কি তার আসল নাম?
কোথায় তার বাড়ি? কি করে সে? কত তার বয়স? দেখতে সে কেমন?
এসব কথা সাধারণ মানুষ জন জানেনা জানে না। অনেক বড় বড় পুলিশ কর্তারাও। কিন্তু যতীন দারোগা তার নাড়ি নক্ষত্র সবকিছু জানে। জানার কারনটা ছিল বড় বিচিত্র। যতীন দারোগা ভুলতে পারবে না কখনো। ভোলা সম্ভবপর নয়। সেসব কথা মনে পড়লে এখনও সারা শরীরটা শিউরে ওঠে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। ভাবনাটা প্রজাপতির মতো একটু পাখানা মেললেই ঘৃণায় বিকৃত হয়ে ওঠে তার মুখ। কখনো কখনো আক্ষেপের সাথে বলে ফেলে– যতসব যোচ্চরের দল। একটা ফুলের মত সহজ সরল ছেলে কে….।
প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা। যতীন দারোগা তখন নতুন তরতাজা ঘোড়া। সবেমাত্র দারোগার ট্রেনিং করে বেরিয়েছে। তাকে দেখে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বড়সাহেব যেন স্বর্গ পেলেন হাতে। খচখচ করে অর্ডার করার খাতায় কি যেন লিখে দিলেন। যতীন দারোগা তার কিছুই অনুমান করতে পারলেন না।
স্যালুট ঠুঁকে বড় সাহেবের রুম থেকে বের হতেই আর.ও. সাহেব বললেন আপনার পোস্টিং হয়েছে গোসাবা থানায়।
গোসাবার কথা শুনে যেন আকাশ ভেঙে বাজ পড়লো যতীন দারোগার মাথায়।ঘরে তার বৃদ্ধ বাবা।অসুস্থ মা। আর বাড়িতে অন্য কেউ নেই। কাজের মেয়ে কাজ করে দিয়ে চলে যায়। একা যতীন দারোগা এতদিন সামলে এসেছেন ঘরের কাজকাম। এখন কি হবে? কে দেখাশোনা করবে তার বাবা-মাকে? ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন যতীন দারোগা। পাড়াপড়শিরা বাবাকে বলল– ছেলেকে একটা বিয়ে দিয়ে দাও। তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
কিন্তু যতীন দারোগা রাজি হলেন না সে প্রস্তাবে। পায়ের মাটি এখন নড়বড়ে যে কোনো মুহূর্তে পা ফসকে পড়ে যেতে পারে। বছর দুই একটু শক্ত হয়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করা অনুচিত। এই মুহূর্তে বিয়ে করা মানে পতঙ্গের মত মৃত্যু জেনেও আগুনে ঝাঁপ দেওয়া।
ব্যাপারটা তো সরাসরি বড় সাহেবকে বলা যাবে না। তাই যতীন দারোগা পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন, নন গেজেটেড কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে নিজের পারিবারিক দুর্দশার কথা জানালেন। কলকাতার আশে পাশে কোথাও পোস্টিং করে দেবার অনুরোধ করলেন। তারা দেখছি, দেখব বলে বেশ কয়েকদিন কাটিয়ে দিল। কিন্তু সুরাহা কিছু হলো না। অবশেষে আর.ও. সাহেবকে ধরলেন। সহজ সরল মানুষ ছিলেন আর.ও. সাহেব। তিনি ব্যাপারটা বলতে গিয়েই বড় সাহেবের ধমক খেলেন। সেই দিনেই কমান্ড সার্টিফিকেট লিখে যতীন দারোগাকে গোসাবা থানা জয়েন করার নির্দেশ দিলেন।
গোসাবা থানাটা যে কোথায়, সে সম্বন্ধে কোন ধ্যানধারণা ছিলনা যতীন দারোগার। লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে যেটুকু জেনেছিলেন তাতে তার বুকটা শুকিয়ে উঠলো। এখন তিনি কী করবেন? কি করার আছে তার? পেটের দায়, বড় দায়। সেই দায় মেটাতে যখন পুলিশের খাতায় নাম লিখিয়েছেন, তখন আর ভেবেচিন্তে লাভ কি?
