সৌম্যকান্তি দত্ত

                                                                                                                                                                                                         ছবি - সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

  আমাদের ভবানীজেঠু







সৌম্যকান্তি দত্ত





 

আমরা যারাসন্দেশপত্রিকার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছি, তাদের কাছেভবানীপ্রসাদনামটি মাঝে মাঝে বেশ বিপাকে ফেলে। কারণ, এই একই নামের দুজনই সন্দেশীদের বড়ো প্রিয় মানুষ। একজনের পদবিমজুমদার’, দ্বিতীয়জনের পদবিদেআজ যাঁকে নিয়ে এ লেখা, তিনি অবশ্যই প্রথমজন—সেটা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। ভবানীপ্রসাদ দে অনেক সময় নিজের নাম শর্টেভপ্রদেলেখেন দেখি। জানি না প্রথমজনভপ্রমকখনও লিখেছেন কি না

আমরা যখনসন্দেশ’-এর সঙ্গে বেড়ে উঠছি, অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে, ভবানীজেঠুর লেখার সঙ্গে পরিচয় তবে থেকেই। অমন সহজ, সরল ভাষায়, কঠিন কঠিন বিষয়কে কী অনায়াসে ছন্দের মাধ্যমে লেখায় ধরা দিতেন—কী জানি, ওঁর কোনও জাদু কলম-টলম ছিল না তো!

কবে প্রথম সামনাসামনি দেখি, সে-সব আজ আর মনে নেই। তবে একটা ব্যাপার না বললেই নয়, ওঁর নামটা ওজনে যতটাই ভারী, হাবে-ভাবে উনি ছিলেন ঠিক তাঁর উলটো। এতও নিপাট ভদ্রলোক, শান্ত-নরম নিরহংকার মানুষ চট করে আজকাল আর দেখা যায় না।ছন্দবিষয়টায় ওঁর একটা অদ্ভুত মুন্সিয়ানা ছিল। কেউ সামনে এসে আবদার করলেই তৎক্ষণাৎ মুখে মুখে ছড়া বানিয়ে বলে যেতে আর কাউকে দেখেছি বলে তো মনে হয় না!

আমি নিজে কোনোদিনই খুব একটা কবিতা-রসিক নই, তেমন তেমন কবিতার সিরিয়াস পাঠক তো নই-ই। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে আজ অবধি যে-কজনের কবিতা বা ছড়া পড়লেই মনটা ঝলমল করে ওঠে তাঁদের একজন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। অনেকেই তাঁকে সুকুমার রায়ের সাহিত্যসৃষ্টির যোগ্য উত্তরসূরি বলেন, কবিতা নিয়ে সে বলার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হয়—সুকুমারের কবিতায় যে সহজাত ভাবভঙ্গি, গভীর বোধের সহজ প্রকাশ; এসব অনেকাংশে ভবানীজেঠুর কবিতায় পেয়েছি

একটা ছোট্ট স্মৃতি বলি। ইস্কুলে সে-বার আবৃত্তি কম্পিটিশন হচ্ছে, আমার এক বন্ধু দিব্যি একটা কবিতা গড়গড় করে বলে গেল। বেশ কায়দা করে কবির নামভবানীপ্রসাদ মজুমদারও বলতে শুনলাম। অনুষ্ঠান শেষের পর বেশ বুক ফুলিয়ে বন্ধুটিকে বললাম, “যাঁর কবিতা পাঠ করলি, তিনি কিন্তু আমার ভবানীজেঠু।

দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সে বললে, “যা যা, গুল দিস না!

শুনে আমার গা-পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল বলাই বাহুল্য। কিন্তু ব্যাপারটা পরে ভবানীজেঠুকে বলতেই উনি এমন মিষ্টি একটা হাসি দিয়েছিলেন, ওঁর চলে যাবার পরও ওই হাসিমুখটাই মনে রাখতে চাই

বছর পাঁচ-ছয়েক আগে এক বিকেলেবিচিত্রপত্র’-র জন্য ওঁর লেখা আনতে গিয়েছিলাম হাওড়ার বাড়িতে। আমার মতো ক্যাবলাকান্তের পক্ষে সেদিনও রাস্তা হারানোয় ফাঁক রাখার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পথে যাকেই জিজ্ঞেস করিঅমুক ঠিকানাটা কোন দিকে হবে বলতে পারেন?’ নিমেষের মধ্যেই উত্তর আসে—ও আচ্ছা, ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের বাড়ি যাবেন।বুঝেছিলাম, কবি হিসেবে ওঁর জনপ্রিয়তার দিকটা। কিন্তু সেদিন একরাশ মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম ওঁর শারীরিক অবস্থা দেখে। রোগে জর্জরিত মানুষটার কী অবস্থা তখন, অথচ সেই শরীর নিয়েও আমাদের বেশ কয়েকটা ছড়া দিয়ে বলেছিলেন, “শোনো, অগ্রিম দিয়ে রাখলাম। লোকে টাকা অগ্রিম দেয়, আমি দিলাম ছড়া। সুযোগ-সুবিধেমতো পরপর ছেপো।

আজও ওঁর হাতের লেখার সে-সব ছড়া-কবিতা বুকে আগলে রেখেছি। আশা রাখি ভবানীজেঠুর ছড়া-কবিতাগুলো বাকি জীবনটা সবার মধ্যে থেকে গেলেই উনিও ছড়ার রাজ্যে রাজকুমার হয়েই থেকে যাবেন। কারণ, ছড়া-কবিতা আর ভবানীপ্রসাদ মজুমদার তো একে অপরের অল্টার ইগো! যেটার মাঝখানে ফাঁক খোঁজাই বৃথা 

  

<