জানা অজানা । আষাঢ় ১৪৩১


  মাধ্যাকর্ষণের পথ ধরে 











সুদীপ্ত শেখর পাল
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ




 

কোন বস্তু উপর থেকে ফেলে দিলে নীচে পড়ে এই সহজ কথাটা সবাই জানে। কিন্তু এই কথাটাকে বিজ্ঞানের আঙিনায় আনতে গেলে ভাবতে হয় আরেকটু। প্রায় চারশো বছর আগে নিউটন দেখেছিলেন আপেল নীচের দিকে পড়ছে। ভাবতে লাগলেন কেন পড়ছেএখানেই নিউটনের কৃতিত্ব।

           প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করেন বলে তাঁরা বিজ্ঞানী। নিউটন কিন্তু ‘নীচের দিক’ নিয়েও ভাবলেন। কারণ কোন এক স্থানের ‘নীচের দিক’ যেদিক হবে অন্য স্থানের নীচের দিক সেটা হবে নাকিছু না কিছু কৌণিক পার্থক্য থাকবেই। উত্তর মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের কাছে যেটা নীচের দিকদক্ষিণ মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের কাছে সেটাই উপরের দিক। তাই উপর – নীচ না বলে বলা ভাল মাটির দিক বা পৃথিবীর দিক। তিনি বললেন যেপ্রতিটা বস্তুকে পৃথিবী তার কেন্দ্রের দিকে টানছে। কেন্দ্রের দিক বলাতে উপর কিংবা নীচ কিছুই বলতে হলো না। এই হলো মাধ্যাকর্ষণের গোড়ার কথা। তবে শুধু এটুকু বলার জন্য নিউটন খ্যাতিমণ্ডিত হননি। এই টানাটানির ব্যাপারটা যে পৃথিবীর একচেটিয়া ক্ষমতা নয় সেটাও বললেন পরিষ্কার করে। তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দিকে। পৃথিবীর তুলনায় কত লক্ষ – কোটি গুণ বড় বড় নক্ষত্র রয়েছে। রয়েছে তাদের কত শত গ্রহ উপগ্রহ। নিউটন বললেন যেপৃথিবীর মতো  নক্ষত্ররাও টানে। নানক্ষত্ররা টানার জন্য আপেলের মতো কিছু পায় কিনা বলতে পারব না। তবে তারা টানে কাছাকাছি থাকা তার মতনই আরেকজনকে। এক নক্ষত্র টানে আরেক নক্ষত্রকে। যাকে টানে সেও চুপচাপ বসে থাকে না।  টানতে থাকে অন্য কাউকেএমনকি যে তাকে টানেতাকেও টানতে ছাড়ে না। এই যে বিশ্বময় টানাটানির খেলা এটাকে নিউটনের সূত্রে পাই ‘Gravitation  বল’ নামে । নিউটন ভাষা থেকে চলে গেলেন গণিতে। গণিতের সূত্রে বেঁধে ফেললেন প্রতিটি গ্রহ নক্ষত্রের মাঝে চলা অদৃশ্য দড়ি টানাটানির খেলা। আমরা পৃথিবীর অধিবাসীবৃন্দ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্য একটা আলাদা নাম দিয়েছি – অভিকর্ষআর সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আকর্ষণকে বলব মহাকর্ষ (Gravitation)

আপাতত অভিকর্ষ ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে বোঝা যাক। কোন বস্তুকে জলে ফেললে তলিয়ে যায়বাতাসের মধ্যে ফেললেও তলিয়ে যাবে অর্থাৎ মাটিতে নেমে আসবে। কিন্তু গ্যাস বেলুন যে এ নিয়ম মানে না! তাকে ছেড়ে দিলে সে অভিকর্ষকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলে যায় উপর দিকে। তবে কি অভিকর্ষ গ্যাস বেলুনের উপর স্নেহশীল?  নাএখানে অভিকর্ষ  আরেকটি বলের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গেছে। সেই বল হল ‘প্লবতা বল’- যার কথা বলে গেছেন আর্কিমিডিসযীশুখৃষ্টের জন্মেরও আগে। যখনই কোন বস্তু বাতাসের মধ্য দিয়ে কিংবা কোন তরলের মধ্য দিয়ে নীচে পড়তে যাবে তখনই অভিকর্ষ বল আর প্লবতা বলের মধ্যে যুদ্ধ বাধবে। যদি অভিকর্ষ জিতে যায় তাহলে বস্তু নীচে পড়বে আর যদি প্লবতা জিতে যায় তাহলে বস্তুটি উপরে চলে যাবে। সর্বক্ষেত্রেই কিন্তু অভিকর্ষ বল কাজ করে। এই বলের পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য নিউটন একটি গাণিতিক সূত্র দিয়েছেন। এটাই নিউটনের বড়ো কৃতিত্ব। নয়তো পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুকে আকর্ষণ করার কথা আমাদের দেশের লোক ভাস্করাচার্য্য বহু বছর আগেই বলেছেন।