পাড়ার এক সবজান্তা লোককে সাথে নিলেন যতীন দারোগা। সঙ্গে নিলেন দরকারি কাগজপত্র। বেডিং বিস্তর। বারোটার মধ্যে থানায় জয়েন করতে হবে। না হলে আবার হাজার রকম কৈফিয়ত দিতে হবে। সকাল সকাল কামালদাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে। পিঠে মালের বোঝা। কাঁধে একটা ঝুলন্ত ব্যাগ।
ঠিক ছটায় ডায়মন্ড হারবারে গিয়ে পৌঁছলেন। স্টেশনে তখন ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। তাতে চেপে বসলেন দুজনে। ছটা পঁচিশে ট্রেন ছাড়লো। বাসুলডাঙা, নেতড়া, দেউলা, সংগ্রামপুর, মগরাহাট, ধামুয়া, হোটর,কল্যাণপুর, বারুইপুর, মল্লিকপুর, সুভাষগ্রাম পার হয়ে সোনারপুর জংশনে গাড়ি থামল। হুটোপুটি করে কোনরকমে নামল দুজনে। মনে স্বস্তি ফিরে পেলেন যতীন দারোগা। যাক,পথ তাহলে আর বেশি দেরি নয়। কিন্তু কামালদার মুখে যখন শুনলেন, আরো অনেকদূর, তখন জিভ শুকিয়ে উঠল যতীন দারোগার।
শিয়ালদহ থেকে ক্যানিংগামি ট্রেন সোনারপুরে এল আধঘন্টা পরে। ভিড় ঠেলে কোনরকমে উঠল দুজনে। কোনরকমে ব্যাগ, বেডিং বিস্তরা একধারে জড় করে রাখল। দুচারজন মুখ বেঁকিয়ে দু'চারটে বাঁকা কথা শুনিয়ে দিল। জিনিসপত্র নিয়ে ভ্যান্ডারে ওঠেনি কেন তার কৈফিয়ত চাইল। মুখ বুজে সব কিছু সহ্য করতে হল যতীন দারোগাকে। তাদের আচার-আচরণ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন যেদিন দারোগা।
ক্যানিংয়ে পৌঁছতে আরো সোয়া একঘন্টা লেগে গেল। ওখানে নেমে ভটভটি চেপে মাতলা নদী পার হতে আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে গেল। তারপর ঢরঢরে একটা বাসে চেপে সোনাখালি। সোনাখালি থেকে গোসাবা ঘাটে পৌঁছতে পাক্কা এক ঘন্টা লাগল। যতীন দারোগা হাতের ঘড়ি দেখতে থাকলেন আর মনে মনে ছটফট করতে থাকলেন। আর কতদূর, আর কতদূর, ভাবতে ভাবতে বিপর্যস্ত হলেন। অবশেষে গোসাবার যাত্রী নিয়ে ওপারের ঘাটে পৌঁছল ভটভটি। মালপত্র নিয়ে গোসাবা থানা যখন পৌছলেন, তখন একটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট।
থানা এরিয়ায় পা দিয়ে চমকে উঠলেন যতীন দারোগা। গেটের সামনে কাঁধে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন কনেস্টবল। পুরানো ঝরঝরে পাকা বিল্ডিং। চার দিকে চুন,বালি সব খসে পড়ছে।রঙের চিহ্ন কোথাও নেই। সামনে যেতেই সেন্ট্রি কনস্টেবল পথ রোধ করে দাঁড়াল।
- কাকে চাই?
যতীন দারোগা কিছু বলার আগেই কামাল সাহেব বললেন– এই বাবুর এখানে পোস্টিং হয়েছে। দারোগার চাকরিতে।
দারোগার কথা শুনে সম্ভ্রমে মাথা একটু নত হল সেন্টি কনস্টেবলের। বেশ হাসিখুশি মুখে বলল– আসুন স্যার!
