শীতের সকাল। সবে সাড়ে ছটা বাজে। এরই মধ্যে ঘুম থেকে
উঠে পড়েছে তুয়া। তুয়ার মা সোমা রান্নাঘরে উনুন ধরাচ্ছিল। কয়লা ও কাদামাটি দিয়ে
তৈরী গুলের আঁচ। ধরাতে সময় লাগে। গ্যাসও এসেছে কিছুদিন হল, কিন্তু সোমার বহুদিনের
অভ্যেস। তুয়া চোখ কচলাতে কচলাতে দরজার কাছে এসে বলল, “মা, আমরা মেলা দেখতে কখন
যাব?”
এত সকালে মেয়েকে ঘুম থেকে উঠে পড়তে দেখে সোমা তো
অবাক, “মহারাণীর আজ এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে গেছে, ব্যাপারখানা কী? মেলা দেখতে যাবে
বলে ঘুমোওনি নাকি?”
“বলো না মা কখন যাব আমরা।”
“আরে বাবা, সে তো বিকেলে। এখন কোথায়?”
“বিকেলে ক’টার সময়?” এমনভাবে জিজ্ঞেস করল তুয়া, যেন
সময়টা বলে দিলে ও কতকিছু বুঝে যাবে! মাস দুয়েক আগেই পাঁচ পূর্ণ হয়েছে ওর। দিনের
যেকোনো সময় কটা বাজে জিজ্ঞেস করলে ফাঁকা কবজির দিকে একবার তাকিয়ে গম্ভীরমুখে জবাব
দেয়, “বারোটা।”
সোমা কিন্তু ধৈর্য্য ধরে তুয়ার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর
দেয়। এখনও কাজ করতে করতেই বলল, “বিকেল পাঁচটায়।”
সঙ্গে সঙ্গে তুয়া বলে উঠল, “তাহলে আর তো বেশি দেরি
নেই মা। আমাকে সাজিয়ে দাও।”
তুয়ার কথা শুনে সোমা তো হেসেই কুটিপাটি। ভেতরের দিকে
ডাক দিয়ে বলল, “এই যে শুনছো! দ্যাখো মেয়ে কী বলছে। বিকেল পাঁচটায় মেলা দেখতে যাবে।
তাই বেশি দেরি নেই আর, এখুনি সাজিয়ে দিতে হবে।”
তুয়া বুঝতে পারল, কিছু একটা ভুলভাল বলেছে ও।
ফিসফিসিয়ে মাকে বলল, “আহ্! সব কথা বাবাকে বলার কী দরকার আছে?”
তুয়ার বাবা মনোজ ভেতরের ঘরে তৈরী হচ্ছিল দোকান খুলতে
যাবে বলে। মনোহারী দোকান মনোজের। রোজ সকালে খোলে, দুপুরে বন্ধ করে বাড়িতে এসে ভাত
খায়। আবার বিকেলে খোলে, একেবারে রাতে বন্ধ করে। আজ মেয়ের আবদারে মেলা দেখতে যাবে
বলে বিকেলে আর যাবে না দোকানে। দোকানের কর্মচারী হারু খুবই বিশ্বস্ত এবং কাজের
লোক। তাই ওর হাতে দোকান ছেড়ে দিয়ে মনোজ নিশ্চিন্তেই থাকে।
মাস গেলে মনোজের রোজগার খুব একটা মন্দ নয়। তার ওপর
নিজেদের জমির ধান। এমনকী বাড়ির পেছনেও বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে সে নানারকম সবজির চাষ
করেছে। তাই সব মিলিয়ে মনোজের পরিবার গ্রামের মধ্যে বেশ সচ্ছল।
জামার একটা হাতা গলাতে গলাতে মনোজ রান্নাঘরের কাছে
এসে মজা করে বলল, “খুকি তো ঠিকই বলছে। আর কতক্ষণই বা বাকী আছে? ওকে জামা পরিয়ে
একেবারে তৈরী করে দাও।”
গম্ভীর স্বরে তুয়া জবাব দিল, “আমি মোটেই খুকি নই। আর
আমি বুঝতে পেরেছি, মেলা যেতে এখনও ঢের দেরি আছে।” এই বলে সে হনহন করে উল্টোদিকে
হাঁটা দিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেল।
