বৈজ্ঞানিকের রান্নাঘর - ৩ । ভাদ্র ১৪৩১





 
ফ্রাই, কিন্তু ড্রাই নয়











অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
দিল্লি, এন সি আর 


 

বারো ক্লাসের রেজাল্ট বেরোবে। চিন্তায় গতরাতে ঘুম হয়নি ভালো করে রিয়ার। এই সপ্তাহে যে-কোনোদিন নাকি বারো ক্লাসের রেজাল্ট বেরোবে। ভালো নম্বর না পেলে কলেজে বিজ্ঞান পড়া হবে না, রিয়া জানে। ভালো কলেজ চাই, তবেই ভালো ল্যাব পাওয়া যাবে। আর তবেই তো নানা আশ্চর্য সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যাবে! পিসির কলকাতার বাড়িতে জ্যোৎস্নাদির রেখে যাওয়া চা-টা কোনোমতে গিলে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল রিয়া। বেলা দশটায় ডাইনিং টেবিল থেকে অর্কর ভারী গলার ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। কোনোমতে চোখে-মুখে জল দিয়ে খাওয়ার টেবিলে এসে রিয়া দেখে অর্ক তার প্রিয় বিশাল মাপের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজ পড়ছে ট্যাবে

বাব্বা, ঘুম ভাঙল তোর? তোদের পরীক্ষার ফল তো বেরোবে বেরোবে করছে। নিশ্চয়ই ভালো খবর আসতে চলেছে।ট্যাব থেকে মুখ না তুলে বলে অর্ক

তুমি আর ভয় পাইয়ে দিও না অর্কদা! এমনিই চিন্তায় ভালো করে ঘুম আসছে না আজকাল।

ভয় পাওয়ানোর কী আছে? তোর তো ঠিক করাই আছে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করা। তবে এখুনি ঠিক করে নে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, না বায়োলজি—কোন বিষয় নিয়ে পড়াশুনো করতে চাস।

আগে নম্বর দেখে নিই।

নম্বরে কী আসে যায়? তোর পড়াশুনোর বিষয় কি নম্বর ঠিক করে দেবে? এই বিষয় নির্বাচন আজকেই করে ফেল দেখি বিকেলের মধ্যে। তার আগে এই গরম গরম ফ্রেঞ্চ টোস্ট পেটে চালান কর। তারপর স্নান করে নে। তোকে নিয়ে একটু এসপ্ল্যানেড যাব। ওখানে আমার একটু কাজ আছে। ডেকার্স লেনে তোকে চাউমিন খাওয়াব। একবার খেলে আর ভুলবি না।

অর্কর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া মানেই পায়ে হেঁটে অনেক ঘোরাঘুরি, নতুন অনেক কিছু জেনে ফেলা, আর কলকাতা শহরের নানা উপাদেয় খাবার খাওয়া। রিয়া সাগ্রহে সামনের প্লেট থেকে একটা ফ্রেঞ্চ টোস্ট তুলে নিয়ে খেতে খেতে বলে, “বাহ্‌, খেতে কী ভালো হয়েছে! জ্যোৎস্নাদির রান্নার হাতটা খাসা। ক্রিসপি আর টেস্টি হয়েছে। আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম, পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল।

এটা সবচাইতে সহজ একটা খাবার, যা যে-কেউ বানিয়ে ফেলতে পারে। আর জ্যোৎস্নাদির ছেলের নাকি কান কটকট করছে আজকে। বাড়ি থেকে ফোন আসায় তিনি সকালের চা-টা নামিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছেন।

তাহলে কে বানাল?”

কেন? আমি! এই সামান্য ব্রেকফাস্টটা বানাতে কোনও ঝামেলাই নেই। তুই চেষ্টা করলেই পারবি। শুধু মনে রাখতে হবে এই ফ্রাইয়ের পিছনে ঘটে যাওয়া রসায়ন। ব্যস, তাহলে আর তোকে পায় কে?”

সব ফ্রাইয়ের রহস্য নাকি এই বিজ্ঞান?”

