কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে (অধুনা বর্ণপরিচয়) মামুর দোকানে ভবানীবাবুর সঙ্গে আমার প্রথম
পরিচয়। এই পরিচয় নেহাত পরিচয় নয়। পরিচয়ের নির্দিষ্ট কারণ ছিল। নিজেদের এলাকা
গাজোল থেকে ছোটোদের উপযোগী একখানি পত্রিকা বের করার ইচ্ছে প্রকাশ করি। তাই এই
বিষয়ে ভবানীবাবুর সহযোগিতা ও মূল্যবান পরামর্শের প্রয়োজন। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই
আমার সেখানে যাওয়া। এখানে বলা প্রয়োজন, পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা আমার মধ্যে একদিনে দানা বাঁধেনি। এর পেছনে
নির্দিষ্ট পটভূমি রয়েছে। সেই আলোচনায় আসছি।
ছোটোবেলা
থেকেই ছিল আমার সাহিত্যানুরাগ। বিশেষত শিশুসাহিত্যের প্রতি ছিল আমার আকর্ষণ। সেই
সূত্র ধরেই শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিক—যেমন গল্প, রূপকথা, উপকথা, লোককথা,
ছড়া-কবিতা বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়।
আমার
পিতৃদেব পেশায় ছিলেন শিক্ষক। তিনিও সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন। তাই নিয়ম করে বাড়িতে
আসত সন্দেশ, শুকতারা,
কিশোরভারতী, রামধনু, পক্ষীরাজ
প্রভৃতি পত্রপত্রিকা। আমি সেই বয়সে এই পত্রিকাগুলো গোগ্রাসে গিলতাম। পড়ে আনন্দ
পেতাম। সন্দেশে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের মজার ছড়াগুলো ছিল আমার ভীষণ প্রিয়।
বড়ো হয়েও
আমার সাহিত্যানুরাগ এতটুকু কমেনি। বরং বেড়েছে। ২০০০ সাল। মালদা জেলার প্রত্যন্ত
অঞ্চল গাজোল থেকে শিশুকিশোর পত্রিকা বের করার মনস্থির করি। এ বিষয়ে পাশে পাই
কয়েকজন সাহিত্য অনুরাগী—যেমন অনিমেষ দাস, নরহরিদা ও বিষ্ণুদাকে। বন্ধুবর অধ্যাপক শৈবাল রায়ের পরামর্শে প্রখ্যাত
ছড়াকার তথা কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। তার
পরামর্শ ছিল, বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিকদেরও পত্রিকার সঙ্গে
জুড়ে নিতে হবে, যাঁদের উপদেশ ও পরামর্শ দীর্ঘ পথ চলতে
সাহায্য করবে। তার বক্তব্য, ভবানীবাবু এই বিষয়ে একজন উপযুক্ত
মানুষ। মফস্সল থেকে প্রকাশিত অসংখ্য পত্রপত্রিকার তিনি পৃষ্ঠপোষক ও পরামর্শদাতা।
মানুষ হিসেবেও খুব ভালো। তা বেশ। এরপরে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে
হবে। কিন্তু কীভাবে? তাঁর ঠিকানা জানি না।
অনেক আগে
থেকেই ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কবিতা, ছড়া পড়েছি। সন্দেশ পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। আমি সন্দেশ পত্রিকার গ্রাহক
ছিলাম। সেই সূত্র ধরে সন্দেশ পত্রিকার দপ্তরে একদিন চলে যাই। গ্রাহক হিসাবে গোটা
কতক পত্রিকাও সংগ্রহ করতে হত। সেই কারণে আমি গিয়েছিলাম আমার গ্রাহক সংখ্যাগুলি
সংগ্রহ করতে। সেখানে টুকটাক কথাবার্তা হতে হতে হঠাৎ করেই ভবানীবাবুর প্রসঙ্গ চলে
আসে এবং সেখানেই পেয়ে যাই তাঁর আড্ডার ঠিকানা। কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের (এখনকার
বর্ণপরিচয়ের জায়গাতেই) মামুর দোকানে।
কলেজ
স্ট্রিট মার্কেটের মামুর দোকান খুঁজে পেতে খুব বেগ পেতে হয়নি। সরু সরু গলির ভিতরে
একটা একচিলতে কাঠের ঘুপচি, মানে দোকান।
দেখি, একজন রোগা-পাতলা দীর্ঘদেহী, সাদা
গোঁফওয়ালা ষাটোর্ধ্ব মানুষ, পরনে খাদির পাজামা-পাঞ্জাবি,
একটা চেয়ারে একা বসে আছেন। সেখানে গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াতেই তিনি
বললেন, “কাকে চাইছেন? ভবানীবাবুকে?”
