প্রদীপরঞ্জন দাস

                                                                                                                                                                                                                           ছবি - তরুণকুমার সরখেল

  ভবানীদার সান্নিধ্যে এক           ভদ্রলোক









প্রদীপরঞ্জন দাস





 

এক ভদ্রলোক তাঁর কিশোর ছেলেকে নিয়ে সেইদিন গিয়েছেন বাংলা আকাদেমিতে একটি বিখ্যাত আবৃত্তির প্রতিযোগিতায়। সেখান থেকে বিফল মনোরথ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কিশোরটি তার বাবাকে বলল, “বাবা বাবা, ওই যে যাচ্ছেন আমাদের একজন জাজ। কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।

ছুট্টে গিয়ে তাঁকে ধরলেন বাবা। বললেন, “নমস্কার! আপনার অনেক কবিতা ছড়া পড়েছি। অসাধারণ অপূর্ব সব! আপনার দুটি বই আছে আমার সংগ্রহে।

তিনি বললেন, “আপনার ছেলে?”

ভদ্রলোকহ্যাঁবলার পরেই তিনি বললেন, “আসুন না একদিন আমার ওখানে, কথা হবে। কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের পেছন দিকে মামার দোকানে।

আর তারপর থেকে ভদ্রলোক প্রায়ই দেখা করতে যেতেন কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে। মিতবাক সেই ভদ্রলোক দিনে দিনে কবির সঙ্গে কেমন যেন নির্মল একটা আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলেন। বিপুল জনপ্রিয় অনন্য অসাধারণ সুরুচিশীল একজন কবি, কেমন করে যেন এই ভদ্রলোকের কাছে হয়ে উঠলেন নিখাদ প্রাণের প্রাণভবানীদা

ভবানীদা প্রায়ই ভদ্রলোককে কাছে ডাকেন। দুজনে খুবই অল্পস্বল্প কথা বলেন। তবে ভবানীদা ভদ্রলোককে মাঝে-মাঝেই তাঁর সদ্য রচিত কবিতা-ছড়া দেন ভদ্রলোকের ছেলের জন্য। সেই ছেলে দিকে দিকে ভবানীদার কবিতা আবৃত্তি করে বিভিন্ন পুরস্কার ও প্রশংসা অর্জন করতে থাকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত এবং একদা সম্পাদিত শতাব্দী-প্রাচীন সমবায় বিষয়ক বিশিষ্ট একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত এই ভদ্রলোক, দিনে দিনে ভবানীদার খুবই প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলেন। উভয়ের বাড়িতে যাতায়াত চলতে থাকল। অবাক কাণ্ড! ভদ্রলোকের বেশ কিছু ছড়া-কবিতা চেয়ে চেয়ে নিয়েছেন ভবানীদা। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশের পরে আবার সেগুলি হাতে করে ভদ্রলোককে তিনি পৌঁছেও দিয়েছেন বহুবার। এইভাবে চলতে চলতেসংস্কৃতি বার্তাপত্রিকার সম্পাদক মান্যবর কবি স্বপন চক্রবর্তী, ‘ফজলিপত্রিকার সম্পাদক কবি নির্মলেন্দু শাখারু প্রমুখের সঙ্গেও ভবানীদার বাড়িতে বেশ কয়েকবার গেছেন ভদ্রলোক। সেখানে ভবানীদা নিজে শুনিয়েছেন নিজের কবিতা। এইসব বৈঠকিতে আলোচনা হয়েছে ভালো ভালো অনেক ছড়া-কবিতা ইত্যাদি নিয়েই। চেনাজানা অপরজন কাউকে নিয়ে কখনও নিন্দামন্দের ধারেকাছেই যান না, এই অকপট ভবানীদা। আর বোধ হয় এই বিশেষ একটি গুণের কারণেও তিনি হাজার হাজার শিশু-কিশোর-তরুণ-বৃদ্ধেরও অত্যন্ত প্রিয় এবং নিকটজন

পরিচিতির আলোকহীন এই ভদ্রলোককে ভবানীদা হঠাৎ একদিন বেশ জোর দিয়েই বললেন, ‘এইবার একটা বই করুন।ভবানীদার উৎসাহ, প্রশ্রয় আর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ভদ্রলোকের একটি ছড়া-কবিতার বই প্রকাশিত হল বইমেলাতে। কয়েকশো কপি বিক্রিও হয়ে গেল সেই বই। এতে ভবানীদার সে কী আনন্দ-উচ্ছ্বাস! তবে সুন্দর, সংযত, সাংস্কৃতিক। এমন একজন নিরহংকারী উৎসাহদাতা ভবানীদার জুড়ি আর কোথায়, যিনি নাকি একেবারে বিনা অর্থে, বিনা উদ্দেশ্যে আর বিনা স্বার্থে মূলত অখ্যাত অকিঞ্চন লেখকদেরকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তুলে ধরতে পারেন?

