আজ আনন্দপুর রাজ্যের আকাশে বাতাসে উৎসবের সুর, প্রজারা সবাই সেজেগুজে সপরিবারে রাজপ্রাসাদে হাজির হচ্ছে। ভোর থেকেই নানা বয়সী মানুষজনের আগমণে রাজপ্রাসাদ সরগরম। রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলের প্রশস্ত পরিষ্কার দালানে, প্রাঙ্গণে রাখা সারিসারি সুন্দর নকশাতোলা আসনের সামনে কলাপাতা আর পানীয়জলের মাটির ভাঁড় রাখা আছে। রাজ্যের মেয়ে বউরা নিজেদের ঘর থেকে এইসব আসন আগে থেকে রেখে দিয়ে গিয়েছে, এ-সব হাতের কাজ রানি রূপমতী তাদের যত্ন করে শিখিয়েছেন। প্রাঙ্গণের চারপাশ ঘিরে চকমিলানো দালানের পূবদিকে শ্বেতপাথরের মেঝেতে পাতা গালিচার ওপরে রাখা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে প্রসন্ন মুখে রাজা নেপালচন্দ্র আর মন্ত্রী বগলাচরণ পাশাপাশি বসে আছেন। দু'জনেই নিজের পাশে রাখা সোনা বাঁধানো গড়গড়ার নলে মুখ দিয়ে শব্দ করে তামাক টানছেন, সামনে বড় এক কাঁসার রেকাবিতে রাখা আছে চানাচুর আর চিনেবাদাম ভাজা, মাঝেমধ্যে রাজামশাই মুঠোয় করে নিয়ে চিবোচ্ছেন। মন্ত্রী তাই দেখে গড়গড়ার নল মুখ থেকে নামিয়ে বলেন, ”খানিক আগেই তো জলযোগে খান চব্বিশেক ঘিয়ে ভাজা ফুলকো লুচি, কাশ্মীরি আলুর দম আর বড় এক বাটি কাজুবাদাম, কিশমিশ দেওয়া গব্য ঘিয়ে তৈরি সুজির মোহনভোগ খেয়ে উঠলেন! এরমধ্যে কিকরে খিদে পায়! এবার খানিকক্ষণের জন্য পাকস্থলীকে একটু বিশ্রাম দিন।”
নেপালচন্দ্র উদাসী মুখে বলে ওঠেন, “আবার তো উনত্রিশ দিন শুকনো রুটি, ঢ্যাঁড়সের
তরকারি আর ট্যালটেলে ঝোল ভাত খেয়ে ডায়েট করতে হবে! ওসব খেয়ে পাকস্থলী এমনিই শুকিয়ে
চিমসে হয়ে গিয়েছে। এই একদিনই পুষিয়ে নিতে হয়। এ রাজ্যে রাজার থেকেও রানি আর মন্ত্রী বেশি মাতব্বর! আজকে
পেটপুরে না খেলে পাকস্থলী এক্কেবারে ফুসকুড়ি হয়ে যাবে।” রাজামশাই এবার
এক মুঠো চানাচুর নিয়ে কচরমচর করে চিবোতে থাকেন।
মন্ত্রী হাত বাড়িয়ে কাঁসার রেকাবি নিজের দিকে নিয়ে আসতে আসতে বলেন, ”এরকম অসংযমী
রাজার মন্ত্রী হয়ে সুখ নেই।”
নেপালচন্দ্র উত্তর না দিয়ে গালিচা থেকে উঠে রন্ধনশালার দিকে এগোন।
দক্ষিণদিকের দালানের লাগোয়া বিশাল রন্ধনশালায় চূড়ান্ত ব্যস্ততা চলছে। একদিকে
সবজি কাটাকুটি হচ্ছে, অন্যদিকে শিলের ওপর নোড়ার পেষণে বাটনা বাটার সাথে সাথে
আরেকদিকে হামানদিস্তেয় মশলা গুঁড়ো করাও চলছে। আর এক দিকে ইঁটের তৈরি বড় বড়
উনুনে দাউদাউ আগুন জ্বলছে, বড় বড় লোহার কড়াইয়ে রান্না চাপছে, সুসিদ্ধ হলেই
সুস্বাদু পদ সারি সারি পিতলের গামলায় ঢেলে রাখা হচ্ছে। থরেথরে খাবার প্রস্তুত করে
রাখা হচ্ছে, কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। রানি রূপমতী ও মন্ত্রীপত্নী কলাবতী
সবকিছুর তদারক করছেন। আজ প্রাসাদে এই রাজ্যের সবার দ্বিপ্রাহরিক আহারের
নিমন্ত্রণ।প্রায় দশ বছর ধরে প্রতিমাসের শেষের দিনেই এই অনুষ্ঠান হয়।রাজা
নেপালচন্দ্র আর মন্ত্রী বগলাচরণের মিলিত উদ্যোগে এই রাজকীয় ব্যবস্থা। অবশ্যই সমস্ত
কর্মকান্ডের নেপথ্য কারিগর রানি রূপমতী।
প্রতি অনুষ্ঠানের পেছনে এক কার্যকারণ থাকে,এক্ষেত্রেও আছে।
বছর দশেক
আগেকার কথা, ষাটোর্ধ রাজামশাই, ভূপালচন্দ্র যখনই স্ত্রী সহ তপোবনে যাওয়ার ইচ্ছে
প্রকাশ করেন তখনই একমাত্র পুত্র, তৎকালীন যুবরাজ নেপালচন্দ্র হাত পা ছড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে
বসেন।
"ও বাবা, মাগো,আমায় ফেলে তোমরা চলে যেওনা।আমার যে রাজা হতে এক্কেবারে
ভাল্লাগে না। সকালে ঘুম ভেঙে
রাজ্যের কাজকম্ম করার কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে! যাত্রাপালার মতো ভারি ভারি রাজপোশাক গায়ে চাপানোর কথা মনে
হলেই গা চিড়বিড় করে! তাছাড়া,
ভোরবেলা দুচোখের পাতা খুলতে ভীষণ কষ্ট হয়! আজ পর্যন্ত বাবার বাজখাঁই গলার আওয়াজ না শুনলে ঘুম তো ভাঙেও
না!আর মা চলে গেলে আমায় ভালোমন্দ রেঁধে খাওয়াবে কে!"