একেবারেই। এই যে ফ্রাইটা করেছি, তাতে একটা হালকা বাদামি রঙ এসেছে। এই রঙটাই হল সেই রসায়নের ফল। ১৯১২ সালে ফরাসি ডাক্তার লুই ক্যামিলো মেইলার্ডের লেখা গবেষণাপত্রে প্রথম এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার কথা উঠে আসে। ডক্টর মেইলার্ড তখন যকৃতের সমস্যা নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি দেখেন, অ্যামিনো অ্যাসিড ও সুগারের বিক্রিয়ায় বাদামি রঙের একটা পদার্থ তৈরি হচ্ছে। সেই পদার্থ হল মেলানয়ডিনস। বেশ খটোমটো নাম, তাই তো? ঘাবড়ে যাস না। এটা একটা পলিমার, যার বিশেষ গন্ধ আছে। গন্ধটা বেশ সুন্দর, মনকাড়া। অর্থাৎ যখন আমরা কিছু খাদ্যপদার্থ ফ্রাই করি, তখন তার বাদামি রঙ ধরে, খেতেও সুস্বাদু হয়। যেমন ধর চিকেন রোস্ট, ফিশ ফ্রাই, আবার ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস। সবকিছুতেই রঙ ধরে বাদামি, প্রত্যেক ক্ষেত্রে একটা অপূর্ব গন্ধ হয়, জিভে জল আসে

শুধু যে ফ্রাইগুলোর নাম করলাম, তারাই নয়, প্রায় সব ভাজাতেই এমনকি পাউরুটি, ব্রাউনি বা কেকে এই রঙ আর গন্ধের খেলার পিছনে আছে মেইলার্ড রি-অ্যাকশন। ফ্রাই করার সময়ে কী করে হচ্ছে এই বিক্রিয়া একটু দেখে নেওয়া যাক

যে-কোনো খাবারে প্রোটিন থাকে তুই জানিস। মাংসই হোক বা আলু। এবার সেই কাঁচা খাবারে সুগারও থাকে। কার্বোহাইড্রেট তাপ পেয়ে ভেঙে গিয়ে সুক্রোজ বা সিম্পল সুগার তৈরি হয়। প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড আর সুগার যদি ১৩৫ - ১৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গরম করা হয়, তবে তৈরি হয় মেলানয়ডিনস। তাপমাত্রা এর কম বা বেশি হলে চলবে না। তাপমাত্রা বেশি হলে মেলানয়ডিনস ভেঙে অন্য যৌগ তৈরি হবে, আর খাবার খেতে গেলে তেতো মনে হবে। তাই ফ্রাই করার সময় বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে তাপমাত্রার দিকে। এই জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রায় চারদিক থেকে সমান উত্তাপ দিলে ফ্রাই হবে ভালো। ফ্রাইয়ের উপরের স্তর বেশ মুচমুচে হবে, কিন্তু ভিতরটা হবে নরম। ফিশ ফ্রাইতে কামড় দিয়ে যেমন একটা দারুণ অনুভূতি হয়! এই হল গিয়ে মেইলার্ড রি-অ্যাকশনের কামাল। আমরা অজান্তেই রোজ এই রি-অ্যাকশনের জন্যই এত সুস্বাদু চিকেন পকোড়া, চিকেন ফ্রাই, ফিশ ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এইসব খেয়ে আনন্দ পাই।

তোমার ফ্রেঞ্চ ফ্রাইটা তাই এত ভালো খেতে হয়েছে। উপরে পেঁয়াজ ছড়িয়ে দিয়ে ভাজায় আরও ভালো খেতে হয়েছে।খুশি হয়ে তিন নম্বর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইতে কামড় দিতে দিতে মন্তব্য করে রিয়া

একেবারে ঠিক জায়গাটা ধরেছিস। পেঁয়াজ ভাজার সময়ও গ্যাসের আঁচ বাড়িয়ে দিয়ে ভাজলে বাদামি রঙ ধরে, একটা সুন্দর গন্ধও পাওয়া যায়। তবে ঘনঘন নাড়াচাড়া না করলেই পুড়ে গিয়ে তেতো হয়ে যাবে খেতে।

আমরা কি আজ যাচ্ছি হকার্স লেনের চাউমিন খেতে?”