স্যার শব্দটা শুনে চমকে গেলেন যতীন দারোগা। এতদিন স্কুল কলেজের শিক্ষকদের স্যার বলে এসেছেন, আজ হঠাৎ সেই 'স্যার' ডাকটা শুনে কেমন যেন চমকে উঠলেন।
চেম্বার থেকে বড়বাবু বার হচ্ছিলেন দুপুরের খাওয়া খেতে। একটুখানি দিবানিদ্রা দিয়ে নিতে। তারপর আবার বিকেল পাঁচটা থেকে যুদ্ধে নেমে পড়তে হবে। ফিরতে রাত বারোটা, একটা, দুটো, তিনটে কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। তদন্ত করতে,আসামি ধরতে, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে হবে। তাই দুপুরবেলায় খাওয়া দাওয়া করে একটুখানি গড়িয়ে না নিলে মহাবিপদ। সময় যখন পাওয়া গেছে, তার সদ্ব্যবহার করতে দোষ কোথায়?
সেন্টি কনস্টেবল বড়বাবুকে বললেন– ইনি নতুন স্যার! জয়েন করতে এসেছেন।
বড়বাবু ব্যাপারটা বোধ হয় জানতেন। বড়সাহেবের সাথে আগে নিশ্চয়ই কথা-বার্তা হয়েছিল। তার আবেদন নিবেদনে বোধহয় যতীন দারোগাকে পোস্টিং করা হয়েছে। তাই যতীনকে দেখেই তিনি বললেন– কি হে ছোকরা! নাম কি ?
বড়বাবুর গলার স্বর বেশ গমগমে শোনাল। ভয়ে চমকে উঠার মত।দেখতেও সেইরকম। বয়স বছর পঁয়ত্রিশ হবে। লম্বা প্রায় ছ'ফিট। খানদানি গোঁফ। পানেতে রাঙা ঠোঁট। যতীন দারোগা কোনরকমে অস্ফুট স্বরে বললেন– যতীন।
- তা যতীন হাতি না ঘোড়া?
আবার সেই চমকে উঠার মত বাঁজখাই গলা। যতীন দারোগা দুটো ঢোক গিলে কোনোক্রমে জবাব দিলেন– যতীন মিত্র স্যার!
- কিন্তু মেসেজে দেখছিলাম যতীন মৈত্র...।
– স্যার! টাইপে হয়তো ভুল….।
কথা আর শেষ করতে পারলেন না যতীন দারোগা। মাঝপথে ঢুকে পড়লেন আর একজন লোক। গায়ে তার খদ্দরের পাঞ্জাবি।পরনে পাজামা। বয়স বছর চল্লিশ।কাঁধে কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ। কখন যে তিনি নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন কিছুই টের পায়নি যতীন দারোগা। তিনি অত্যন্ত বিনীত কন্ঠে বড়বাবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন– আমি তাহলে আসি স্যার! দয়া করে ব্যাপারটা একটু দেখে দেবেন।
বড়বাবু পরিচয় করিয়ে দিতে বললেন– ইনি হলেন আপনাদের নতুন বাবু। নাম যতীন মিত্র। আজই জয়েন করেছে। প্রয়োজনে আপনাদের ওখানে পাঠাব।
কথাটা শুনে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ভদ্রলোকের। দু'হাত জড় করে নমস্কার জানালেন। একটুও দেরী না করে বললেন– আমার নাম স্যার মন্টুদাস। কচুবেড়ে বাড়ি। স্কুল মাস্টারি করি। একটু আধটু পার্টির কাজকর্মও করি। ওখানে গেলে আমার বাড়িতে অবশ্যই ঘুরেআসবেন স্যার!
যতীন দারোগা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। মন্টুদাস চলে গেলেন। বড়বাবু চিৎকার করে ডাকলেন– মেজবাবু!