মহাকর্য নিয়ে নিউটনের আরো একটি বড় কথা এই যেপৃথিবী কোন বস্তুকে যে পরিমান বলে টানেবস্তুটিও পৃথিবীকে সেই পরিমান বলে টানে। পৃথিবী যেমন আপেলকে টানে আপেলও পৃথিবীকে টানে। তবে পৃথিবীর বুকে আপেল পড়ে কেনপৃথিবী নিজেই কেন আপেলের কাছে যায় না সেটা বুঝতে গেলে পদার্থবিদ্যার অন্য একটা বিষয়ে প্রবেশ করতে হবে। সেই বিষয়ের নাম ‘ত্বরণ’ (acceleration ) বলের  পরিমানকে বস্তুর ভর দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় ত্বরণ। তাহলে আপেল আর পৃথিবীর মধ্যেকার টানের পরিমানকে পৃথিবীর ভর দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যাবে পৃথিবীর ত্বরণ আর আপেলের ভর দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যাবে আপেলের ত্বরণ। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে আপেলের ত্বরণ এত বেশি যে আপেলকেই দেখি পৃথিবীর দিকে যেতে। কেননা কোন বস্তুর ত্বরণ বলতে বুঝি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বস্তুর বেগ কীরকম পরিবর্তন হচ্ছে

এই বার মনে করা যাক পাশাপাশি দুটো গাছ রয়েছে। আপেল গাছ আর কুল গাছ। দুটো গাছ থেকে একই সময়ে একটা আপেল আর একটা কুল খসে গেলআর ধরে নিলাম সে দুটি একই উচ্চতায় ছিল। তাহলে কে আগে পড়বেবাস্তবে তো এমনটা হওয়া সম্ভব নয়। তবুও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এই ধরণের চিন্তা উড়িয়ে দেননি। তারা বলেছিলেন একটু অন্যভাবে। বলেছিলেন একটা একশ পাউণ্ডের বস্তু আর একটা এক পাউণ্ডের বস্তু একসঙ্গে ছেড়ে দিলে একশ পাউণ্ডের বস্তুটি একশগুণ দ্রুত পড়বে । কারণ তার উপর পৃথিবীর আকর্ষণ একশগুণ বেশি হবে বলতেন আর সবাই মেনেও নিতেন। সর্বপ্রথম গ্যলিলিও  বলেন যে বস্তু হালকা ও ভারী যাই হোক না কেন পৃথিবীর বুকে তারা একই সঙ্গে পড়বে। শুধু বলেই ক্ষান্ত হলেন নাসত্যি সত্যি একদিন পিসা শহরের হেলানো মিনার থেকে এক পাউন্ড ও একশ পাউণ্ডের দুটি বস্তু একসঙ্গে ছেড়ে দিয়ে দেখালেন তারা একই সঙ্গে মাটিতে পড়ছে। দীর্ঘ্যদিনের একটা ভুল ধারণা ভেঙে গেল। কিন্তু গ্যলিলিও যদি একটা পালক  আর একটুকরো  পাথর নিয়ে পরীক্ষাটা করতেন তাহলে কি তারা একই সঙ্গে পড়ত?

নাবাতাসের বাধার জন্য পালক পড়ত অনেক দেরিতে। তাই যদি হবে তাহলে  আগের পরীক্ষায় নিশ্চয় বাতাসের বাধা ছিল যা’ চোখে ধরা পড়েনি। দুটি বস্তুকে একই সঙ্গে মাটিতে পড়তে দেখলেও তাদের মধ্যে সময়ের কিছু না কিছু পার্থক্য ছিল। এই সমস্যার সমাধানও করলেন মহামতি নিউটন। তিনি একটি কাঁচের নলকে কৃত্রিম ভাবে বায়ুশূন্য করে একই সঙ্গে একটি মুদ্রা ও একটি পালক এক প্রান্ত থেকে ছেড়ে দিয়ে দেখালেন তারা একই সঙ্গে অন্য প্রান্তে পৌঁছাচ্ছে। এটাই হল অভিকর্ষ বলের মহিমাসব বস্তুকে ভিন্ন ভিন্ন বলে টানলেও ত্বরণের মান সেই স্থানে একই থাকে। এই ত্বরণের মান একই বলেই কোন স্থানে যে কোন দোলকের দোলনকাল একই।  দোলকের এই ধর্মের উপর নির্ভর করে তৈরি হলো ঘড়ি। অভিকর্ষের মহিমায় মানুষ পেয়ে গেল সময় নিরূপনের দুর্লভ চাবিকাঠি।    

..........

১) বিশ্বকোষ – ১৪শ খণ্ড , ৫৭১ পৃষ্ঠা