আমরা তখন সপ্তম-অষ্টম
শ্রেণি। আমরা মানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার শহর ও গ্রামের সেইসব ছন্দ-পাগল
চাক্ষুষ পরিচয় না হওয়া বন্ধুরা, যারা একই
সময়ে স্বরবৃত্তের অন্ত্যমিলের খেলায় সবে মেতে উঠছি। চোখে দুর্বার স্বপ্ন কবি
হবার। বাড়িতে বড়োদের আর ইশকুলে শিক্ষকদের চোখ এড়িয়ে ক্লাসের খাতায়
প্রশ্নোত্তরের পাশের ফাঁকা জায়গাটিতে ছন্দের
কাটাকুটিতে মশগুল। ঠিক তখনই একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই আমাদের স্বপ্নের জগতকে
তোলপাড় করে হাজির হলেন এক অপ্রতিরোধ্য ছন্দের ঘোড়সওয়ার। মুহূর্তে সব ওলটপালট
হয়ে গেল তাঁর অসম্ভব জাদুকরী, তীব্র আক্রমণাত্মক
বৈচিত্র্যময় ছন্দমিলের উচ্চারণ-অভিঘাতে। যেদিকেই চোখ ফেরাই, কান পাতি—প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক, ক্ষুদ্র ও
স্বাস্থ্যবান যতরকম শিশুতোষ পত্রপত্রিকা দেখি, এমনকি দৈনিক
পত্রিকার ছোটোদের বিভাগ—সর্বত্রই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি, একক
আধিপত্য। অদ্ভুতভাবে কী এক অমোঘ আকর্ষণে তিনি বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত এলাকার
সমস্ত নতুন কলমচিদের টেনে বার করে আনছেন শিশুসাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গনে। হয়ে উঠছেন
সকলের মধ্যমণি। পথপ্রদর্শক। ছোটোদের যে-কোনো পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে কোনোটায়
তিনি উপদেষ্টা, সভাপতি, কোনোটায় আবার
ছোটোদের ছড়ার আসর পরিচালক—নাম ‘সবুজবুড়ো’। তাঁকে নিয়ে গড়ে উঠছে ফ্যান ক্লাব। তিনি আর কেউ নন, বাংলা শিশুসাহিত্যের মুকুটহীন ছড়া সম্রাট ভবানীপ্রসাদ
মজুমদার।
কলকাতা থেকে কয়েকশো
কিলোমিটার দূরে উত্তর চব্বিশ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের এক অখ্যাত গ্রাম কোঠাবাড়িতে
থাকি। যেখানে মাইলের পর মাইল সবুজ মাঠ, ধানক্ষেত,
মাটির রাস্তা; যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে কিছুই
নেই, পায়ে হেঁটেই স্কুল-কলেজ অফিস-আদালতে যেতে হয়।
কলকাতায় যাওয়া-আসা সেদিন ছিল খুবই কঠিন। পোস্ট অফিস মাত্র একটা; গোটা গ্রাম পেরিয়ে আর একটি গ্রামে—তিন-চার মাইলের দূরত্ব। শিরা-উপশিরার
মতো নদীবেষ্টিত সুন্দরবনের এমন একটা রিমোট গ্রামে থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্থান
কলকাতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা খুবই দুষ্কর। তবু সেখান থেকেই শুরু হল
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের ছোটো-বড়ো নানা পত্রিকায়, কলকাতার
দৈনিক খবরের কাগজের রবিবারের সাহিত্য বিভাগে ছড়া পাঠানো। তখন স্কুল-ছাত্র,
সুতরাং পয়সা কোথায়। ফলে রেজিস্ট্রি বা এনভেলপ খামে টিকিট সেঁটে
নয়, মাত্র পনেরো পয়সার পোস্টকার্ডই একমাত্র উপায়। বিকেল
হলেই হা-পিত্যেশ অপেক্ষায় থাকা কখন নিজের লেখা প্রকাশিত হওয়া কোনও পত্রিকা আসবে
কিংবা কারও লেখা চিঠি।
সালটা ১৯৭৯-৮০। ঠিক করলাম, সুন্দরবনের প্রথম ছড়া কার্ড পত্রিকা হিসেবে ‘হাসির ফুলকি’ নামে একটি পোস্টকার্ড সাইজের ছড়া
কার্ড পত্রিকা প্রকাশ করব। পোস্টকার্ডের মাপে আর্ট পেপার কেটে এক পিঠে চার লাইনের
ছড়া, অন্য পিঠে পত্রিকার নিয়মকানুন এবং সবশেষে ডানদিকে
যাঁকে পাঠানো হবে তাঁর ঠিকানা লেখার জন্য থাকবে লাইন টানা স্পেস—এই হবে পত্রিকাটির
চেহারা। তখন একমাত্র নেশা ছিল বিভিন্ন কবি ও পত্রিকা সম্পাদকদের ঠিকানা সংগ্রহের।
ফলে আমাদের সেই সময়ের আইকন সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে যিনি ছন্দের ঘোড়সওয়ার রূপে
দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই ছড়ার জাদুকর ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের
ঠিকানা সংগ্রহ খুব কঠিন ছিল না। অনেক ভয়ে ভয়ে একটি পোস্টকার্ডে চিঠি লিখলাম তাঁর
চার লাইনের একটি ছড়া ও আশীর্বাণী চেয়ে। ভাবলাম, নিশ্চয়ই
বঞ্চিত হব না। পেলে যে কী সাংঘাতিক ব্যাপার হবে! ভবানীপ্রসাদের লেখা দিয়ে ছড়া
কার্ডের প্রথম সংখ্যা প্রকাশ মানে সেদিন আমাদের কাছে ছিল আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার
স্বপ্ন। হলও তাই। এক অপেক্ষমান বিকেলে ডাকপিওন হাতে ধরিয়ে দিল একটি চমৎকার
রঙবেরঙের স্কেচ পেনে লেখা হস্তাক্ষরে কারুকার্যময় পোস্টকার্ড। স্বভাবত দীর্ঘকাল
পরে অজস্র পুরোনো চিঠির ঝাঁপি থেকে খুঁজে বের করা খুব সহজ ব্যাপার নয় কোনটা আমাকে
লেখা ভবানীদার প্রথম পোস্টকার্ড। কিন্তু হাল ছাড়িনি। কয়েকদিন খোঁজার পর সেটা
সম্ভব হল। বিখ্যাত ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার আমাদের ‘হাসির
ফুলকি ছড়া কার্ড’-এর জন্য ছড়া পাঠিয়েছেন, পরবর্তীকালে যার নাম পালটে হয় ‘শিশু ছড়া কার্ড’। শুধু ছড়াই নয়, অসাধারণ