ডাক শুনে পাশের রুম থেকে 'আসছি স্যার' বলে ছুটে এলেন মেজবাবু। নাদুস নুদুস চেহারা। দেহ থেকে ভুঁড়িটা বার হয়ে এসেছে অনেকটা। নাম অসিতানন্দ চ্যাটার্জী। বড়বাবুর সামনে এসে তিনি বললেন-- বলুন স্যার!
– নতুন প্রবেশনার এসেছে। ওকে হাতেকলমে সব কাজকাম শেখাবেন।আর ওকে থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। খাবার জন্য মেসেও বলে দেবেন। একথা বলে বড় বাবু কোয়াটারের দিকে হাঁটা দিলেন।
অসিতানন্দ বাবু বললেন– পুলিশের চাকরিটা বড় কঠিন ভায়া। তাছাড়া যা দিনকাল পড়েছে, সবাই রাজা এই রাজার রাজত্বে। তবে তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। তোমরা হলো 'ডাইরেক্ট ক্যাডেট।' অনেক বিদ্যে বুদ্ধি আছে তোমাদের পেটে। আমরা হলাম ক অক্ষর গোমাংস। তবে যেটুকু যা জানি,তা তোমাকে শিখিয়ে দেব। এই দেখ, তোমাকে তুমি বলে ফেললাম। রাগ করলে না তো?
– না না, রাগ করবো কেন? অসিতানন্দের কথার উত্তরে যতীন দারোগা বললেন– আপনি আমার থেকে অনেক বয়স্ক। আমার জ্যাঠার বয়েসী। আমাকে আপনি তুমি কিংবা যতীন বলে ডাকবেন। তাতে আমি কিছু মনে করব না।
প্রথম এক বছর ব্যারাকপুরে পুলিশ ট্রেনিংকলেজে কাটাবার পর এক সপ্তাহ ছুটি। তারপর আলিপুর পুলিশ লাইনে জয়েন। পরের সপ্তায় গোসাবা থানায় পোস্টিং। সেখান থেকে শুরু হল যতীন দারোগার আসল কর্মজীবন। মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ। তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা শোনা। অপরাধীদের ধরে আনা। মামলা রুজু করে তাদের জেলে পাঠানো। মৃত ব্যক্তির সুরথড়াল রিপোর্ট তৈরি করা। থানার নানানরকম কাজে ক্রমশঃ জড়িয়ে পড়লেন যতীন দারোগা।
দিন যত গড়াতে থাকল, ততই কর্মদক্ষতায় পটু হয়ে উঠলেন যতীন দারোগা। বড়বাবু, মেজবাবু, ছোটবাবু, এ.এস.আই.বাবু, থানার মুন্সি,এমনকি হোমগার্ডদের কাছে অতীব প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন যতীন দারোগা।সবার কাজে সাহায্য করা, রেইড করতে যাওয়া, কারোর লিখে দেওয়া, সব কাজই আমন্ত্রিত হতেন যতীন দারোগা। আর হাসিমুখে যতীন দারোগা তা পালন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন। কাজের চাপে বাড়ি যাওয়ার কথা ভুলেই বসলেন যতীন দারোগা। তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকলে তার বাবা-মা। কবে তাদের ছেলে বাড়িতে আসবে? কবে তার মুখ দেখতে পাবে?
