জানা অজানা । কার্তিক ১৪৩১

 




          সঙ্গীতের সঙ্গী হতে 











সুদীপ্ত শেখর পাল
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ



 

সুখে,  দুখে অবসরে যাকে সঙ্গী করতে চাই সে হলো সঙ্গীত। নিজে গাইতে পারলে তো ভালোই নয়তো পাশে থাকা আমার মত মানুষকে বলি একটা গান গাইতে। সেই গানের সঙ্গে বাজনা থাকতেই হবে এমন কোন কথা নেই।

কিন্তু মঞ্চের উপর কোন শিল্পীকে আহ্বান জানিয়ে যখন ঘোষণা করা হয়--- এখন আপনাদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করছেন.....। এই ঘোষণা শুনলেই আমরা বুঝে যাই যে সঙ্গীতের সঙ্গে থাকবে উপযুক্ত সঙ্গতও।  তবলার মতো তাল বাদ্য ছাড়াও গীটারকী বোর্ড কিংবা বাঁশির মতো সুরধারক যন্ত্রের এক বা একাধিক উপস্থিত থাকাটাই স্বাভাবিক। আবার সাম্প্রতিক কালে শিল্পী নিজে কোন যন্ত্র না বাজিয়ে নেচে নেচে গান করেন।  আমরা তখন সেই গান কানের  সাথে   চোখ দিয়েও অনুভব করি।  আবহমান কাল ধরে সঙ্গীতের যে সংজ্ঞা চলে আসছে সেখানে গীত বাদ্য এবং নৃত্যের একত্র সহাবস্থানের কথা বলা হয়।  তবে সে নৃত্য যে সর্বদা সঙ্গীত শিল্পীর নিজস্ব নৃত্য হতে হবে এমন নয়।  

তবুও গান বা সঙ্গীত বলতে আমরা সংজ্ঞা অনুযায়ী ভাবার পরিবর্তে শুধু কণ্ঠের ভূমিকাটাই বুঝি।  আবার যখন শুধুমাত্র যন্ত্র বাজানো হয় তখন বলি যন্ত্র সঙ্গীত।  উভয়ের মধ্যে সেতু বন্ধন করে আছে শব্দ।  তাই এবার শব্দের নিরিখে সঙ্গীতের সজ্ঞা সন্ধান করব। 

দার্শনিক দৃষ্টিতে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে শব্দ থেকে।  বিজ্ঞানের গবেষণা থেকে জানলাম যেশব্দের মূলে আছে কম্পন। জগৎ সংসার   সৃষ্টির কথাটিকে এখন নতুন ভাবে বলতে পারি যে যাবতীয় বস্তুর মূলে আছে কম্পন।  এখানেই সঙ্গীতের সঙ্গে একান্ত হয়ে যায় সমস্ত কিছুকারণ সঙ্গীতের শব্দের মূলেও আছে কম্পন।  অবশ্যই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে। 