তারপর আমার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে তিনি নিজে থেকেই জানালেন,
“একটু দাঁড়ান, এক্ষুনি চলে আসবেন।”
আমি তো
রীতিমতো অবাক হয়ে যাই। আমি যে ভবানীবাবুকেই চাইছি বা ভবানীবাবুর কাছেই এসেছি তা
উনি জানলেন কী করে? পরে জেনেছি,
এখানে যাঁরাই আসেন তাঁরা ভবানীবাবুর জন্যই আসেন।
অল্প সময়ের
ব্যবধানেই তিনি এলেন। আমি আগে কখনও তাঁকে দেখিনি। তাঁকে দেখেই তো আমি আপ্লুত। তিনি
যে মানুষ হিসাবে এত সাধারণ আগে ভাবতেই পারিনি। ভাবতে না পারার কারণ হিসাবে মনের
ভিতরে গেঁথে ছিল যে বিখ্যাত মানুষেরা সাধারণত অহংকারী হন। তাছাড়া গ্রামবাংলার
মানুষদের প্রতি তাঁরা বেশ খানিকটা উদাসীনও থাকেন। সর্বোপরি উন্নাসিক হয়ে থাকেন।
দেখলাম এসবের ধারেকাছেও তিনি নেই। অথচ তিনি এই সময়ের একজন অতি-বিখ্যাত মানুষ।
শিশুসাহিত্যে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। দেখলাম পোশাকে-আশাকে বিন্দুমাত্র জৌলুস নেই, নেই চলনে-বলনে দাম্ভিকতা।
আর
কথাবার্তা? প্রথম আলাপ?
যেন মনে হল, আমাদেরই পাশের বাড়ির আপনজন। অত্যন্ত অল্প
সময়ের মধ্যে তিনি আমাকে আপন করে নিলেন। আমরা মালদা থেকে ছোটোদের উপযোগী একটি
পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা করছি শুনে তিনি যারপরনাই খুশি হলেন। খুশি হলেন গাজোলের মতো
ছোট্ট জায়গা থেকে ছোটোদের জন্য পত্রিকা প্রকাশের আগ্রহ জেনে। তারপর তিনি অত্যন্ত
আপনজনের মতো বললেন, “পত্রিকা করুন। আমি সঙ্গে আছি।”
বললাম, “আপনার উপদেশ নিয়েই পথ চলা শুরু করতে চাই।
আপনাকে আমরা উপদেষ্টা হিসাবে পেতে চাই।”
তিনি
তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানালেন।
মালদা জেলা
বইমেলা ২০০০-এ ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের আশীর্বাণী নিয়ে ‘ফজলি’ আত্মপ্রকাশ
করল। শুরু হল পথ চলা। আমিও ২০০০ সালের জুন মাসে কলকাতায় বদলি হয়ে বিধাননগর
সরকারি মহাবিদ্যালয়ে চলে আসি। ফলে কলেজ স্ট্রিটের মামুর দোকান অলিখিতভাবে
কলকাতায় ‘ফজলি’-র যোগাযোগ কেন্দ্র
হয়ে দাঁড়াল। মামুর দোকান আমাদের নিত্য আড্ডার স্থল হয়ে গেল। তার মধ্যমণি অবশ্যই
হলেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।
সম্ভবত ২০০৫
বা ২০০৬-তে আমাকে পারিবারিক কারণে প্রায়ই মালদা যেতে হত। ফলে ‘ফজলি’-র আম-সংখ্যার
কাজ আমি ঠিক করে উঠতে পারিনি। এই সময়ে ভবানীদা নিজে দায়িত্ব নিয়েছিলেন পত্রিকা
প্রকাশের। পরে জেনেছি, খরচ কমাবার জন্য ভবানীদা নিজে কাগজের
দোকানে গিয়েছেন, ছাপানোর জন্য প্রেস খুঁজেছেন। সঙ্গে
সঞ্জিতদাও ছিলেন এবং সহযোগিতা করেছেন। এটা ভবানীবাবুর কাছ থেকে আমার বাড়তি পাওনা।
ভবানীবাবু এমন একজন বাংলা ছড়াকার, যাঁর লেখা ছড়া শুধু
পশ্চিমবাংলাতেই নয়, আসাম ও ত্রিপুরাতেও সমান জনপ্রিয়।
এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও তাঁর জনপ্রিয়তার ছাপ রয়েছে। সেই জনপ্রিয়তার
সন্ধান পাওয়া যায় মহানগরী কলকাতা, সংলগ্ন মফস্সল পেরিয়ে
গ্রামবাংলার প্রায় সব শিশুকিশোরদের ছোটো-বড়ো পত্রিকায়। তাঁরই মুখে শোনা এ-কথাটি
যে তাঁর রচিত ছড়ার সংখ্যা কম করেও দশ হাজারের কাছাকাছি। মজাদার ছড়া লেখায় তিনি
অদ্বিতীয়। সম্ভবত সুকুমার রায়ের পরে তাঁর কথা মনে পড়ে। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো
ব্যক্তিত্ব জহুরির জহর চেনার মতো ভবানীবাবুকে চিনে সুকুমার রায় স্মৃতি পুরস্কারে
নিজ হাতে সম্মানিত করেছিলেন। ছড়াকার রূপে তিনি যে শুধু মজাদার ছড়াই লিখেছেন তা
নয়। ছোটো-বড়ো সব পাঠকের কাছেই তিনি অতি প্রিয়। তার কারণ তাঁর ছড়ার
বিষয়-বৈচিত্র্য, রচনার আঙ্গিক বর্ণবহুল, ছন্দের নানা রূপময়তা আর সবার উপর সহজ, সরল
লক্ষ্যভেদী শব্দবন্ধের অনায়াস ব্যবহার। পাঠকমহলের হৃদয়জয়ী ছড়াকার বলতে তাঁর
নামই ঘরে বাইরে সবাই উচ্চারণ করেন।