অর্ক হা হা করে হেসে উঠে বলে, “ওরে দিল্লিওয়ালি, হকার্স নয়, ডেকার্স লেন। হ্যাঁ, যাচ্ছি তো বটেই। আর একটু মেইলার্ড রি-অ্যাকশনের গল্প বলে নিই। চাউমিন বানানোর সময় দেখবি একটা বিশাল কড়াইতে ওরা নাচিয়ে নাচিয়ে চাউমিন ভাজে খুব বেশি আঁচে। এটাকে বলে স্টায়ার ফ্রাই। এর পিছনেও আছে সেই মেইলার্ড রি-অ্যাকশন। উচ্চ তাপে চাউমিনেও অ্যামিনো অ্যাসিডের সঙ্গে সুগারের বিক্রিয়ায় বাদামি রঙ ধরে। নাচাতে হয় যাতে বেশিক্ষণ কড়াইতে বসে চাউমিন বেশি তাপমাত্রা পেয়ে সব স্বাদ মাটি না হয়

রান্নার সময় একটু চিনি মেশালে খাবারে স্বাদ আসে, জানিস নিশ্চয়ই। সামান্য চিনি মিশিয়ে দিলে তরকারিতে একটা হালকা বাদামি রঙ আসে। মাংস রান্নার সময়ও তাই। বেশি চিনি দিলে অবশ্য আমার একটুও ভালো লাগে না। অতিরিক্ত সুগার থাকলে বাদামি রঙ তো হয়, কিন্তু পায়েস খাচ্ছি না তরকারি বোঝা যায় না।

আচ্ছা অর্কদা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। গ্যাস ছাড়া আমরা মাইক্রো-ওয়েভ ওভেন বা এয়ার ফ্রায়ার ব্যবহার করে কি বেশি ভালো ফল পাব?” জিজ্ঞেস করে রিয়া

মাইক্রো-ওয়েভ ওভেনে গ্রিল + মাইক্রো মোডে দিয়ে ফ্রাই করা যায়। ভালোই হয়। তবে এয়ার ফ্রায়ারে চারদিক থেকে গরম হাওয়া সঠিক তাপমাত্রায় খাবারকে ফ্রাই করে বলে বেশি ভালো লাগে। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস বানাতে এয়ার ফ্রায়ারই ভালো। দুটো মেশিনেই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার সুবিধা আছে, গ্যাসে তেমন নেই। তবে অভ্যেসের ফলে যে-কোনো বিজ্ঞান না জানা রাঁধুনিও চমৎকার ফ্রাই বানিয়ে ফেলে।

বড়ো বড়ো হোটেলে সেফরা তো বিজ্ঞান জানে। তারা সেই জন্যই এত ভালো ভালো খাবার তৈরি করে তাক লাগিয়ে দেয়, তাই না?”

অবশ্যই। তাদের রান্নার বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করতে হয়। কিন্তু ভালো রান্নায় বিজ্ঞানের চাইতে বেশি প্রয়োজন হল অভিজ্ঞতা আর অভ্যেস। তবে একটু আধটু রান্নার বিজ্ঞান জানা আমাদের মতো অপেশাদার লোকদের খুব দরকার। আবার দেখা গেছে, অনেক বিজ্ঞানীরা কাজের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য রান্না নিয়ে মাথা ঘামান, সুন্দর সুন্দর পদও বানাতে পারেন।

বিজ্ঞানীরা রান্নাও করেন?” চোখ গোল করে প্রশ্ন করে রিয়া

কেউ কেউ তো অবশ্যই করেন। বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় ব্যাচেলর ছিলেন। নিজের হাতে প্রতিদিন রান্না করে খেতেন। আবার সব পেশার মধ্যেই এমন মানুষ পাওয়া যাবে, যারা রান্নাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন ভালোবেসে। যেমন ধর সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভদ্রলোক নাকি ফাটাফাটি মাংস রাঁধতে পারতেন। তাঁর লেখা বইআদর্শ হিন্দু হোটেলপড়লে মাংস রান্নার সময় ঠান্ডা জল না ঢেলে গরম জল দেওয়ার কথা উঠে এসেছে। এবার তৈরি হয়ে নে বেরোনোর জন্য। ডেকার্স লেনে গিয়ে দেখবি কেমন করে স্টায়ার ফ্রাই করে চাউমিন বানায়।

ছবি ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই – লেখক 


আরও পড়ুন  -