***
মেলায় এসেছে তুয়া। গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ জীবনে একটু খুশির হাওয়া বয়ে নিয়ে আসে
এই মেলাগুলো। একই দামে হরেক রকম জিনিস, রোল, চাউমিন, মিষ্টির দোকান, ফুচকা, পাপড়ি
চাট, ঘুগনি, নাগরদোলা, ব্রেকড্যান্স, বাচ্চাদের টয়ট্রেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান – সব
মিলিয়ে একেবারে হইহই ব্যাপার। এছাড়াও আরেকটা জিনিস যেটার জন্য তুয়া এই মেলার প্রতি
এত উৎসাহী থাকে, সেটা হল পাখি।
তুয়া পাখিদের খুব ভালোবাসে। আর এই মেলায় খাঁচায় ভরে
আসে নানারকম পাখি। টিয়া, তোতা, বদ্রী, ময়না, চন্দনা, কাকাতুয়া… এরকম আরও কত! তুয়া
সেইসব পাখিদের চোখ ভরে দেখে। যারা কথা বলতে পারে, তাদের সাথে বকবক শুরু করে দেয়।
কোনো কিছু নিয়েই তেমন বায়না করে না তুয়া, কিন্তু তার অনেকদিনের ইচ্ছে খাঁচাসমেত
একটা পাখিকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার। এর আগেও এক-দুবার বাবাকে ধরেছে পাখি কিনে দেওয়ার
জন্য। কিন্তু মনোজ প্রতিবার এড়িয়ে গেছে। আজ তুয়া ভেবে এসেছে, যেভাবেই হোক, একটা
পাখি সে নিয়ে যাবেই।
মেলায় ঢুকেই তুয়া প্রথমেই যেদিকটাতে পাখির পশরা
সাজিয়ে বসে বিক্রেতারা, সেদিকে চলল। মেয়েকে চেনে মনোজ। জিজ্ঞেস করল, “তুয়া, আগে
পুরো মেলাটা ঘুরে নিলে হত না?”
তুয়া অনিচ্ছুক স্বরে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল, “ঘোরা
হয়ে গেলে আমাকে পাখির কাছে নিয়ে যাবে তো?”
“আরে হ্যাঁ রে বাবা, নিয়ে যাব।”
“কথা দিলে?”
“দিলাম।”
সন্তুষ্ট হয়ে তুয়া মেলার অন্য দোকানগুলোর দিকে এগিয়ে
গেল। বাবা-মায়ের সাথে ব্রেকড্যান্সে চড়ল। ফুচকা, পাপড়ি চাট দুইই খেল। একটা খেলনা
গাড়ি কিনল। কিছুক্ষণ স্টেজে ছোটো ছেলে-মেয়েদের নাচ দেখল। এইসবের পর মনোজ ভেবেছে
তুয়া হয়ত পাখির কথা ভুলেই গেছে। পরীক্ষা করে দেখার জন্য তুয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে
সোমাকে বলল – “শুনছো, এবার তাহলে বাড়ির রাস্তা ধরি, নাকি?”
কথাটা শুনেই তুয়া কোমরে হাত দিয়ে এমন ট্যারা চোখে
মনোজের দিকে তাকাল যে মনোজ সাত তাড়াতাড়ি বলে উঠল – “না মানে আগে তো পাখিগুলোর দিকে
যাব, বাড়ি তো অনেক পরে।”
এবার তুয়ার মুখে হাসি দেখা দিল। আগে আগে চলতে লাগল
সে, বাবা-মাকে রাস্তা দেখিয়ে। পাখির জায়গায় পৌঁছে আনন্দে তার চোখ দুখানি ঝিলমিল
করে উঠল। কত্ত পাখি এখানে! কত রঙ, কত বাহার! কোনোটা ছোটো, কোনোটা বড়! কারও আবার
মাথায় ঝুঁটি। কারো ঠোঁট গাঢ় লাল।
এরই মধ্যে তুয়ার নজরে পড়ল ধবধবে সাদা একটা কাকাতুয়া।
মাথায় হালকা হলুদ রঙের ঝুঁটি। খাঁচার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দৌড়ে
বেড়াচ্ছে। খাঁচার রডে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরছে বারবার। বোধহয় সদ্য ধরে এনেছে। খাঁচার