সামনেই নেপালচন্দ্রের মা, রাজ্যের রাজমাতা দুর্গাবতী দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি পুত্রের
কথায় প্রতিবাদ করে বলেন, "আর জ্বালাসনি নেপাল! রাজপুত্র হয়ে টপাস টপাস করে মিথ্যে
বলতে মুখেও আটকাচ্ছে না!রূপমতী সর্বক্ষণ সবদিকে নজর রেখে তোর যত্ন করছে! আসলে
অতিরিক্ত যত্ন পেয়ে পেয়েই তোর এই দশা হয়েছে! কিছু নিজে থেকে করতে চাস না!"
রাজমাতা চল্লিশোর্ধ পুত্রের নাবালকের মতো আচরণে যারপরনাই বিরক্ত হন,
"মহারাজ ঠিক বলেছেন। রাজপুত্রের একদিনও সকালে নিজে থেকে ঘুম ভাঙেনা। রাজ্যের কাজের জন্য তাড়া নেই যে! মন্ত্রীপুত্রের সাথে শুধু ভ্রমণ আর ভোজন,
বয়োবৃদ্ধিই হয়েছে, দায়িত্ব না নিলে এরকমই থাকবে।"
নেপালচন্দ্র কাঁচুমাচু হয়ে জানান, "আগামীকাল থেকে
নিজেই ঘুম থেকে উঠে রাজ্যের কাজকম্ম দেখাশুনো করবো।"
বাস্তবে কথায় আর কাজে কোনো মিল দেখা যায়না।সবার অজান্তে মন্ত্রীপুত্রের সাথে
অশ্বারূঢ় হয়ে চুপিসারে বেরিয়ে যান।
এমতাবস্থায় একদিন ভূপালচন্দ্র রেগেমেগে বললেন,"না, আর বিলম্ব নয়। দুই নাতনির বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে, আর কতদিন এই
রাজ্যভার সামলাবো? পরকালের চিন্তা, ঈশ্বরের আরাধনায় কথা আর কবে ভাববো? চল্লিশ বছর ধরে
সিংহাসনে বসে বসে কোমরে ব্যথা হয়ে গেলো! যেমন রাজপুত্র তেমনই
মন্ত্রীপুত্র!বগলাচরণের বাবা, কালিচরণেরও তথৈবচ অবস্থা। এবার তোরা দুজনে রাজ্যের দায়
দায়িত্ব নে,নইলে যা পারিস কর। আমাদের তপোবনে যাওয়া একপ্রকার স্থির।"
রাজমাতা দুর্গাবতী আর রানি রূপমতী দুজনেই পরস্পরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসেন।
এরপর পাঁজিপুঁথি দেখে রাজপুরোহিতের কথামতো শুভ দিনে ভূপালচন্দ্র আর কালিচরণ
সস্ত্রীক তপোবনে চলে যান।প্রজারা চোখের জলে তাদের বিদায় দেয়। তারপর থেকেই নেপালচন্দ্র আর বগলাচরণের অহর্নিশ ভ্রমণ বন্ধ
আর সেইজন্যই দুজনের আরও বেশি মন খারাপ। মাঝেমধ্যেই অকারণে দুই বন্ধু ডুকরে কেঁদে উঠছে,
"ও বাবা গো,ও মা গো!" রাজপ্রাসাদের সবাই তাই দেখেশুনে কেউ মুখ টিপে,
কেউ আঁচলে মুখ ঢেকে,কেউ আবার ফিচিক করে হেসে ফেলছে।
রূপমতী আর কলাবতীও খিলখিলিয়ে হাসেন। বেশ কয়েক মাস এভাবেই চলে যায়।রাজা আর মন্ত্রী,দুজনেই সময় করে
খেয়েদেয়ে মুখ গোমড়া করে থাকেন। ভোজন ঠিকঠাক হলেও ভ্রমণ একদমই বন্ধ।রূপমতী তাদের মন
ভালো করার নানান ফন্দিফিকির করেও ব্যর্থ হয়ে প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছেন,বুদ্ধি বের
করতে গিয়ে মাথা চুলকে চুলকে চুল উঠে যায়,চুলে জট পড়ে যায়, সেই জট ছাড়াতে
অত্যধিক সময় চলে যায়,তবুও যুতসই কোনো উপায় আর বের করতে পারেন না।
এক দুপুরে, অবসরে রূপমতীর শয়নকক্ষের পালঙ্কে বসে কলাবতী দীর্ঘশ্বাস
ফেলেন,”সই, মন্ত্রীমশাই আজকাল প্রাত:ভ্রমণেও যাচ্ছেন না, কোনো কথার
উত্তরও দেন না। কিছু বললেই
ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেন।”
রূপমতী হাসতে হাসতে সইয়ের গায়ে লুটিয়ে পড়েন,” এদিকে তো
খেয়েদেয়ে শয্যায় বসে কাঁদতে কাঁদতেই অঘোর নিদ্রায়।”
কলাবতীও হাসিতে যোগ দেন,"বয়েস হয়েছে এখনো বালখিল্যের মতো আচরণ আর সয়না।রাজ্যের কথা
না ভেবে নিজেদের মিথ্যে হাহুতাশ করতেই ব্যতিব্যস্ত।এ কেমন রাজা, এ কেমন