এইসবের কিছুদিন বাদে কেমন করে যেন হারিয়ে গেল কলেজ স্ট্রিট মার্কেটটা। তারপর থেকে ভবানীদা প্রায় বুধবারেই সকালে ফোন করেন ভদ্রলোককে—আজকে বিকেলে আসুন।কলেজ স্কোয়ারের ভেতরে বিদ্যাসাগরের মূর্তির ঠিক উত্তরদিকে ঠাকুরতলায়। কখনো-বা ফেভারিট কেবিনে। তিনি প্রায়ই বলেন, পরের দিনে একটা কবিতা আনবেন, বর্ষার। কখনও শারদ। কখনও স্বাধীনতা দিবসের। কখনও হাওড়া জেলা নিয়ে। কখনো-বা চান মদনমোহন তর্কালঙ্কার, কখনো-বা বিদ্যাসাগর, জগদীশ চন্দ্র, সুভাষচন্দ্র বিষয়ক ছড়া-কবিতা। ভদ্রলোক যারপরনাই অবাক আশ্চর্য হয়ে চলেছেন, তিনি এত নানান বিষয় নিয়ে এত এত কবিতা-ছড়া লিখে চলেছেন কীভাবে! কার শুভ মন্ত্রবলে! আসলে এখানে সেই একই যুক্তিসার। ঈশ্বর আবির্ভূত হন মানুষের রূপে। মানুষের মধ্য দিয়ে। সেই ঈশ্বরই সর্বতো শুভ করেন। কৃষ্টি করেন। সংস্কৃতি করেন। সুধীজনের অন্তরে শক্তিসুধা-সঞ্চারী সেই ভগবানই যে জাগ্রত রয়েছেন ভবানীদার হৃদয়ে। আর দিনে দিনে তাঁরই প্রসাদপুষ্ট হয়ে সাহিত্য সৃষ্টিতে সফলকাম হয়ে চলেছেন ভবানীদার অগণিত অনুরাগীরা সকলে

এইসবের প্রেক্ষিতে লক্ষ করবার বিষয় এই যে, ভবানীদার সঙ্গলাভ যাঁরই হয়েছে, তাঁরইপ্রাপ্তিমিলেছে সাংস্কৃতিক উত্তরণ ও সমৃদ্ধির। ভালো হয়েছে। আর ওই আবহেই নিশ্চয়, এই ভদ্রলোকেরও বিভিন্ন ছড়া-কবিতা গল্প সংখ্যায় দুশোরও বেশি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে চলেছে

তবে মনখারাপের বিষয় হল, গত কয়েক বছর ধরে ভবানীদা ভীষণ অসুস্থ। চলাফেরা একেবারেই করতে পারেন না। নিজের মনে থাকেন। তাঁর কবিতা ছড়া লেখা, অনুষ্ঠানে যোগদান করা, অনুরাগী স্নেহাস্পদ আর কৃষ্টি জগতের প্রাণের জনদের থেকে তিনি যোগাযোগহীন, একাকী। তবু অমন ঈশ্বরতুল্য স্নিগ্ধ অনসূয় মানুষের জন্য অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞচিত্তে সর্বক্ষণ যে কাঁদে অন্তরের অন্তঃস্থল! বিশেষ করে কাগজ-কলম নিয়ে বসলেই ভদ্রলোকের অনুভবে ভেসে ভেসে ওঠেন অভাবনীয় হৃদয়বান ভবানীদা। আহা, অতীতে ফেলে আসা আনন্দঘন সকল সফল মুহূর্তগুলি যেন বাঙ্ময় ও রূপময় হয়ে ওঠে

প্রসঙ্গান্তরে উল্লেখ্য যে, এরই মধ্যে ভদ্রলোক তাঁর একমাত্র সন্তানের বিবাহ অনুষ্ঠানে ভবানীদাকে সপরিবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু কোনোক্রমেই ভবানীদার আসা তো সম্ভবই নয়। তাই বিবাহের অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে ভবানীদার অন্যতম প্রিয় আদরের বাচিক শিল্পী এই ভদ্রলোকের সেই পুত্র আর নববধূকে নিয়ে যাওয়া হল ভবানীদার বাসস্থানে। সেখানে ভবানীদাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করে, অর্ঘ্য উপহার দিয়ে সকলের প্রাপ্তি হল ভবানীদার নির্মল ঈশ্বরতুল্য হাসিমাখা শুভেচ্ছারাশি। কথাবার্তা আর আলাপ হল খুবই সীমিত। তিনি নবদম্পতিকে শিরে কোমল স্পর্শ করে অশেষ আশীর্বাদ করলেন। অত্যন্ত সুন্দর এবং অমূল্য দুটি প্রীতি-উপহার দিলেন নবদম্পতিকে। তখন একাধারে আনন্দ ও বেদনায় ভদ্রলোকের আবেগঘন অশ্রুসিক্ত চোখ দুটি ভীষণভাবে ছলছল করতে লাগল। আপ্লুত ভদ্রলোক ঈশ্বরের কাছে নিয়ত প্রার্থনা করে চললেন, হে পরম করুণাময় ঈশ্বর! ভবানীদাকে ভালো রাখো। সুস্থ রাখো। আনন্দে রাখো। ভবানীদার দীর্ঘ জীবন করো সুন্দরতর

  

<