পিতা অনিমেষ। বাবানকে জড়িয়ে ধরলেন। তার মনের ক্ষতের মলম হয়ে এসেছে তার একমাত্র নাতি। তার ভালোবাসাহীন, শ্রদ্ধাহীন জীবনের ধ্বংস স্তূপ কয়েক মুহূর্তের জন্য রাজপ্রাসাদে পরিণত হলো। নিস্তব্ধ মুহূর্তগুলো অশ্রু জোয়ারে ভেসে গেল অনন্ত মুহূর্তের দিকে ।
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় পাওয়া একজোড়া উষ্ণ উপহারকে অনিমেষ লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে ঘুমের বিছানায় ব্যবহার করতেন। তবে বেশিদিন তার সুখ সহ্য হলো না। রিতেশের অফিসে জেনারেল মিটিং। ওপর তলার বস আসবে, তাই সব কর্মচারীদের ফিটফাট হয়ে যেতেই হবে। অফিস ফেরত বৃষ্টি ভেজা মোজার দুর্গন্ধে খোঁজ পড়লো পরিষ্কার মোজার। কোথাও না পেয়ে বাবার ঘরে খোঁজ করতে গিয়ে নীলার চোখ পড়লো সাদা ধবধবে দুটি মোজার ওপর। মরচে ধরা ট্রাঙ্কে কি যত্নে-ই না রাখা। নীলার আবিষ্কার স্তম্ভিত করলো রিতেশকে। পাশের ঘরে তখন বাবানের সাথে অনিমেষ। কাল বাবানের রচনা প্রতিযোগিতা। দাদাভাইয়ের কাছে আরও একবার মুখস্থটা সে বলে নিচ্ছে। এই সুযোগে নিঃশব্দে বাবানের ভালোবাসার উপহার চুরি করে রিতেশ নীলা চুপিসারে বেরিয়ে গেল অনিমেষের ঘর থেকে।
আজ একটু তাড়াতাড়ি-ই ঘুমের আয়োজন করে ফেললো নীলা। পরেরদিন-ই রিতেশের মিটিং, বাবানের-ও প্রতিযোগিতা আছে। মশারির ভিতরে বসে বাবান জোরে জোরে মুখস্থ বলছিলো রিতেশের কাছে। নীলাও সুগন্ধী প্রসাধনীতে মত্ত। হটাৎ দরজায় ধাক্কা । অনিমেষের ভেজা ভেজা গলার উদ্বেগ,
"খোকা....... শুয়ে পড়েছিস...... আসলে... আমার একটা দরকারি জিনিস পাচ্ছি নারে।"
"লুকিয়ে মোজা কেনা! কালকের মিটিং টা যাক। তারপর আসল বোঝাপড়া হবে তোমার সাথে!" নিজেকে সংযত করলো রিতেশ।
"দেখ, কোথায় হারিয়েছ। এখন বিরক্ত না করে যাও।"
নীলা আর রিতেশের অস্বাভাবিক চোখাচোখি বয়সে ভারাক্রান্ত বিশ্বাসী চোখদুটির নজর এড়ালেও বাবানের তীক্ষ্ণ বালক দৃষ্টিকোণে সন্দেহ সৃষ্টি করলো।
শেষ রাতে শরীরের আন্দোলন উপেক্ষা করতে না পেরে শয্যা নিলেন অনিমেষ। আজ আর স্নিগ্ধ প্রশান্তির নরম পরশ ঘুমের ছদ্মবেশে তাকে হাতছানি দিলো না, বরং এক বৃদ্ধ পাখির বয়সের ডানায় ভর করে আকাশ দেখার ব্যর্থ ইচ্ছার ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নে বিচলিত হলো মন। পাখিটা খুব চেষ্টা করছে অশক্ত বুড়ো পালকে ভর দিয়ে উড়ে যেতে মুক্ত জীবনের পথে-যে জীবনে বাঁধন নেই, নেই সংকীর্ণতা। অনিমেষের ঘুমন্ত উৎসুক চোখ বৃদ্ধ ডানার বারংবার প্রচেষ্টায় নিবদ্ধ।
"হে পক্ষী, হে ছোট্ট জীবন! আমার সমস্ত জীবনী শক্তি তোমায় দিলাম। আমার সমস্ত অবদমিত ইচ্ছা তোমায় দিলাম। তুমিই পারবে পারস্পরিক সম্পর্কের মুখোশগুলো টেনে খুলে জরাগ্রস্ত মানসিকতার ঊর্ধ্বে যেতে। আমি তোমার চোখেই আপোষহীন ভালোবাসার সিন্ধু দেখবো। হে মহাজীবন! তুমি উড়ে যাও, উড়ে যাও, উড়ে যাও।"
চেতনার অতল গভীরে নিমজ্জিত অনিমেষের সম্বিৎ ফিরলো রিতেশের আর্তনাদে।
"বাবা, আমার একটা প্রয়োজনীয় জিনিস দেখেছো?"
হটাৎ ভাঙা ঘুমের ঘোর বর্তমান পরিস্থিতি অনুধাবনে বিলম্ব ঘটালো । জড়ানো গলায় জানতে চাইলেন, "কি জিনিস খোকা?"
"ওর এক জোড়া সাদা উলের মোজা পাচ্ছি না।" মোজা খোঁজার তাড়নায় নীলার মুখের পর্দা ফাঁসে সবাই হতচকিত।
নির্বাক স্মিত হাসি অনিমেষের চোখের কোণায়।
এক নৈঃশব্দ্য নেমে এলো ওদের মাঝে। শুধু দূর থেকে শোনা গেল স্পষ্ট উচ্চারণে মনীষী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনী পাঠ।