মন্ত্রী! এদ্দিন ঝামেলা
ঝঞ্ঝাট হলে দুজনের শ্বশুরমশাই আর শাশুড়ী মায়েরা মিলে একটা না একটা উপায় ঠাউরাতেন,
এখন! সই, শীগগির কোনো একটা উপায় বের করতে হবে!" রূপমতী কলাবতীর
কাছে পরামর্শ চান। কলাবতী রানির বাল্যসখীও, জন্মাবধি একই
রাজ্যের বাসিন্দা, আবার দুজনে একই দিনে একই রাজ্যে বিবাহিত জীবনে প্রবেশ
করেছেন।
"ওদের দুজনকে প্রজাদের অভিযোগের কথা জানানোর ব্যবস্থা করে ব্যতিব্যস্ত রাখলে
কেমন হয়!", কলাবতী গালে হাত রেখে নিজের মনে বলেন।
"পরামর্শ মন্দ নয় কিন্তু রাজসভায় তো প্রজারা অভাব অভিযোগ জানাতেও আসেনা। এ রাজ্যে প্রজারা তো আনন্দেই থাকে। আগে তাও মন্ত্রীমশাইয়ের অনুরোধে প্রজারা আসতো
এখন তো মন্ত্রীমশাইও রাজার মতো একই আচরণ করছেন! "রূপমতী কলাবতীর কথায় কিছুক্ষণ ভাবেন, মাথায় এক
বুদ্ধি আসে,তারপর সখীর দিকে জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা
জানান। সব শুনে কলাবতীও উৎসাহী হন,"মন্দ নয়,চেষ্টা করে দেখা যাক!" সেইমতো
বিশ্বস্ত কিছু দাসদাসীর সাহায্যে আরো এক উপায় স্থির হয়।
এর ক'দিন পরেই রাজামশাই আর মন্ত্রীমশাই ভরপেট প্রাতরাশ শেষ করে
রাজসভায় নিজেদের আসনে বসে গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে যখন নিজেদের পিতামাতার
অনুপস্থিতির কথা ভেবে বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন রাজপ্রাসাদের ফটকে ঝোলানো বিশাল
পিতলের ঘন্টা "ঢং, ঢং, ঢং" করে তিন তিনবার বেজে উঠলো। বহু যুগ আগে সুবিচার চাইতে
প্রজারা এই ঘন্টা বাজাতো,সেসব অরাজকতা এই রাজবংশের চোদ্দ পুরুষের আমলে প্রজারা কেউ
স্বচক্ষে দেখেনি। রাজপ্রাসাদের সেই জৌলুশ এখন না থাকলেও ঘন্টাটা ঠিক
আগেরমতোই ঝোলানো আছে,মাঝেমধ্যেই সেটা নামিয়ে তেঁতুল দিয়ে ঘষেমেজে ঝকঝকে করে আবার
ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।কখনোসখনো রাজসভায় প্রবেশের আগে, এদিকওদিক চেয়ে
রাজামশাই নিজেই সেটা বাজিয়ে দিয়েই টুপ করে সিংহাসনে বসে পড়েন, আড়াল থেকে রানি
সেই কান্ড দেখে মুখে আঁচল চেপে হাসি লুকোন।
সেদিন ঘন্টাধ্বনির গমগমে আওয়াজে রাজামশাই চমকে প্রশ্ন করেন, "মন্ত্রী,
এ রাজ্যে এমন কি অঘটন হোলো?ঘন্টা কে বাজায়!"
মন্ত্রীও হতবাক, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও চেপে যান, "বুঝতে পারছি
না।রাজ্যের খবরাখবর রাখা হচ্ছে না। বেশ কদিন তো এভাবেই শোকপর্ব চলছে!"
বলতে না বলতেই প্রায় নব্বই বছরের এক সিড়িঙ্গে বৃদ্ধ হাতে লাঠি,চোখে পুরু
কাঁচের চশমা, খালি গায়ে হেটো ধুতি পড়ে রাজসভার সামনে এসে দাঁড়ায়। ইতিউতি
চেয়ে ভুরু কুঁচকে,মাথা উঁচিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে খুনখুনে গলায় বলে,
"কোনজন রাজা আর কেই বা মন্ত্রী, কিছুই তো ঠাহর পাচ্ছিনা।"
"ঠাহর করার দরকার নেই,যা বলার বলে ফেলো।” মন্ত্রী বলেন।
রাজা মন্ত্রীকে থামিয়ে প্রশ্ন করেন, ”এই শরীরে তুমি কি একা এসেছো?তুমি তো সোজা
হয়ে দাঁড়াতেই পারছো না, তাহলে ও-ই ঘন্টার নাগাল পেলে কিকরে!"
“এটা আপনি ঠিকই ধরেছেন।” মন্ত্রী তারিফ করেন,বুঝতে পারেন,মনমরা হলেও
রাজার বুদ্ধিতে কিন্তু মরচে পড়েনি।
বুড়ো ফোকলা মুখে তুবড়ানো গালে হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি!