ভেতরের ভবিতব্যটা এখনো মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু তার ওই ধূসর ঠোঁটের সাধ্য কী যে
ওই লোহার শিককে বাঁকাবে।
প্রথম দেখাতেই তুয়া ভালবেসে ফেলল ওই কাকাতুয়াকে।
পাখিটা যে এবার তার চাই-ই চাই। কাকাতুয়ার দিকে আঙ্গুল তুলে বাবার দিকে চেয়ে বলল,
“বাবা, এই পাখিটা আমায় কিনে দাও। আমি তোমার কাছে চকোলেট, খেলনা এসব আর কিছুই চাইব
না।”
এই ভয়টাই পাচ্ছিল মনোজ। পাখিকে খাঁচায় ভরে রাখা তার
এক্কেবারে না-পসন্দ। আজ পর্যন্ত কোনোদিন কোনো পশু বা পাখিকে সে নিজেও ধরে রাখেনি,
পরিবারের কেউ রাখলেও তাকে রাখতে দেয়নি। আর ঠিক এই কারণেই তুয়া এর আগেও কয়েকবার
পাখি কিনে দেওয়ার কথা বললেও ও কোনো না কোনোভাবে কাটিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তেও সে
একইভাবে বলল, “তুমি তো জানো তুয়া, এই একটা জিনিস আমি চাই না তোমাকে দিতে। তুমি
অন্য কিছু চাও, আমি এখুনি তোমায় দেব। কী চাই বলো? ফ্রক? খেলনা?”
তুয়া নাছোড়বান্দা ভঙ্গিতে বলল, “কিচ্ছু চাই না আমার।
শুধু ওই কাকাতুয়াকে ছাড়া!”
“আঃ, তুমি দেখতে পাচ্ছো না, খাঁচার ভেতর পাখিগুলোর
কেমন কষ্ট হচ্ছে?”
“কিন্তু আমি তো ওকে খুব ভালোবাসব, দেখো তুমি। খাওয়াব,
কথা শেখাব, ওর সাথেই খেলব। কিনে দাও না বাবা।”
“কেন জেদ করছ সোনা? অন্য কিছু চাও।”
“না না, আমি শুধু ওই কাকাতুয়াকেই চাই।” এই বলে তুয়া
বের করল তার ব্রহ্মাস্ত্র। মাটির ওপর শুয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
সোমা তুয়াকে টেনে ওঠানোর চেষ্টা করছে, “এসব কী
অসভ্যতা করছ তুমি তুয়া? জামাকাপড় নোংরা হয়ে যাচ্ছে তো। উঠে পড়ো সোনা।”
তুয়া যেন আজ পণ করেছে, কোনো কথাই সে শুনবে না। মাটিতে
গড়াগড়ি খেতে খেতে একই কথা সে বারবার বলতে থাকল।
মনোজ বুঝল, মেয়ে আজ মনে মনে ঠিক করেই এসেছে যে, পাখি
না নিয়ে সে বাড়ি যাবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, “ঠিক আছে তুয়া, চলো তোমায়
পাখি কিনে দিচ্ছি।”
কথাটা শোনার সাথে সাথে তুয়ার কান্না থেমে গেছে। এখনো
হজম করতে পারছে না। বাবার দিকে তাকিয়ে বুঝে নিতে চেষ্টা করছে, এটা নতুন কোনো চাল
কিনা।
সোমাও অবাক হয়ে মনোজের দিকে তাকাল। সে জানে মনোজের
অপছন্দের কথা। মনোজ চোখের ইশারায় তাকে বোঝাল, চিন্তা নেই, সব ঠিক আছে।
***
কাকাতুয়াটা নিয়ে আসার পর থেকে তুয়া এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে চোখের আড়াল
করছে না। সারাদিন তার সাথেই খেলছে, তাকে খাওয়াচ্ছে আর বলে চলেছে, “জানিস তো, তোর
নাম কাকাতুয়া। আর তোর নামের থেকে কাকাটা বাদ দিয়ে দিলেই আমার নাম। হিহি। তুয়া বলে ডাক
না রে একবার!”