স্নেহ-মমতা মাখানো একটি ছোট্ট চিঠিও লিখেছেন। যে-চিঠির শুরুতে সম্বোধনব্যঞ্জক
শব্দবন্ধটির অন্তর্নিহিত জাদু বা মুহূর্তে আপন করে নেওয়ার হৃদয়ী স্পর্শ আমাকে
ভেতর থেকে এতখানি আকৃষ্ট করল, অদ্ভুত এক দুর্বার আকর্ষণ গড়ে
উঠল তাঁর প্রতি, যে-কারণে কয়েকদিন ঘুমই এল না আনন্দে। সুযোগ
পেলে সেই পোস্টকার্ড সবাইকে দেখানোটা ছিল একান্তই গর্বের বিষয়। হ্যাঁ, সেই চিঠির সম্বোধনটি ছিল ঠিক এইরকম—
‘স্নেহসুন্দর ভাই অজিত,
তোমার চিঠি পেয়েছি। তোমার
কথামতো একটি চার লাইনের ছড়া পাঠালাম।’
চিঠির শেষে লিখলেন, ‘ইতি তোমাদের বড়দা।’ আর কী চাই! চেনা
নেই, দেখা নেই অথচ কলকাতা পেরিয়ে সেই হাওড়া জেলার শানপুর
দাশনগর থেকে ভ্রাতৃসম স্নেহে এতটা কাছে টেনে নেওয়া ক’জনের
পক্ষে সম্ভব জানি না। অন্তত আমার জীবনে ওই বয়সে এ ছিল এক পরম পাওয়া। ক্রমশ
জেনেছি, শুধু আমার নয়, সমগ্র
পশ্চিমবাংলার আমার মতো নতুন লিখতে আসা প্রত্যেকেরই একই অভিজ্ঞতা। তবে প্রথম
সংখ্যায় নয়, পোস্ট অফিসের ভূতের কারণে লেখাটি হাতে এসে
পৌঁছতে দেরি হওয়ায় ছাপা হয় ‘হাসির ফুলকি’ ১৩৮৭-র শ্রাবণ, ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যায়। চার লাইনের
ছড়টি ছিল এইরকম—
‘তুতুল তুতুল পুতুল খুকুর
পাঁচটা বিড়াল, সাতটা
কুকুর।
সকাল বিকাল সারা দুকুর
পুতুল খেলা চলছে খুকুর।’
শুধু ‘হাসির ফুলকি ছড়া কার্ড’-এ নয়, ১৩৮৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় নাম পালটে হওয়া ‘শিশু
ছড়া কার্ড’-এর প্রতিটি সংখ্যায়, যেমন
১৩৮৮-র ১ম বর্ষ ১০-১১-১২ অর্থাৎ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় যুগ্ম সংখ্যায়ও ভবানীদা
লিখেছিলেন একটি মজার ছড়া।—
‘জামালপুরের কামাল মিয়ার
দামাল ছেলে আব্বাস।
ইঁদুর দেখেই ডিগবাজি খায়
সবাই বলে সাব্বাস!’
মাত্রা-মিলের ঘোড়া টগবগ ছুটছে!
আশার আকাশে ভাষার সূর্য হাসছে
রাজপুত্তুর
আসছে আসছে আসছে আসছে আসছে!
খুশির সাগরে রাশি রাশি ঢেউ উঠছে
চাঁদের চাঁদোয়া পৃথিবীর বুকে লুটছে!
মেঘের মেলাতে জ্যোৎস্নার ভেলা ভাসছে
রাজপুত্তুর
আসছে আসছে আসছে আসছে আসছে!
মধুর লোভেতে ভ্রমরেরা ফুলে জুটছে
মনের কোণেতে আনন্দে মাথা কুটছে!
ভেদাভেদ ভুলে প্রাণ খুলে ভালবাসছে
রাজপুত্তুর
আসছে আসছে আসছে আসছে আসছে!
বুকের গভীরে সুখের তারারা ফুটছে
বন্দিনী রাজকুমারীর ঘুম টুটছে!
চোখ জুড়ে তার সোনালি স্বপ্ন ভাসছে
রাজপুত্তুর
আসছে আসছে আসছে আসছে আসছে!’
সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে আমার
এবং আমার সম্পাদিত পত্রিকার সঙ্গে ভবানীদার সম্পর্ক ক্রমশ গভীর এবং আত্মিক হয়ে
ওঠে। নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে বড়দার কাছে তাই নিজের
দুঃখ-কষ্ট ও নানা সমস্যা—সবকিছু বলা সহজ হয়ে ওঠে একসময়। এভাবেই ধীরে ধীরে
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার আমাদের কাছে, অন্তত আমার কাছে হয়ে
উঠলেন ‘বড়দা’। আর চিন্তা কী! এরপর থেকে নিয়মিত বড়দার সঙ্গে চিঠি ও লেখা আদানপ্রদান। যতটুকু
মনে পড়ে, আমার প্রথম ছড়া প্রকাশিত হয় আমারই সম্পাদিত ‘হাসির ফুলকি ছড়া কার্ড’-এর প্রথম সংখ্যায়।
দ্বিতীয়টি ভবানীদার হাত দিয়ে হাওড়ার ‘শিশুপ্রিয়’ পত্রিকায়। এরপর একের পর এক আমার অজস্র ছড়া চেয়ে নিয়েছেন ভবানীদা,
প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা ও সুদূর প্রত্যন্তের কোনও না কোনও ছোটোদের
পত্রিকায়। ভবানীদা আমার মতো ওই সময়ে লিখতে আসা আমাদের বন্ধুদের লেখাও বিভিন্ন
পত্রিকায় প্রকাশ করে প্রাথমিকভাবে যে পরিচিতি গড়ে দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে, এমনকি আজও তার সুফল ভোগ করে চলেছি
অন্তত আমি—এটা স্বীকার না করলে সত্যেরই অপলাপ হয়।
অতঃপর ১৯৯০ সালে যখন
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার্স পড়তে আসি, তখনই ভবানীদার সঙ্গে প্রথম চাক্ষুষ পরিচয় হয়। সে এক
রোমাঞ্চকর দিন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটির পর আমাদের মূল আড্ডার জায়গা ছিল
সেদিনকার কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার দোকান ‘নিউস্ক্রিপ্ট’-এ, আজ যেখানে গড়ে উঠেছে মাল্টিপারপাসড হাইরাজড
বিল্ডিং ‘বর্ণপরিচয়’। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিখ্যাত সব শিশুসাহিত্যিক-সহ ভবানীদার উপস্থিতি ছিল
অনিবার্য। কী অসাধারণ প্রাণবন্ত, এনার্জেটিক
মানুষ; নিজের এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান
শিক্ষকের দায়িত্ব সামলে নির্দিষ্ট সময়েই হাজির হতেন কলেজ স্ট্রিটে। আবার রাত্রে
ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতেন। চলত মুড়ি-চপ-চায়ের সঙ্গে চুটিয়ে সাহিত্যিক আড্ডা।
আমাদের নতুন ছড়া শুনতেন। বলতেন, ‘এটা আমাকে দাও।’ ভবানীদা তখন বিভিন্ন জেলার ছোটো পত্রিকা-সহ কলকাতা থেকে প্রকাশিত বেশ
কয়েকটি নামকরা দৈনিক পত্রিকার ছোটোদের বিভাগ পরিচালনা করতেন। যেমন সেই সময়ের
‘ওভারল্যান্ড’ এবং ওই গ্রুপের মাসিক ক্রাউন
সাইজের ‘সোনামানিক’ পত্রিকায়ও।
এ-সমস্ত পত্রিকায় আমার যত ছোটোদের ছড়া বা পদ্য প্রকাশিত হয়েছে, সবই ভবানীদার মাধ্যমে। আসলে তিনি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন নতুন প্রতিভা
আবিষ্কারক, যথার্থ জহুরি।
***
আজ উত্তর পঞ্চাশে পৌঁছে
যখন ভবানীদাকে নিয়ে এ গদ্যটি লিখছি, তখন পেছনে