"কাছেই তো থাকি,এর ওর হাত ধরে এসে পড়েছি। আর ঘন্টাটা ঝুলছে দেখে বাজানোর ইচ্ছে হলো।ওই যে
ব্যাটাচ্ছেলে নিমাই, রাজপ্রাসাদের দারোয়ান,তাকে বলতেই
আমায় খপাৎ করে কোলে তুলে নিলো! ব্যাটা জওয়ান মানুষ,গায়ে বল আছে,তার জন্যিই
ঘন্টা বাজাতে পারলাম। একবার বাজালেই হোতো কিন্তু এ জন্মে আর বাজানো হবে
কিনা কে জানে!তাই তিনবারই বাজালুম।"
"তা, অভিযোগ কিছু আছে নাকি?" রাজামশাই সিংহাসনে সোজা হয়ে বসেন।
"আছে বৈকি। নইলে এই শরীরে
এদ্দুর কেউ আসে?” বুড়ো সিংহাসনের দিকে এগিয়ে আসে।
“তাহলে বলে ফেলো।” নেপালচন্দ্র সোজা হয়ে বসেন।
“বড় আদরের
একমাত্র নাতবৌয়ের কাছে আবদার করে ঘিয়ে ভাজা রসে চপচপে ক'খান ক্ষীরের
মালপোয়া খেতে চেয়েছিলুম, সে কিছুতেই তৈরি করে দেয় নি। এখন অতৃপ্তি নিয়ে যদি মরণ হয় তবে তো আবার এই পৃথিবীতে জন্ম
নিতে হবে। আমি বাপু আবার জন্ম নিতে চাইনা। আমার মালপোয়া চাই।"
বুড়ো সিংহাসনের সামনে সরু সরু দুই পা ছড়িয়ে, বসে পড়ে।
নেপালচন্দ্র সেই দেখে বলে ওঠেন, “ও কি,তুমি অমন বসে পড়লে কেন?”
“বেশিক্ষণ দাঁড়ালে আমার ঠ্যাং কাঁপে। একটা ফয়সালা করে দিলেই নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যাই।” বুড়ো বসে বসেই
বলে।
"তোমার নাতবৌ মালপোয়া না দিয়ে ভারি অন্যায় করেছে।ঠিক আছে, দেখছি কি করা
যায়। এখন তুমি বাড়ি যাও,” বলেই মন্ত্রী হাঁক পাড়েন, ”এই কে আছিস,একে বাড়ি পৌঁছে
দিয়ে আয়।" মন্ত্রীর ডাকে নিমাই তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে। নিমাইয়ের
বাপ-ঠাকুর্দাও রাজপ্রাসাদের দারোয়ানের কাজই করে গিয়েছে। তবে নিমাইয়ের কাজ কিছু বেশিই, কখনো দ্বারপাল,
কখনো অশ্বপাল, কখনো বা গো-পাল, কখনো আবার ভৃত্য, প্রয়োজনে মালি,
মোটকথা একাই একশো! রানি নিমাইকে খুব স্নেহ করেন। রাজপ্রাসাদেরই এক কক্ষে তার
আস্তানা।
সে এসেই বুড়োকে চ্যাংদোলা করে অবলীলাক্রমে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায়।রাজা আর
মন্ত্রী পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন।
মন্ত্রীই প্রথমে নীরবতা ভঙ্গ করেন, "আজ রাতে গোপনে,
ছদ্মবেশে বুড়োর খবরের সত্যতা জানতে আমাকে বের হতে হবে।"
"রাজ্যের রাজা হয়ে চুপ করে বসে না থেকে আমিও যাবো। মৃত্যুর আগে বৃদ্ধ প্রজা সামান্য মালপোয়া খেতে চেয়ে পাবেনা,
এ হতে পারেনা!" বলতে বলতে রাজামশাই নিজেও আনমনা হয়ে যান, আপনমনে বলে
ওঠেন, "বগলা, শেষ কবে মালপোয়া খেয়েছি!"
"ভুলে গেলি এরইমধ্যে! ন্যাপলা,
তোর, স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছে! ব্রাহ্মীশাক খা!"
রাজামশাই রেগে
যান, "আবার!"
"নিজের বেলা আটিসুটি পরের বেলা দাঁতকপাটি! তুই যে আমায় 'বগলা' বললি!তার বেলা!"
মন্ত্রীমশাই রাজার দিকে ক্রুদ্ধভাবে তাকান।
"বেশ, বেশ, শোধবোধ।"
"পিতামাতা তপোবনে যাত্রার দিন অন্যান্য খাবারের সাথে সুগন্ধি ঘিয়ে ক্ষীরের
মালপোয়া ভাজা হয়েছিল।তুই নিজেই খান পঞ্চাশেক খেয়েছিলি। তখন তোর যা চেহারা
ছিল!মহারাজ নয় এক্কেবারে গজরাজ!"
নেপালচন্দ্র
আবারও চোখ পাকান, "মন্ত্রী, পুনরায় আপনি আমায় অপমান করলেন!"