কিন্তু নাম ধরে ডাকার কোনো উৎসাহ সেই কাকাতুয়া
দেখাচ্ছে না। সে এখনও খাঁচার এদিক থেকে ওদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছে আর ঠোঁট দিয়ে খাঁচার
শিক কাটার চেষ্টা করে যাচ্ছে। খাওয়াদাওয়ার পরেও রাত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে তুয়া
যখন পাখিটাকে কিছুই বলাতে পারল না, তখন সে বিষণ্ণ মনে শুতে চলে গেল।
গ্রামের দিকে সকালটা, শহরের থেকে বেশ তাড়াতাড়িই হয়। পাখির ডাকে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল তুয়ার। চমকে উঠে পড়ল সে। বাবা-মা দুজনের কেউই
আর বিছানায় নেই। পাখিটা কী করছে এখন? সেও কি ঘুম থেকে উঠে পড়েছে?
বিছানা থেকে নেমে এল তুয়া। দরজার কাছে এসে টানল
দরজাটা। একি! খুলছে না কেন? আরও জোরে টান মারল তুয়া। খুলল না। দরজাটা কি বাইরে
থেকে কেউ লাগিয়ে দিয়েছে? ‘মা, মা’ বলে চিৎকার করে ডাকল সে। কোনো সাড়া নেই। তার
ছোট্ট হাতের সমস্ত জোর দিয়ে আরেকবার চেষ্টা করল দরজা খোলার। এতটুকুও নড়ল না
দরজাটা। এবার তার ভয় লাগল। ‘মা’, ‘বাবা’ বলে চিৎকার করতে করতে ভ্যাঁ করে কেঁদে
ফেলল।
এতক্ষণে বাইরে থেকে তুয়ার বাবা-মায়ের গলা শোনা গেল –
“খুলছি সোনা, একটু ধৈর্য্য ধরো।” বাবা-মায়ের গলা শুনে একটু ধাতস্থ হল সে। দরজা
নড়ার শব্দ হল। কেউ যেন খুব চেষ্টা করছে দরজা খোলার। কিন্তু দরজা তো খুলছে না।
আবার তুয়ার বাবার গলা শোনা গেল, “তুয়া মা, দরজা তো
খুলছে না কিছুতেই, কীভাবে যেন আটকে গেছে।” অ্যাঁ? দরজা আটকে গেছে মানে? খুলবে না
আর দরজা? তুয়া আর বেরোতে পারবে না এই ঘর থেকে? যেতে পারবে না তার মা-বাবার কাছে?
চেপে যাওয়া কান্নাটা আবার নতুন করে শুরু হল। ভেতর
থেকে তুয়াও দরজা ধাক্কা দিতে লাগল, টানতে চেষ্টা করল। কিছুতেই কিছু হল না। মিনিট
পাঁচেক পর কেঁদে কেঁদে যখন তুয়া চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে, ঠিক তখনই দরজা খুলে ঢুকল ওর
বাবা-মা। তুয়া একছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল।
মনোজ তুয়াকে কোলে তুলে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে
বলল, “দেখলে তো সোনা, ঘরের মধ্যে এইটুকু সময় আটকে থাকতে তোমার কেমন কষ্ট হচ্ছিল?
তাহলেই ভাবো, ওই খাঁচাটার মধ্যে সবসময় থাকতে পাখিটার না জানি কত কষ্ট হচ্ছে!”
তুয়ার কান্না তখনও পুরো থামেনি, হেঁচকি উঠেই চলেছে।
কিন্তু এমনভাবে সে তার বাবার দিকে তাকাল, সেই দৃষ্টিতে যেন কোনো প্রশ্ন ছিল না,
ছিল অনেক উত্তর পাওয়ার স্বস্তি।
শেষটুকু –
তুয়া বাবা-মায়ের সাথে খাঁচাটাকে নিয়ে ছাদে এসেছে।
ছাদের পাঁচিলে রাখা খাঁচার দরজাটা খুলে দিল সে। বলে উঠল, “যা পাখি, যা, উড়ে যা।”
কাকাতুয়া প্রথমটায় অবিশ্বাসের চোখে দেখল তুয়াকে।
তারপর এক পা, দু পা করে এগিয়ে এসে খোলা দরজা দিয়ে মাথাটা বের করে পরখ করে নিল
বাইরে কোনো লুকানো বিপদ আছে কিনা। যখন দেখল সবকিছু ঠিক আছে, তুয়ার দিকে এমনভাবে
তাকাল, সে তাকানোয় স্পষ্ট লেখা ছিল– ‘ধন্যবাদ’। উড়ে যাওয়া কাকাতুয়ার দিকে দেখতে
দেখতে তুয়া খিলখিল করে হেসে জোরে হাততালি দিয়ে উঠল।