কোন কিছু কম্পিত হয়সেই কম্পনে বাতাস কাঁপে৷ সেই কম্পিত বাতাস এসে পৌছায় আমাদের কানেমস্তিষ্কে একটা অনুভূতির সৃষ্টি করে।  আমরা কখনো খুশি হইকখনো বিরক্ত হই।  আমাদের অনুভূতির উপর নির্ভর করেভালো শব্দ অথবা খারাপ শব্দ।  কোন বাড়িতে লোহার গেটে বিকট শব্দ হলো।  সেই বাড়ির কোন  বালক সেই বিকট শব্দে আনন্দিত হলোকেননা সে জানে বাবা আসছে।   কিন্তু পাশের বাড়ির লোক বিরক্ত হলো।  তাই বলতে পারি একই শব্দের অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন রকম।  আবার পরদিন ভোরে যখন কোকিল ডাকবে তখন সেই বালকও যেমন আনন্দিত হবে পাশের বাড়ির ভারিক্কি মেজাজের কাকুও আনন্দিত হবে।  সেই কাকুর হয়তো সময় হবে না কোকিলটাকে দেখাকিন্তু সেই বালক গাছের পাতার আড়ালে কোকিলকে ঠিক খুঁজে বার করবে। কোকিলের কণ্ঠের জন্য তাকে ভালোবাসবে আবার কোকিলের অনুরূপ শব্দ নিজের কণ্ঠে তৈরি করে কোকিলের সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করবে।  পরিণত বয়সের মানুষের কাছে বালকের আচরণ নিতান্ত সাধারণ।  কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যেএই জাতীয়   বালক সুলভ আচরণ ছিল কয়েক হাজার বছর আগের চিন্তাশীল কিছু মানুষের মধ্যে।  তাঁরা পারতেন কবিতা রচনা করতে।   এবার পরিবেশ থেকে ভালোলাগা কিছু শব্দ বেছে নিয়ে নিজেদের কণ্ঠে উৎপাদন করার কৌশল আয়ত্ব করলেন।  সেই কবিতার উচ্চারণ করার সময় ব্যবহার করলেন পরিবেশ থেকে আহরিত   সেই সব শব্দ। সে সব শব্দ আর নিছক শব্দ রইল না।  তাদের বলা হল স্বর।    কবিরা  নিজেদের কণ্ঠস্বর মিলিয়ে দিতে চাইলেন সর্বজনের ভালো লাগা সেই স্বরগুলিতে।  এভাবেই স্বর আত্মপ্রকাশ করল কবিতার সুরে।  রচিত হলো সঙ্গীতের ভিত।  হয়তো বা তাঁরা জানতেনই নাসেই ভিতের উপর ভবিষ্যতে কী বিশাল অট্টালিকা গড়ে উঠবে।  

এখন আমরা সেই অট্টালিকা পেয়েছি। বহু প্রকোষ্ঠবহু অলিন্দ তার। নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী সেই সঙ্গীত অট্টালিকার কেউ  বাসিন্দা কেউ বা দর্শক।  

            এক এক করে শব্দ  আহরণ করা গেল। এগুলো সঙ্গীতের উপযোগী।  প্রতিটি শব্দ আলাদা করে চেনাও যায়।  এদের নাম দেওয়া হল 'শ্রুতি'   মোট সংখ্যা বাইশ। এর জন্য  নিশ্চয় অনেক সময় লেগেছে।  সেই শ্রুতি মানুষ তার কণ্ঠে তৈরি করার পাশাপাশি নানা রকম যন্ত্রের সাহায্যে সৃষ্টি করা শিখল।  যন্ত্র বলতে প্রধানত তার যন্ত্র।  মানুষ দেখেছিল এক বা একাধিক টান করে বাঁধা তার একদিকে টেনে ছেড়ে দিলে কাঁপতে থাকে ও শব্দ উৎপন্ন হয়। প্রাচীন কালে যখন ধাতুর তৈরী তার ছিল না তখন গাছের আঁশ কিংবা পশুর অন্ত্র থেকে তার তৈরি করত।   তারের কম্পন দেখে মানুষের ধারণা হলো যে তাদের গলায় যে শব্দ উৎপন্ন হয় সেখানেও কিছু না কিছু কাঁপতে থাকে।  মানুষের গলায় থাকে স্বরতন্ত্রী ( vocal cord)ফুসফুস যখন বাতাসকে ঠেলে উপরে পাঠায় তখন ভোকাল কর্ড এর কম্পনে শব্দ উৎপন্ন হয়।  ভোকাল কর্ডের লাগোয়া মাংস পেশি নিয়ন্ত্রণ করে আমরা শব্দের কম্পাঙ্ক পরিবর্তন করতে পারি।  আর এভাবেই গলা দিয়ে  নির্গত হয় গানের উপযোগী শব্দ।   সঙ্গীতের জন্য যে সব শব্দ নির্দিষ্ট করা আছে তাদের যত কাছাকাছি শব্দ যে কণ্ঠে তৈরি হবে সেই কন্ঠ তত সুরেলা।   কণ্ঠ সুরেলা  করার চেষ্টাই হল সঙ্গীত সাধনার প্রথম ধাপযদিও এর সূক্ষ্ণতার অন্ত নেই।  তাই যে কোন পর্যায়ে সঙ্গীতশিল্পীর কাছে স্বর সাধনার গুরুত্ব কমে না।  