"গোদা হাতি বলতে গিয়েও সামলে নিয়েছি! যাকগে, এবার বরং সভাভঙ্গ করে ওঠা যাক, দ্বিপ্রাহরিক
ভোজন শেষে দিবানিদ্রাও দিতে হবে। অদ্য রাত্রি জাগরণে সুখনিদ্রার দফারফা।" মন্ত্রী উঠে
পড়েন, "ছদ্মবেশের আলখাল্লা খুঁজেপেতে বের করতে হবে।"
রাজা আর মন্ত্রী দিবানিদ্রায় যেতেই রূপমতী আর কলাবতী
স্বামীদের আলখাল্লা ভালোভাবে পরখ করে ছেঁড়াখোড়া জায়গা সূচসুতোয় রিপু করে পোশাকের
তাকে এমনভাবে রাখেন যাতে সহজেই চোখে পড়ে।খাস দাসী মালতী আর নিমাইকে ডেকে রানি বাকি
কর্মপন্থা সাজিয়ে নেন।
রাত গভীর হয়, আহার শেষে রাজামশাই আর মন্ত্রীমশাই আলখাল্লায় নিজেদের আবৃত
করে রাজপথে নামেন।
রূপমতীও পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন, কলাবতীও নিজের পালঙ্কে চোখ বোজেন।
"বুড়োর কথা যদি সত্যি হয়,তবে এই বাড়িটাই মনে হচ্ছে।" মন্ত্রী
পরিচ্ছন্ন এক মাটির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান।
"ঘরে আলো জ্বলছে, কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয়না?" রাজা প্রশ্ন
করেন।
"রাস্তায় কাউকে দেখা যাচ্ছে? এই রাতবিরেতে কে আর ঘর থেকে বেরোবে!" মন্ত্রী আলো
লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে রাজাও তাকে অনুসরণ করেন।
খোলা জানলা দিয়ে উঁকি দিতেই ঘরের এককোণে রাখা মৃদু লন্ঠনের আলোয় ভেতরের দৃশ্য
চোখে পড়ে। এক তরুণী
শয্যায় শায়িত সে-ই বৃদ্ধের পা টিপে দিচ্ছে, "দাদু,রাজার পেয়াদা
যদি তোমার নালিশ শুনে আমায় ফাটকে পুরে দেয়, তোমার নাতি
কিন্তু মনের দু:খে তপোবনে চলে যাবে!"
বুড়োর গলার আওয়াজ ভেসে আসে, "আমি কি মিথ্যে নালিশ করেছি? তোকে মালপোয়া
করতে বলিনি? তুই করেছিস?"
"ওমা! কবিরাজ মশাইয়ের
কথা অমান্যি করবো! আমার এতো বড়
দু:সাহস আছে নাকি! উনি পইপই করে
কুপথ্য ভোজন করতে বারণ করেছেন,কদিন আগেই যমেমানুষে টানাটানি গেলো! বাড়ির সবার চিন্তায়
মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়, আর তুমি মালপোয়া খাওয়ার কথা ভাবছো! "তরুণী এবার বুড়োর পায়ে রাখা হাত নিজের মাথায়
ঠেকায়, "হে ভগবান!এই লোলা সকসকে বুড়ো দাদাশ্বশুরকে নিয়ে আমি কি করি!"
বুড়ো মুচকি হাসে, "বেশি ভাবিস না। রাজার পেয়াদাও নেই কয়েদখানাও নেই। আর আমাদের
রাজামশাইও খুব ভালোমানুষ। রাজার ঠাকুর্দাই বাউণ্ডুলে আমায় এখানে জমিজমা দিয়ে থিতু
করিয়ে দিয়েছিলেন।পুণ্যির রাজত্ব, আমাদের ভাগ্য ভালো বলেই বংশ পরম্পরায় এমন রাজাদের রাজত্বে
বাস করি।তাছাড়া মন্ত্রীমশাই আছেন না!উনি বিচক্ষণ মানুষ। তুই বরং ভোরে রানিমাকে ক্ষেতের টাটকা শাকসব্জি দিয়ে আসবি। এখন ভাগ এখান থেকে!"
তরুণী বৃদ্ধের গায়ে চাদর চাপা দিয়ে মশারি টাঙিয়ে লন্ঠনের আলোর সলতে আরও কমিয়ে
দিয়ে সে ঘর থেকে চলে যায়।
রাজামশাই মন্ত্রীর দিকে চাইতেই মন্ত্রী বলেন, "এইজন্যই আড়াল
থেকে স্বচক্ষে দেখে স্বকর্ণে শুনে বিচার করতে হয়। নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য
যাচাই করে দেখতে হয়।এবার খানিক এগিয়ে দেখি।"
সামান্য এগোতেই এক জেলের বাড়ি, খোলা উঠোনে জাল ছড়ানো আছে, মাছের আঁশটে
গন্ধ,অন্ধকারে বাড়ির পাঁচিলে বেশ কয়েক জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে।
"ভুউত, ভুত, ওরে বগলা! প্রাসাদে ফিরে চল!রাম রাম,রাম রাম! "রাজামশাই ততক্ষণে চোখ বুজে ফেলে মন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেছেন।
"আরে, ছাড়ুন শিগগির,ওগুলো বিড়ালের চোখ,মাছের গন্ধে ওত
পেতে বসে আছে! আপনি বরং
এখানেই দাঁড়ান, আমি উঁকি মেরে আসি, কিছু জানা যায় কিনা!"
"আমি একা থাকতে পারবো না!" রাজাও মন্ত্রীর সঙ্গ নেন।
আচমকা ঘরের দরজা খুলে যায়, শাড়ি পরা একজন একহাতে হ্যারিকেন অন্য হাতে একটা থালা নিয়ে
বেরিয়ে এসে সেই পাঁচিলের দিকে এগিয়ে যায়। তার কণ্ঠস্বর শোনা যায়, "উমনি, ঝুমনি, চুন্নি মুন্নি,
সব আয়।নে, মাছ ভাজা খেয়ে
বিদেয় হ। কত্তা আজ নদীতে
জাল ফেলে অনেক মাছ ধরেছে, ক্লান্তিতে খেয়েদেয়ে নাক ডাকছে, আমিও এবার
ঘুমোতে যাবো। ভোরে উঠতে হবে। বেশ কয়েকখানা রুই, গলদা চিংড়ি
আলাদা করে মাটির জলভর্তি জালায় রেখে দিয়েছি, রানিমাকে
সক্কালবেলা দিয়ে আসবো, শুনেছি আমাদের রাজামশাই ডালনা আর চিংড়ির মালাইকারি খেতে খুব
ভালোবাসে।"
বেড়ালগুলো আদুরে ডাকে, "ম্যাও!"