আসলে একজনের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে আরেকজন পড়েন দুর্দশায়। দুঃখে ভরে ওঠে তাদের জীবন। সেকথা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলেন যতীন দারোগা। বার বার বলেও ছুটি মিলছিল না তাঁর।
ছ'মাস প্রবেশনারি প্রিয়ড শেষ হবার পর সপ্তমমাসে আলিপুরের ডাক পড়ল পরীক্ষা দেবার।সেই অবসরে বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আসবে, এটাই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন যতীন দারোগা। অনেক আবেদন নিবেদন করে দুটো দিন ম্যানেজ লিভ মঞ্জুর করেছিলেন বড়বাবু। ৩০তারিখে থানায় ফিরতে হবে,এই অঙ্গীকার করে সেদিন আলিপুর এস.পি. অফিসে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর পরীক্ষা দিয়ে সোজা বাড়িতে। দুটো দিন বাড়িতে মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কী আনন্দই না কাটল, তা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। এর মধ্যে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখাও করে এলেন যতীন দারোগা।তৃতীয়দিনে মন খারাপ হয়ে গেল সবার। এবার ফিরতে হবে কাজে। বাবা মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লেন যতীন দারোগা।
দুপুরবেলা যখন গোসাবা থানায় পৌঁছলেন তখন দেখতে পেলেন থানার সামনে ৫০/৬০ জন লোকের ভিড়। মুখে তাদের শ্লোগান। 'ধরতে হবে' 'ধরতে হবে'। আসামীকে অ্যারেস্ট করতে হবে। করতে হবে। না হলে এ আন্দোলন চলছে চলবে। আকাশ-বাতাসে মুখরিত হয় তাদের সেই সমবেত কণ্ঠ। মাতলা নদীর জোয়ারের মত ফুঁসছে তারা। সবকিছু ভেঙেগুঁড়িয়ে ফেলতে চাইছে তাদের মুষ্টিবদ্ধহাত। তাদের মধ্যে মন্টু মাস্টারও ছিলেন। যতীন দারোগাকে থানায় ঢুকতে দেখে তাদের গলার ভলুম যেন আরো বেড়ে গেল।
যতীন দারোগা অবাক হয়ে গেলেন বিষয়ে অভিভূত হলেন এ যে এক অন্য চিত্র দেখছেন যে মাষ্টারমশাইকে দেখে যতীন দারোগার মনে হয়েছিল অত্যন্ত ভদ্র শান্ত শিষ্ট আজ তার চেহারা তার বাচনভঙ্গি যেন অনেক স্বতন্ত্র ঠিকমতো অশান্ত আগ্রাসী ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলার চক্রান্ত।
যতীন দারোগা থানায় ঢুকে সহকর্মীদের কাছে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন ব্যাপারটা। মন্টু মাস্টারের মেয়ে অঞ্জলি দাসকে অপহরণ করা হয়েছে। কে অপহরণ করেছে? কবে অপহরণ করেছে? কেন অপহরণ করেছে? কেন সেই অপরাধীকে গিয়ে ধরা হচ্ছে না? এই রকম নানান প্রশ্ন এসে ভিড় করে দিল যতীন দারোগার মাথায়। জিজ্ঞাসা করে সবটুকু জানা যাবে না ভেবে নিজের জিনিসপত্র সব রেখে বড়বাবুর চেম্বারে ঢোকে যতীন দারোগা। তাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন বড়বাবু।