তাকালে বর্তমানের সঙ্গে সেদিনের ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কোনও মিলই খুঁজে পাই না।
মেলাতে পারিনা তাঁর কোনও কিছুই। সময় এতখানি নিষ্ঠুর—বদলে দেয় মানুষের জীবন ও
বেঁচে থাকাকে। স্বীকার করতেই হয়, এ-গদ্যের অবতারণা বিখ্যাত
শিশুসাহিত্যিক তথা ছড়া সম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সৃজন-বিষয়ক আলোচনা বা
মূল্যায়নের কারণে নয়, নিতান্তই তাঁর সঙ্গে আমাদের, অন্তত আমার একান্ত ব্যক্তিগত যোগাযোগের সূত্রপাত, তাঁর
আন্তরিক প্রশ্রয় ও শিশুসাহিত্যে এগিয়ে চলার যে পথের দিশা তিনি দেখিয়েছেন তারই
অকপট উন্মোচন বা স্বীকারোক্তির প্রয়োজনেই। কিন্তু কান টানলে তো মাথা আসবেই। ফলত
যাঁকে নিয়ে এত আবেগ-অনুভূতি, তিনি তো সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন
শিশুসাহিত্যিকই, আর যেহেতু একমাত্র সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে
যোগাযোগ, আন্তরিক সেতুবন্ধ, ফলে
সেদিকটায় মৃদু হলেও একটু দৃষ্টিক্ষেপণের অবকাশ থেকেই যায়।
ভবানীপ্রসাদ ছোটোদের কত
বড়ো লেখক তা আমি নই, আজকের এবং ভবিষ্যতের শিশুসাহিত্যের
ইতিহাস তথা সময়ই বলবে। তবু এ-পর্যন্ত যতটুকু বুঝেছি, তাতে
এ-কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার না করে উপায় নেই যে, ভবানীপ্রসাদ
আমাদের সময়ের তো বটেই, আগামীকালের শিশুসাহিত্যের সেই
বহুপ্রসূ ভার্সেটাইল শিশুসাহিত্যিক বা ছড়া সম্রাট যাঁকে খুব সহজে অতিক্রম করা
যাবে না। এ-কথা শুধু তাঁর রচনার সংখ্যাধিক্যের বিচারেই নয়, প্রকৃত
শিশুতোষ রচনার গুণমান এবং বিষয়-বৈচিত্র্যের—সর্বোপরি ভাষা, নির্মাণ,
ছন্দ ও মৌলিকতার নিরিখেই। তাঁর ছোটোদের ছড়ার বিষয়-বৈচিত্র্য,
ছন্দের নিপুণ কারুকাজ, হাসি, মজা বা আনন্দের উপকরণ শিশুমনে দ্রুত জায়গা করে নেয়। এক-একটি ছড়া যেন
প্রবাদবাক্য হয়ে ওঠে। যেমন তাঁর বিখ্যাত ও বহুশ্রুত একটি মিষ্টি ছড়ার চারটি
পঙক্তি—
‘যারা যায় ইশকুল
তারা খুব পিসফুল।
সেইসব ছেলেদের
হাতে গুঁজে দিস ফুল।’
কী অসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত
উচ্চারণ, শিশু-মনস্তত্ত্বের উন্মোচন। এমন ছড়া ইদানীং আর কে লিখতে
পারেন জানি না। প্রকৃত অর্থে ছড়া বলতে যা বোঝায় সেটাই লিখেছেন সারাজীবন ধরে,
যদিও তা ট্র্যাডিশনাল বা বাংলার লোকছড়া থেকে সম্পূর্ণ আলাদা,
কিন্তু ছড়ার সমস্ত ধর্ম, বৈশিষ্ট্য ও অভিমুখ
সব মিলে এক নতুন বা আধুনিক ছড়া সৃষ্টি করেছেন তিনি। যে-কোনো ঘটনা, বিষয়, পুজো-পার্বণ, ব্যক্তি
বা বিশেষ কোনও দিন ইত্যাদিকে সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্র ছন্দ-কুশলতায় সাবলীল ছড়ার
ফর্মে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ক’জনের
সৌভাগ্য হয় জীবিতকালে নিজের সৃষ্টি সরকারি পাঠ্যগ্রন্থে ছাত্রপাঠ্যরূপে
অন্তর্ভুক্ত হওয়াকে দেখে যেতে পারা—ভবানীপ্রসাদ সেই সৌভাগ্যেরই অধিকারী। তাঁর