বৌটি তাদের সাথে বকবক করে, "যা,ভাগ এবার!আমাদের রাজা বড্ড ভোলেভালা,তার জন্যই তো
আমরা এতো শান্তিতে আছি। খাজনার বাজনা
নেই, নিজের আরাম আয়েস নেই। বাপ মাকে কি
মান্যিগন্যি করে! যেমন রাজা তেমনই মন্ত্রী!বায়া আর তবলা।"
ঘরের ভেতর থেকে পুরুষের ঘুম জড়ানো গলা ভেসে আসে, "ও বৌ, শুবি আয়।"
বৌটি আর দাঁড়ায় না। দেওয়ালে
অন্ধকারে মিশে থাকা রাজা মন্ত্রীকে লক্ষ্যও করেনা।
মন্ত্রী আবার ফোঁসফোঁস আওয়াজ শুনতে পায়, বিরক্ত হয়ে বলে
ওঠেন, "এখন আর কান্নাকাটি না করলেই নয়! এরকম ভিতু,প্যানপেনে রাজা আর কোন রাজ্যে আছে!"
নিঝুম রাত, রাস্তা জনশূন্য, আশেপাশে বাড়ির প্রধান দরজা কোথাও হাট করে খোলা,
কোথাও ভেজানো, কোথাও বা বন্ধ করা। এ রাজ্যে চুরিডাকাতি হয়না, একে অন্যের বিপদেআপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাজসভায় যারা যায়,সেও রাজার
জন্যই, প্রতিদিন সিংহাসনে মন্ত্রীকে নিয়ে একাএকা বসে থাকেন,কেউ না গেলে মন
খারাপ হবে না! অনেক সময়
মন্ত্রী বা রানিও প্রজাদের আমন্ত্রণ জানান।
"আর হাঁটতে পারছি না।" রাজামশাই হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন।
"ইদানীং প্রাতঃভ্রমণে ঢিলেমি হচ্ছে অথচ এলাহি খাবারদাবার খাওয়া চলছে! আমার আর
কি! আবার গজরাজ
হবেন! চলুন, ওই পাথরের ওপর
সামান্য বসা যাক।" মন্ত্রী রাস্তার পাশে পড়ে থাকা পাথরের বেদির দিকে এগিয়ে যান।
পাশাপাশি বসতেই রাজা বলেন, "কি ভালো সব প্রজা!"
"পূর্ববর্তী রাজা আর মন্ত্রীরাও ভালো হওয়ায় প্রজারাও বংশ পরম্পরায় সেই ধারা
বজায় রেখেছে। এদের বাপ
ঠাকুর্দারাও অনেক সুযোগ সুবিধে পেয়েছে, অকৃতজ্ঞ নয়। "মন্ত্রীরও আত্মপ্রসাদ আসে,তারাও যে এই
রাজ্যে বংশ পরম্পরায়, মন্ত্রী পদ অলংকৃত করেন! রাজ্য পরিচালনায় তাদেরও যে অবদান
আছে।
আচমকাই রাস্তার অদূরে নিমাই এসে হাজির হয়, মনেমনে বলে,
"এই রাতদুপুরে এখানে দু'জনে বসে কেন?অন্য কোনো মতলব নেই তো!যাকগে, আমি আমার
কর্তব্যটুকুই করি।"তারপর কাছে, আসে, চিনতে না পারার ভান করে জিজ্ঞেস করে, "হেই, তোমরা কারা?
রাতে না ঘুমিয়ে এখানে বসে কি করছো? দেখছো না সারা রাজ্য নিদ্রায় যাচ্ছে!নির্ঘাত
কোনো বদ মতলব আছে। চলো, রাজার কাছে চলো।"
মন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে কন্ঠস্বর বিকৃত করে বলেন, "সামনেই বাড়ি,
পথশ্রান্ত হয়ে দুই বন্ধু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। তুমি যাও নদের নিমাই, আমরাও এগোই।"
মন্ত্রী রাজার হাত ধরে টান মেরে, দ্রুত পদক্ষেপে রাজপ্রাসাদের দিকে অগ্রসর হন।
নিমাই খানিক দাঁড়িয়ে থাকে, মাথা চুলকে ভাবে, ”আমার এখন কি করা উচিত,বুঝে উঠতে
পারছি না!যাক গে! এবারে আমিও
প্রাসাদে ফিরে ঘুম দেবো, সকাল থেকেই আবার রাজ্যের কাজ!"
আলখাল্লা ছেড়ে রাতের পোশাক পরে রাজা মন্ত্রী দুজনেই নিজেদের
শয্যায় শায়িত হতে না হতেই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েন।
সূর্যের রোদ গায়ের চামড়া বুঝি জ্বলুনি ধরিয়েছিল, রাজামশাইয়ের
ঘুম ভাঙে, শয়নকক্ষের খোলা জানলা দিয়ে রোদ্দুর এসে গায়ে পড়েছে।
কতো বেলা হোলো! কেউ ডাকেনি
কেন! বাতাসে কিসের
সুগন্ধ ভেসে আসছে!
"রানি!নিমাই কই!" রাজা শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন।
"ঘুমুচ্ছে!"
"এখনো!"
“টলতে টলতে উঠে উদ্যানে যাচ্ছিল, আমিই বারণ করলাম। একা ওই বয়েসের ছেলে কত দিক আর সামলাবে! তাছাড়া, আজকে সাতসকালে প্রজারা সবজি, মাছ দিয়ে
গিয়েছে, বাজার যাওয়ার ঝক্কিঝামেলা নেই বলে আমিই ওকে আরও খানিক ঘুমোতে বললাম! গরুঘোড়া, ঘরদোর, বাগান সব তো
একহাতে সামলায়!দরকার পড়লে আবার রাতেও টহল—! ” রূপমতী নিমাইকে দিয়েই বুড়োর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন, মুখ ফস্কে বলে
ফেলছিলেন, চেপে গিয়ে কথা ঘুরিয়ে নেন,” মন্ত্রীমশাইও
কখন উঠে প্রাতঃভ্রমণ শেষে প্রাতরাশ সেরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
“বাতাসে পরিচিত খাদ্যের সুগন্ধ ভেসে আসছে।”
“মালপোয়া ভাজা হচ্ছে।” রূপমতী রাজামশাইয়ের মুখের ভাব পরখ করেন।
"মালপোয়া! গন্ধেই মালুম হচ্ছিল! তা, হঠাত এতো সদয় হওয়ার কারণ কি!"