এফ.আই.আরটা. উল্টে দেখলেন যতীন দারোগা। মন্টুমাস্টার তার নিজের বয়ানে লিখেছেন– আজ ২৫ শে জুলাই রাত্রি দশটা নাগাদ গোসাবা বিডিও অফিস থেকে কাজকাম সেরে বাড়িতে ফিরি। দেখি আমার ঘরদোর সব অন্ধকার। অঞ্জলি গেল কোথায়? তাকে দেখতে না পেয়ে চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকি।কিন্তু তার কোন সাড়া শব্দ পাইনা। আমার স্ত্রী সেদিন বাড়িতে ছিল না। ডাক্তার দেখাতে কলকাতায় গিয়েছিল। অগত্যায় অঞ্জলীকে খুঁজে পেতে আমি গাঁয়ের লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকি। নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের কাছে জানতে পারি আজ দুপুর ১১ টার সময় আমি বাড়ি ছেড়ে যাবার কিছু পরেই পলাশ আমাদের বাড়িতে যায়। অঞ্জলীকে জোর করে ঘর থেকে টেনে বার করে। তাকে বেআব্রু ভাবে টানতে টানতে নদীর ঘাটের কাছে নিয়ে যায়।তারপর তাকে অসৎ উদ্দেশ্যে ডিঙিতে চাপিয়ে নিয়ে চলে যায়। এখনো আমি আমার মেয়ের কোন সন্ধান পাইনি।আমার ধারণা, আমার বিশ্বাস আমার মেয়েকে অসৎ উদ্দেশ্যে কিডন্যাপ করেছে পলাশ। তার যথোপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
চিৎকার-চেঁচামেচি তখন অনেকটা স্তব্ধ। বড়বাবুর চেম্বার থেকে খুব একটা আওয়াজ আসছিল না কানে। বড়বাবু খবর পাঠালেন মাস্টারমশাই ও তাঁর তিনজন লোক নিয়ে তার চেম্বারে আসতে। সেইমতো মাস্টারমশাই স্থানীয় বিধায়ক কমল মন্ডল, হোল টাইমার কঙ্কন মন্ডল ও যুবনেতা সমীর জানা এলেন বড় বাবুর চেম্বারে।
কথাবার্তার শুরুতেই আক্রমণের ভূমিকা নিলেন কমলবাবু। বেশ জোর গলায় তিনি বলতে শুরু করলেন– না বড়বাবু! আপনার চেম্বারে ঢুকে গালগল্প করতে আসিনি আমরা। হাতে এখন আমাদের অনেক কাজ। আমরা বুঝতে পারছি আপনারা কোন গুরুত্ব দিচ্ছেন না এই কেসে। না হলে ২৫ তারিখে অভিযোগ পাওয়ার পর আজও পর্যন্ত কোনো তদন্ত হলো না কেন? আমরা এখন কোন রাজ্যে বাস করছি? সরকার আমাদের, লোকজন আমাদের, আমরা আপনাদের মাইনে দিয়ে পুষি, অথচ আমাদের কোনো কাজ হচ্ছেনা, সব বিরোধীদের কাজ করছেন আপনারা।
বড়বাবু মৃদুস্বরে প্রতিবাদ করলেন। না না, এরকম কথা বলছেন কেন? বিরোধীদের কথা আমরা কেন শুনতে যাব? আমরা তো আইনমাফিক…..।
– আর আইনমাফিক এর কথা বলবেন না বড়বাবু! আইন আমরা অনেক দেখেছি। আইন মেনে আপনারা জুয়া খেলান। আইন মেনে আপনারা মদের পার্টি বসান। আইন মেনে….. এরকম অত্যন্ত তীর্যক ভাষায় নানা মন্তব্য করলেন বিধায়ক সাহেব। তার সাথে সঙ্গ দিলেন অন্যান্যরা। এমনকি শিক্ষক মশাই মন্টুদাসও। এসব কথা শুনে বড়বাবুর মতো রাসভারি লোক কেন্নর মত কেমন জড়সড় হয়ে গেলেন। আর অন্যদিকে বাঁধভাঙা বন্যার মত মুখে যা এলো তাই বলে গেল ওরা। সেই স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল বড়বাবুর সব যুক্তিপূর্ণ কথা।
অবশেষে যতীন দারোগা আগ বাড়িয়ে বললেন –আমি দেখছি ব্যাপারটা। আমি আজই কচুবেড়ে যাব ঘটনাটা তদন্ত করতে।
নতুন নিষ্কলঙ্ক যতীন দারোগার কথায় কাজ হলো কিছুটা। রাগতস্বরে মন্টুমাস্টার বললেন– ঠিক আছে। আমরাও দেখব, ঘটনাটা ঠিকমতো তদন্ত হচ্ছে কিনা? না হলে বৃহত্তর আন্দোলনের পথে নামব আমরা।
একথা বলে বড়বাবুর চেম্বার ছেড়ে তারা বার হয়ে গেল। থেমে গেল সমস্ত রকম চিৎকার-চেঁচামেচি। হাতির পালের মত ধীরগতিতে সার বেঁধে চলে গেল সব। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন বড়বাবু। বিনীত কণ্ঠে বললেন– যতীন! তুমি কচুবেড়ে গিয়ে ব্যাপারটা একটু দেখে এসো। ( ক্রমশ)