ছড়া রীতিমতো প্রাইমারি, আপার প্রাইমারি লেভেলে পড়ানো
হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাঁর অজস্র ছড়া শহর এবং প্রত্যন্ত
গ্রামবাংলার বিভিন্ন আবৃত্তি সংস্থা ও আবৃত্তি শিল্পীদের দ্বারা ক্যাসেটবন্দি হয়ে
ছড়িয়ে আছে। সরকারি বা বেসরকারি আবৃত্তি প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে নির্বাচিত হয়
তাঁর ছড়া পাঠের জন্য; আবৃত্তি করেন এ-সময়ের বিখ্যাত
আবৃত্তি শিল্পীরা।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার
এই যে, তাঁর মতো দ্রুত অজস্র অনায়াস ছড়া লেখার ক্ষমতা তাঁর এবং
আমাদের সময়ে আর কারও মধ্যে দেখা যায় না। তাঁর ছড়ার সংখ্যাও বোধ করি বিগত ও
বর্তমান সময়ের অনেক বিখ্যাত ছড়াকারদের ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের মধ্যে যাঁরা
শিশুতোষ রচনা করেন, বলতে দ্বিধা নেই ক’জনই-বা
যথার্থ ছড়া লেখেন—বেশিরভাগই লেখেন পদ্য বা কিশোর কবিতা। শিশুমনের কল্পনার ও
স্বপ্নের জগতটি তাঁর কলমে যেমন সহজ স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধরা দেয়, তেমনি বাস্তব দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয়ও। স্বরবৃত্ত বা শ্বাসাঘাত প্রধান
ছন্দের ক্ষেত্রে ভবানীপ্রসাদ অনন্য সাধারণ রূপ-বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন, লয়ের ক্ষেত্রে এনেছেন নতুনত্ব। মূলত ধ্বনিপ্রধান তাঁর উচ্চারণরীতি,
নির্ভুল মাত্রা সংযোজন, সর্বোপরি বিষয়কে
যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা ও শিশুমনে আবেদনময় করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ছড়া
প্রতিমুহূর্তে নতুন, সহজে পুরোনো হবার নয়।
আধুনিক বাংলা ছড়ার
ক্ষেত্রে কিংবদন্তি হয়ে ওঠা যে ভবানীপ্রসাদ মজুমদার সারাজীবন কলমের ডগায় ছন্দের
টগবগানো ঘোড়া ছুটিয়েছেন, সেই ছন্দের ঘোড়সওয়ার আজ ক্লান্ত।
একটি পা হারানোর কারণে গৃহবন্দি, চরম আর্থিক সংকটের
মুখোমুখি। এহেন অবস্থায় বোধ করি তাঁর মতো একজন খ্যাতনামা শিশুসাহিত্যিকের পাশে
সরকারের এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে যিনি ছিলেন
মেরুদণ্ডে টানটান, হার না মানা, সতত
সৃষ্টিশীল, সেই প্রবাদপ্রতিম স্রষ্টার অবিরাম অক্লান্ত সাদা
কাগজের বুকে মুহুর্মুহু অজস্র অজস্র ছন্দের ফুল ফোটানো আজ স্তব্ধ! কিন্তু সমগ্র
পশ্চিমবাংলা, এমনকি প্রতিবেশী বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের
অঙ্গনে, সিলেবাসে, আবৃত্তিতে তিনি
সমানভাবে টগবগানো ছন্দে মাতিয়ে রেখেছেন শিশুদের, বাংলা
ভাষার অগণিত পাঠকের হৃদয়ে অভিষিক্ত হয়ে আছেন একালের একজন অনতিক্রমী কালজয়ী
শিশুসাহিত্যিক বা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছড়া সম্রাট হিসেবে, এখানেই
তিনি বাঙালি ও বাংলা ভাষার গর্ব, বাংলা শিশুসাহিত্যের
মুকুটহীন সম্রাট।