রাজামশাইয়ের প্রাণমনে আনন্দর সাথে কৌতূহল জেগে ওঠে।
"প্রজাদের বিতরণের জন্য, প্রতিদিন ওরা এটাসেটা দিয়ে যায়, নিয়ম করে
রাজপ্রাসাদ মেরামত করে দিয়ে যায়। এদ্দিন জানতাম, রাজাই প্রজাদের
দেখভাল করেন, কিন্তু এ
রাজ্যে তো প্রজারাই রাজার যত্ন আত্তি করে! সেইজন্য মাঝেসাঝে ওদের কথাও তো ভাবতে
হয়! আমার হাতের
তৈরি ক্ষিরের মালপোয়া খেতে সবাই ভালোবাসে! আপনার জন্যও দুখানা রেখে দিয়েছি! "রানি রাজার হাতে গামছা ধরিয়ে দেন, "মন্ত্রীমশাই
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন কিন্তু!"
"ঘিয়েভাজা মালপোয়া!তাও মাত্র দুখানা!" রাজামশাই হতাশা
গোপন করেন না।
"মন্ত্রীমশাইয়ের হুকুম,এর বেশি খেলে আবার শরীরের গন্ডগোল হবে। "রাজার কাছে এসে
ফিসফিস করেন, "আরও চাড্ডি সরিয়ে রেখেছি,সময় বুঝে দেবো'খন।"
বহুদিন পরে রাজা রানির দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকান, ”ধন্য তুমি
রূপমতী।” গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে রাজামশাই স্নানঘরে ঢুকে
যান।
ভোজনকক্ষে রানির দেওয়া মালপোয়া খেয়ে রস চাটতে চাটতে রাজামশাই
মন্ত্রীকে জানান, "আজ সন্ধ্যেয় জরুরি আলোচনা সভা বসবে।আপনি সস্ত্রীক আসবেন।"
"জরুরি আলোচনা! কোন ব্যাপারে?
এখনই বলে ফেললেই তো হয়!"মন্ত্রী আয়েস করে মালপোয়ায় কামড় দেন।
"মালতী বরং সইকে ডেকে আনুক।" রূপমতী রাঁধুনিকে নির্দেশ দিতেই কলাবতী এসে হাজির।রূপমতীর
নির্দেশে মালতী কলাবতীকে বসার জন্য কাঠের চৌকি এগিয়ে দিয়ে
কাঁসার রেকাবিতে খানকয়েক মালপোয়া ধরিয়ে দেন।
রাজামশাই সে-ই রেকাবির দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকেন।
মন্ত্রী তাই দেখে গলা খাঁকারি দেন, "জরুরি আলোচনার
কি হোলো?"
রাজামশাই উদাসভাবে বসে থাকেন। মন্ত্রী আর সইয়ের দিকে চেয়ে রানি উঠে দাঁড়ান,
ছোট্ট কাঁসার রেকাবিতে দুখানা মালপোয়া নিয়ে রাজার হাতে দিয়ে
বলেন, "এভাবে বসে থাকলে জরুরি আলোচনা হবে কিকরে?"
এতোক্ষণে রাজার মুখে হাসি ফোটে, মালপোয়ায় কামড় দিয়ে বলেন, "প্রতিমাসে
একদিন রাজপ্রাসাদে প্রজাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?"
রানি আগ্রহসহকারে বলেন, "দারুণ হয়। এ তো পুণ্যের কাজ।"
মন্ত্রী মালপোয়া খেয়ে জল পান করছিলেন, ধীরেসুস্থে গ্লাস রেখে বললেন, "রাজকোষ কিন্তু
বহ বছর ধরে শূণ্য, এ কথা স্মরণে রেখে করলে তবেই পুণ্য।"
কলাবতী বলে ওঠেন, "এদ্দিন ধরে শ্বশ্রূমাতার সাথে আমরা,বধূরাই ধরেছি
অন্দরমহলের হাল, এবারেও উপায় বের হবেই নিশ্চয়।"
"কিন্তু কিভাবে?অর্থ কই?" মন্ত্রী স্ত্রীর কথায় অবাক হন।
"চলুন রাজকোষ দর্শনে।" রূপমতী উঠে দাঁড়ান,বাকি তিনজন তাকে অনুসরণ করেন,আঁচলে বাঁধা
চাবির গোছা থেকে নির্দিষ্ট চাবি বের করে তালা খুলে সেই ঘরে প্রবেশ করতেই মেঝেতে
বিভিন্ন আকারের রাশি রাশি মাটির ভাঁড় চোখে পড়ে।
"এসব কি!"রাজামশাই অবাক হয়ে যান।
মন্ত্রী স্মিত হাসেন, "অর্থভাণ্ডার!"