বাইশটি শ্রুতির মধ্যে বারোটি শ্রুতি প্রত্যক্ষ ভাবে সঙ্গীতে ব্যবহার করা হয়।  এগুলোকে বলা হয় স্বর। এখন এদের  চেনার সব চেয়ে সোজা পথ হল হারমোনিয়াম যন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় করা।  এখানে যেকোনো একটি চাবি চাপলে একটা স্বর নির্গত হবে।  সেটাকে বলা হোক প্রথম স্বর।  এটাকে  নম্বর দিলে যথাক্রমে ১, , , ১০ও ১২ নাম্বার স্বর গুলি হলো শুদ্ধ স্বর। যাদের  নাম যথাক্রমে ষড়জ (সা)ঋষভ (রে)গান্ধার (গা) মধ্যম (মা)পঞ্চম (পা)ধৈবত (ধা)  ও নিষাদ (নি)।  বন্ধনীর মধ্যে দেওয়া হল ওদের ডাকনাম।  এই ডাক নাম গুলোই সঙ্গীতে ব্যবহার করা হয়। এই সাতটা বাদ দিয়ে বাকী পাঁচটি স্বর হলো বিকৃত স্বর ।  এদের চারটি হলো  (  , ৯ ও ১১ নাম্বার স্বর)  কোমল স্বরডাকা হয় ঠিক পরে অবস্থিত স্বরের নামে।  বাকী ৭ নাম্বার স্বরের নাম কড়িমা।  এই হলো বারোটি স্বরের কথা।  এছাড়া আছে আরো দশটি শ্রুতি  যেগুলো হারমোনিয়ামে বাজানো যায় নাএকমাত্র তারযন্ত্রে (যেমন এস্রাজ)  এগুলো ধরা দেয়।  

এবার হয়তো মনে হচ্ছে হারমোনিয়ামের বাকী চাবি গুলির নাম তো বলা হল না!  নাআর বলার দরকার নেইকেননা ১৩ নাম্বার স্বরটির নামও সা।  তবে অন্য এলাকার।  এই  দ্বিতীয় ' সা' এর কম্পাঙ্ক প্রথম সা এর কম্পাঙ্কের দ্বিগুণ। একই নামের ব্যক্তির মধ্যে  পার্থক্য করতে যেমন তাদের বাসস্থানের ঠিকানা বলি এখানে তেমনি বলা হয় সপ্তক (Octave)    হারমোনিয়ামে থাকে তিনটি সপ্তক।  ১৩ নাম্বার স্বর হলো 'তারা' সপ্তকের  প্রথম স্বর।  

সেই হিসাবে বললে ১ নাম্বার স্বর হলো ' মুদারা' সপ্তকের প্রথম স্বর।  আরএর আগের স্বর গুলির এলাকা কে বলা হয় 'উদারা' সপ্তক।  আমরা স্বর সাধনা শুরু করি মুদারা থেকে।  তবে কোথা থেকে কোন শিক্ষার্থী মুদারার সা শুরু করবে সেটা সঙ্গীত শিক্ষক ঠিক করে দেনশিক্ষার্থীর কণ্ঠের তীব্রতা অনুযায়ী। শিল্পীর   সেই বিশেষ মুদারা (সেই সঙ্গে   'উদারা' 'তারা' সপ্তকও)  হারমোনিয়ামের যে অংশ সূচিত করে তাকে  বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে।  যেমন এবিবি ফ্লাটসিসি ফ্লাট, ডিএফ ইত্যাদি।  এগুলো হলো সঙ্গীতের স্কেল। যে স্কেলই হোকনা কেনমুদারার কোন স্বরের কম্পাঙ্কের দ্বিগুন হবে তারা সপ্তকের ঐ স্বরের কম্পাঙ্ক। সঙ্গীত পরিবেশন করার সময় সমস্ত সাহায্যকারী যন্ত্রের কম্পাঙ্ক  নিয়ন্ত্রণ করে একই স্কেলে নিয়ে আসা হয়। তবেই সঙ্গীত অধিকতর শ্রুতি মধুর হয়।


আরও পড়ুন  -

বেচারা তিমি

নানা রকম দেখা

মাধ্যাকর্ষণের পথ ধরে

ইংরাজি ভাষা ও তার অক্ষর পরিচয়