গল্প - ২ । আশ্বিন - ১৪৩১


   আমাদের ঝাড়ুদার  











সুদীপ্ত শেখর পাল
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ



 

গরমের সময় কিছুদিন আমাদের স্কুল সকালে বসত। আমরা সেই সময় বটতলা বাজারের ভিতর দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে চলে যেতাম। রাস্তা কিছুটা কম হতো। তার চেয়ে আমাদের আকর্ষণ ছিল বন্ধ দোকানগুলো। কত রকমই না দোকানের দরজা ছিল। কোনটা ছিল ঝাঁপ দেওয়া, কোনটা ছিল তক্তা দিয়ে বন্ধ করা। তাতে নাম্বার লেখা থাকত, সেই নাম্বার না মিলালে ঠিক- ঠাক বন্ধ হত না। লোহার গ্রিল বা সাটার তখন আসেনি।

এইসব দেখতে দেখতে একদিন দেখলাম একটা লোক বাজার ঝাঁট দিচ্ছে। নারকেল কাঠির ঝাঁটার মাথায় বেশ লম্বা একটা লাঠি বাঁধা। সেই লাঠি ধরে এ গলি ও গলি ঝাঁট দিচ্ছে। বাজারটা যে কেউ ঝাঁট দেয় একথা কোনদিন মনেই আসেনি। দু' একদিন এমন হয়েছে, কোন গলির ভিতর দিয়ে যাচ্ছি আর উলটো দিক থেকে ঝাঁট দিতে দিতে আসছে। ভাবলাম এইবার বুঝি বকুনি দেবে। কারণ বাড়িতে মা যখন ঝাঁট দিত তখন ঝাঁটার সামনে পড়লেই বকুনি শুনতে হত। কিন্তু সে বকল না। একপাশে সরে দাঁড়াল। যেন আমরা সেই রাস্তার মালিক। আমরা চলে গেলে আবার সে ঝাঁট শুরু করত। সেই বয়সে আমাদের কাছে সেটা বিরাট সম্মানের ব্যাপার ছিল।

গরমের ছুটি একসময় শেষ হল। বর্ষা শুরু হয়েছে। এমন সময় একদিন দেখি স্কুলে সেই লোকটা হাজির। বিশু আমাকে বলল, ঐ দেখ সেই ঝাঁট দেওয়া লোকটা। 

দীপু বলল, ঝাঁট দেওয়া লোকটা কী? এক কথায় বল। ঝাঁট দেওয়ার লোককে কী বলেঝাড়ুদার বলে।

এর কিছুদিন পর জানলাম স্কুল বসার আগে আমাদের স্কুল ঐ ঝাড়ুদার ঝাঁট দেয়। আমরা দেখতাম আগের থেকে স্কুলের ঘর মাঠ সব ঝক ঝক করছে। ঐ ঝাড়ুদারের ছেলে যে আমাদের সঙ্গে পড়ে তা' আগে জানতাম না। একদিন অঙ্ক না পারার জন্য প্রলয় স্যার বংশীকে বললেন, তুই কি বাবার মতো ঝাঁট দিবি নাকি? সেদিন থেকে জানলাম যে আমাদের বংশী ওই ঝাড়ুদারের ছেলে। ওরা থাকে বাগদী পাড়া পার হয়ে খালের ধারে। দেখলাম স্যারের কথায় বংশী কেমন মন মরা হয়ে গেল। পরে এক সময় বংশীকে বললাম- তোর বাবা স্কুল ঝাঁট দেয় তুই আগে বলিসনি তো!

বংশী বলল, এ আর বলার কী আছে! বাবা বাজার ঝাঁট দেয়, ওখানে তো বেশি পায় না তাই...

- আর কিছু করে না?