সেই কক্ষের দুপাশে বসবার জন্য দুটি সুসজ্জিত গদিওয়ালা দোলনা ঝুলছিল, একটিতে রাজা আর
মন্ত্রী পাশাপাশি বসেন অন্যটিতে রূপমতী আর কলাবতী বসেন।
মন্ত্রীর দিকে চেয়ে রানি সহাস্যে বলেন,"আমাদের
শ্বশ্রূমাতার শিক্ষা, উনারাও এভাবেই ব্যয়সংকোচ করতেন।"
"কিন্তু অর্থ এলো কিভাবে? খাজনা তো গ্রহণ করা হয়না।"রাজা প্রশ্ন
করেন।
"প্রজারা যেসব শস্য, সবজি, মাছ দিয়ে যায়,খেয়েও উদ্বৃত্ত থেকেই যায়। আবার নিয়মিত সার,জল পেয়ে
বাগানের গাছে প্রচুর ফলফুল হয়, ওদিকে রাজ্যে আপনার নিজস্ব ক্ষেতে ফসলও অধিক ফলে, চাষিরা প্রয়োজন
মতো কিছু রেখে অধিকাংশ নিয়মিতভাবে সেসব বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে আমায় অর্থ দিয়ে যায়। এসব করেই এই অর্থাগম।" রানি সবিস্তারে
জানিয়ে দেন।
"ক্ষেতের ব্যাপারস্যাপার নাহয় চাষিরা সামাল দেয় কিন্তু উদ্যানের ব্যাপারে কি হয়?
তুমিও কি শস্য,ফলমূল ঝাঁকায় করে নিয়ে হাটেবাজারে
বিক্রি করতে যাও!"রাজামশাইয়ের কৌতূহল আর যায় না।
রূপমতী বিমর্ষ হওয়ার ভান করে বলেন, ”যেতে তো ইচ্ছে করে কিন্তু রানি হওয়ারও যে অনেক
জ্বালা,রাজা হওয়ার মতোই।”
মন্ত্রী জিজ্ঞেস করেন, ”তাহলে! কিভাবে?”
"জুঁই, মালতী, চম্পা, নিমাই, নিতাই এরা আছে কিজন্য?" মন্ত্রীপত্নী
উত্তর দেন।
"বাপরে! অন্দরমহলের
সবাইকে দলে টেনে নিয়েছেন!” রাজামশাই আশ্বস্ত হন।
এবারে রূপমতী মুখ খোলেন,"আপনাদের মতো আমরাও যে দুই সই। আপনারা বরাবর ভোজন আর ভ্রমণে
কালাতিপাত করেছেন। সংসারের ভাবনাই
ভাবেন নি তো রাজ্যের! আর এখন তো
অকারণ বিষণ্ণ হয়ে অলস ভাবে সময় কাটাচ্ছেন। এটুকু ভাবনা তাই ভাবতেই হয় নইলে প্রজাদের খেয়াল কে রাখবে?"
কলাবতী রূপমতীর হাতে হাত রাখে, ”আমাদের শ্বশ্রুমাতারা কন্যা স্নেহে অনেক শিক্ষা
দিয়েছেন, এসব তারই ফলশ্রুতি।”
“সই একদম সঠিক কথা বলেছে, আর সেইজন্যও তাঁরা বিশ্বাস করে যে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন,তার অমর্যাদা
করি কিকরে!” রানি গর্বের সাথে বলেন।
এবারে রাজা আর মন্ত্রী দুজনেই লজ্জিত হন।
"তাহলে আগামীকালই ঢেঁড়াপেটা করে সমস্ত রাজ্যে এই সংবাদ জানিয়ে দেওয়া হবে।"
রাজামশাই স্মিতহাস্যে বলেন।
"সে আর বলতে!শুভ কাজে বিলম্ব করা ঠিক নয়। নিমাই তো অনেকদিন ঢোল বাজায় নি, সে খুশি হয়ে
প্রজাদের মধ্যে এই বার্তা ঘোষণা করে দেবে।" মন্ত্রী
সোল্লাসে জানিয়ে দেন, ”আমি এক্ষুনি ওকে জানিয়ে দিচ্ছি।”
রাজামশাই মন্ত্রীর দিকে চেয়ে বলেন, ”রাজবৈদ্যর কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে সে-ই বুড়োকে
দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, সে-ই তো এই কান্ডের আসল কান্ডারী।”
রূপমতী আঁচলে চাবি বাঁধতে বাঁধতে বলেন, ”বুড়োর নাতবৌ
প্রায়ই ওদের ক্ষেতের শাকসবজি নিয়ে এসে দিয়ে যায়, তাকে বলেকয়েই
এই প্ল্যান করা হয়েছে।বুড়োও সব জেনেশুনেই রাজসভায় এসেছিল, ওর শরীর ঠিকই
আছে।”
“মানে!” রাজা, মন্ত্রী দু'জনেই আশ্চর্য হয়ে রূপমতীর দিকে চেয়ে থাকেন।
“আপনাদের স্বাভাবিক করতে এটুকু ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছে।” রূপমতী চাবির
গোছা বেঁধে উঠে দাঁড়ান। কলাবতীও রানির
সঙ্গ নেন।
কক্ষ থেকে বেরোনোর আগে রানি পেছন ফেরেন, "প্রতিমাসে
ভোজনের পদ আলোচনা করেই ঠিক হবে,” তারপর রাজার দিকে চেয়ে বলেন, ”তবে প্রতিবারেই
মালপোয়া অবশ্যই থাকবে।"
চারজনের মুখেই হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
"রাজার ভাগ্যে কিন্তু গোনাগুনতি দুইখান, মনে থাকে যেন!"
মন্ত্রী মুচকি হেসে বলেন।
রূপমতী আর কলাবতী হাস্যমুখে কক্ষ ত্যাগ করেন।
সেই থেকে এই মাসিক দ্বিপ্রাহরিক আহারের আয়োজন।
রাজামশাই অবশ্য গোপনে অনেকগুলো মালপোয়াই খান।