- আগে একটা কোম্পানীতে কাজ করত। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।

সেই থেকে আমরা বংশীকে কিছু কিছু সাহায্য করতাম। কেউ পুরানো পেন্সিল দিতাম কেউ বা দিতাম পুরানো ডায়রী। নেওয়ার সময় ওর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ত।

আমরা বুঝতাম বংশী চেষ্টা করে খুব, কিন্তু পারে না। কোথায় যেন থেমে যায়। অংক মেলে না, বানান ভুল হয়ে যায়, টেন্স গুলিয়ে যায়। ও মাঝে মাঝে বলত- আমি আর বেশি পড়তে পারব না। মাধ্যমিকের পর কোন একটা কাজ শিখব। আমরা তখন কলেজের স্বপ্নে বিভোর। আর কয়েক বছর পরে কলেজে যাব। কারো কারো এরই মধ্যে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন মনে ভাসছে। এর পাশাপাশি আমাদেরই একজন কোন একটা হাতের কাজ শিখে রোজগারের চিন্তা করছে।

আমি বললাম, তুই  তো অনেক চেষ্টা করিস, দেখনা কী হয়। ভালো ভাবে পাশ করলে কেন পড়বি না

বংশী বেশি কিছু বলত না। ও জানে যে ওর বাবা গরীব। বাবা যে পড়ানোর খরচ জোগাড় করতে পারবে না সেটা কোনদিন বলেনি। বাবার অক্ষমতাকে ঢেকে রাখত নীরবতা দিয়ে।

একদিন দেখলাম স্কুলটা কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম- ঝাঁট দেওয়া হয়নি। বংশী ক্লাসে বসেছিল। সে বলল যে তার বাবার জ্বর হয়েছে তাই আসেনি। এমন সময় আমাদের দপ্তরী শঙ্করদা বংশীকে ডেকে নিয়ে গেল- হেড স্যার ডাকছেন।

আমরা দু'তিন জন বংশীর পিছন পিছন গেলাম। হেডস্যারের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে শুনলাম, বংশীকে খুব বকছেন- কেন তার বাবা আসেনি? জ্বরের কথা বংশী বলেছে কি না জানি না। হয়তো বলার সুযোগ পায়নি কিংবা হেড স্যার সেটাকে নিছক অজুহাত হিসাবে দেখেছেন।

বংশী বেরিয়ে এলে দেখি যে ওর চোখ মুখ থমথমে। সামনে তাকাচ্ছে বটে কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু দেখছে বলে মনে হল না। পা গুলো যেন টলছে। আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল টিচার্স রুমের দিকে।

আমি বললাম, কোথায় যাচ্ছিস বংশী? ক্লাসে যাবি না?

- তোরা যা। আমি পরে যাচ্ছি।

এর মধ্যে প্রেয়ারের ঘন্টা পড়ল। আমরা মাঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইলাম। তারপর ক্লাসে চলে গেলাম।

প্রথম ক্লাস বাংলা। তমাল স্যার আসবেন। যেদিক দিয়ে আসবেন সেদিকে তাকিয়ে দেখি বংশী একটা ঝাঁটা নিয়ে বারান্দা ঝাঁট দিচ্ছে। সেই মুহুর্তে এমন একটা বেদনা আমার বুকে এসে লাগল যে আর ক্লাসে থাকতে পারলাম না। ছুটে বেরিয়ে গেলাম। বংশীর হাত থেকে ঝাঁটা কেড়ে নিয়ে বললাম- তুই ঝাঁট দিচ্ছিস কেন! চল ক্লাসে যাবি। বংশী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। পিছনে তাকিয়ে দেখি আমাদের ক্লাসের বিশু, দীপু, প্রভাত দাঁড়িয়ে আছে। তমাল স্যারও আমাদের দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। হয়তো বকতেন, কিন্তু বংশীর ঐ কান্না দেখে কিছু বললেন না।

আমি বললাম, ঝাঁট যদি দিতে হয় আমরা সবাই দেব। তুই একা কেন দিবি? বিশু, দীপু এদের দিকে তাকিয়ে বললাম তোরা পারবি আশপাশের বাড়ি থেকে ঝাঁটা চেয়ে আনতে?

ওদের উত্তর দেওয়ার আগেই বংশী বলল, এই কাজে আমার লজ্জা নেই। আমার বাবার কাজ আমি করছি।  

বিশু বংশীর হাত ধরে টান দিল ক্লাসের দিকে।

প্রায় একসঙ্গে সবাই বললাম, আমাদেরও লজ্জা নেই, আমাদের স্কুল আমরাই ঝাঁট দেব।